৫ মে সংঘটিত খুন ও নির্যাতনের বিচারের দাবি বহাল আছে ও থাকবে : হেফাজত আমির
দৈনিক নয়া দিগন্ত
হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা
০৫ মে ২০২৩
৫ মে সংঘটিত খুন ও নির্যাতনের বিচারের দাবি বহাল আছে ও থাকবে বলে বিবৃতি জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির ও প্রবীণ আলেম আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। শুক্রবার (৫ মে) দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমরা ২০১৩ সাল থেকেই ৫ মে শাপলা চত্বরের গণহত্যা, খুন ও নির্যাতনের বিচার দাবি করে আসছি। এখনো করছি এবং করতেই থাকব। শহিদদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় পতাকা অবশ্যই উড়বে ইনশাআল্লাহ।
হেফাজত আমির বলেন, আজ ঐতিহাসিক ৫ মে। শাপলা চত্বরে আশেকে রাসূলদের শাহাদাতের দিন। যারা ইসলাম ও প্রিয় নবীর ইজ্জতের হেফাজতে শহীদ হয়েছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন, আমরা তাদের ভুলতে পারি না। আমরা ভুলতে পারি না নির্যাতিতদের কথা, মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারদের কষ্টের কথা। ভুলতে পারি না গত ১০ বছর ধরে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় হয়রানির শিকার ও নির্যাতিত মজলুম ভাইদের কথা।
ঐতিহাসিক ৫ মে শাপলা চত্বরের শহীদ দিবসকে স্মরণ করে তিনি আরো বলেন, এই ইসলাম বিদ্বেষী জালিম সরকার সেদিন আলেম-উলামা ও তৌহিদী জনতার উপর গণহত্যা চালিয়েছিল। রাতের আঁধারে গুলি করে হত্যা করেছিল অসংখ্য তলাবা, উলামা ও তৌহিদী জনতাকে।
তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা ১৩ দফা ঈমানী দাবি নিয়ে শাপলা চত্বরে অবস্থান করছিল। ইসলাম বিদ্বেষী ও নাস্তিক্যবাদী জালেম শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে। রক্ত ঝরিয়েছিল হাজারো আশেকে রাসূলের। শাপলার এই গণহত্যার ইতিহাস দেশপ্রেমিক ঈমানদার জনতা কখনো ভুলবে না। আল্লাহর জমিনে এক দিন এই গণহত্যার বিচার হবেই ইনশাআল্লাহ।
হেফাজত আমির বলেন, আমরা সব সময়ই তাদের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে দোয়া করছি। মহান আল্লাহ পাকের কাছে খুনিদের বিচারের জন্য ফরিয়াদ জানিয়েছে। বাংলাদেশের মুসলিমদের উপর যে অত্যাচার জুলুম নির্যাতন চলছে, তার ইহলৌকিক ফায়সালার জন্য সবাইকে কায়মনোবাক্যে মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে দোয়া করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
ঘুস ছাড়া ব্যবসা হয় না
হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা
মার্চ ২০২৩
ডয়েচেভেলে
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্ট্যাডিজ (সিজিএস) নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণায় বলছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) উদ্যাক্তাদের ৭৭.৯ ভাগকে ব্যবসা পরিচালনা করতে কোথাও না কোথাও ঘুস দিতে হয়। ওই জরিপে অংশ নেয়া ব্যবসায়ীদের ৬০.১ শতাংশ রাজনৈতিক চাপ এবং ৪৬.৩ শতাংশ চাঁদাবাজির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। মঙ্গলবার ঢাকার একটি হোটেলে এই রিপোর্ট প্রকাশের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি বলেছেন,"উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। এই দুর্নীতি কমলে এখানে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।” তিনি আরো বলেন,"দুর্নীতি চিহ্নিত করে তা দমন করতে পারলে অর্থনীতির অগ্রগতি হবে। বাংলাদেশে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা গেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ভালো করতে হলে দুর্নীতির লাগাম টানতে হবে।”
সিজিএসের গবেষণায় আরো জানা গেছে যে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ৪৩.৯ শতাংশ ব্যবসায়ীকে স্বজনপ্রীতি এবং ৪৩.১ শতাংশ ব্যবসায়ীকে অনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার আশ্রয় নিতে হয়। দেশে এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের ১০ জনের মধ্যে নয় জন মনে করেন, এই খাতে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার হয়েছে। জরিপে অংশ নেয়া ৬২.৪ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, পুরো ব্যবস্থাই দুর্নীতিতে আক্রান্ত। ৭১.৩ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, দুর্নীতিকে সঙ্গে নিয়েই তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে হচ্ছে।
৪২ ঘাটে ঘুস!
এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ জহুর। তিনি জানান, সারাদেশের ৮০০ উদ্যোক্তার মধ্যে এই গবেষণাটি করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ঢাকায় আবার এসএমই উদ্যোক্তদের মধ্যে শেয়ার করে মতামত নেয়া হয়। বিষয়গুলো সরকারকেও জানানো হয়। তিনি বলেন,"১০ লাখ টাকার একটি ব্যবসা শুরু করতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৪২টি স্বাক্ষর লাগে। প্রতিটির জন্যই ঘুস দিতে হয়। ঘুস দিলে কাজ দ্রুত হয়, না দিলে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। যারা ঘুস দেননা তাদের সময় বেশি লাগার কারনে কস্টিং বেড়ে যায়। আবার কোনো কোনো ব্যবসা আছে যেখানে সময় গেলে সেই ব্যবসা বা ব্যবসার উপকরণ নষ্ট হয়ে যায়। তাই ব্যবসা বাঁচাতে তারা ঘুস দিতে বাধ্য হন। হয় ঘুস দিতে হবে, না হলে রাজনৈতিক বা অন্য কোনো প্রভাব থাকতে হবে।” তার কথা," নতুন ব্যবসা শুরু করা, ব্যবসার বিভিন্ন ধরনের সেবা নেয়া আবার বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স নবায়ন করা- সবখানেই দ্রুত কাজ পেতে হলে ঘুস দিতেই হবে। এটা একটা কালচারে পরিণত হয়েছে।” এদিকে গত জানুয়ারি মাসে একই ধরনের একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। বাংলাদেশ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশে এই জরিপ পরিচালনা ও ফলাফল প্রকাশ করে।
গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে তারা এই জরিপ করে। জরিপে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকায় কৃষি উৎপাদন ও সেবা খাতে নিয়োজিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৭৪ জন ব্যবসায়ী অংশ নেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৪.৬ শতাংশ জানিয়েছেন ব্যবসা সম্প্রসারণ করার এখন প্রধান বাঁধা দুর্নীতি। এছাড়া ৪৪.৬ শতাংশ মনে করছেন, ব্যবসায় আরেকটি বাধা অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুফল না পাওয়া। ৪৩.১ শতাংশ বলছেন. আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারনে তারা ব্যবসায় সুফল পাচ্ছেন না। দুর্নীতির বিষয়ে ৫৪ শতাংশ ব্যবসায়িক লাইসেন্স নিতে, ৪৮ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন কর দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি, ৪৯ শতাংশ গ্যাস-বিদুৎ-পানির সংযোগ নিতে এবং সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ আমদানি-রপ্তানিতে দুর্নীতির কথা বলেছেন।
ঘুসের চাপ কে বহন করে:
এফবিসিসিআই-এর সাবেক পরিচালক মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, "যেকোনো ধরনের শিল্প বা ব্যবসার নীতিমালাই এমনভাবে করা হয়েছে যে যিনি ব্যবসা করবেন তাতে ঘুস দিতেই হবে। যেমন ধরুন, এলপিজি স্টেশনের যে নিয়ম করা হয়েছে সেখানে চারপাশে অনেক জায়গা ছাড়ার কথা বলা হয়েছে। এটা ঢাকা শহরে সম্ভব নয়। তাই ৭০-৮০ ভাগ স্টেশনই অবৈধভাবে চলে ঘুস দিয়ে। আরো যত নিয়ম আঝে সেগুলোও একইভাবে জটিল। আর সেই সুযোগ নেয় লাইসেন্স ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ঘুস দিলে পাওয়া যাবে, না দিলে পাওয়া যাবেনা। তাই আমরা এখন এটাকে ঘুস না বলে ব্যবসার স্পিড মানি হিসেবে ধরে বিনিয়োগের মধ্যেই রাখছি।” তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, "করোনার সময় সরকার যে লোন দিলো তার মধ্যে একটি শর্ত লেখা ছিলো। আর তা হলো ব্যাংকগুলো সুসম্পর্কের ভিত্তিতে এই লোন দেবে। এখন এই সুসম্পর্ক যার আছে সে পাবে। যার নাই তার সুস্পর্ক করতে হবে। সেটা তো আর অর্থ ছাড়া হয় না।” "আমাদের প্রত্যেক টেবিলে টেবিলে তো ঘুস দিতেই হয়, তারপর প্রত্যেক দপ্তরের অফিস সহায়কদেরও দিতে হয়। তা না হলে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল যায় না,”বলেন এই ব্যবসায়ী নেতা। তার কথা," যারা বড় শিল্প বা ব্যবসার মালিক তারা সরকারকে বলতে পারেন। তারা হয়তোবা একটি উপায় বের করতে পারেন। কিন্তু যারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি তাদের কিছু করার থাকে না। তাদের ঘুস দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।”
আর কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের(ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন মনে করেন, "ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের এই যে ঘুস দিতে হয় তার চাপ শেষ পর্যন্ত ক্রেতা সাধারণকেই নিতে হয়। এর ফলে তাদের পণ্য ও সেবার উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তারা তাই দাম বাড়িয়ে পুষিয়ে নেন।” তার কথা,"পণ্য ও সেবার এই যে বেশি দাম তার প্রধান কারণ এই খাতে ঘুস ও দুর্নীতি। এটা বন্ধ করা গেলে ক্রেতাদের ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমত।”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন