ভাবনা-৩৭
সাম্প্রতিক অতীতে ইন্তিকাল করা মরহুম ডা. জাফরুল্লা’র একেবারে শেষ বয়সে এসে কুরআন শিখার একটি ভিডিও চোখে পড়ায় আজকের লেখার অবতারণা। কে এই জাফরুল্লাহ চৌধুরী? জাফরুল্লাহ চৌধুরী চট্টগ্রামের এক সৌভাগ্যবান সন্তান। তাঁর জন্ম ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী কোয়েপাড়া গ্রামে। মূলত বাংলাদেশের চিকিৎসা-জগতের এক প্রতিকৃৎ মরহুম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে সক্রিয় এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধা। তা’ছাড়া তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামক স্বাস্থ্য বিষয়ক এনজিওর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮২ সালে প্রবর্তিত বাংলাদেশের ‘জাতীয় ঔষধ নীতি’ প্রণয়ন ও ঘোষণার ক্ষেত্রে তিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেন। উইকিপিডিয়ার তথ্যে জানা যায়, তিনি বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস-এ এফআরসিএস পড়াকালীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে চূড়ান্ত পর্ব শেষ না-করে লন্ডন থেকে ভারতে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার নিমিত্ত আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন এবং এরপরে ডা. এম এ মবিনের সাথে মিলে সেখানেই ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। তিনি সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যজ্ঞান দান করেন যা দিয়ে তারা রোগীদের সেবা করতেন এবং তাঁর এই অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়।
ডা. জাফরুল্লাহর বিশ্বাস ও জীবনাচার নিয়ে খুব একটা জানা যায় না। তবে কোন কোন পত্রিকায় তাঁকে সাম্যবাদী বা বামপন্থী বলে প্রচার করা হয়েছে। জন্মগতভাবে তিনি একজন মুসলিম পরিবারের সদস্য। মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে এমন অনেকেই বামপন্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন—এম নযীর কম নয়। সেদিক থেকে মরহুম জাফরুল্লাহ চৌধুরী আক্ষরিক অর্থেই বামপন্থার সাথেসাথে সেক্যুলার জগতের একজন বাসিন্দা ছিলেন—তা বলা যায়। যেমন ছিলেন শিক্ষাবিধ মরহুম অধ্যাপক আবুল ফজল। তিনি অবশ্য সেক্যুলারিজম নিয়ে অতিসরব ছিলেন। সে অর্থে ডা. জাফরুল্লাহ সরব ছিলেন না; নীরব ছিলেন। মরহুম আবুল ফজলের সাথে একটি বিষয় মরহুম জাফরুল্লাহ’র সাথে মিলে যায়। তা হলো, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ইসলামের দিকে স্বতঃস্ফুর্ত প্রত্যাবর্তন। তাঁর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে কুরআন শিখার ভিডিওটি দেখলে অনেক কিছু অনুভূত হয়। বোঝা যায়, তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কখনও “আলিফ-বা-তা”শিখায় ব্রতী হননি। তাঁর ছাত্র জীবন, কর্মজীবনের কোথাও তাঁর পারিবারিক বিশ্বাস ইসলামের উপস্থিতি ও আচরণ ধরা দেয়নি। মোটাদাগে বলা যায়, জাফরুল্লাহর জীবন ছিলো প্রধানত সেক্যুলারধর্মী। কিন্তু কেবল আল্লাহর রহমতে তিনি তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্তে আপন গৃহে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যখন একজন আলিমের মুখেমুখে “আলিফ-বা-তা” আরবী হরফগুলো পড়ছিলেন, মনে হচ্ছিলো, তাঁর মধ্যে কোন কপটতা বা লৌকিকতা নেই। তাঁর চোখেমুখে ছিলো, ঘরে ফেরার অদম্য আনন্দ ও মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের নির্ভেজাল প্রত্যয়। আমার মনে হয়েছে, আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেছেন। মরহুম অধ্যাপক আবুল ফজলের মতোই তিনি তথাকথিত সেক্যুলারিজমকে ছুঁড়ে ফেলে রেখে গেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত।
আমাদের দেশের সেক্যুলাররা যেভাবে মুসলিমদের বিভ্রান্ত করতে নানা কৌশল অবলম্বন করে ঈমান নষ্টে দিনরাত সচেষ্ট, তাদের জাল ছিন্ন করে ইসলাম-ঈমান রক্ষায় মরহুম আবুল ফজল ও জাফরুল্লাহ চৌধুরী যে নযীর দেখিয়েছেন তা বর্তমান অবুঝ সেক্যুলারদের পথ দেখাতে পারে বলে বিশ্বাস। কথায় বলে না: শেষ ভালো যার সব ভালো তার! আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সতর্ক করে বলেছেন: তোমরা আল্লাহকে ভয় করার মতো ভয় করো, মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। এখানে সেক্যুলার হওয়ার কোন পথ খোলা নেই। দেশের মিডিয়াগুলো মরহুম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অনেক গূণের বয়ান দিয়েছে কিন্তু এড়িয়ে গেছে তাঁর কুরআন শিখার ব্যাপারটি। কারণ তাতে যদি সেক্যুলারিজমের গোমর ফাঁস হয়ে যায়? আলোচকেরাও তাঁদের টকশোতে সে-কথা বেমালুম চেপে গেছেন সজ্ঞানে।তাতে কি পরিত্যক্ত সেক্যুলারিজমকে রক্ষা করা যাবে? আমরা আশা করবো, মরহুম আবুল ফজল ও ডা. জাফরুল্লাহ’র মতো সন্তানদের দেখানো পথে অবুঝ সেক্যুলাররা শেষজীবনে হলেও ইসলামের আহ্বানে সাড়া দেবে।
৩০.০৪.২০২৩