পুরনো লেখা

লেখা তুমি লেখা নও, কও কথা মোরে,
কথায় কাঁদাও তুমি কি যে ব্যথা ওরে!
কাগজের ভাঁজে গিয়েছ যতনে ঘুম,
স্মরণের আদরে দিলাম তোমারে চুম।

-MGRI 



 


পুনর্গঠিত হেফাজত: প্রত্যাশা ও সংশয়

মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী

(ফেইসবুক থেকে)

গত ১৫ই নভেম্বর ২০২০, রবিবার পুনর্গঠিত হলো হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটি চট্টগ্রামের দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে উক্ত পুনর্গঠন হয় মূল-কমিটিতে কারা-কারা স্থান পেয়েছেন, তা এখন অজানা নয়।  হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আমীর হিসাবে সাবেক মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী এবং মহাসচিব হিসাবে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী নতুন কমিটিতে নির্বাচিত হয়েছেন। পুনর্গঠিত কমিটি নিয়ে আপাতত যা জেনেছি: দুএকটা বিষয় বাদ দিলে বাকি সব চলনসইএমন মতামত অধিকাংশের।  মোটের উপর আল্লামা আহমদ শফী রহ.-র ইন্তিকালের পর হেফাজতের পুনর্গঠন নিয়ে সবার যে দাবি ছিলো, সেটার উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।

পুনর্গঠিত হেফাজত নিয়ে বলতে গেলে বাস্তবতার খাতিরে কিছু কথা বলতে হয়যা একজন পর্যবেক্ষকের নিরপেক্ষ ও ব্যক্তিগত মতামত হিসাবে গ্রহণ করলে বিতর্কের কিছু থাকে না।  বলাবাহুল্য, বর্তমান বছরের ১৮ই সেপ্টেম্বর সাবেক আমীর আল্লামা আহমদ শফী রহ. ইন্তিকাল করেন। সেই থেকে হেফাজতে ইসলামের আমীরের পদ শূন্য। তখন থেকে জাতি তাকিয়েছিলো হেফাজতে ইসলামের ভবিষ্যৎ আমীর নির্বাচনের দিকে। সংগতকারণে, গত ১৫ই নভেম্বর, রোববার হাটহাজারী মাদরাসায় মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী দা.বা.-র আহ্বানে পুরো দেশের জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিদের নিয়ে আমীর নির্বাচন ও কামিটি গঠন বা পুনর্গঠনের নিমিত্ত একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের দৃশ্যমান আদ্যপান্ত একজন কাউন্সিলর হিসাবে সশরীরে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে।  একজন ব্যক্তি হিসাবে আমার নিজস্ব স্ভাব, মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে সম্মেলনের কিছুকিছু বিষয় যেমন ইতিবাচক মনে হয়েছে তেমনি নেতিবাচক বা অসামঞ্জস্যশীলও মনে হয়েছে।  বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে সেসব এখানে এখনই না বলা শ্রেয় বলে মনে করি।  একটি সংগঠনের সাংগঠনিক মেজাজকে নিরীক্ষণ করলে, বিশেষত, আল্লামা আব্দুস সালাম চাটগামী (লাল্লাহ মাকামাহু), . আফম খালিদ হোসাইন সাহেব, মাওলানা সাজিদুর রহমান সাহেব, ঢাকার মাখযানুল উলূম মাদরসার পরিচালক মাওলানা নুরুল ইসলাম সাহেব প্রমূখের বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।  আল্লামা চাটগামী দা.বা. তাঁর উর্দূতে দেয়া বক্তব্যে একটি শরয়ী দস্তূর এবং সেই দস্তূরের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা বলে আকদর প্রসঙ্গ টেনেছেন। আমার মনে হয়েছে, পুরো সম্মেলনে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা। হযরতের কথায় তিনটি বিষয় উঠে এসেছে--এক, শরীয়াহভিত্তিক দস্তূর; দুই, আকদ এবং তিন, আকদের প্রতি দায়বদ্ধতা।  কোন সংগঠনই দস্তূর বা সংবিধান ছাড়া দাঁড়াতে পারে না। অথচ হেফাজতে ইসলাম তার দীর্ঘ পথচলায়ও পূর্ণাঙ্গ একটি গঠনতন্ত্র পাশ করতে পারেনি। ড. খালিদ ভাইও সে-কথা বললেন তাঁর বক্তব্যে। এরপর আসে আকদ বা সংবিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের বিষয়, যা সাংগঠনিক-মনস্তাত্বিক ইজাব-কবূলকে চিহ্নিত করে। এটি সংগঠনের মৌলিক স্তম্ভগুলোর একটি।  হযরত চাটগামী দা.বা.-র কথা মানলে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সাংগঠনিক শপথ নেয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। শপথ নেয়া কোন প্রতীকী কর্ম নয়, বরঞ্চ গঠনতন্ত্রের প্রতি আনুগত্যের দলীল। এটাকে ইচ্ছাকৃত লঙ্ঘন করা হলে, লঙ্ঘনকারীকে বা-গী বা বিদ্রোহী বলে অভিযুক্ত করা যায়।  সুতরাং, নির্দ্বিধায় বলা যায়, আল্লামা চাটগামীর উক্ত মৌলিক নির্দেশনায় হেফাজতে ইসলামের ভবিষ্যৎ পথচলার নিরাপত্তা অনেকখানি নির্ভর করে

যা হোক, প্রতিনিধি সম্মেলনের কথায় ফিরে আসি।  আগেই বলেছি, হেফাজতে ইসলামের সম্মেলন নিয়ে জাতির প্রত্যাশা ছিলো চোখে পড়ার মতো।  যা কিছু হয়েছে, আমি বলবো পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। তবে এমন কিছু প্রত্যাশা আমরা মনেপ্রাণে কামনা করিএখানে বলতেই হচ্ছে:

. পুনর্গঠিত কমিটি যাচাই-বাছাইকরণ: কোন কাজ-ই এক লাফে হয় না; ধীরেধীরে-ধাপেধাপে করতে হয় ১৫ই নভেম্বরের পুনর্গঠিত কমিটিকে আরেকবার যাচাই-বাছাইয়ের কষ্টিপাথরে পরখ করে নিলে ভাল হয় যেমন ধরুন, যেহেতু সারা দেশ থেকে দায়িত্বশীল নেয়া হয়েছে, তাই প্রথম ধাপে কিছুকিছু ক্ষেত্রে এলোমেলো হওয়া অস্বাভাবিক নয় এমনটি হতেই পারে দেখতে হবে, কোন দায়িত্বশীল কোন দায়িত্বশীলের নিকটবর্তী থাকলে কাজ সম্পাদনে সহজতা আসে কোন-কোন দায়িত্বশীল কেন্দ্রে থাকবেন, কোন-কোন দায়িত্বশীল রাজধানীতে থাকবেনসেসব বণ্টন করতে হবেতরীকায়ে কা-’-র পথচিত্র তৈরি করে  মনে রাখতে হবে, তাকসীমে কা-র বাস্তবায়িত হবে তরীকায়ে কা-রের দক্ষতার উপর ভিত্তি করে সঙ্গতকারণে, কার্যকরী কমিটির প্রথম বৈঠকেই এ বিষয়টির সমাধান করা হলে আশা করি ভাল ফল বয়ে আনবে

. সাংগঠনিক বলয় সুসংহতকরণ: স্বীকার করতে হয়, সাংগঠনিক বিস্তৃতি বা শক্তিশালী সাংগঠনিক পথরেখা প্রস্তুতকরণ একটি আদর্শ সংগঠনের প্রাণ। সাধারণত সাংগঠনিক সম্পাদক এ কাজে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন।  এ-কাজে সফল হতে সাংগঠনিক সম্পাদকের দক্ষতার বিকল্প নেই।  বলা যায়, এ-দিকটায় হেফাজতে ইসলামের অবস্থান বেশ দুর্বল বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আজও দেশের প্রত্যেক জেলা-উপজেলা-মফস্বল কমিটি গঠন, কমিটির নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠানে তদারকি, সাংগঠনিক সম্পাদকের দেশব্যাপী ত্রৈমাসিক সফর, কমিটিগুলো থেকে তরুণ-নেতৃত্ব ও কর্মী গড়ে তোলা, কর্মীদেরকে সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন করে গড়ে তোলা ইত্যাদিতে সন্তোষজনক কাজ করা হয়নি বলে মনে হয়। পাশাপাশি আমাদের দেশের ভূ-বিবেচনায় সাংগঠনিক সম্পাদকের অবস্থান রাজধানীতে হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেহেতু রাজধানী সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু, তাই নির্বাচিত সাংগঠনিক সম্পাদক রাজধানীতে বসে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারবেনযা দেশের অন্য কোথাও বসে মানোত্তীর্ণ করা দুষ্কর। বিষয়টি আশা করি পুনর্গঠিত হেফাজত নেতৃবৃন্দ ভেবে দেখবেন। এখানে আমার একটি প্রস্তাবনা আছে। তা হলো, একজন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে ঢাকায় রেখে ৮টি বিভাগে ৮ জন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের মাধ্যমে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যেতে পারেএতে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের উপর থেকে কাজের চাপ কমবে এবং বৃহত্তর পরিসরে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সহজ হবে।   

. জবাবদিহিতা:  জবাবদিহিতা একটি প্রতিষ্ঠানের মূল-নিয়ামক।  যেখান জবাবদিহিতা নেই, সেখানে সততা নেই; যেখানে জবাবদিহিতা আছে, স্বচ্ছতা আছেসেখানে সততা আছে, প্রগতি আছে, সফলতা আছে।  হেফাজতের আঙ্গিকে জবাবদিহিতা হবে প্রথমত, স্বয়ং রব্বুল আলামীনের কাছে এবং দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠানের কাছে--যেখানে প্রত্যেক দায়িত্বশীল দায়িত্বের পরিধি অনুসারে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতা করতে বাধ্য হবেন। মনে রাখতে হবে, কেবল অর্থের হিসাবেই জবাবদিহিতা বন্দী নয়।  এর বাইরেও অন্যান্য দায়িত্ব পালনে জবাবদিহিতা থাকতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, হেফাজতে ইসলাম কোন পেশাধারী প্রতিষ্ঠান নয়; এখানে কেউ বেতনধারী চাকরিজীবি (ব্যতিক্রম বাদে) ননতাই, কেবল প্রাতিষ্ঠানিক আইন প্রয়োগ করে সমস্যার সমাধান হবে না। এখানে প্রয়োজন সবার সম্মিলিত স্বেচ্ছাসেবামূলক আন্তরিক প্রচেষ্টা। এখানটায় কোন প্রকার ঘাটতি দেখা দিলে পুরো ব্যবস্থাই ধসে যেতে বাধ্য।  বিশেষ করে, কমিটির প্রতিটি বৈঠকে পূর্বের বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তাবয়ন নিয়ে পর্যালোচনা করা অত্যন্ত জরুরী। যদি এমন নিয়ম করা হয় যে, পূর্ববর্তী বৈঠকের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা ব্যতিরেকে চলমান বৈঠক শুরু করা যাবে না, তাহলে কাজে স্বচ্ছতা আসবে। প্রত্যেক বৈঠকের নির্ধারিত প্রাতিষ্ঠানিক খাতায় বৈঠকের বিবরণী দফতর সম্পাদক কর্তৃক লিখিত ও সংরক্ষিত থাকতে হবে এবং বিবরণীর অনুলিপি বা নকল মহাসচিব বরাবরে জমা দিতে হবে।  

. পূর্ণাঙ্গ হিসাবের অডিটসময়ে-সময়ে যে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ওঠে তা হলো: হেফাজতে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ আয়-ব্যয়ের হিসাব। ২০১৩ সাল থেকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের অডিট রিপোর্ট আমার যদ্দূর জানা আছে এখনও চূড়ান্ত করা যায়নিবারবার কমিটি গঠন, সভাপতি পরিবর্তন, সদস্য পরিবর্তন, অযাচিত হস্তক্ষেপ ইত্যাদি কারণে অডিট চূড়ান্তের বিষয়টি আর এগোয়নি। চট্টগ্রামের একজন দায়িত্বশীল যিনি এখন মূলধারাবিরোধী, মতান্তরে ২২ লক্ষ বা ২৬ লক্ষ টাকা উত্তোলন করে হিসাব না দেয়ার বিষয়ে পূর্বতন কেন্দ্রীয় কমিটি কোন ব্যবস্থা নেয়নি, যা আজও অনিস্পন্ন হয়ে রয়েছে বলে আমি জানিবিষয়টি সাবেক অর্থ সম্পাদক বা কোষাধ্যক্ষ থেকে জেনে নেয়া যেতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, হেফাজতের এসব অর্থ মুসলিম সর্বসাধারণেরকারও ব্যক্তিগত নয়। তাহাফ্ফুযে আমওয়ালুল মুসলিমীন বা মুসলিম উম্মাহর সম্পদ রক্ষার যে অনিবার্য দায়িত্ব হেফাজতের কাঁধে বর্তেছে তার জন্য জবাবদিহিতার কোন বিকল্প নেই। আমরা আশা করবো, বর্তমান পুনর্গঠিত কমিটি হেফাজতে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অডিট চূড়ান্তকরণে নিরপেক্ষ ও সৎ সদস্যসহযোগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং অনাদায়ী অর্থ আদায় করবেন।  

মেয়াদভিত্তিক কমিটি: একটি নির্বাচিত কমিটির নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকা জরুরী। সেটা তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদী হতে পারে। এতে প্রত্যেক কমিটির উপর কর্ম-সম্পাদনের একটি মেয়াদভিত্তিক সীমা ও চাপ থাকবে; থাকবে মেয়াদ শেষে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা। প্রতি মেয়াদ শেষে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন বা পুনর্গঠন হলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবার সুযোগ পাবে। এতে হেফাজতের তৎপরতা শানিত হবে

. হেফাজত-প্রশাসন সম্পর্ক: হেফাজত ও প্রশাসনের মধ্যে সম্ভাব্য কোন সম্পর্ক থাকবে কি না বা থাকলে কতোটুকু থাকবেসে নিয়ে বিতর্ক বরাবরই থেকেছে। সে দিনের সম্মেলনে মাওলানা মামুনুল হক সাহেব এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেন। তিনি বলেন: হেফাজত সরকার-বিরোধীও নয় আবার সরকার-সমর্থকও নয়। আমি বলবো একদম যথাযোগ্য কথা। আমার মনে হয়েছে, মুহতারাম মামুনুল হক সাহেব কথাটি বলেছেন বর্তমান আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী দা.বা.-র একটি বক্তব্যের ভাবকে ধারণ করে। সম্ভবত সম্মেলনের সপ্তাহখানিক আগে বাবুনগরী হযরত এক সম্মেলনে বলেন: আমরা সরকারবিরোধী নই, আমরা বাতিলবিরোধী। যা হোক, এখান থেকে আমরা আলোচনার সূত্রপাত করতে পারি। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে চারপাশের পরিবেশের। মনে রাখতে হবে, আমাদের চারণভূমি বাংলাদেশ। এখানে যা কিছু আমরা করবো, আমার দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতিকেই বিবেচনায় রেখে করবো। এটা পাকিস্তানও নয়, আফগানিস্তানও নয়; এটা য়ুরোপও নয়, আমেরিকাও নয়নয় ভারতও। এটা আমাদের প্রাণের প্রিয় জন্মভূমি-পিতৃভূমি: বাংলাদেশ।  এখানকার মাটি-এখানকার মানুষ আমাদের মূল উপজীব্য।  যারা এখন সরকারে বসে দেশ চালাচ্ছেন, তাঁরাও এ মাটির সন্তান। সঙ্গতকারণে, প্রশাসন বলুন, সরকার বলুনতাঁদের সাথে হেফাজতে ইসলামের একটি আদর্শিক ও কৌশলগত সম্পর্ক থাকতে পারেযার ভিত্তি হবে দা’ওয়াত ইলাদ্দীন।  যারা আবেগবশে হেফাজতকে সবসময় সরকাবিরোধী একটি অবস্থানে দেখতে বা দেখাতে চান তাদের সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করি সবিনয়ে।  এতে ইসলামপন্থীদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।  আমার স্পষ্ট মনে আছে, আশির দশকে যখন খেলাফত আন্দোলনের প্রধান আমীরে শরীয়াত হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ. প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও প্রেসিডেন্ট এরশাদকে দাওয়াত দিতে বঙ্গভবনে যান, বলেছিলেন: আমি ক্ষমতা চাই না; আপনাদের ক্ষমতা আপনাদের হাতেই থাকবে। আপনারা কেবল আল্লাহর জমীনে আল্লাহর শাসন কায়েমের ঘোষণা দিন।  এই হচ্ছেদা’ওয়াত ইলাল্লাহ বা ইলাদ্দীন।  এ কাজ কি হেফাজত করতে পারে না?  আমার মনে হয়, প্রশাসনের সাথে সম্পর্কে হেফাজতে ইসলামের দু’টো ধারা থাকতে পারে: এক, দা’ওয়াতী  এবং দুই, ইহতিজাযী দু’টো ধারার দু’টো দল থাকবে।  যাঁরা দাওয়াতী ধারার সাথে যুক্ত থাকবেন তাঁরা সরকার বা প্রশাসনের সাথে সংলাপে থাকবেন।  সংলাপ ব্যর্থ হলে ইহতিজাযী ধারা সর্বসাধারণ নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে মাঠে থাকবেন।  স্মর্তব্য, ইহতিজাযী ধারা দাওয়াতী ধারার  অনুকূলে একটি প্রেসার গ্রুপ হিসাবেও কাজ করবে।  এতে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন বহিরাঙ্গনে বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। এখানে আরও একটি কথা বলতে হয়: দা’ওয়াতী ধারার দলটি কেবল প্রশাসন বা সরকারের সাথে নয়, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও নিজেদের অবস্থান নিয়ে কথা বলবেন।  বিষয়টি সদয় বিবেচনার জন্য হেফাজতে ইসলামের পুনর্গঠিত কমিটির কাছে উত্থাপিত হলো।  

. শাপলা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার দাবি: বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্বরতম হত্যাকাণ্ড ২০১৩ সালের ৫ই মেরাতে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরের সমাবেশে চালানো হত্যাকাণ্ড।  কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, ঘটনা-পরবর্তী কিছুদিন শাপলা-হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে হেফাজতে ইসলাম দাবি জানালেও ধীরেধীরে সে দাবির উচ্চারণ করতে ভুলে যায় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।  হেফাজতের অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট সরকারের দালালগোষ্ঠীর প্রভাবে এমন হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।  তাই হেফাজতের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা এ নিয়ে বিক্ষুব্ধ ছিলো দিনের পর দিন।  নবগঠিত কমিটি থেকে দালালগোষ্ঠী বাদ পড়ার পর এখন শাপলা-হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি আবার জেগে উঠছে।  সঙ্গতকারণে, জাতির প্রত্যাশা: হেফাজতে ইসলাম আবার শাপলা-হত্যাকাণ্ডের বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি ও  দায়ীদের আইনের কাঠগড়ায় তোলার জোড়ালো দাবি তুলবে, সাথেসাথে নিজেরাও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ৫ই মে’র ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য তুলে ধরবেন।

. আন্তর্জাতিক সম্পর্কহেফাজতে ইসলামের মতো  বৃহৎ সামাজিক শক্তির জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।  মনে রাখতে হবে, এখন বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশনের যুগ। এ যুগে কোন প্রতিষ্ঠান বা দলের দর্শন ও অবস্থান বিশ্ব পরিমণ্ডলে পরিস্কার করতে না পারলে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া যায় না।  তাই, হেফাজতে ইসলামের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী ও দক্ষ দলের কোন বিকল্প নেই।  এ বিভাগের নেতৃত্ব দেবেন হেফাজতের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক।  দলটি একদিকে যেমন দেশের বিদেশী রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারদের কাছে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন তেমনি মাঝেমাঝে বিদেশ সফর করে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব বা বিদেশী রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করে নিজেদের অবস্থান বুঝিয়ে দেবেনস্মরণ রাখা দরকার, শাপলার হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে আন্তর্জাতিক চাপের যথেষ্ট গুরুত্ব থাকে।  তাই, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দলটি তাঁদের দাবির স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক  সমর্থন অর্জনে সমর্থ হলে শাপলা হত্যাকাণ্ডের বিচার ত্বরান্বিত হতে পারে।  এ বিষয়টিও হেফাজতের নতুন পরিষদের সামনে বিবেচনার জন্য থাকলো।

. একটি হেফাজত আর্কাইভ গঠন:  পৃথিবীর যেসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান মনে করে, তাদের ভূমিকা ঐতিহাসিক এবং ইতিহাসের পরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাদের তৎপরতা ও অবদান পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আছেতারা গঠন করে যায় যাবতীয় দলীল ও স্মৃতির আর্কাইভ বা সংরক্ষণাগার।  যেহেতু সকল হেফাজত কর্মী মনে করেন,  হেফাজতে ইসলাম নিছক কোন ক্লাব-সমিতি নয়; এর রয়েছে একটি ইতিহাস এবং শাপলার মতো রক্ত ঝরানো অধ্যায়, সুতরাং হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের কুরবানীর স্মৃতি ও দলীল-দস্তাবেজ রক্ষার জন্য একটি আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  এখানে থাকবে  হেফাজতের আন্দোলনের বিভিন্ন প্রকাশিত নথিপত্র, হেফাজত গঠনের ইতিহাস, শাপলার হত্যাকাণ্ডের ছবি ও পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট ইত্যাদি। এ ধরনের একটি আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করা গেলে কওমী ছাত্রদের মানস থেকে কখনও শাপলার স্মৃতি মুছে যাবে না এবং তা থেকে পুরো জাতি নাস্তিক-মুরতাদদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার অনুপ্রেরণা লাভ করবে

১০. সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ:  সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ জনকল্যাণমুখী যে কোন সংস্থার জন্য অপরিহার্য। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির পাশাপশি যেসব সামাজিক কর্মকাণ্ডে হিসসা নেয়, সেসবের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মানুষ সে-কথা বোঝে। তবে অরাজনৈতিক কোন সংস্থা যখন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়, সেখানে মানুষ সেটাকে রাজনীতি মনে করে না।  আমাদের দেশে রাজনীতির প্রবল অপব্যবহারের কারণে মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর উপর আস্থাহীন হয়ে পড়েছে।  সেদিক থেকে হেফাজতে ইসলামের উত্থানকে এদেশের মানুষ একটি কল্যাণমূলক ব্যতিক্রম বলে গ্রহণ করেছে। দলমত নির্বিশেষে সবাই তাই হেফাজতের কাতারে শরীক হয়েছে, হচ্ছে।  এ সুযোগটাকে হেফাজতে ইসলাম কাজে লাগাতে পারে।  তৃণমূল পর্যায়ে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে হেফাজত প্রমাণ করতে পারেতারা নিছক ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী নয়; তাঁরা মানবকল্যাণ এবং দেশ গঠনেও অগ্রসর। এটা হেফাজত করবে কেবল মানুষকে কাছে টানার অভিপ্রায়ে নয়, আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনের নিমিত্ত। এতে জাতীয়ভাবে তাঁরা সম্মানীত হবেন। সংগঠনের সমাজকল্যাণ সম্পাদক এ কাজে নেতৃত্ব দেবেন। বিষয়টি আশা করি হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভেবে দেখবেন।

সবশেষে পুনর্গঠিত হেফাজত নিয়ে  সংশয়ের কথা বলি।  পুনর্গঠিত কমিটি নিয়ে ইদানীং কিছু কথা হচ্ছে।  বিশেষ করে রাজনৈতিক কোন ব্যক্তি হেফাজতের উর্ধতন দায়িত্বশীল হতে পারেন কি না বা এমন হওয়া উচিৎ কি নাএসব নিয়ে কথা হচ্ছে।  যেহেতু এখনও হেফাজতে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ কোন গঠনতন্ত্র প্রকাশ করা হয়নি, তাই এ বিষয়ে নিজস্ব কোন নিয়ম নিয়ে কথা বলা দুষ্কর।  যেহেতু হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক চরিত্র অরাজনৈতিক, তাই একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের উর্ধতন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক কোন ব্যক্তি হতে পারেন কি নাসে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।  এর নিস্পত্তি হতে পারতো গঠনতন্ত্রে। সেটা যখন নেই, দেখতে হবে দু’টো বিষয়: এক, অন্যসব অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ধারা অথবা দুই, অভিজ্ঞতা।  নেতৃবৃন্দ যদি চান অন্য প্রতিষ্ঠানের উদাহরণকে কাজে লাগাতে পারেন বা অরাজনৈতিক সংস্থায় রাজনৈতিক ব্যক্তির দায়িত্ব প্রদানের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।  এখন প্রশ্ন আসে, হেফাজতে ইসলামের আল্লামা আহমদ শফী সাহেব রহ.-র সময় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অংশগ্রহণের ফল কেমন ছিলো?  আমার মনে হয়, প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা কঠিন কিছু নয়।  কথায় বলেনা: ফলেই বৃক্ষের পরিচয়!  ২০১৩ থেকে এ অব্দি রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের নেতৃত্বের কারণে হেফাজতের যোগ-বিয়োগ কী হয়েছে তা কি কারও কাছে অস্পষ্ট? এখানে আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হোক। কোন আম মিষ্টি কি টক--সে সিদ্ধান্ত বইয়ের লেখায় নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে নিতে হয়।  হেফাজতের অতীত থেকে আমরা বারবার দেখেছি, সবাই নন, এক শ্রেণীর নীতিহীন ব্যক্তির অংশ্গ্রহণের কারণে হেফাজত বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমাদের চট্টগ্রামে একটি আঞ্চলিক প্রবাদ আছ: যার বাবাকে কুমিরে খেয়েছে, সে ঢেঁকি দেখলেও ডরায়।  এখন দেখতে পাচ্ছি, হেফাজত কর্মীদের অনেকেই সেই রাজনীতি-ভাইরাসে শঙ্কিত। মূল সংশয়টা কাজ করছে এখানে।  তার ওপর একটি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের ৩৪ জন নেতার হেফাজতের মূল কমিটিতে স্থান পাওয়া নিয়ে দেখলাম বেশ কথা হচ্ছে।  বিষয়টি এখনও সংশোধনের সুযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে। মনে হয়, আগামীতে কার্যকরী কমিটির বৈঠক বসলে গঠনমূলক আলোচনার ভিত্তিতে ভারসাম্য বজায় রেখে সংশোধন করা সম্ভব। তার পরেও আমাদের সম্মিলিত একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আর তা হলো: হেফাজতে ইসলামের উর্ধতন দায়িত্বে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণ নীতিগত কারণে সম্ভব কি না।  হেফাজত-কর্মীদের আরেকটি সংশয় হলো, বর্তমানে যে কমিটি বাছাই করা হয়েছে, তাতে রাজনৈতিক কারণে হেফাজতের উপর কোন প্রভাব পড়ে কি না। উপরন্তু রাজনতিসংশ্লিষ্ট যাঁরা এখন কমিটিতে আছেন, তারা ভবিষ্যতে হেফাজতে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করবেন কি না। যদি তাই হয়, ভবিষ্যতে হেফাজত আবারও বিতর্কিত হবে কি না। এগুলোই মোটামুটি সংশয়ের চিত্র।

পরিশেষে বলতে হয়: পুনর্গঠিত কমিটি নতুন পথ তৈরি করুক, এ জাতিকে আলোর পথ দেখাক; কওমী তরুণেরা বুক বাঁধুক নবচেতনায়সেটা আমরা মনেপ্রাণে চাই।  সকল বাধাবিঘ্ন পেরুতে নেতৃবৃন্দের সতর্ক-দৃষ্টি যে অনিবার্যসেটাই হোক আমাদের বাস্তব উপলব্ধি। সকল পদ আর অর্থের লোভ পায়ে মাড়িয়ে বাংলাদেশের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ফাঁদ পেতে থাকা অপশক্তির দূর্গ ধ্বংস করে তাওহীদের বাণীতে ভরপুর করে দিক হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশএ মুনাজাতই করি সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে। আল্লাহ হা-ফিয।

১৮.১১.২০ 

 


 

আমাদের কওমী তরুণ আলিম-সমাজ ও কিছু কথা

মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী 

আমাদের কওমী তরুণ আলিম-সমাজ নিয়ে কিছু কথা লিখবো বলে ভাবছিলাম দীর্ঘদিন থেকে। কিন্তু কলম ধরিনি ডরে-ভয়ে, কচিৎ যদি বাহাদুরি করে ফেলি। এর উপর নিজের সীমাহীন অযোগ্যতা, প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব, অভিজ্ঞতার নিদারুণ দুর্ভিক্ষ ইত্যকার কারণে লেখা আর হয়ে ওঠেনি। তবুও আজ লিখছি অন্তত বড়দের কিছু বকাঝকা খেয়ে যৎসামান্য অর্জন করতে পেরেছিলাম বলে। কেউ মনে করবেন না যেন আমি আবার সকলকে মুরীদ-ছাত্র ভেবে নাসীহাহ পেশ করতে বসেছি। বরঞ্চ বড়দের মজলিস আর জুতোর স্পর্শ থেকে যা কিছু শিখেছি সে-সবকে সম্বল করে তাঁদের তারজুমান হিসাবে কিছু লিখে যাচ্ছি। তাওফীক মহান জাতে বারী তাআলার।

বড়দের দেখা আমি পেয়েছি দুভাবে। এক,কিতাব থেকে  দুই, সরাসরি। বলতে পারেন অনেকটা কিতাবুল্লাহ ও রিজালুল্লাহর আঙ্গিকে। কিতাব থেকে পেয়েছি আমাদের বেহেশতবাসী আকাবির হযরতবৃন্দকে আর সরাসরি যাঁদেরকে তাঁদের জীবদ্দশায় পেয়েছিলাম। বড়দের কাছ থেকে কিছু পাবার ও নেবার নেশাটা আমাকে ধরিয়ে দিযেছিলেন মূলত আমার উস্তাযে মুহতারাম জামিয়া বাবুনগরের ফিকাহ বিভাগের প্রধান মুফতী মাহমূদ হাসান সাহেব দা.বা.। তখন সালটা ১৯৮৮ হবে। আমি তখন চব্বিশ বছরের এক যুবক। জামিয়া বাবুনগরের পূর্বপাশের পুরনো হলুদ-ইমারতটার (যা বর্তমানে নেই) উত্তরের এক কামরায় থাকতেন উস্তাযুল আসাতিযা, শাইখুল হাদীস আল্লামা ইছহাক আল-গাযী সাহেব রহ.। একদিন হযরত মুফতী সাহেব হুযুর আমাকে হযরত রহ.-র রুমে পাঠালেন এক কাজে। তখনও বুঝতে পারিনি কতো বড়ো মহীরুহের মুখোমুখি হয়েছিলাম। সেই থেকে দীর্ঘদিন হযরতের খিদমাতে থাকার সুযোগ হয় অধীনের। এরপর ১৯৯১ সালে দেওবন্দ যাবার প্রাক্কালে হযরত রহ.-র কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে অশ্রুসজল কণ্ঠে হযরতের কাছে আরয করলাম: হুযুর, ওখানে তো বড়বড় আলিমদের সাথে দেখা হবে, তাঁদের সাথে আমার সম্পর্ক কেমন হবে? এর জবাবে হযরত রহ. যা বলেছিলেন তা আমার জীবনে এক স্বর্ণালী লেখা হয়ে থাকবে। আজও সে-কথা বারবার মনে পড়ে। বড়দের এসব ঋণ কোনদিন শোধ হবার নয়। হযরত রহ. বলেছিলেন: আমার সাথে সম্পর্ক বহাল থাকবে, নাসীহাহ যেখানেই পাবে সফর করে হলেও গিয়ে নিয়ে আসবে। কী হৃদয়ভেদী কথা! এ কথাটাই আজকের কওমী তরুণ অলিম-সমাজের উদ্দেশে তুলে ধরতে এ লেখার অবতারণা। বড়দের সংস্পর্শ বিনে এ-সব কথা কি আদৌ পাওয়া যাবে ভাই? আজ কেন জানি আমাদের তরুণ আলিমশ্রেণী বড়দের নাসীহাহ গ্রহণে খুব আগ্রহী বলে মনে হয় না। তাদের ধারণা, দারসী জ্ঞানার্জনেই তো যথেষ্ট। অথচ তারা ভুলে যান দ্বীনের এক মৌলিক অঙ্গ রিজালুল্লাহর কথা। বড়দের নৈকট্য ও তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণের ফল যে কতো সুদূরপ্রসারী আর সুমিষ্ট হয় তার এ এক নীরব সাক্ষী আমি। সে কথাই বলছি। আমি কল্পনাও করিনি, হযরতের সেদিনের দোয়া ও নাসীহার কারণে ভারতের এমনসব বুজুর্গব্যক্তির সাথে অধীনের মুলাকাত হবে। নিঃসন্দেহে হুযুরের দোয়ার বরকতে মুলাকাত হয়েছিলো ফকীহুন্নাফস রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ.-র সাহেবজাদা মাওলানা হাকীম মাসঊদ গাঙ্গুহী রহ.-র সাথে। তাযকিরাতুর রশীদ’-এ পড়েছিলাম, হযরত গাঙ্গুহী রহ. শেষ-বয়সে দুর্বল হয়ে পড়লে সাহেবজাদা হাকীম মাসঊদ গাঙ্গুহীর ইমামতিতে নামায আদায় করতেন। এখনও মনে আছে, হযরত গাঙ্গুহী রহ.-র বাড়িটা এক দিহাতী এলাকায়। কাঠের তৈরী বিশাল বাড়িতেই মুলাকাত হলো হাকীম সাহেব রহ.-র সাথে। আমরা হাযিরীনের আর্জিতে হযরত আমাদেরকে কিছুক্ষণ নাসীহাহ প্রদান করলেন। যারা পেরেছিলাম হযরতের দুহাত ধরে অত্যন্ত মূল্যবান উপদেশ শুনছিলাম। ধবধবে সাদা শরীর তাঁর। কী মোহনীয় কথার তারীকা! হযরতের ডান হাতের কব্জি ধরেছিলাম আমি। সে এক অন্যরকম অনুভূতি!

এরপর মুলাকাত হলো, হাকীমুল উম্মাহ হযরত থানভী রহ.-র মাশহূর খলিফা মাওলানা মসীহুল্লাহ খান সাহেব রহ.-র সাথে। সে এক অন্য সাম্রাজ্য। বোঝার কোন উপায় ছিলো না, এ বিশাল রাজপ্রাসাদে আল্লাহর এক দরবেশ বসে আছেন। জামিয়া বাবুনগরে পড়ার সময় একদিন হযরত গাযী সাহেব হুযুর রহ. আমাকে একান্তে সতর্ক করে বলেছিলেন: মনে রাখবে, তাকওয়া পোষাকের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে অন্তরের উপর। মনে রেখো, রাজার পোষাক পরেও একজন বিনয়ী হতে পারে আবার ফকীরের পোষাক পরেও কেউ মুতাকাব্বির বা অহংকারী হতে পারে। হযরতের এ উপদেশের অক্ষরাক্ষর প্রতিফলন দেখেছি হযরত মসীহুল্লাহ খান সাহেব রহ.-র দরবারে। বাইরে থেকে মনেই হবে না, এখানে আল্লাহর এক জবরদস্ত অলী রূহের খোরাক বন্টন করে যাচ্ছেন। তখন দুপুর, হযরতের মূল খানকার বাইরে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, দুপাশে দুসারিতে মুরীদরা বসে আছেন। ভেতর থেকে বেশ গরম-স্বরে হযরতের ইসলাহ-ধ্বনি ভেসে আসছিলো। আওয়ায শুনে ভয়ে আমরা কাঁপছিলাম। বাইরে দাঁড়ানো খাদিমকে আমাদের কাফেলার আমীর চকরিয়ার মাওলানা হাফেজ ইলিয়াস ভাই সাহস করে বললেন, আমরা দেওবন্দ থেকে এসেছি, হযরতের সাথে দেখা করতে চাই। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, খাদিম গিয়ে বলা মাত্রই হযরতের আওয়ায বন্ধ হয়ে গেলো। ভেতর থেকে খাদিম এসে বললেন, হযরত আমাদেরকে যেতে বলেছেন। অনেক ডরে-ভয়ে আমরা কজন লাইন ধরে যথাসম্ভব আদব রক্ষা করে হযরতকে সালাম দিয়ে ঢুকলাম। এতক্ষণ ধরে ভয়ে-ভয়ে যার আওয়ায শুনছিলাম, দেখি, অত্যন্ত সাধারণ এক মানুষ; হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানালেন। অতি সাধারণ এক সাদা পান্জাবী পরে বসে আসেন। আমরা পরিচয় দিয়ে বললাম, আমরা দেওবন্দ থেকে এসেছি হযরতের নাসীহাহ নিতে। আমি প্রথম দফাতেই হযরতের ডান হাতের কব্জি ধরে হযরতের নূরানী চেহারার দিকে চেয়ে রইলাম। আহ, কী দারুণ অনুভূতি! সে কি বোঝানো যায়? হযরত ইত্তিবায়ে সুন্নাহর উপর জোর দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নাসীহাহ প্রদান করলেন। বাইরে বেরিয়ে ভাবছিলাম, যাঁর ভয়ে সবাই কাঁপছে, তিনিই আমাদের কাছে কতো বে-তাকাল্লুফ হয়ে দেখা দিলেন। কতো যথার্থই না বলেছেন কবি: উলা-ইকা আ-বা-য়ী ফাজিঅ্নী বিসলিহিম.

ফিদায়ে মিল্লাত হযরত আসআদ মাদানী রহ.-র কথা কখনও ভোলার নয়। এমন হাসিখুশি মানুষ আমি আর দেখিনি। কাছে-দূরে এক-ই রকম। মনে হতো, হযরতের জীবনে দুঃখ বলে কোন শব্দ নেই। পেরেসানী যেন তাঁর ধারকাছ দিয়েও যায়নি। অথচ বাইরের দুনিয়া জানতেও পারেনি, তিনি কতো উঁচু মানের বুজুর্গ ছিলেন। সকালে ফজরের নামাযের পর যখন অধিকাংশ ঘুমাতো, আমি বেরিয়ে পড়তাম হযরতের পেছন-পেছন হাঁটতে। লম্বাপথ ধরে হযরত মাদানী হাঁটতেন। হযরতের সাথে আমরা ছয়-সাত জন থাকতাম। এর মধ্যে কেবল আমিই ছিলাম বাঙ্গালী। আজও রহস্য জাগে হযরত মাঝেমাঝেই কেন জানি মাথা ঘুরিয়ে আমাকে এক নযর দেখে নিতেন। কিন্তু অজানা ভয়ে আমি কথা বলতে পারতাম না।

শরফে মুলাকাত হাসিল হলো দারুল উলূম দেওবন্দের তৎকালীন মুহাদ্দিস আল্লামা সায়্যিদ আহমদ পালনপুরী দা.বা.-র সাথে। দারুল উলূমের ছাত্রেরা দুজন উস্তাযকে বাঘের মতো ভয় করতো। তাঁদের একজন হলেন হযরত পালনপুরী, দ্বিতীয়জন হলেন, তৎকালীন নাযিমে তালিমাত হযরত আরশাদ মাদানী দা.বা.। দূর থেকে এ দুই হযরতকে যতোটা ভয়-জাগানিয়া মনে হতো, কাছে কিন্তু তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত বন্ধুসুলভ। হযরত পালনপুরী যখন ঘর থেকে বেরিয়ে মাদরাসার দিকে আসতেন আমরা ভয়ে অলিগলিতে ঢুকে পড়তাম। তাঁর চেহারার দিকে তাকাতে ভয়  হতো। একদিন আসরের নামাযের পর হঠাৎ দেখি হযরত পালনপুরী রহ. কয়েকজন ছাত্রকে ডাকছেন। আচানক অবাক করে দিয়ে আমাকেও শামিল করা হলো কাফেলায়। আহ, কী আনন্দ! এমন সুযোগ কি আর হবে? আমরা হযরতের পেছনে-পেছনে হাঁটছি। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম হযরতের বাড়ির আঙ্গিনায়। মুহূর্ত পরে আমাদেরকে বসতে দেয়া হলো এক ঘরে। ঘরে বসে দেখি, যাঁর ভয়ে সবাই কাঁপে, সেই তিনি এখন অন্য এক মানুষ। সে কি বন্ধুসুলভতা তাঁর! যেন আমাদের-ই একজন। ভেতর থেকে একটা বড় থালা নিয়ে এসে আমাদের সামনে রেখে দিলেন। দেখে ভেবেছিলাম আপ্যায়ন বুঝি। ওমা, এ দেখি পেঁয়াজের স্তুপ। হযরতও বসে গেলেন। এবার হযরত পালনপুরী রহ. বললেন, এটা আমার নিত্যদিনকার কাজ। আমরা তো একেবারে থ। হযরত আমাদের মনের অবস্থা বুঝে বলতে লাগলেন, কেন বিবির সাথে কাজ আন্জাম দেয়া কি সুন্নাহ নয়? আমরাও হযরতের সাথে খুশিখুশি কাজে হাত দিলাম। এবার শুরু হলো অসাধারণ এক আলোচনা। হযরত বললেনআমি তো প্রতিদিন বিবির খিদমাত করি, তার কাজে সহযোগিতা করি। হযরত বলছিলেন: দেখ ভাই, আমার ছয়-সাতটি সন্তান। ওদের একজনের বেলায়ও জন্মের সময় আমি নার্স বা ধাত্রী ডেকে আনিনি। আমি নিজেই সব করেছি। কারণ, প্রথমত কাজটি আমি জানি আর দ্বিতীয় হলো, আমার স্ত্রীর সামনে আমার চেয়ে বড় মাহরাম আর কে? আমি খিদমাত হিসাবে এসব কাজ আন্জাম দিয়েছি। আল্লাহু আকবার! শুনে তো আমাদের শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে গেলো বুঝি। তারপর একজনকে জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ভাই মাওলানা! বিয়ে করেছো? সে বললো, জ্বী হযরত। হযরত বললেন, বলো কি! তোমার কি রস-কষ বলতে কিছু নেই? কে বলেছে তোমাকে এখানে আসতে? ঘরে বিবি আর তুমি এখানে! আজীব ইনসান তুমি! সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে গেলো। সেদিনের স্মৃতি আজও মনে পড়ে। 

 

অরেকজন বড় মানুষের কথা না বললেই নয়। উনি ভারতের বিখ্যাত আরবী সাহিত্যিক আল কামুসুল জাদীদের লেখক মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানভী রহ.। পোষাক-আষাকে এমন পরিপাটি একজন মানুষ আমি আর দেখেছি বলে বলতে পারবো না। এতো সুন্দর করে একজন মানুষ কথা বলতে পারে, ভাবাও মুশকিল। উচ্চারণে কখনও দ্বিত্ব করতে দেখিনি তাঁকে। দেওবন্দের কুতুবখানা হুসাইনিয়াতে বসতেন নিয়মিত। কখনও জানতে পারিনি, কেন তিনি আমাকে এতো স্নেহ করতেন। হুসাইনিয়াতে এসেই আমার খোঁজে লোক পাঠিয়ে দিতেন। আমাকে পাশে বসিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যেতেন। ইতিহাস, তাঁর জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা বলে যেতেন অনুপম সাহিত্যের ভাষায়। আমি চেয়ে থাকতাম অপলক আর আত্মস্থ করতাম তাঁর কথা বলার শৈলী। কথা প্রসঙ্গে তিনি দারুল উলূমে তাঁর শিক্ষকতাকালীন বিভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করতেন। একদিন তিনি বললেন, জানো মাওলানা! দারুল উলূম থেকে হাকীমুল ইসলাম কারী তয়্যিব সাহেব রহ.-র বিদায়ের পেছনে যে আন্দোলন হয়েছিলো তাতে নেতৃত্ব দিযেছিলাম আমি। মাশহূর যে, ওয়াহিদুজ্জামান যদি আন্দোলনে নেতৃত্ব না দিতেন তবে কারী তয়্যিব সাহেব স্বপদে থেকে যেতে পারতেন। সেদিনের কথা স্মরণ করে হযরত বললেন, ভাই রব্বানী, আজ বুঝতে পারছি, সেদিন আমি কতো বড় ভুল করেছিলাম। তাই পরবর্তীতে যখন আমাকেই বিদায় করার সিদ্ধান্ত হলো, বেরিয়ে আসার সময় আমি সব ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে বলে এসেছিলাম: ভাই, আমার আজকের এ-দিন সেদিনের বদলা বা কাফ্ফারা মনে করো যেদিন আমি হাকীমুল ইসলাম কারী তয়্যিব সাহেবকে বের করে দেয়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। এ জন্য আমি হযরতের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। হযরত কিরানভী রহ.-র এমন ইখলাসপূর্ণ কথায় সেদিন আমি না কেঁদে থাকতে পারিনি। দেওবন্দ থেকে আসার সময় সবচেয়ে বেশি মনে পড়েছে হযরত কিরানভীর কথা। আল্লাহ তাঁকে কবূল করুন। 

 

আমার স্মৃতির পাতাগুলোর কিছু অংশ আজ উল্টালাম আমাদের কওমী তরুণ আলিমদের জন্য। বলেছিলাম, বড়দের নৈকট্য আর সান্নিধ্যের কথা। আমি আজও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, দেওবন্দ যাবার প্রাক্কালে যদি হযরত গাযী সাহেব হুযুর রহ.-র দোয়া আর নাসীহাহ আমার শামিলে হাল না হতো তবে আমার সফর কোন অর্থ বহন করতো না। যা কিছু অধীনের কপালে জুটেছে, সবই আমার মুহতারাম আসাতিযায়ে কেরামের বদৌলতে। আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি বরকত এসেছে বলতে পারি আমার শ্রদ্ধেয় উস্তাযবৃন্দের জুতো সিধা করার কাজ থেকে। এ কথা আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি  


আজ বড় ফিৎনার যুগ। বিশ্বাসগত নৈরাজ্য, আচরণগত অভদ্রতা আর প্রাতিষ্ঠানিক বিশৃংখলা আমাদেরকে কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে। কেউ বলছে: কিতাবই যথেষ্ট, আকাবির শরয়ী দলিল নয়; কেউ বলছে: যাহেরী অর্থই শিরোধার্য, ফিকহের কোন প্রয়োজন নেই। আবার কেউ দেশের বাইরে থেকে উচ্চডিগ্রী নিয়ে এসে এমনসব ব্যাখ্যা দিচ্ছে যা আমাদের উলামায়ে কেরামের ঐতিহ্যবাহী ব্যাখ্যার পরিপন্থি। আমাদেরকে বোঝানো হচ্ছে, কওমী উলামা এতোদিন জাতিকে ভুল শিক্ষা দিয়ে এসেছেন। এমন অবস্থায় আমাদের কওমী তরুণ আলিমরা এক ঘূর্ণিচক্রের মুখোমুখি; এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। কী করবে এখন তারা? তাদের সামনে দু’টো প্রশ্ন: তারা কি নিজেদেরকে রক্ষা করবে, না কি আত্মসমর্পণ করবে? ধরুন, আপনার দীর্ঘদিনের পৈত্রিক ভিটা যেখানে আপনি বংশানুক্রমে বসবাস করে আসছেন। এখন কেউ জাল খতিয়ান দেখিয়ে আপনাকে উচ্ছেদ করতে উদ্যত হলো। আপনি কী করবেন? আপনি কি বিনা খরচে আত্মসমর্পণ করে ভিটা ছেড়ে দেবেন, না কি যাবতীয় কাগজপত্র দেখিয়ে শত্রুপক্ষকে বিতাড়িত করবেন? নিশ্চয় আপনি যদি আপনার বংশের হালালী-সন্তান হয়ে থাকেন তবে বৈধ কাগজ দেখিয়ে শত্রুপক্ষকে বিদায় করবেন। এখন আসুন, সিদ্ধান্ত নিন: আপনি কওমী-জগতের বৈধ সন্তান কি না। যদি নিজেকে লস্করে নানুতুভীর বৈধ সন্তান বলে মনে করে থাকেন, আত্মসমর্পণ না করে আমাদের উলামায়ে কেরামের সিন্দুক থেকে বৈধ কাগজ বের করে কওমীর শত্রুপক্ষকে পরাজিত করুনহাতে কিতাবুল্লাহ, পথচলায় রিজালুল্লাহ আর অন্তরে তাকওয়াএ তিন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কওমীর ঝাণ্ডা করে রাখুন চির-উড্ডীন। 

মুহতারাম কওমী তরুণ আলিম-সমাজ, নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন যোগ্য হিসাবে গড়ে ওঠা। যতোদিন না ফারিগ হচ্ছেন ততোদিন ছাত্ররাজনীতি থেকে দূরে থাকুন। মনে রাখবেন, মাদরাসায় ছাত্ররাজনীতি আত্মহত্যাসরূপ। আকাবিরদের উপর আস্থা ও ভালবাসা রাখুন। তাঁদের ইতিহাস আঁকড়ে ধরে রাখুন। নিজেদের সংশোধনে বড়দের পরামর্শ নিন। আপনার জিজ্ঞাস্য বিষয় উত্থাপন করে দারসকে প্রাণবন্ত করে রাখুন। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ আপনাদেরকে বিজয়ী করবেন। আল্লাহু হাফিয।

২০১৯ 

 



বৈধতা নিয়ে বিতর্ক : মাদরাসায় ছাত্র-রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে কারা কী ভাবছেন?

ফাতেহ ২৪

রাগিব রব্বানি :

বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছাত্র-রাজনীতি বেশ প্রতিষ্ঠিত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সবকয়টি আলিয়া মাদরাসায় ছাত্র-রাজনীতির চর্চা বিদ্যমান। সেই সুবাদে আশির দশক থেকে বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোতেও শুরু হয় ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র-রাজনীতির চর্চা। বর্তমানে সবকয়টি ইসলামি দলের ছাত্র সংগঠন আছে এবং মাদরাসা-ভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র রাজনীতিতে সকলেই তৎপর। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার পর থেকে মাদরাসায় ছাত্র-রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে।

তবে আলেমদের বড় একটি অংশ মাদরাসাভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র-রাজনীতির বিরোধিতা করে আসছেন শুরু থেকেই। এ বিষয়ে ইসলাম বিষয়ক লেখক মাওলানা মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী বিশিষ্ট রাজনীতিক মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী’র বরাতে বলেন, ৮০-র দশকে হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ.-এর খেলাফত আন্দোলন চলাকালীন প্রশ্ন ওঠে মাদরাসায় ছাত্রেরা রাজনীতিতে যুক্ত হবে কি না। এ প্রশ্নে মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. ও শাইখুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক রহ. ছাত্র-রাজনীতির পক্ষে মতামত দেন। পক্ষান্তরে লালবাগ মাদরাসার তৎকালীন পরিচালক মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ সাহেব রহ. ও মুহাদ্দিস মাওলানা ছালাহ উদ্দীন সাহেব রহ. মাদরাসায় ছাত্র-রাজনীতির বিপক্ষে মতামত দেন। মুহতারাম মাওলানা আব্দুর রহীম ইসলামাবাদী সাহেব, যিনি সে-সময় খেলাফত আন্দোলনের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন, এমনটাই বলেছেন আমাকে।

মাওলানা গোলাম রব্বানী বলেন, এখান থেকেই খেলাফত আন্দোলনের ভাঙ্গনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং শেষোক্ত দুই হযরত লালবাগ ছেড়ে জামিয়া মাদানিয়া যাত্রাবাড়ি প্রতিষ্ঠা করে চলে যান। অর্থাৎ, বহুল আলোচিত খেলাফত আন্দোলনের ভাঙ্গনের শুরুর কারণ ছিল মাদরাসায় ছাত্র-রাজনীতির প্রসঙ্গ।

তবে শুরুতে হজরত হাফেজ্জি হুজুর রহ.-এর অমতের কারণে খেলাফত আন্দোলন মাদরাসায় ছাত্র রাজনীতির বিরোধিতা করলেও বর্তমানে সংগঠনটি এ বিরোধিতা থেকে সরে এসেছে। বর্তমানকার ইসলাম-ভিত্তিক সকল রাজনৈতিক দলেরই ছাত্র সংগঠন আছে এবং প্রায় সকল ঘরানার ইসলামি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাদরাসায় ছাত্ররাজনীতিকে সমর্থন করেন।

হাফেজ্জি হুজুর রহ. মাদরাসায় ছাত্র রাজনীতির কেন বিরোধিতা করেছিলেন এবং বর্তমানে কেন তাঁর দল এ বিরোধিতা থেকে সরে এল? এ বিষয়ে কথা বলেছেন খেলাফত আন্দোলনের বর্তমান আমির এবং হাফেজ্জি হুজুরের সাহেবজাদা মাওলানা শাহ আতাউল্লাহ হাফেজ্জি।

মাদরাসায় ছাত্র-রাজনীতির চর্চায় হজরত হাফেজ্জি হুজুর রহ.-এর বিরোধিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আব্বাজান রহ.-এর কাছে যখন অধ্যাপক আখতার ফারুক রহ.-সহ অনেকে ছাত্র সংগঠনের প্রস্তাব দিলেন তখন তিনি বলেছিলেন, ছাত্র সংগঠনের কিছু নিয়মনীতি থাকে আর মাদরাসারও নিয়মনীতি আছে। উভয় নিয়মনীতি, কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় কঠিন। আর ছাত্ররা দেখা যাবে অনেক সময় মাদরাসার নিয়মের চেয়ে সংগঠনের নিয়মকে বেশি প্রাধান্য দেবে। এর দ্বারা উস্তাদদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণের আশঙ্কা থাকে। আর মাদরাসার ছাত্রদের পূর্ণ সফলতা নির্ভর করে উস্তাদদের নিয়মের কাছে নিজেদের পরিপূর্ণ সমর্পণের মধ্যেই। তাই আব্বার পরামর্শ ছিল ছাত্ররা উস্তাদদের তত্ত্বাবধানে সরাসরি আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করুক। আলাদা ছাত্র রাজনীতির আওতায় না যাক। তবে যেহেতু স্কুল কলেজে সঠিক ইসলামি আন্দোলন করার সুযোগ নেই তাই আলেমদের সাথে তাদের সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য সেখানে ইসলামি ছাত্র সংগঠন হতে পারে।

হাফেজ্জি হুজুরের সেই মত থেকে দলের সরে আসার বিষয়ে মাওলানা শাহ আতাউল্লাহ হাফেজ্জি বলেন, সময় এখন অনেক বদলেছে। আব্বা রহ. যখন রাজনীতি করেছেন, তখন আলেমরা সবাই এক পতাকার নিচে ছিলেন। আলাদা ছাত্র সংগঠনের দরকার ছিল না। এখন বিভিন্ন সংগঠন হয়েছে, সহীহধারার পাশাপাশি বাতিল ধারার সংগঠনও বর্তমানে বিদ্যমান। তাই ছাত্রদের সহীহ ধারায় ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদের তত্ত্বাবধানে ছাত্র সংগঠন করাটা প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে পরিবেশ ও সময়ে পরিবর্তন এসেছে। পরিবেশ ও প্রয়োজনের ভিন্নতার কারণে যেহেতু শরিয়তের হুকুমও পরিবর্তন হতে পারে তাই হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর কথাও বর্তমান সময়ে এভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে।

রাজনীতিক আলেমগণ মাদরাসায় ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারে সম্মত থাকলেও দেশের অরাজনৈতিক আলেমগণ এ ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থানে নেই। ছোটবড় অধিকাংশ কওমি মাদরাসায়ই ছাত্র রাজনীতি আইনত নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ছাত্রদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি এবং একাধিক সংগঠন থাকার কারণে ছাত্রদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কোন্দল তৈরি হতে পারে।

রাজধানীর অন্যতম বৃহৎ মাদরাসা জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদের নায়েবে মুহতামিম মুফতি নুরুল আমীন ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, ছাত্র রাজনীতির ফলে মাদরাসায় ছাত্রদের মধ্যে নানামাত্রিক উশৃংখলতার সৃষ্টি হয়। একাধিক দল থাকার কারণে মাদরাসায় রাজনীতির অনুমতি দিলে একদল আরেক দলের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া নিজ দলের সঙ্গে মাদরাসার কোনো উসতাদের মতের অমিল দেখলে সেই উসতাদকে নানাভাবে অবজ্ঞা করার চেষ্টা করে ছাত্ররা। পড়াশোনার ক্ষতি তো আর আছেই। এসব এখন বাস্তবতা। এই বাস্তবতা অনেক আগেই উপলব্ধি করেছেন আমাদের মাদরাসার আকাবিররা। তাই শুরু থেকেই ফরিদাবাদে ছাত্র রাজনীতি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে।

মুফতি নুরুল আমিনের এই কথাগুলোকে আরেকটু বিস্তারিত করে বলেছেন মাওলানা গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী। তিনি বলেন, ছাত্র-রাজনীতির বিষয়টি এখন মাদরাসার জন্য বেশ চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তি-পাল্টাযুক্তি দিয়ে তর্ক-বিতর্কের উঠোন হয় তো বড় করা যেতে পারে কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফলাফল সকল যুক্তিকেই পরাজিত করছে এখন। ছাত্র-রাজনীতি কওমি মাদরাসার মধ্যে এখন দু’টো মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। এক. ছাত্রদের মধ্যে বিভক্তি। দুই. শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বদ্ধতা হ্রাস। যেহেতু ছাত্রেরা তাদের পছন্দানুযায়ী দল করে, সেখানে একেক দলের একেক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনুসারী ছাত্রেরাও ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শুরু হয় নিজ-দলের দৃষ্টিভঙ্গিকে অপর-দলের দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রাধান্য দেয়ার পালা। জন্ম নেয় একটি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতা, নিজদলের নেতাদের প্রতি অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শন আর অন্যদলের নেতাদের ছোট করে দেখার মানসিকতা। এগুলোই ধীরে-ধীরে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, মাদরাসায় ছাত্র-রাজনীতি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের প্রতি দায়বদ্ধতাকে ব্যহত করে। ছাত্রেরা দলকে সবকিছুর ঊর্ধে স্থান দেবার চেষ্টা করে। যে শিক্ষক তার দলকে সমর্থন করেন না বা বিরোধিতা করেন, সে-শিক্ষককে তির্যক-দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা শুরু হয়। এখান থেকে জন্ম নেয় অভদ্র আচরণ বা শৃঙখলা ভঙ্গের মতো নিন্দনীয় কাজ। অনেক সময় দেখা যায়, একটি দলের অনুসারী কোনো ছাত্রের বিরুদ্ধে মাদরাসা ব্যবস্থা নিলে সে-দলের অন্যেরা প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়।

মাওলানা গোলাম রব্বানী বলেন, মাদরাসায় ছাত্র-রাজনীতির অতীত থেকে আমি নিজে সেসব তিক্ত ঘটনার কথা জেনেছি। ১৯৮৫ সালে হাটহাজারী মাদরাসায় কওমী আদর্শ পরিপন্থী একটি ছাত্র সংগঠনের কর্মী-সমর্থক কর্তৃক হামলার ঘটনায় উপরের সব উপাদান উপস্থিত ছিলো। ওসব কারণে পরবর্তীতে ফটিকছড়ির নাজিরহাট বড় মাদরাসায়ও হামলার ঘটনা ঘটে।

তবে মাদরাসায় ছাত্র-রাজনীতির চর্চার পক্ষে যাঁরা জোরালো বক্তব্য দেন, তাঁদের যুক্তি হচ্ছে ছাত্রদের প্রশিক্ষণ। বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে আগামী দিনের নেতৃত্ব তৈরি করা অতীব জরুরি, আর এ নেতৃত্ব তৈরির জন্য ছাত্র রাজনীতির চর্চা আবশ্যক।

এ বিষয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও রাজধানীর বারিধারা মাদরাসার শায়খুল হাদিস মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর ডটকমকে বলেন, একজন তালিবুল ইলমকে দরসি পড়াশোনার পাশাপাশি বক্তব্য ও লেখালেখিতে পারঙ্গম করে তোলা যেমন জরুরি, তেমনি দেশ ও উম্মাহ’র সংকট ও সম্ভবনা সম্পর্কে সচেতন করে তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের যোগ্যতা বিকশিত করাও আবশ্যক। আর এ জন্য ছাত্র রাজনীতির বিকল্প নেই।

মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক বলেন, বাংলাদেশ বলুন আর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বলুন, মুসলিম উম্মাহ নানাভাবে বিপর্যস্ত আজ। বাংলাদেশে ইসলামি শক্তির অবস্থা নতজানু হয়ে আছে। যোগ্য নেতৃত্বের অভাব এখানে প্রকট। আজকের মাদরাসার ছাত্ররাই আগামী দিনের উম্মাহর কাণ্ডারী। তাদেরকে যদি রাজনীতি বিষয়ে এখন থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া না হয়, তাহলে পড়াশোনা শেষ রাজনীতির এ যোগ্যতাটা হাসিল করবার সুযোগ তাঁদের আর হবে না। এসব দিক বিবেচনা করেই আমরা বলি, দেশের প্রতিটা মাদরাসায় ইসলামি রাজনীতির চর্চা অবাধ করে দেওয়া জরুরি।

রাজনীতি করতে গিয়ে মাদরাসার অভ্যন্তরে নানাবিধ উশৃঙ্খলা সৃষ্টির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বারিধারা মাদরাসার প্রবীণ এ আলেম বলেন, শিক্ষকদের সঠিক নেগরানি থাকলে এবং তাঁরা শুদ্ধধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে বা এ বিষয়ে সচেতন থাকলে ছাত্রদের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতা সৃষ্টির কোনো সুযোগ থাকবে না।

নিজের মাদরাসাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বারিধারা মাদরাসায় তো আমভাবে ছাত্ররা রাজনীতি করছে, কই এখানেতা বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় না৷ রাজনীতির কারণে ছেলেদের পড়াশোনায়ও কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। বেফাকে প্রতি বছরই তো আমাদের ছেলেরা ভালো ফলাফল করে আসছে।


ভাইরাস করোনা সেক্যুলারত্বের অসহায়ত্ব

মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী

একটি আদর্শের পরীক্ষা হয় সমস্যার ধাক্কায় মেধাবীর মেধার পরীক্ষা যেমন তার আত্মস্থের সামর্থ্যে আর প্রতিভাবানের পরীক্ষা যেমন তার সৃজনশীলতায়, তেমনি একটি আদর্শ পাশ-নম্বর পায় সমস্যায় অনুসারীরা কতোটা সমাধান পায়, সেটার উপর অভিধান বলে: ‍আদর্শ হলো, কিছু বিশ্বাস বা নীতির অবস্থান যার উপর কোন রাজনৈতিক পদ্ধতি, দল বা প্রতিষ্ঠান স্থিতিশীল হয়। (a set of beliefs or principles, especially one on which a political system, party, or organization is based.) তাই যদি হয়, আমাদের দেশের ন্যাকা সেক্যুলাররাযারা সেক্যুলারিজমকে তাদের হাজার বছরের লালিত চৌদ্দ পুরুষের সংস্কৃতি বলেন, সংবিধানে নীতি বলে জবরদস্তি বসিয়ে রেখেছেন, তারা ভাইরাস করোনার এমন ধংসযজ্ঞের সময় তাদের সেক্যুলারিজমকে দিয়ে একটি মানুষকেও সান্ত্বনার বাণী শোনাতে পেরেছেন? এবার কিন্তু আমাদের ন্যাকা সেক্যুলারদের উপর ভয়াবহ একটা পরীক্ষা হয়ে গেলো ভাইরাস কোভিড-১৯ আসার পর কেমন যেন ন্যাকা সেক্যুলারমহল খেই হারিয়ে বসেছেন কোথায় গেলো তাদের হম্বিতম্বি, কোথায় গেলো মঙ্গল-শোভাযাত্রার মঙ্গলীয় উম্মাদনা, কোথায় গেলো সেক্যুলার-সংস্কৃতির লু-লু ধ্বনি! সত্যিই, তাদের দীনতা-হীনতার জন্য আমার খুব করুণা হয় কথায় বলে: বিপদে বন্ধুর পরিচয়

সেক্যুলারিজমকে যারা নীতি মানেন, পার্থিব জীবনের জাগতিক মানার বিষয় মানেনতাদের তুলনা কিন্তু সেই গাভীর মতো, যার কথা রচনা বইতে লিখা আছে কিন্তু না আছে দেহ, না আছে গৃহ আচ্ছা, না হয় ধরেই নিলাম, জাগতিক মানার টা পাই তাদের পকেটে আছে, তবে আজকের জাগতিক বিমার করোনার জন্য চামচ সেক্যুলার দাওয়াই দিতে পারেন কি? অথবা কালাম নিরাময়ের বা সান্ত্বনার বাণী শোনাতে পারেন কি? নাই যদি পারেন, তবে কোলকাতার বানানো শতরকমের পেঁচা-পেঁচির মুখোশ পরে, নর্দন-কুর্দন করে যে মঙ্গলযাত্রা করেছিলেন, সে-সবের সঞ্চয় অল্প বলবেন কি? আজ খবরে শুনলাম, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন সেক্যুলার অধ্যাপক নাকি দেশবাসীকে করোনা থেকে রক্ষায় খোদার দরবারে হাত তুলতে বলেছেনওমা একি শুনি! ষাঁড় কি তবে বাচুর প্রসবে দিকভ্রান্ত হইল? সতী নারী স্বামীর মরণে বিধবা হয় আর বেশ্যা পতিতালয় বন্ধে ঘড়ছাড়া হয় অবাক হবার কী আছে?

অধ্যাপক আবুল ফজলের কথা নতুন-প্রজন্ম না জানুক, বড়-প্রজন্মদের তো জানার কথা বাংলাদেশের নামকরা যে জন শিক্ষাবিদ স্মরণীয় হয়ে থাকবেনতাঁদের মধ্যে তাঁকে শুমার করা যাবে নিঃসন্দেহে ১৯৮৩ সালে তাঁর ইন্তিকাল হয় সারা জীবন তিনি সেক্যুলারিজমের ওকালতিতে লিখেছেন, ইসলামী শাসনের অযৌক্তিতার পক্ষে কলম ধরেছেন, মোল্লা-মৌলভীদের দৌড় যে মসজিদে গিয়ে খতম হয়েছেসেসবও অবাধে বলেছেন তাঁর যুক্তি ছিলোধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার অতএব, রাষ্ট্র হবে ধর্মভিত্তিক নয়, সেক্যুলার; রাষ্ট্রের সংস্কৃতিও হবে সেক্যুলার ১৯৭০ সালে প্রকাশিত তাঁর সমকালীন চিন্তাবইটি মাঝেমাঝে যখন হাতে নিই, মনে হয়: সময়ের কাছে মানুষ কতো অসহায়! সেই  অধ্যাপক আবুল ফজল যখন সেক্যুলারিজমের চৌহদ্দি ছেড়ে মৃত্যুশয্যায়; দেখলেন, ওপারে সেক্যুলরিজম নেইওপারে অপেক্ষা করছে অন্য এক ইজম, তার নাম: ইসলামঅসার হয়ে দেখা দিলো তাঁর সেক্যুলার-জীবন; একজন মৌলভী ডেকে তাওবা করলেন জীবনের করুণ সায়াহ্নে খবরটি যখন নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে দৈনিক ইনকিলাবের আলোচিত কলামকাজীর দরবার’- প্রকাশিত হলো, সেদিনকার সেক্যুলাররা শরমে মূর্ছা গিয়েছিলেন কিনা জানি না দোয়া করি, আল্লাহ মরহুম আবুল ফজলকে মাগফিরাত দান করুন কিন্তু স্মরণ করি, যে মৌলভীদের পেছনে তিনি কলম ঘুরিয়েছেন অহোরাত্র, শেষতক তাঁদের হাতেই হাত রেখে অনুতাপের স্বীকারোক্তি দিতে হলো মরহুম অধ্যাপককে এখানেই তো সেক্যুলারিজমের কলঙ্কিত পরাজয়, নির্লজ্জ ব্যর্থতা আজ যে জাবির জন সেক্যুলার শিক্ষক করোনা থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে বলেছেন, সেটাকে আমরা মুবারকবাদ জানাই, সাথেসাথে অনুরোধ করবো: তাঁরা যেন সেক্যুলারিজমের অসারতাকে উপলব্ধি করেন

করোনা ভাইরাস যখন ঘরের দোরগোড়ায় ঠকঠক শব্দ করছিলো, আমাদের সেক্যুলাররা তখন কোন প্রাণীর মুখোশ পরেছিলেন, তাদের বাঙ্গালি সংস্কৃতির কাছে মঙ্গল কামনায় বিভোর ছিলেন কিনা জানি না তবে, সেসব বাদ দিয়ে তারা যে, বিদেশী সংস্কৃতির অষুধের বোতল হাতড়াতে সচেষ্ট ছিলেন, তা বলতে পারি সহজেই কারণ, আমি আগেই বলেছি, সেক্যুলারদের দেহ নেই, গৃহ নেইওদের বিশ্বাসের কোন ভিটা নেইওদের সংস্কৃতি যেমন ওদের কথায়বহমান নদীর মতো’, তাই বিশ্বাসও বোধ করি ভাসমান মেঘের মতো ভাসমান মেঘ যেমন হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, তেমনি ওদের বিশ্বাসও হারিয়ে যায় হঠাৎ করেতখন- ওরা হয়ে পড়ে নাস্তিক ছাত্রজীবন থেকে বিশ্বাস আমার দৃঢ় হয়েছে: সেক্যুলারিজম হচ্ছে নাস্তিকতার প্রবেশদ্বার আমাদের বাংলাদেশেই ধরা যাক, যারা নাস্তিক বলে পরিচিতি পেয়েছেন, তারা কিন্তু এক লাফে নাস্তিক হননি; সেক্যুলারিজমের দরোজা দিয়েই নাস্তিকতায় প্রবেশ করেছেন আরও শক্তিশালী উদাহরণ দেই যেমন ধরুন, সংবিধানে সেক্যুলারিজমকে ঢোকানো হলো, কি হলো? করোনা ঢুকতেই সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সরকারের পাইক-পেয়াদারা পর্যন্ত শুধু হম্বিতম্বি ছাড়া মুখে একবারও আল্লাহ-খোদার নাম নেয়নি কারণ,ওটা নিলে আবার সংবিধানের মূলনীতি লঙ্ঘন হয় যদি! অতীতের অন্যসব সরকারের সময় শুনতাম জাতীয় কোন বিপদে মসজিদে-মসজিদে দোয়ার আহ্বান জানাতে এখন ওগুলো সেক্যুলারপরিপন্থী, তাই না! এভাবেই একদিন প্রশাসনযন্ত্র নাস্তিকতার লেবাসে আক্রান্ত হবে সেদিন তো সেক্যুলার সংস্কৃতির ব্যানারে সরকার পর্যন্ত স্কুলে-স্কুলে দেশ জাতির মঙ্গল কামনায় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করতে হুকুম জারি করেছিলো কই, মঙ্গল যে এলো না! রবিন্দ্রগীতিতে তো চিড়া ভিজলো না কোলকাতাইয়া বাবুরা পানি ছাড়তে পারে, মঙ্গল ছাড়তে পারে না?

বিশ্বাস যদি আজ এমন হতো যে, সব কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ; তিনিই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক, তিনিই একমাত্র রোগ নিরাময়কারীতাহলে আজ সরকারী সম্প্রচারে দোয়ার কথা উঠতো তা না বলে, বলা হচ্ছে: অমুক আমাদের নেত্রী, তাই করোনার ভয় নেই ইসলামের ভাষায় এগুলো স্পষ্ট শিরক ধর্মত্যাগী কাণ্ড আজকের ন্যাকা সেক্যুলাররা অন্তত মরহুম অধ্যাপক আবুল ফজলের মতো বিবেকের পরিচয় দিতে পারতেন তাতে তাদের- মঙ্গল হতো সে মঙ্গল আসতো ওপাড় থেকে নয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের সেক্যুলারদের অসহায়ত্বের দৃশ্য দেখে এতোটুকুই লিখলাম

২৩.০৩.২০২০

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

Featured Post

জামায়াতে ইসলামীর সাথে কওমীদের ঐক্য কি আদৌ সম্ভব ? ভাবনা-৫০ বাংলাদেশে ইসলাপন্থীদের ঐক্য নিয়ে আলোচনার হায়াত অনেক দীর্ঘ । এক সময় ঐক্যের শে...