دار العلوم دیوبند اعلان داخلہ 2023 طریقہ کار، ہدایاتদারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তিচ্ছুকদের জন্য নিয়মাবলী
আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আল আরবিয়া হেফজখানা ও এতীমখানাপশ্চিম আাঁধার মানিক (বড় বিল), থানা-ভুজপুর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম। :সংক্ষিপ্ত বিবরণী:“যদি তোমরা আল্লাহর পথে সাহায্য কর, তোমরাও সাহায্যপ্রাপ্ত হবে।”-কুরআন।
কওমী মাদরাসার অনলাইন ব্যবস্থাপনা
দারুল উলূম দেওবন্দের ঐতিহাসিক তারানা
কওমী-জগৎ এবং অন্তর্নিহিত সামাজিক শক্তির খতিয়ান
মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী
[গবেষণা-প্রবন্ধ]
একটি দেশের জনগণ দেশটির মূলশক্তি। এ শক্তির সাথে যে অংশের সম্পর্ক যতো গভীর ও নিবিড়, সে দেশের জনগোষ্ঠীতে সে অংশের সামাজিক প্রভাবও ততো প্রবল। সাধারণত একটি দেশের কোন রাজনৈতিক শক্তিকে দেশটির সামাজিক শক্তি হিসাবে বিবেচনায় নেয়া হয়। আসলে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, রাজনৈতিক শক্তি এবং সামাজিক শক্তির মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট। রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতামুখী আর সামাজিক শক্তি সমাজমুখী। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ উপর থেকে নিচের দিকে নিম্নগামী আর সামাজিক শক্তির বিকাশ নিচ থেকে উপরের দিকে অগ্রসরমান। যেমন: রাজনৈতিক দলগুলো তৃণমূল পর্যায়ের জনগণ থেকে সৃষ্ট নয়। কিন্তু একটি সামাজিক শক্তি জনগণের একেবারে নিম্নস্তর থেকে শক্তি সঞ্চয় করে গঠিত হয়। বিকাশের সাথে সাথে এর ডালপালাও চতুর্দিকে সমৃদ্ধ হতে থাকে। উদাহরণসরূপ বলা যায়, বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক দলগুলো গঠিত হয় বা হয়েছে সেগুলোর কোনটাই তৃণমূলে গঠিত হয়নি, হয়েছে রাজধানীতে। আর রাজধানী মানেই এলিট-শ্রেণীর কেন্দ্র। পরবর্তীতে সেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতামুখী রাজনীতির খাতিরে তৃণমূলে গেছে কালেভদ্রে যদিও তাদের সাথে তৃণমূলের সম্পর্ক ছিলো কেবল-ই রাজনৈতিক, সামাজিক নয়।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আমাদের দেশে দু'টি রাজনৈতিক দল তাদের শুরুর সময়টাতে তৃণমূলে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেছিলো। দল দু'টি হলো: মুক্তিযুদ্ধের অভিভাবক মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ এবং স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। তাঁদের চলে যাবার পর দল দু'টিই নিজেদের সামাজিক চরিত্র আত্মস্থ করার পথ হারিয়ে ফেলে। এখন দল দু'টি এলিট-শ্রেণীর পূর্ণ-নিয়ন্ত্রণে। তবে বাংলাদেশে এমন কোন শক্তি আজও সৃষ্টি হয়নি যারা সমভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি।
বলছিলাম, সামাজিক শক্তির কথা। একটি আদর্শ সামাজিক শক্তি বৃহত্তর সমাজের ভেতর থেকে তার প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। আদর্শ সামাজিক শক্তির মূল-বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বৃহত্তর সমাজের মৌলিক উপাদান জনগোষ্ঠীর কল্যাণ, সামাজিক ও নৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করা। সেদিক থেকে সকল বিবেচনায় দেশের কওমী-জগৎ একমাত্র আদর্শ সামাজিক শক্তি হিসাবে বিবেচনার যোগ্য। কিন্তু কেমন করে কওমী-জগৎ দেশের একমাত্র আদর্শ সামাজিক শক্তিতে পরিণত হলো সে অলোচনাই আজকের বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করেন তাদের বেশির ভাগই এ কওমী-জগৎ সম্পর্কে খুব বেশি জ্ঞাত নন। জ্ঞাত নন বলেই কওমী-জগৎ সম্পর্কে ভ্রান্ত-ধারণার শিকার হন। প্রথমে কওমী-জগতের কিছু রাজনৈতিক-সংস্কারমূলক ইতিহাসের চিত্র স্মরণ করা যাক। এখানে একটি কথা বলে নিতে হয় যে, '৭৫ পরবর্তীযুগে কওমী-জগৎ যেসব রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় হয় সে-সবের মূল-লক্ষ্য ছিলো সমাজ-সংস্কার, ক্ষমতা নয়। যেহেতু সংস্কারের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ইসলাম থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়--সে প্রেক্ষিতে কওমী-জগতের যাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় হন তাঁরা নিখাদ ধর্মীয় দায়িত্ব থেকেই রাজনৈতিক দল বা জোট গঠন করেন। পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিশ্বাস থেকে কওমী আলিম-সমাজ কখনও রাজনীতির ময়দানে পা রাখেননি। ৮০-র দশকের প্রারম্ভে যখন বিখ্যাত বুজুর্গ, জাতির আধ্যাত্মিক দিশারী আমীরে শরীয়াত মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলনের সূচনা হয়; দেশের মান্ষু নতুনভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পায় কওমী-জগতের রাজনৈতিক সচেতনতার সাথে। যদিও পাকিস্তান আমল থেকে বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের রাজনৈতিক তৎপরতার কথা জনগণ জেনে এসেছে কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বলতে গেলে খেলাফত আন্দোলনই দেশের মানুষের কাছে বৃহত্তর পরিসরে কওমী-জগতের রাজনৈতিক সচেতনতার খবর পৌঁছে দেয়। উল্লেখ্য, হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর খেলাফত আন্দোলন নিছক রাজনৈতিক ও ক্ষমতামুখী আন্দোলন ছিলো না; ছিলো রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সৎ ও নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব সৃষ্টির সংস্কারমূলক আন্দোলন। নির্বাচনে খেলাফত আন্দোলনের অংশ নেবার উদ্দেশ্য কখনোই প্রচলিত রাজনৈতিক দলের মতো ক্ষমতামুখী ছিলো না; ছিলো জনমুখী আত্মশুদ্ধিতা সৃষ্টির মাধ্যমে একটি খোদাভীরু প্রশাসন সৃষ্টি করা। তাই হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. তাওবা-দিবসের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি সে দা'ওয়াত নিয়ে প্রথমে প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে বঙ্গভবনে সাক্ষাৎ করেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. উভয়কে বলেন: আমি ক্ষমতা চাই না, আপনারাই ক্ষমতায় থাকুন। কেবল আল্লাহকে ভয় করে দেশ চালান, দেশে ইসলামের আইনগুলো প্রবর্তন করুন। তবেই দেশে শান্তি আসবে। সেদিন কওমী-জগতের দা'ওয়াতের ডাক বঙ্গভবন পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
স্মর্তব্য যে, '৭২-৭৫' পর্যন্ত ইসলামী রাজনীতির উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিলো এবং এর ফলে কওমী আলিম-সমাজের মাঝে দেশ ও জাতির বৃহত্তর উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবার কারণে বঞ্চনার যে মানসিক চাপ তৈরি হয় তা থেকে উত্তরণের সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ ছিলো খেলাফত আন্দোলনের অগ্রযাত্রা। সন্দেহ নেই, এ আন্দোলনের পথ ধরেই কওমী আলিম-সমাজ ইসলামী রাজনীতিতে ও বৃহত্তর জাতীয় উন্নয়নে সক্রিয় হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, জাতীয় উন্নয়নে কওমী আলিম-সমাজের সক্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে মূল-নিয়ামক শক্তি ছিলো তাঁদের সুসংগঠিত সামাজিক শক্তি।
বলছিলাম, কওমী-জগতের সামাজিক শক্তি হয়ে উঠার কথা। কিন্তু কেমন করে কওমী-জগৎ সম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণের মতো সবার অলক্ষে, নীরবে-নিভৃতিতে নিজেদের দুর্দান্ত সামাজিক শক্তি সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলো- সে সম্পর্কে কিছু তথ্য পাঠকদের জানা থাকা দরকার।
১. বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নে কওমী-জগতের অবদান:
আগে বলে এসেছি, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী রাজনীতি ও আলিম-সমাজের তৎপরতার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিলো। এ সময় কওমী আলিম-সমাজকে বড়জোর মাদরাসার দারসকেন্দ্রিক তৎপরতাতেই মাশগুল থাকতে হয়েছে। সরকারিভাবে এবং দলীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে তাঁদের দেখা হতো স্বাধীনতা-বিরোধী বা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী হিসাবে। সমাজে যেন তাঁরা অনুগ্রহের পাত্র। অনেকটা নিজের দেশে উদ্বাস্তুর মতো। জাতীয় কোন কাজে তাঁদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের সুযোগ ছিলো না। সে বিভীষিকাময় যুগের কথা স্মরণ করে বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক এ, এল খতিব তাঁর অনূদিত গ্রন্থ 'কারা মুজিবের হত্যাকারী?' (Who killed Muzib?)-র ৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-"... দেশ স্বাধীন হবার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রতিদিন প্রচলিত 'ইনশাল্লাহ' এবং 'আসসালামু আলাইকুম' শব্দ দুটি শুনলেও রাগে ফেটে পড়তো"(প্রথম প্রকাশ:১৯৯২, শিখা প্রকাশনী, ঢাকা)। যদিও লেখক এ ধরনের মনোভাবকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ইসলামের নামে শোষণ-নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া বলেছেন তবুও এটা স্বীকার্য যে, ঐ সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে ও দলীয়ভাবে দেশে ইসলামবৈরী মনোভাব বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার কারণে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বিলুপ্ত করা হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামবৈরী পরিবেশের বার্তা পৌঁছে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে নব্যস্বাধীন বাংলাদেশের পরিচিতি হয়ে উঠে একটি হিন্দু প্রভাবিত রাষ্ট্র হিসাবে যা কোনভাবেই এ দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মঙ্গলজনক ছিলো না। তাই সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো '৭৫ পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের পর মেজর জিয়াউর রহমান বীরোত্তম দেশের নেতৃত্বে আসীন হলে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। শুরু হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের এক নবযাত্রা। এ সময় প্রেসিডেন্ট জিয়ার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় দু'টো বিষয়: এক. দেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়ন এবং দুই. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রসার। এ দু'টোর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেন্জ ছিলো বহির্বিশ্বে: বিশেষত, আরব ও মুসলিমবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নতকরণ। কারণ, বাংলাদেশ তখন সম্পূর্ণরূপে বিদেশী সাহায্যনির্ভর একটি ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ। অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন—অবকাঠামো (infrastructure) নির্মাণে বিদেশী সাহায্যের কোন বিকল্প ছিলো না। ফলে, সবচেয়ে বেশি সাহায্যকারী দেশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে '৭২-'৭৫-এর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন করাটা ছিলো বড় রকমের জটিল একটি কাজ। প্রেসিডেন্ট জিয়াকে সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। ঠিক এখানটায় তৎকালীন দারিদ্র্য-জর্জরিত কওমী আলিম-সমাজ সবার অজান্তে-অলক্ষে বিস্ময়করভাবে আরবদেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে যে ভূমিকা রাখেন তা ইতিহাস কখনোই ভুলবে না। কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব হলো? আসুন তা হলে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
সত্তরের দশকের শেষের কথা, যখন দেশের সার্বিক-বিষয়ে আমূল-পরিবর্তন আসলো, কওমী আলিম-সমাজ মাদরাসাগুলোর পরিকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয়কে গুরুত্বের সাথে নিলেন। তাঁদের চিন্তা-চেতনায় বাংলাদেশের দরিদ্র অর্থনীতির প্রভাবহেতু সীমাবদ্ধতার চিত্র আগে থেকেই আঁকা ছিলো। তাই তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের আরব-দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। সে-সময় আরব-দেশগুলোতে তেল-সম্পদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উর্দ্ধগতি বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশব্যাপী অনুন্নত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য এবং মাদরাসা-মসজিদের অনুদান সংগ্রহের নিমিত্ত কওমী-আলিমসমাজ দেশীয় ধনাঢ্য ও ধর্মপ্রিয় ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় এবং প্রবাসে বসবাসরত শুভাকাঙ্খীদের অনুরোধে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সফর করার সিদ্ধান্ত নেন। সে মোতাবেক ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম (সংগৃহিত তথ্যানুসারে) বাংলাদেশের সুপরিচিত কওমী মাদরাসা চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার তৎকালীন পরিচালক সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুজুর্গ-ব্যক্তিত্ব শাহ মুহাম্মাদ ইউনুস সাহেব রহ. ( যিনি আলিম-সমাজে হাজী সাহেব হুজুর নামে পরিচিত ছিলেন) আরব আমিরাত সফরে যান। এরপর চট্টগ্রামের জিরি মাদরাসার মুফতী নুরুল হক সাহেব রহ. সৌদি আরব ও দুবাই সফর করেন (১৯৭৮)। এরপর নিকটবর্তী কোন সময়ে (আনুমানিক ১৯৭৯-১৯৮০) দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মাওলানা কাসেম সাহেব ফতেহপুরী রহ. আরব আমিরাত সফর করেন। আনুমানিক ১৯৮০-১৯৮১ সালের মধ্যে চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাচীন দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ফটিকছড়ির জামিয়া আরবিয়া নছিরুল ইসলাম (নাজিরহাট বড় মাদরাসা)-এর পরিচালক আল্লামা হাফিয শামছুদ্দীন সাহেব রহ. সৌদি আরব সফর করেন। এখানে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ--সেটি হচ্ছে, কওমী আলিম-সমাজ যখন মধ্যপ্রাচ্যে যান তাঁরা সেখানকার ধনাঢ্যব্যক্তিবর্গ বা সংস্থা থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে পূর্ব থেকে সৃষ্ট নেতিবাচক ধারণানির্ভর প্রশ্নের সম্মুখীন হন। এখানকার কওমী-আলিমসমাজ সেখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে সকল-প্রকার নেতিবাচক ধারণার বিপরীতে ইতিবাচক ধারণা প্রদান করেন এবং আরব-জনগণকে একথাটি বোঝাতে সক্ষম হন যে, বাংলাদেশ মোটেও হিন্দু-প্রভাবিত রাষ্ট্র নয়। এখানে হাজার হাজার মাদরাসা, মসজিদ, মক্তব আছে। এখানে সাহায্যের প্রয়োজন আছে। এখানকার নব্বই শতাংশ মুসলমান। আরব-ভাইদের প্রতি এদেশের মুসলমানের আন্তরিক ভালোবাসা আছে। এখানে ধনী মুসলিমরাষ্ট্রগুলোর সাহায্যের প্রয়োজন আছে; এখানে মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করছে; এখানে দরিদ্র-মানুষের আধিক্য আছে; এখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে গভীর নলকূপ বসানোর প্রয়োজন আছে; এখানকার সরকারকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়া উচিৎ ইত্যাদি। প্রসঙ্গত বলতে হয়, সে-সময়কার পরিস্থিতিতে আরব-সমাজে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেয়ার বিষয়টা ছিলো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। এমন কি এখানকার বাস্তবতা প্রমাণে কওমী আলিম-সমাজ আরব-সাহায্যদাতা ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশ সফর করারও আমন্ত্রণ জানান। পরে দেখা যায়, কওমী-আলিমসমাজের প্রাণান্তকর চেষ্টায় আরব-সমাজের তৃণমূলে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বিদূরিত হয়। এভাবে সময়ের ব্যবধানে তৃণমূলের উক্ত পরিবর্তন আরব-সমাজের উচ্চস্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে কওমী আলিম-ব্যক্তিত্ববৃন্দের সাথে আরব-সমাজের উর্দ্ধতনমহলের বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাতের কারণে আরব-প্রশাসনেও বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণার উদয় হয়। এরই ফলশ্রæতিতে পরবর্তীতে পবিত্র মক্কা ও মদীনার সম্মানিত ইমামগণ ও সৌদি আরবের জাতীয় স্পীকার চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী এবং ফটিকছড়ির জামিয়া ওবাইদিয়া নানুপুর পরিদর্শনে বাংলাদেশ সফর ('৯০-এর দশক) করেন যা সরকারের পক্ষেও আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। ফলে, একদিকে যেমন দেশের দরিদ্র এলাকায় মানবিক সাহায্য আসতে শুরু করে পাশাপাশি কওমী আলিম-সমাজের এ ভিত্তিগত দা'ওয়াতের সুফল চলে যায় বাংলাদেশ সরকারের হাতে ('৭৬-৮১')। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের সংযোগ ও পাশাপাশি কওমী আলিম-সমাজের তৃণমূল পর্যায়ের সংযোগ--এ দু'য়ের সংমিশ্রণে মধ্যপ্রাচ্যের আরব-দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়। বাংলাদেশে আসতে শুরু করে বৈদেশিক সাহায্যের একটি বিশাল অংশ যা এখানকার পরিকাঠামো নির্মাণে অসামান্য অবদান রাখে। এর সাথে শুরু হলো মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমশক্তি রফতানীর ধারা। বলতে দ্বিধা নেই, এখনও কওমী আলিমসমাজের যে অংশ মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষত বিভিন্ন মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিন হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন তাঁরা সার্বক্ষণিকভাবে আরব-সমাজে দেশ ও জাতি সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরিতে সচেষ্ট। আমরা অনেকেই জানি না, তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অসংখ্য শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে ঢুকতে সক্ষম হয়েছেন।
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্মলগ্নে কওমী-সন্তানদের এ অসামান্য অবদান ইতিহাস একদিন সঠিকভাবেই বিচার করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, ইতিহাসের এ অনস্বীকার্য বাস্তবতাকে এ জাতি মূল্যায়ন করতে কেবল ব্যর্থই থেকে যায়নি উপরন্তু জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সংগ্রামে অবিভক্ত জাতিসত্ত¡ার স্বাদ ভোগ করতেও অক্ষম থেকে গেছে।
২. দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কওমী-জগৎ
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে (Socio-economical development) কওমী-জগতের অবদান এক-কথায় বিস্ময়কর। বিষয়টি প্রথমে বুঝে নেয়া দরকার। প্রাথমিকভাবে এর ব্যাখ্যা হলো: Socio-economic development is the process of social and economic development in a society. অর্থাৎ,সমাজে সামাজিক ও আর্থনীতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া। এটাকে আরো ব্যাখ্যা করে বলা যায়: সামাজিক-আর্থনীতিক উন্নয়ন হল একটি প্রক্রিয়া যা একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ও আর্থনীতিক চাহিদাগুলো চিহ্নিত করতে চায় এবং দীর্ঘমেয়াদে স¤প্রদায়ের সর্বোৎকৃষ্ট স্বার্থে এমনই সব কৌশল তৈরি করতে চেষ্টা করা হয় যা তাদের চাহিদাগুলোকে পূরণ করবে। মোদ্দাকথা হলো, মানুষের সামাজিক ও আর্থনীতিক উন্নয়ন। এবার আসুন, এ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কওমী-জগৎ কী অবদান রাখলো সেটা খতিয়ে দেখি। এখানে আমরা মৌলিকভাবে ৬ টি বিষয়কে বিবেচনায় নিচ্ছি:
(ক) শিক্ষা।
(খ) কর্মসংস্থান।
(গ) সামাজিক স্থিতিশীলতা।
(ঘ) মানবসম্পদ উন্নয়ন।
(ঙ) মানবিক সাহায্য প্রদান।
(চ) সমাজ-সংস্কার।
(ক) শিক্ষা: শিক্ষার ক্ষেত্রে কওমী-মাদরাসার অবদান অনস্বীকার্য হলেও একশ্রেণীর স্বার্থান্ধমহল ও প্রচারমাধ্যম শিক্ষায় কওমী-জগতের অবদানকে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল করে রাখতে চায়। এখানে প্রথমে বুঝতে হবে, কওমী-শিক্ষাব্যবস্থা মূলত কুরআন-সুন্নাহনির্ভর হলেও সমাজের তৃণমূলে রয়েছে এর গভীর-শেকড়। শহুরে এলিট-শ্রেণী এ বিষয় সম্পর্কে নিতান্ত অজ্ঞ বা অজ্ঞতার ভারে ভারাক্রান্ত। স্মর্তব্য, কওমী-শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক-কাঠামো কিন্তু শুরু হয় মসজিদভিত্তিক মক্তব দিয়ে, বিশাল কোন মাদরাসা-ভবন দিয়ে নয়। মক্তবের শিক্ষার প্রধান দুই উপাদান হলো: সমাজের তৃণমূল থেকে উঠে আসা শিক্ষক এবং সমাজের তৃণমূল থেকে উঠে আসা ছাত্রছাত্রী। এ দুই উপাদানের নিচে আর কোন স্তর নেই। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মক্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় যা অন্য কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাওয়া অসম্ভব। সেটা হলো, মক্তবের শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীর মানসিক ভারসাম্য এতোই নিখুঁত যে, সেখানে উভয়পক্ষ আপন-আপন সামর্থ্য ও প্রাপ্তি সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞাত। সঙ্গতকারণে, মক্তবের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার সরলতা, সহজবোধ্যতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার উদারনৈতিক ও সংশোধনমূলক সম্পর্ক এবং সুভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রতিজ্ঞা মক্তবভিত্তিক শিক্ষাকে সমাজের গভীরে প্রোথিত বলে আখ্যায়িত করতে বাধ্য করে। তা'ছাড়া, মক্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রন্থগত শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক আদব-কায়দা, নেতিবাচক কর্ম সম্পর্কে প্রাত্যহিক সতর্কবাণী ইত্যাদি শিশু-ছাত্রছাত্রীদের মনে এমনই গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে যা বয়োবৃদ্ধ হলেও মানুষ স্মরণ করে। আর্থনীতিক দিকের কথা উঠলে বলতে হয়, মক্তবের শিক্ষকদের জাগতিক পাওনা গ্রামবাসীর উৎপাদিত বা অর্জিত শস্য, ধান, চাউল অথবা অর্থ-সাহায্যে মিটানো হয়। মক্তবের শিক্ষক গ্রামের বাসিন্দাদের অন্যতম সদস্য হওয়ার কারণে আর্থনীতিক লেনদেনে সমস্যা দেখা দেয় না। বিষয়গুলো মক্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার শেকড় যে সমাজের কতো গভীরে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে। মূলত মক্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার ধারা ইতিহাসের প্রাচীন অধ্যায় ( সুলতানী আমল) থেকে শুরু হলেও ১৮৬৬/৬৭ সালে উত্তর-ভারতে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পর মক্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালকগণ মক্তবের দেখভালের ভার গ্রামবাসীর উপর অর্পণ করেন। ফলে, সমাজের তৃণমূল-পর্যায়ের মানুষ নিজেদের পরিচর্যায় একটি শিক্ষাব্যবস্থা পেয়ে সেটার সাথে নিজেদের আত্মার সম্পর্ক খুঁজে পান। এখানেই কওমী-জগতের সামাজিক শক্তির শেকড় নিহিত। কওমী-জগতের মূলরস এখান থেকেই আহরিত হয়। তাই, দেখা যায় কওমী-মাদরাসাগুলোতে সমাজের এলিট-শ্রেণীর পরিবর্তে তৃণমূলের মাটির মানুষের সন্তানেরা অধিকহারে লেখাপড়া করে যারা মূলত মক্তবভিত্তিক শিক্ষার মৌলিক উৎপাদন। বড়ো হয়েও তাদের আত্মার সাথে মিশে থাকে কওমী-শিক্ষালয়ের অবিচ্ছিন্ন ভালোবাসা। শিক্ষা এবং আত্মার সমন্বয়ে এমন ব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোন শিক্ষায় পাওয়া যায় না। এভাবেই কওমী-জগৎ তাদের মৌলিক সামাজিক শক্তির সঞ্চয় ও ক্রমবিকাশ ঘটায়। আজ যারা কওমী-মাদরাসাভিত্তিক শিক্ষার উৎপাটন চায় আসলে তারা জানেন-ই না কওমী-জগতের মূল এদেশের মাটি আর মানুষের গভীর নিগড়ে নিহিত--পাশ্চাত্য থেকে ধার করা কোন সংস্কৃতিতে নয়। এ দেশের মাটি আর মানুষের সাথে মিশে থাকা মক্তবভিত্তিক এ শিক্ষাব্যবস্থার সামাজিক শক্তি সম্পর্কে যেখানে খোদ আমরাই অসচেতন সেখানে পাশ্চাত্যের সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি ঠিক-ই আঁচ করতে পারে মক্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার শক্তি সম্পর্কে। তাই তারা পরিকল্পনা করে মক্তবকে অকার্যকর করতে চালু করে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা। কারণ, খুব সকালে শুরু হওয়া মক্তবে প্রতিদিনকার অপরিহার্য অংশ কুরআন-পাঠের শিক্ষা। প্রথমাবস্থায় সরকারও পাশ্চাত্যবাদী শক্তির ইশারায় কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাকে প্রচুর পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। এতে প্রাথমিকভাবে মক্তবের চিরাচরিত প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটেছে বটে কিন্তু কওমী-মাদরাসাকেন্দ্রিক মক্তব বা নাজেরা শিক্ষাব্যবস্থার কারণে পাশ্চাত্যবাদী শক্তির উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। পরবর্তীতে '৮০-র দশকের শুরুতে এক কওমী-সন্তান কারী বেলায়েত হুসাইন রহ. কর্তৃক উদ্ভাবিত 'নুরানী শিক্ষা পদ্ধতি'র বিস্ময়কর প্রসারে পাশ্চাত্যবাদী শক্তির মক্তববিরোধী সকল অপচেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যায়।
(খ) কর্মসংস্থান: আমরা যখন প্রাইমারি ছেড়ে হাইস্কুলে উঠি তখন বাংলা-রচনায় গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা ছিলো-- বেকার সমস্যা। বেকারত্বের অভিশাপ কাকে বলে এবং তা কতো প্রকার ও কি কি-- সেটা কেবল ভুক্তভোগীই অনুধাবন করতে সক্ষম। আমাদের দেশে প্রচলিত সাধারণ-শিক্ষাকে সরকারীভাবে 'মূলধারা' নামে আখ্যায়িত করা হয়। এ তথাকথিত মূলধারার পেছনে ফী-বছর ঢালা হচ্ছে রাষ্ট্রের হাজার-কোটি টাকা। কিন্তু এত্তোসবে প্রসব করছে টা কী? কেউ কি সে খবর রেখেছি? সে স্বাধীনতার পর থেকে বলা হচ্ছে বেকারত্ব দূর করতে হবে, ওটা দূর না হলে দেশ অচল হবে। কৈ, বেকারত্ব তো গেলোই না বরং উল্টো বেড়েই চললো খরগোশ-গতিতে। স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পরে এসেও বেকারত্বের অভিশাপ দিনদিন বেড়েছে। এ-রি মধ্যে কতো মায়ের সন্তান যে বেকারত্বের বোঝা সইতে না পেরে গলায় ফাঁস লাগিয়েছে--সে হিসাব কে দেবে? জনগণের টাকায় এতোগুলো সরকার গদিতে বসলো তাতে কর্মসংস্থান হলো না, বাড়লো বেকার মানুষের কাতার। কেন? আসুন তবে একটা পরিসংখ্যান দেখি-"যুব-মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে দেশে বর্তমানে (২০১১) ১৮ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত যুব পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি। আগামী বছর (২০১২)-এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় পাঁচ কোটিতে। ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে এদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি। তার মধ্যে শিক্ষিত বেকার হচ্ছে ২ কোটি ২০ লাখ। অপরদিকে দেশে পরিবারের সংখ্যা সোয়া পাঁচ কোটি। প্রত্যেক পরিবার থেকে একজনকে চাকরি দিতে হলে সোয়া পাঁচ কোটি লোককে চাকরি দিতে হয়, যেটা বাংলাদেশের বাস্তবতায় খুবই কঠিন। দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। স্বল্প-শিক্ষিতের পাশাপাশি উচ্চ-শিক্ষিত কর্মহীনের সংখ্যাও বাড়ছে। সে সঙ্গে ছোট হয়ে আসছে কর্মসংস্থানের পরিধি। ইঞ্জিনিয়ারিং ও এমবিবিএস এর মতো সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে অনেক উচ্চ-শিক্ষিত তরুণ-তরুণী ঘুরছেন বেকারত্ব নিয়ে। দেশে স্বল্প-শিক্ষিত ও মধ্যম-শিক্ষিতের কর্মসংস্থানে যে সংকট, প্রায় তার অনুরূপ সংকট উচ্চ-শিক্ষিতের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও (Bangladeshnews24.com. 29sep, 2011)। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ, নারী ১২ লাখ ৩০ হাজার। যা মোট শ্রমশক্তির সাড়ে ৪ শতাংশ। তিন বছর আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এক দশক আগে ছিল ২০ লাখ (দৈনিক যুগান্তর, ১৯ মার্চ ২০১৬)। এ তো গেলো তথাকথিত মূলধারার শিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের চিত্র।
এবার আসুন, দেখি দেশের কওমী-মাদরাসাগুলোর কর্মসংস্থানের চিত্র। যদিও একটি বিস্তৃত পরিসংখ্যানের অভাবে আমরা স্তরভিত্তিক বিভিন্ন কওমী-মাদরাসার সংখ্যা নিরূপণে এখনো সক্ষম হইনি তবুও নিদেনপক্ষে একটি কাছাকাছি ধারণা নেয়ার চেষ্টা করতে পারি। দেশের সর্ববৃহৎ কওমী মাদরাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরবিয়ার নিজস্ব ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে তাদের অধীন মাদরাসার সংখ্যা ২০,০০০( বিশ হাজার)। এখানে অবশ্য সব মাদরাসা একই স্তরের নয়। স্পষ্ট কোন পরিসংখ্যান না থাকায় দাওরায়ে হাদীসের স্তর পর্যন্ত মাদরাসার সঠিক সংখ্যাও পাওয়া যায়নি। আবার সরকার কর্তৃক সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে দেশের কওমী মাদরাসার সংখ্যা ১৩,৯০২ (প্রথম আলো, ২২ মে ২০১৫)। তবে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এর সংগৃহীত তথ্যানুসারে মোট কওমি মাদ্রাসার মধ্যে ১২ হাজার ৬৯৩টি পুরুষ ও ১ হাজার ২০৯টি মহিলা মাদ্রাসা রয়েছে। এসব মাদ্রাসায় ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৩৬ জন ছাত্র ও তিন লাখ ৩৯ হাজার ৬১৬ জন ছাত্রী পড়াশোনা করছে। সারা দেশে শিক্ষক আছেন ৭৩ হাজার ৭৩১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬৬ হাজার ৯০২ জন এবং মহিলা ৬ হাজার ৮২৯ জন। এদিকে কওমী-মাদরাসার নতুন গঠিত সম্মিলিত বোর্ড হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ-এর সূত্রে জানা যায় বোর্ডের প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় দেশের ৭৩৭টি মাদ্রাসা থেকে ১৫ হাজার ৬৮৩ জন ছাত্র ও ৩ হাজার ৬৬৮ জন ছাত্রী দাওরায়ে হাদিস সমাপণী পরীক্ষায় অংশ নেন।
সরকারি হিসাবে মোট কওমী মাদরাসার যে সংখ্যা বলা হচ্ছে সেটাতে বিতর্ক আছে। কওমী-আলিমসমাজের মতে দেশে মোট কওমী মাদরাসার সংখ্যা আরো বেশি। যা হোক, নবগঠিত কওমী-শিক্ষাবোর্ডের তথ্য মোতাবেক এবারে তাদের অধীনে ৭৩৭টি মাদরাসার পরীক্ষার্থী সমাপণী পরীক্ষায় অংশ নেন। যদিও এর বাইরে আরো মাদরাসা রয়ে গেছে যারা নবগঠিত বোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি বা নিতে পারেনি। আপাতত এ তথ্যমতে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫,৬৮৩ (ছাত্র) +৩,৬৬৮ (ছাত্রী)= ১৯,৩৫১জন। যেহেতু এর বাইরেও আরো মাদরাসা রয়ে গেছে তাই আপাতত আমরা সমাপণী পরীক্ষায় অংশ নেয়া ( বোর্ডের ভেতরে ও বাইরে) মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২০,০০০ ধরে নিচ্ছি। এ বিশ-হাজারের মধ্যে ধরে নিলাম কর্মে যোগ দেয়া কওমী-ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা: ১৫,০০০+১,০০০= ১৬,০০০ ( বিদেশগামী ছাত্র ও সংসারাবদ্ধ ছাত্রী বাদে)। তাহলে, এটা এখন মোটামুটি বলা যায়, ফী-বছর দেশের কওমী-মাদরাসাগুলো থেকে ১৬,০০০ ছাত্রছাত্রী বেরুচ্ছে এবং কওমী-মাদরাসা কর্তৃক সৃষ্ট কর্মপদে যোগ দিচ্ছে। এটা মেনে নিলে প্রমাণীত হবে: কওমী-মাদরাসাগুলো ফী-বছর ১৬,০০০ কর্মপ্রত্যাশী জনশক্তিকে কর্মসংস্থান করে দিচ্ছে। এবার আসুন, এ ১৬,০০০ জনকে যদি কওমী-মাদরাসা কর্তৃপক্ষ কর্মসংস্থান করতে ব্যর্থ হতো তবে দেশের অর্থনীতিতে কী চাপ পড়তো? বলা যায়, ১৬,০০০ বেকার তৈরি হতো এবং দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি-চাপ সৃষ্টি করতো। যুব-মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান আমরা উপরে দেখে এসেছি। সূতরাং কথিত মূলধারার শিক্ষা যেখানে সরকারি অর্থের ভাগীদার হয়ে বছর-বছর জন্ম দিচ্ছে বিশাল-অঙ্কের বেকার, সেখানে কেউ কি বলতে পারবেন কওমী অঙ্গনের ক'জন বেকার রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? বরঞ্চ কওমী-জগৎ তো নিজেদের কর্মসংস্থান করছেই উপরন্তু তাদের প্রতিষ্ঠানে সাধারণ বাংলা-ইংরেজি-অংক ইত্যাদি বিষয়গুলো পাঠদানে সাধারণ শিক্ষিতদেরও নিয়োগ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে যারা মূলত সরকারী বেকার-খাতের অংশ। কওমী-জগতের এ অর্থনৈতিক অবদানকে কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন? জাতীয় উন্নয়নে এ অবদান কি ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না? নিঃসন্দেহে, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কওমী-জগতের এ অবদান অবশ্যই মূল্যায়নযোগ্য।
(গ) সামাজিক স্থিতিশীলতা: এটি ইংরেজিতে Social stability নামে পরিচিত। এখানে আমরা সামাজিক স্থিতিশীলতা বলতে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যকার স¤প্রীতিমূলক বোঝাপড়াকে বুঝবো যা অস্থিতিশীল কোন পরিবেশকে হ্রাস বা বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে সমাজে অস্থিরতা কমে গিয়ে স্বস্তি ফিরে আসার পথ উম্মুক্ত হয়। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন: কওমী আলিম-সমাজের এখানে কী ভূমিকা? আসুন তা হলে সে জাওয়াব খুঁজি।
যারা বিশেষত গ্রামাঞ্চলে থাকেন, মফস্বলের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত তাদের জন্য বিষয়টা সহজ। স্মর্তব্য, বাংলাদেশের জনসংখ্যার পরিসংখ্যান হিসাবে গ্রাম (Rural area) শহরের (Urban area) তুলনায় অনেক বেশি জনসংখ্যাসমৃদ্ধ। এখনও মনে করা হয়, দেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মফস্বলে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এ থেকে ধারণা করা যায়: মফস্বলের সামাজিক স্থিতিশীলতা পুরো দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতার পরিচায়ক যদিও প্রচারমাধ্যম ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে শহুরে জীবনের চিত্র আলোচিত হয় বেশি।
কওমী মাদরাসাগুলোর অবস্থান সম্পর্কে যারা জানেন তাদের জন্য এটা বাহুল্যবিষয় যে, দেশের নব্বই শতাংশ মাদরাসা গ্রামীণ জনপদে অবস্থিত। ফলে গ্রামীণ জনপদের যে সমাজচিত্র অস্তিত্বশীল হয়ে আছে তার সাথে যৌক্তিকভাবে লেপ্টে আছে কওমী মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রদের জীবন ও জীবনপ্রভাবিত সামাজিক সংস্কৃতি। যেহেতু কওমী মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রেরা গ্রামীণ সমাজের জন্মগত ও অপরিহার্য উপাদান তাই গ্রামীণ সামাজিক স্থিতিশীলতার অনিবার্য নিয়ামক এ কওমী-জগত। উল্লেখ করতে হয়, সামাজিক স্থিতিশীলতা নির্মাণে ও রক্ষণে কওমী-জগৎ প্রধানত তিনটি বিষয়ে কাজ করে। বিষয় তিনটি হলো: ১. সমাজের বিভিন্ন অংশের সাথে সম্পর্কের সমন্বয়। ২. সমাজের সামনে বক্তব্য উপস্থাপন। এবং ৩. কওমী মাদরাসাকেন্দ্রিক বলয় নির্মাণ।
আগে বলে এসেছি, কওমী-মাদরাসার সামাজিক ভিত্তি এখানকার চিরায়ত সমাজ ও সামাজিক সংস্কৃতির গভীরতার সাথে জড়িত। যেহেতু এখানকার শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী এ সমাজ থেকেই উঠে আসে তাই তাদের জীবনাচারের সাথে কওমী-জগতের অনুশীলনের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা তথাকথিত মূলধারার শিক্ষায় পাওয়া যায় না। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, কোন পাড়া বা এলাকার কওমী-মাদরাসা সে এলাকার মানুষের আবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে কাজ করে। ফলে সমাজের বিভিন্ন অংশের সাথে মাদরাসার একটি সমন্বয়মূলক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। ১৯৯১ সালে আমি ভারতের দেওবন্দে দেখেছি, তৎকালীন বড়-হুজুর মুফতীয়ে আযম মুফতী মাহমূদ হাসান গাঙ্গোহী রহ.'র কাছ থেকে পানিপড়া নিতে দেওবন্দের মুসলিমদের সাথে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও গøাস-বোতল ইত্যাদি নিয়ে আসতো। দেখতাম তাদের সবাই দারুল উলূম দেওবন্দ ঘুরে দেখার, সেখানকার শিক্ষকদের কাছ থেকে দোয়া নেয়ার, তাঁদের সাথে পরামর্শ করার একটা গরজ অনুভব করতো। অনেক হিন্দু-শিখকে দেখেছি খুব সকালবেলা দোহানো দুধ নিয়ে বিক্রি করতে চলে আসতো দেওবন্দ মাদরাসায়। দেওবন্দ মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রদেরকে তারা খুব সম্মান দেখাতো। ঠিক এ চিত্র কিছুটা পরিবর্তিত আকারে আমাদের এখানেও দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দামাত্রেই জানেন, পাড়া বা গ্রামের কোন কওমী-মাদরাসা সে এলাকার বিবিধ সম্মিলনের কেন্দ্র। গুরুত্বপূর্ণ কোন শলা-পরামর্শ, বিবাহপূর্ব সামাজিক আচার যেমন: বিয়ের কথাবার্তা, বিয়ের আকদ ইত্যাদি জনসংগঠনমূলক কর্মকাণ্ড এলাকার কওমী-মাদরাসার মাঠে বা গৃহে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পল্লীর তৃণমূলের সাথে কওমী-মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রের এমনই এক সৌহার্দমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠে যা পরস্পরের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে আবদ্ধ। এলাকার মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক সমস্যা, ধর্মীয় সমস্যা নিরসনে মাদরাসার পরিচালক বা বয়জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের কাছে গমনাগমনের মধ্য দিয়ে কওমী-মাদরাসার সাথে গ্রামীণ-সমাজের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এখানে আরও একটি অভূতপূর্ব বিষয় সংযোজন করতে হয়। সেটি হলো, কওমী-মাদরাসাগুলোর মুষ্টিচাউল আহরণের ব্যবস্থা। আমি আগে বলে এসেছি, মক্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় মক্তবের শিক্ষকদের জাগতিক বিনিময়ে নগদ অর্থের চেয়ে শস্য-প্রদান অগ্রাধিকার পেতো। তবে দিনদিন চাষাবাদের হার হ্রাসের কারণে এখন অর্থই প্রাধান্য পাচ্ছে। কওমী-মাদরাসায়ও এ রীতির ব্যত্যয় ঘটেনি। ধান-শস্যের মওসুমে পল্লীর ঘরেঘরে ধান-শস্য তোলা এখনো দৃশ্যমান। এটাও পল্লীর মানুষের সাথে কওমী-মাদরাসাগুলোর সম্পর্ক রাখার এক প্রাচীনরীতি। তবে ধান-শস্য তো বারোমাস পাওয়া যায় না। তাই, যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কওমী-মাদরাসার সাথে গ্রামীণ-সমাজের মাসওয়ারী রীতি বা সংস্কৃতি চালু থাকে তা হলো, মুষ্টি-চাউল সংগ্রহ ব্যবস্থা। অনেকেই জানেন না, 'মুষ্টি-চাউল' কওমী-মাদরাসার এক বিস্ময়কর জনসংযোগ-ব্যবস্থা। আরও বিস্ময়কর হলো, এ ব্যবস্থায় পল্লীর নারী-সমাজের সম্পৃক্ততা। বলতে গেলে গ্রামীণ নারীসমাজকেও কওমী-মাদরাসা তাদের পাঠদানের ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করে রেখেছে মুষ্টি-চাউল রীতির মাধ্যমে। প্রতিদিনকার দু'বেলা ভাতের জন্য হাঁড়িতে যে চাল নেয়া হয় তা থেকে একমুঠো চাল আলাদা করে রেখে দেন ঘরের গৃহিণী বা কর্ত্রীরা মাদরাসার জন্য। নিত্যদিন জমা হয় দু'মুঠো চাল। আগে চালগুলো রাখতে মাদরাসা থেকে হাঁড়ি দেয়া হতো ঘরেঘরে। এখন গেরস্তরাই নিজ দায়িত্বে চাল জমা করে রাখেন। মাসশেষে যা জমা হয় প্রতিঘর হতে; স্ব-স্ব এলাকার মাদরাসায় পৌঁছে দেয়া হয়। এবার ভাবুন, এমন করে যতো ঘর, ততো ঘর থেকে মুঠিমুঠি চাল চলে যায় মাদরাসার খোরাকিখানায়। কি চমৎকার ব্যবস্থা! এর পেছনে আছে এক অভাবনীয় দর্শন। নিত্যদিন মাদরাসার জন্য দু'মুঠো চাল তুলতে গিয়ে নারীরাও মানসিকভাবে মাদরাসার প্রতি দায়িত্ববান হয়ে ওঠেন: পরবর্তীতে যা পুরুষদের জন্য অনুপ্রেরণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মুষ্টি-চাউলের এ রীতির মাধ্যমে কওমী-জগৎ তার শেকড় যে সমাজের কতো গভীরে বিস্তৃত করেছে তা সহজেই অনুমেয়। এভাবে কওমী-জগৎ ও দেশের বৃহত্তর সমাজব্যবস্থা পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক হিসাবে গড়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবে কওমী-জগৎ সমাজের গভীরে থেকে নিজেদের চিরায়ত প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে সামাজিক স্থিতিশীলতা নির্মাণে ও রক্ষণে অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। এ ধরনের প্রভাবের কারণে সমাজের বিভিন্ন অংশের সাথে সম্পর্কের জেরে কওমী-জগৎ পারস্পরিক সমন্বয়ের কাজটা নিখুঁতভাবে করতে সক্ষম হয়। এখানেই কওমী-জগতের এক বিস্ময়কর সামাজিক শক্তি অস্তিত্বশীল হতে এবং ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে দেখা যায়। এ ভিত্তি আর চিত্র পৃথিবীর অন্য কোন শিক্ষাব্যবস্থা দেখাতে পারেনি।
(ঘ) মানবসম্পদ উন্নয়ন: Human resource development বা মানবসম্পদ উন্নয়নে কওমী-জগতের রয়েছে অসামান্য অবদান। এখানে বুঝতে হবে মানবসম্পদ উন্নয়ন বলতে আসলে কী বোঝায়। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত UNDP (United Nations Development Programme) -এর এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে: "মানবসন্তান সুনির্দিষ্ট কিছু সুপ্ত ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। উন্নয়নের উদ্দেশ্য হল এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে সকলেই তাদের যোগ্যতার প্রসার ঘটাতে পারে। প্রত্যেক মানুষেরই যে জীবনের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধায় জন্মগত অধিকার আছে সেটার সার্বজনীন স্বীকৃতিই হল মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল ভিত্তি, "(HDR report P-14, সৌ: লোকপ্রশাসন সাময়িকী, মার্চ ১৯৯৭, অষ্টম সংখ্যা, পৃ: ১২১, বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ঢাকা)। উক্ত সাময়িকীর বর্ণিত পৃষ্ঠায় আরো বলা হচ্ছে: "একটি সমাজের সকল মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়ানোর প্রক্রিয়াই মানবসম্পদ উন্নয়ন" (M.M Verma, P-14, HDR)। সুতরাং, মানবসম্পদ উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝবো দেশের সার্বিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনের প্রক্রিয়া। এদিক থেকে আমরা এবার কওমী-মাদরাসার ভূমিকা পর্যালোচনা করতে পারি। উল্লেখ্য, সারাদেশে কওমী-মাদরাসার সংখ্যা সরকারী হিসাবমতে প্রায় ১৪ হাজার বলা হলেও কওমী আলিম-সমাজের পর্যালোচনায় এ সংখ্যা যথার্থ নয়। তাঁরা বলছেন, এটা ২৫ হাজারের মতো হবে। কারণ, দেশের সর্ববৃহৎ কওমী-বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরবিয়া বলছে, কেবল তাদের অধীনেই আছে ২০ হাজার মাদরাসা। এ ছাড়া অন্যান্য বোর্ড তো রয়েছেই। সুতরাং বলা যায়, দেশের সর্বমোট কওমী-মাদরাসার সংখ্যা ২৫ হাজারের কাছাকাছি। আমরা এখানে ধরে নিলাম ২২ হাজার। এখন মাদরাসাভিত্তিক ছাত্রসংখ্যার যেহেতু কোন পৃথক পরিসংখ্যান নেই তাই ধরে নিলাম বড়, মাঝারি ও ছোট মিলিয়ে গড়ে প্রতিটি মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রী বয়সভেদসহ ৫ শত। এটা কমবেশি হতে পারে। তবুও এ হিসাবে বলা যায় দেশের কওমী ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১ কোটি ১০ লক্ষ। এ ১ কোটি ১০ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে নতুন সম্মিলিত কওমী বোর্ড হাইয়াতুল উলয়ার এবারের পরীক্ষার্থীদের পরিসংখ্যনকে বিবেচনায় নিয়ে ধরে নিচ্ছি: এ বিশাল-সংখ্যক কওমী ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ছাত্রীদের হার ১৫ শতাংশ এবং ছাত্রদের হার ৮৫ শতাংশ। এবার আমরা মানবসম্পদ উন্নয়নে কওমী অবদানে ফিরে আসি। এ বিশাল-সংখ্যক অর্থাৎ ১ কোটি ১০ লক্ষ কওমী ছাত্র-ছাত্রী উঠে আসে এ বহমান সমাজ থেকে যেখানে তৃণমূলের অংশগ্রহণ ৮০ শতাংশের বেশি। নিঃসন্দেহে এ বিশাল-সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী দেশের একটি সুসংগঠিত মানবসম্পদ। এরা শিক্ষা গ্রহণের শুরু থেকে সমাপনী পর্যন্ত পূর্ণ ১৬-১৮ বছর সময়কাল কওমী-মাদরাসার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকে। উক্ত মেয়াদকালীন সময়ে ১ কোটি ১০ লক্ষের বিশাল মানবসম্পদটা গড়ে উঠে অধিকাংশ ধর্মীয় শিক্ষা, প্রয়োজনীয় সাধারণ-শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে।
এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে: এ বিশাল মানবসম্পদ নিয়ে কওমী-জগৎ কেমন করে মানবসম্পদ উন্নয়নের শর্তাদি পূরণ করছে? আসুন তাহলে সে উত্তর খোঁজা যাক। মাসবসম্পদ উন্নয়নের অনেক তথ্যই ঘেঁটে দেখলাম। সবখানেই মানবসম্পদ উন্নয়নের মূলশর্ত বলা হয়েছে শিক্ষা। অর্থাৎ শিক্ষা এবং শিক্ষার উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। কারণ, জাতি শিক্ষিত না হলে জাতির সদস্যদের উন্নয়ন অসম্ভব। যদিও এখানকার পরিবেশ অনুযায়ী মানবসম্পদ উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসাবে শিক্ষার পরে স্বাস্থ্য, পুষ্টি-সরবরাহ, বিশুদ্ধ-পানি সরবরাহ ইত্যাদিকে যুক্ত করা হয়েছে। তবে আমরা মূলত শিক্ষা নিয়েই আলোচনা করবো। বাকিগুলো কওমী-জগতের আওতাধীন নয় বলে এখানে বাহুল্য বিবেচনায় বাদ দেয়া হলো। উল্লেখ্য, কওমী-মাদরাসাগুলো মূলত কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। আগে বলে এসেছি, এখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সাধারণ-শিক্ষা যেমন: বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদিও শিক্ষা দেয়া হয়। তবে একটি কথা বলে নেয়া প্রয়োজন যে, কওমী-মাদরাসায় কুরআন-সুন্নাহনির্ভর আরবী শিক্ষায় যুক্তিবিদ্যা, প্রাচীন দর্শনশাস্ত্র ও ঐতিহাসিক ভূবিদ্যা সম্পর্কেও জ্ঞান দান করা হয়। উদাহরণ হিসাবে একটি মেডিক্যাল কলেজে যেমন সিংহভাগ শিক্ষা চিকিৎসানির্ভর তাই সেখানে ইংরেজি ভাষ্যের চিকিৎসা-শিক্ষার বিকল্প নেই। তদ্রুপ কওমী-মাদরাসার মতো কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক শিক্ষালয়ে সিংহভাগ আরবী পদ্ধতির শিক্ষারও বিকল্প নেই। সঙ্গতকারণে, সেখানে অন্য জাগতিক শিক্ষার প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক ও অবান্তর। যা হোক, কওমী-মাদরাসায় প্রদত্ত শিক্ষা মূলত স্রষ্টা ও সৃষ্টির পারস্পরিক সম্পর্ক, স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির করণীয় ইত্যাদি বিবেচনায় ধর্মীয়-নৈতিক উচ্চ-চরিত্রের মানুষ তৈরির সর্বোত্তম মাধ্যম। বিশ্বে বর্তমানে ইসলামী, ধর্মনিরপেক্ষ ও নিরেট বস্তুবাদী বা নাস্তিকতাবাদী--এ তিনশ্রেণীর শিক্ষা-পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। কোন্ শিক্ষা-পদ্ধতি কেমন, কেমন সেটার পরিণতি সে ফলাফল আশা করি আর বলার প্রয়োজন নেই। কারণ ফলই বৃক্ষের পরিচয়।
ধর্মনিরেপক্ষ (Secular) শিক্ষা-পদ্ধতির কথা এখানে কিছু বলতে হয়। ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা যেমন ধর্ম ও জাগতিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে পৃথকীকরণের কথা বলে তেমনি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থাও প্রকারান্তরে ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় সার্বজনীন শিক্ষার মধ্যে পার্থক্যকে গ্রহণ করে। তবে কৌশলগত কারণে এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আংশিক ধর্মীয় শিক্ষা রাখা হলেও ধীরেধীরে ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্বহীন করে তোলা হয়। যেহেতু এদেশের নব্বই ভাগ মানুষ বিশ্বাসগতভাবে মুসলমান তাই তাঁদের ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্রীয় শিক্ষায় ইসলামী শিক্ষার প্রভাবকে গুরুত্ব দেয়ার বাধ্যবাধকতার কথা বলেন এদেশের আলিম-সমাজ ও সচেতন শিক্ষাবিদগণ। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেক্যুলার শিক্ষার নামে রাষ্ট্রীয় শিক্ষায় ইসলামী শিক্ষাকে কেবল উপেক্ষাই করা হয়নি বরঞ্চ কট্টর বামপন্থী ও উগ্রসেক্যুলার বুদ্ধিজীবিদের যোগসাজশে সেক্যুলার ও প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের নামে হিন্দুয়ানী, ক্ষেত্রবিশেষে নাস্তিক্যবাদী ও অনৈতিক পাঠ সংযুক্ত করে দেশব্যাপী বিতর্কের জন্ম দেয়া হয়। ফলে, ছাত্রসমাজে নৈতিকতার চরম ধস নেমে আসে যা এখনকার পত্র-পত্রিকার পাতা উল্টালে বোঝা যায়। এ নৈতিক অবক্ষয়ের স্রোতে বিপর্যস্ত অভিভাবকেরা এখন তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হতে সচেতন হয়ে উঠেছেন। দেখা যাচ্ছে, দেশের সাধারণ শিক্ষিতশ্রেণী নিজেদের সন্তানকে রক্ষায় কওমী-মাদরাসায় শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজেদের সন্তানকে কওমী-মাদরাসায় দেয়ার কথা জানিয়েছেন। এখানে আরও একটি বিষয় বিচার্য। সেটি হলো, বর্তমানে যে প্রজন্ম সাধারণ শিক্ষায় অর্থাৎ তথাকথিত মূলধারায় শিক্ষিত হচ্ছে তাদের মধ্যে নৈতিকতা, স্বদেশপ্রেম, দায়িত্ব-সচেতনতা ও ধর্মীয় অনুভূতির লক্ষণীয় অভাবের কারণে জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়নের যে মাপকাঠি ধরা হয় তা ভেস্তে যেতে বসেছে। এ অবস্থায় লাগাম টেনে ধরা না গেলে পরিণতি যে কতো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। এ অবস্থায় জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়নে আদর্শ, শিক্ষিত ও নৈতিকশক্তিসম্পন্ন নাগরিক গড়ে তুলতে কওমী-মাদরাসার গুরুত্ব উদীয়মান সূর্যের মতো প্রতিভাত হচ্ছে। তাই সরকার বাস্তবতা অনুধাবন করে কওমী-মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের সনদকে এম. এ সমনান ঘোষণা করেছেন দারুল উলূম দেওবন্দের মূলনীতি অনুসারে।
বলছিলাম, মানবসম্পদ উন্নয়নের শর্ত পূরণে শিক্ষিত, দক্ষ ও দেশপ্রেমী নাগরিক তৈরিতে কওমী-মাদরাসার ভূমিকা নিয়ে। বলতে দ্বিধা নেই, কওমী-সন্তানেরা ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিক অনুশীলন ও সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রতি তীব্র বাধ্যাধকতা নিয়ে গড়ে ওঠে। তাই দেখা যায় মাদরাসা-শিক্ষা শেষ করে তাঁরা অধিকাংশ মেধার পাচার না ঘটিয়ে দেশের ভেতরে ধর্মীয় শিক্ষাবিস্তারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন এবং সর্বোপরি এদেশের দরিদ্র ও অসামর্থ্য জনগোষ্ঠীকে শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে সন্নিবেশিত করেন। এটা প্রকৃত বাস্তবতাদৃষ্টে বিশাল এক জাতীয় অবদান। আর যাঁরা অর্থনৈতিক কারণে বিদেশে যাচ্ছেন তাঁরা একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বিপুল রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন তেমনি বিদেশে এদেশের জনশক্তি রফতানীতে অবদান রেখে চলেছেন। অনেক কওমী-সন্তান এমন আছেন যাঁরা শিক্ষকতার পাশাপাশি স্বল্প-বিনিয়োগে ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। অথচ তাঁরা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পান না। তবুও নিজেদের সামান্য সম্বল বিক্রি করে বা ঘনিষ্ঠজন থেকে ঋণে ছোটখাট ব্যবসা করছেন ব্যক্তিগতভাবে বা সমিতির মাধ্যমে। এতে যে জাতীয় অর্থনীতি লাভবান হচ্ছে না--তা কি কেউ দাবি করতে পারেন? আশা করি কওমী-জগৎ যে মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার মাধ্যমে এবং শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়ার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে তা বুঝতে কারো অসুবিধা থাকার কথা নয়।
(ঙ) মানবিক সাহায্য প্রদান: দেশের সহায়হীন একটি উল্লেখযোগ্য-অংশকে মানবিক সাহায্য প্রদান করে যাচ্ছে কওমী-জগৎ। সহায়হীন অংশটি হচ্ছে: এতীম-শিশু। উল্লেখ্য, এতীম-শিশু (Orphan) সম্পর্কে বাংলাদেশে চলছে ঔপনিবেশিক শক্তি বৃটিশদের রেখে যাওয়া সংজ্ঞা। বৃটিশ-আইন THE ORPHANAGES AND WIDOWS’ HOMES ACT, 1944 (BENGAL ACT NO. III) অনুসারে এতীমদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে: orphan means a boy or girl under eighteen years of age who has lost his or her father or has been abandoned by his or her parents or guardians. অর্থাৎ, 'এতীম' অর্থে সে ছেলে বা মেয়েকে বোঝাবে যাদের বয়স ১৮ এর নিচে যারা বাবাকে হারিয়েছে অথবা অভিভাবক কর্তৃক পরিত্যক্ত। এবার দেখা যাক ইসলামী পরিভাষায় এতীম (মূল: 'ইয়াতীম' এর বঙ্গীয় উচ্চারণ) কাকে বলে? অভিধানে বলা হচ্ছে:
(اليتيم: من فقد ولد قبل بلوغة (وليس اباه
(العجي: من فقد ولد قبل بلوغة (وليس امه
(اللطيم: من فقد ولديه كلهما قبل بلوغة (وليس ابو
[Orphan: who lost his/her father before reaching puberty (not his father)
Al-Ajji: Who lost his/her mother before reaching puberty (not his mother)
Al-Latim: Whoever lost both his/her parents before puberty ( not his/her parents)]
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ইসলামী পরিভাষায় সহায়হীন শিশু সম্পর্কে তিনটি ভাগ করা হয়েছে। ১. ইয়াতীম (اليتيم) ২. আজী (العَجيّ) এবং ৩. লাতীম (اللطيم)। 'ইয়াতীম' বলা হয়েছে যে শিশু বালিগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে তার বাবাকে হারিয়েছে অর্থাৎ, পিতৃহীন শিশু। 'আজী' বলা হয়েছে সে শিশুকে, যে বালিগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে তার মাকে হারিয়েছে অর্থাৎ মাতৃহীন শিশু এবং 'লাতীম' সে শিশুকে বলা হয়েছে, যে বালিগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে তার মা-বাবা উভয়কে হারিয়েছে অর্থাৎ পিতৃমাতৃহীন শিশু।
এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। ইংরেজ কর্তৃক রেখে যাওয়া বর্তমানে বাংলাদেশে (এতীম সম্পর্কে) চলমান আইনের ভাষ্য ইসলামী ব্যাখ্যার প্রথমশর্তকে পূরণ করলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাস্তবতা সম্পর্কে কোন ধারণা দেয়নি। ফলে, মাতৃহীন ও পিতৃমাতৃহীন: এ উভয়শ্রেণীর শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর বর্তায় কিনা তা নির্দ্ধারিত হয়নি। আমাদের ধারণা: যেহেতু সরকার আইনের বাইরে যেতে সক্ষম নয়, তাই সরকারি শিশুসদনে ঐ দুই শ্রেণীর অসহায় শিশুর স্থান পাওয়ার কথা নয়। বলা দরকার, আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় উক্ত দুই শ্রেণীর শিশুর সার্বিক অবস্থা ব্যতিক্রম বাদে খুবই বেদনাদায়ক। বিশেষ করে মাতৃহীন শিশু সৎমা বা অন্য কোন কারণে অবহেলার শিকার হয়ে পিতা কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে এক দুর্বিসহ অবস্থায় পতিত হয়। যেহেতু এদের আশ্রয় দেয়ার ও লালন-পালনের বিষয়ে আইনত সরকারের বাধ্যবাধকতা নেই, তাই এরা ক্রমেই জাতির একটি সহায়-সম্বলহীন অংশে পরিণত হয়। এমন সংকটাপন্ন সন্ধিক্ষণে উক্ত দুই শ্রেণীসহ সকল অসহায়-শিশুর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় একমাত্র কওমী-মাদরাসা। এখানে আমরা আলোচনার স্বার্থে ঐ তিন শ্রেণীর শিশুকে বলবো--অসহায় বা সহায়হীন শিশু।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে ১১ থেকে ১৫ লক্ষ অনাথ শিশু আছে। দেশে কর্মরত এনজিওগুলোর হিসাব মতে, এ সংখ্যা ৫৫ লাখের মত (সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২১ এপ্রিল, ২০১৬)। বলা বাহুল্য, দেশের প্রতিটি কওমী-মাদরাসা (ছোট, মাঝারি ও বড়) এতীমখানাযুক্ত। আসে ধরে এসেছি, দেশের মোট কওমী-মাদরাসার সংখ্যা ২২ হাজারের মতো। বিভিন্ন মাদরাসার সংগৃহীত খবর অনুযায়ী ধরে নিলাম গড়ে প্রতিটি মাদরাসায় অসহায়-শিশুর সংখ্যা ৪০-৫০ জন। তাহলে আপাতত ৫০ জনকে ধর্তব্য মনে করে যদি হিসাব করা যায় তবে সর্বমোট দাঁড়ায় ১১ লক্ষ। বলা যায়, এজিওগুলোর হিসাবমতে ৫৫ লাখ অসহায় শিশুর মধ্যে দেশের ২২ হাজার কওমী-মাদরাসা ১১ লাখ অসহায় শিশুর শিক্ষা ও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করছে। বিশাল একটা ব্যাপার! কিন্তু কি করে এটা সম্ভব হচ্ছে? হ্যা, এটাই হচ্ছে কওমী-জগতের অন্যতম একটি নীরব সামাজিক ব্যবস্থাপনা যা সরেজমিন পর্যবেক্ষণ ব্যতিরেকে উপলব্ধি করা যায় না। এটি নতুন কিছু নয়। ১৮৬৬/৬৭ সালে ভারতে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পর থেকে সমাজের অসহায় মুসলিম-শিশুদের দেখভালের যে দায়িত্ব কওমী-মাদরাসা কাঁধে তুলে নিয়েছে তা আজ সুশৃঙ্খল একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। কওমী-মাদরাসার সামাজিক চরিত্র সম্পর্কে যারা জানেন, বিলক্ষণ বুঝবেন, কওমী-মাদরাসা তাদের নির্বাহ-খরচ তুলে আনে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনসাধারণের কাছ থেকে। কারো কারো কাছে প্রক্রিয়াটি দুর্বোধ্য হলেও কওমী-মাদরাসার সাথে এদেশের মাটি ও মানুষের সুগভীর বন্ধনের প্রভাব বুঝতে পারলে বিষয়টি সহজবোধ্য হয়ে যায়। দেশের প্রত্যন্ত-অঞ্চলের কওমী-মাদরাসার বাৎসরিক মাহফিলগুলোতে উপস্থিত থাকতে পারলে দেখতে সক্ষম হবেন, সম্পর্ক কতো গভীর হলে গাঁয়ের গৃহিণীরা ঘরের সামান্য চাল-ডাল থেকে মুঠোমুঠো মাদরাসার জন্য তুলে দেয়, অর্থ-সাহায্য দেয় এমন কি পারলৌকিক মুক্তির আশায় ও নেশায় গলার গয়না পর্যন্ত তুলে দেয়। এএই ছবির কিছু প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছে বলেই বলছি। এভাবে নগর পর্যায়েও কওমী-মাদরাসার জন্য হস্ত প্রসারিত করেন দেশের ধর্মপ্রাণ নাগরিকেরা। আমি অনুরোধ করবো, যারা এখনো কওমী-জগৎকে সঠিক অর্থে উপলব্ধি করতে অক্ষম থেকে গেছেন তারা অনুগ্রহ করে, ক'কদম গিয়ে একটি কওমী-মাদরাসার পরিবেশের সাথে ক'টা দিন কাটিয়ে আসুন। তাহলেই বোধগম্যতা আসবে ইনশাআল্লাহ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দেশের কওমী-মাদরাসাগুলো সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীকে যে মানবিক সাহায্য দিয়ে, তাদের শিক্ষা দিয়ে ও ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে যে জাতীয় দায়িত্ব পালন করছে তা এদেশের গণমাধ্যম বলুন অথবা প্রচারমাধ্যম বা বুদ্ধিজীবিমহল বলুন, সম্ভবত অজ্ঞতার কারণে অথবা বিদ্বেষমূলকভাবে কখনো উপস্থাপন করেন না। এটা খুব দূঃখজনক।
এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। কেবল অসহায় বা ইয়াতীম শিশু নয়, দেশের অসংখ্য দারিদ্র্য-পীড়িত পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া ও প্রাসঙ্গিক দায়-দায়িত্ব পালন করে চলে কওমী মাদরাসাগুলো। বলা-বাহুল্য, বাংলাদেশ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দেশ। দেশের অধিকাংশ দরিদ্র-পরিবারের সন্তানেরা আর্থনীতিক দুরাবস্থা, সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি, এলিট শ্রেণীর প্রভাব ইত্যাদির কারণে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও উচ্চশিক্ষা থেকে সামগ্রিকভাবে বঞ্চিত। এমন অবস্থায় দরিদ্র-পরিবারের সন্তানেরা নিরক্ষরতা ও অশিক্ষার বিপজ্জনক আক্রমণের শিকার হয়। দেশের কওমী মাদারাসাগুলো দরিদ্র-পরিবারের এসব সন্তানদের নিশ্চিত পতনের হাত থেকে রক্ষা করে বিনা খরচায় ও খোরাকীতে সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করে। তাদের থাকা-খাওয়া, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা প্রদান--এমন কি পোশাক-আশাকের ব্যবস্থাও করে কওমী মাদরাসা। এর ফলে রাষ্ট্র একটি বিশাল পরিমাণ আর্থনীতিক ও সামাজিক চাপ থেকে মুক্ত থাকে। মানবিক সাহায্য সরবরাহে কওমী জগতের এ অবদান অনস্বীকার্য।
(চ) সমাজ-সংস্কার: সমাজ রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান। সমাজ বাদে রাষ্ট্র হয় না। মূলত সমাজের উপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রের গঠন। তাই একটি রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক চরিত্র মূলত সে রাষ্ট্রের সমাজের চরিত্রের প্রতিফলন। তাই রাষ্ট্রের চরিত্রকে সঠিকপথে রাখতে সমাজের সংস্কার ও পরিমার্জন অপরিহার্য। কওমী-মাদরাসার সমাজ-সংস্কার মূলত ইসলামের নিখুঁত আকীদা-বিশ্বাস ও কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক অনুশীলনের সংস্কার হলেও ইসলামের চিরন্তন মানবতা ও সমাজের প্রতিটি অংশে ন্যায্য অধিকার প্রদানের তাগিদকে সামনে রেখে তাঁরা সমাজকে স্থিতিশীল রাখতে যথেষ্ট অবদান রাখে। বিশেষ করে তাঁদের বার্ষিক মাহফিলগুলোতে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে যেসব উপদেশ প্রদান করা হয় সেগুলো দেশের সামষ্টিক পরিবেশকে স্থিতিশীল রাখতে অভাবনীয় অবদান রাখে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কওমী-মাদরাসার প্রভাবাধীন এলাকায় সাম্প্রপ্রদায়িক সম্প্রীতির সূচক অত্যন্ত উঁচু। বিচ্ছিন্নভাবে যা ঘটে তা রাজনৈতিক ইন্ধনপ্রসূত বৈ কিছু নয়। তা'ছাড়া সাপ্তাহিক জুমআর আলোচনায় কওমী-খতীববৃন্দ মুসল্লীদের উদ্দেশে বিদআত-শিরকমুক্ত, নারী-নির্যাতনমুক্ত এবং শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে উপদেশমূলক ও জাতি-গঠনমূলক যে-সব আলোচনা রাখেন তা নিঃসন্দেহে জাতীয়-সংহতির জন্য খুবই ফলদায়ক বলে গণ্য হয়। যেহেতু বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার গভীরে কওমী-জগতের বন্ধন তাই কওমী আলিম-সমাজের প্রভাব সমাজে প্রচণ্ডভাবে দৃশ্যমান। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেদিক থেকে বলা যায়, দেশের কওমী-জগৎ পুরো জাতির জন্য একটা ইতিবাচক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টিতে সার্বক্ষণিক অবদান রেখে চলেছে।
সুতরাং আজ ভাবার সময় এসেছে, দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কওমী-মাদরাসাভিত্তিক কওমী-জগৎ এ-দেশের মাটি থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো; এ-দেশের মাটিতেই তাঁদের বসত; এ-দেশের মাটিতেই তাঁদের শেকড়। এঁদের শিক্ষা-সংস্কৃতি হাজার বছর ধরে এ-দেশেরই মাটির লালনে লালিত; এ-দেশের মাটির বন্ধনে আবদ্ধ। মূলত, কওমী-মাদরাসার শিক্ষাই এ-দেশের মূলধারার শিক্ষা। ঔপনিবেশিক শিক্ষা এ-দেশের মূলধারা নয়। যারা আমাদেরকে ছয় শ' বছর শোষণ করেছে সে ইংরেজ বেনিয়াগোষ্ঠীর দেয়া শিক্ষাকে মূলধারা মেনে নিয়ে কওমী-জগৎ এ-দেশের মাটি আর মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার শিক্ষা পায়নি।
কৈফিয়ত
কওমী-জগতের অন্তর্নিহিত সামাজিক শক্তির বিশদ বর্ণনার একেবারে প্রান্তে চলে এসেছি। এ দীর্ঘ আলোচনার এ প্রান্তে এসে আমার অনুভূত হচ্ছে সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দের কাছে বর্ণিত শিরোনামের একটা কৈফিয়ত তুলে ধরার গরজ। কেন এ আলোচনা? কিসের তাগিদে এতো তথ্য ও তত্ত্বের অবতারণা? এ প্রশ্নের সুরাহা না হলে বোধ করি পাঠকবৃন্দের কাছে এবং আমার বিবেকের দুয়ারে একটি অসম্পূর্ণ ও অতৃপ্ত-ভাবের আবহ থেকে যাবে। তাই, সে কৈফিয়ত নিয়ে হাজির হচ্ছি।
আমার হৃদয়ের ভালোবাসা-মিশ্রিত সম্মানিত পাঠ-সমাজ! আপনাদের অনেকেই জানবেন, স্বাধীনতা পরবর্তী '৭২-'৭৫ পর্যন্ত সময়কাল বাংলাদেশের কওমী আলিম-সমাজের জন্য ছিলো এক বেদনাবিদূর ক্রান্তিকাল। এ সময়ে তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ। নব্য-স্বাধীন দেশের উগ্র-বামপন্থী ও উগ্র-সেক্যুলারগোষ্ঠী পরিবেষ্টিত সরকারের সন্দেহের জাল মাথার উপর টাঙ্গানো থাকতো সর্বক্ষণ। মনে হতো কওমী-মাদরাসার আলিম-ছাত্রেরা ভিনগ্রহের বাসিন্দা। এদেশের মাটিতে জন্ম নিয়েও এঁদের কোন মানবাধিকার নেই। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অনেক আলিমকে শহীদ করে দেয়া হয় যাঁদের সংখ্যা কখনো কেউ জানবে না। বর্তমানে বেঁচে থাকা কিছু প্রবীণ আলিমের সাথে কথা বলে সেসব জেনেছি আমি। অথচ তাঁদের শতবছরের ঐতিহ্যের ইতিহাসের পাতাগুলো তখনো ছিড়ে যায়নি। আপনারা যারা মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়টা প্রত্যক্ষ করেননি তারা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হবেন: কী অবর্ণনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে কওমী আলিম-সমাজ দ্বীনি মাদরাসাগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তখন থেকেই মূলত কওমী-জগৎকে উপহাসের পাত্র হিসাবে দেখার পর্ব শুরু হয়। একশ্রেণীর বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও অধ্যাপক তাদের লেখায় ইসলাম, মাদরাসাশিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক রম্যরচনা, কবিতা, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখতে থাকেন। এদের পেছনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো স্পষ্ট। কিন্তু এতো কিছুর পরও কওমী আলিম-সমাজের প্রতি হৃদয়ের ভালোবাসা নিংড়ে দিয়েছিলেন; কওমী-মাদরাসাগুলোর দিকে হাঁড়ির চাল-ডাল দিয়ে সর্বাত্মক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন--এদেশের খেটে খাওয়া তৃণমূলের জনগণ, মেহনতি মানুষ, মজদুর আর শ্রমিক-শ্রেণী। এখানে একটি কথা না বললে সত্য আড়ালে থাকবে। তাহলো, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তার সময়কালের এসব অপতৎপরতা নিয়ে বিরক্ত ছিলেন বরাবরই। তাই তিনি বহুবার বলেছেন: ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিলে এ দেশ জ্বলে উঠবে। তাই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে জোরদার করা উচিৎ (দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা, ১৭ই আগস্ট ১৯৯৪, পৃ:১৬)। কিন্তু তাঁর সতর্কবাণীতে কান দেয়নি উগ্রবাম ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি। সরকারেও শেখ মুজিবুর রহমানের নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ ছিলো না বলে প্রশাসনের একটি অংশ ইসলাম ও মাদরাসাবিরোধী এসব অপতৎপরতায় হাওয়া দিতে থাকে।
স্বাধীনতার আজ ছিচল্লিশ বছর অতিক্রান্ত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কওমী-জগৎ থেকে উগ্র-বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ শিবির হতে আসা অভিযোগগুলোর কোন জবাব দেয়া হয়নি। কেন হয়নি এ নগণ্যের সেটা জানা নেই। জাতি আজ জানুক, দেখুক--এ দেশের জাতীয় উন্নয়নে, সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পথযাত্রায়, রাষ্ট্রের মানবসম্পদ উন্নয়নে, মানবিক সাহায্য প্রদানে এবং ধর্মীয় শিক্ষায় নৈতিকতা সৃষ্টিতে কওমী-জগতের অবদান দেশের অন্য যে কোন বিভাগের চেয়ে বেশি ছাড়া কোন অংশে কম নয়। তাই কওমী-মাদরাসার বারান্দায় গড়াগড়ি দেয়া একজন নগণ্য কওমী-সন্তান হিসাবে আমি বিবেকের কাছে বারবার আঘাতে জর্জরিত হয়েছি, আহত হয়েছি। মনের প্রতিটি অলিতে-গলিতে বেদনার ভারে ভারাক্রান্ত হয়েছি। হন্য হয়ে খুঁজেছি, সে অভিযোগগুলোর জবাব। যাঁদের কাছে কওমী-মাদরাসার লোকমা তুলে দু'হরফ পড়ে মানুষ হতে শিখেছিলাম; যাঁদের জুতোর স্পর্শে ধন্য হয়েছে এ জীবন- সেসব মহাত্মাদের সম্পর্কে অবাস্তব প্রশ্ন উঠবে আর আমরা নীরবে হেঁটে যাবো, সে কেমন করে হয়? এ কঠিন বাস্তবতার দৃষ্টিকোণে নেহায়েত কওমী-মাদরাসার ইজ্জতের দিকে তাকিয়ে, আমার ঋণগ্রস্থ-সত্ত্বার সতীত্বের আহ্বানে অবশেষে কলম ধরতে হলো স্বাধীনতার প্রায় চারযুগ প্রান্তে। আমার এ আলোচনা থেকে কোন কওমী-সন্তান যদি খুঁজে পান কওমী-শত্রুদের প্রত্যুত্তরের জবাব, তবে এ নগণ্য এ আশায় বুক বাঁধবে: এটাকেই আমার নাযাতের উপায় হিসাবে গণ্য করা হবে কিয়ামাতের কঠিন দিবসে। আল্লাহ হাফিয।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন