দৈনিক পূর্বদেশ, ৩১শে মার্চ ২০২৩, চট্টগ্রাম। |
১ম কিস্তি, দৈনিক পূর্বদেশ, চট্টগ্রাম। ২৪.০৩.২৩, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পাতা |
উত্তর-চট্টলার বিস্মৃত সাহিত্যিক ও স্বভাবকবি
মুন্সী আলতাফ মিয়া চৌধুরীর আলাওল গবেষণা ও চট্টলার ইতিহাস
ভূমিকা ও সম্পাদনায়:
মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী
ভূমিকা:
‘ইতিহাস’ কি কেবল-ই অতীতগাঁথা?—কেবল-ই গহ্বরে লকিয়ে থাকা কিছু ঘটনার লৈখিক বিবরণী বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন? না কি মানুষের বর্তমানের সাথে অতীতের সেতুবন্ধন? এ নিয়ে বিশেষজ্ঞমহলের মতের অভাব নেই। মতভেদ আছে, তাতে ইতিহাসচর্চা আর ইতিহাস-রচনা থেমে থাকেনি কখনও। আধুনিক মানুষের হিসাবে ইতিহাসের বয়স আড়াই হাজার বছর, কিন্তু সে তো একেবারে কড়াগণ্ডায় করা হিসাব নয়। এমন অনেক-অনেক ঘটনা হয়তো থেকে গেছে—যা কখনও মানুষের নাগালে আসেনি; হতে পারে আসার সম্ভাবনাও নেই। তাই বলে কি সেগুলো ইতিহাসের গণনা থেকে বাইরে থেকে যাবে? ঘটনাবলী কি মানুষের সংস্পর্শ না পেলে ইতিহাস হবে না? এমন অনেক প্রশ্ন ইতিহাসজ্ঞদের ঘরে-বাইরে, তবুও ইতিহাসের পথচলা কখনও থামেনি। ইতিহাস এগিয়েছে আপন গতিতে; আপন পথে। এরপরের প্রশ্ন: কেন এ ইতিহাস? কী তার কাজ? সততার কোন নিক্তিকে কি মেনে চলতে হয় ইতিহাসকে? ইতিহাস নিয়ে মনুষ্য-সমাজের কি কোন লাভ-লোকসানের খাতা খুলতে হয়? একজন ইতিহাসবিদকে কি কোন শর্ত মানতে হয়, হলে কী সে-সব? সমুদ্র যেমন ঢেউয়ের পরে ঢেউ সম্বল করে বেঁচে থাকে, তেমন করে ইতিহাসও ও-রকম হাজারো প্রশ্নের খতিয়ান খুলে নির্মাণ করে মহীরুহ।
ইতিহাস নিয়ে মানুষের গবেষণার কমতি নেই—সে ধারণা আগেই দিয়েছি। ইতিহাসের আরবী প্রতিশব্দ: التاريخ ইংরেজি প্রতিশব্দ: History। ইতিহাস নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত মোটামুটি এ রকম:
“ইতিহাস হলো মানুষের অতীত ঘটনা ও কার্যাবলীর লিখন, বিশ্লেষণ ও অধ্যয়ন। তবে কোন-কোন দার্শনিক মনে করেন যে, ইতিহাস হলো বর্তমান, কারণ অতীত ঘটনাগুলোই বর্তমানে ‘ইতিহাস’ হিসাবে অধ্যয়ন করা হয়। বৃহৎ একটি
বিষয় হওয়া সত্ত্বেও এটি কখনও মানবিক বিজ্ঞান এবং কখনও বা সামাজিক বিজ্ঞানের একটি
শাখা হিসেবে আলোচিত হয়েছে। অনেকেই ইতিহাসকে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে
একটি সেতুবন্ধন হিসেবে দেখেন। কারণ, ইতিহাসে এই উভয়বিধ শাস্ত্র থেকেই পদ্ধতিগত সাহায্য ও বিভিন্ন উপাদান নেওয়া
হয়। ইতিহাসের উদ্দেশ্য হলো বর্তমানের সাথে অতীতকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা।“(১)
আরবী-মাধ্যমে ইতিহাস সম্পর্কে বলা হচ্ছে:
التاريخ هو الماضي كما هو موصوف في
الوثائق المكتوبة، ودراسته. الأحداث التي تحدث قبل السجلات المكتوبة تعتبر ما قبل
التاريخ. "التاريخ" هو مصطلح شامل يتعلق بالأحداث الماضية بالإضافة إلى
الذاكرة، واكتشاف، وجمع، وتنظيم، وعرض، وتفسير المعلومات حول هذه الأحداث. يطلق
على العلماء الذين يكتبون عن التاريخ اسم المؤرخين
(ইতিহাস অতীতের ঘটনাবলী—যা লিখিত দলীলে লিপিবদ্ধ থাকে এবং তা চর্চা করা হয়। যেসব ঘটনা লৈখিক-সংস্কৃতির
পূর্বে ঘটেছে, সেগুলো প্রাগৈতিহাসিক। ইতিহাস এমন
এক বিস্তৃত পরিভাষা যা স্মৃতি, আবিষ্কার, সংগ্রহ, প্রতিষ্ঠান, উপস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত এবং সে-সবের তথ্যকে
ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। যেসব জ্ঞানী ইতিহাস রচনা করেন, তাঁরা ইতিহাসবিদ নামে পরিচিত।)(২)
বেনেদেত্তো ক্রোচে নামক এক ইতালিয়ান দার্শনিক বলেন, “All history is contemporary history”. অর্থাৎ সকল ইতিহাসই সমসাময়িক ইতিহাস। কারণ, ইতিহাস সর্বদাই অতীতের আলোয় বর্তমান আর ভবিষ্যতকে আলোকিত করে। বর্তমানের সাথে অতীতকে প্রাসঙ্গিক করে তোলাটাই ইতিহাসের উদ্দেশ্য। ইতিহাসের কাজ সত্যকে তার আসলরূপে উপস্থাপন করা(৩)
উপরোক্ত তথ্যকে সামনে রেখে আমরা বলতে পারি, ইতিহাস অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর লৈখিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক উপস্থাপন যা মানুষের সমসাময়িকতাকে অর্থবহ করে তোলে। বর্তমানের সাথে অতীতকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা ইতিহাসের কাজ। তাই ইতিহাসের মৌলিক শর্ত হলো, আসলরূপে তাকে তুলে ধরা। ইতিহাসের আধুনিক যুগে এসে আমরা ইতিহাসকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করতে পারি: বর্ণনামূলক ও বিশ্লেষণমূলক। বর্ণনামূলক হলো: ঘটনাস্থল থেকে অবিকৃতভাবে বা অখণ্ডভাবে ঘটনার বয়ান দেয়া। সেখানে রচকের কোন মন্তব্য বা নিজস্ব বিশ্লেষণ থাকবে না। বিশ্লেষণমূলক হলো: বর্ণনার সাথেসাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষাপট, পারিপার্শ্বিকতা ও চরিত্রকে বিচারে নিয়ে পাঠকদেরমধ্যে সম্ভাব্য বা নিশ্চিত প্রশ্নের সমাধান করে মূল-ঘটনার মূলভাব প্রতিষ্ঠা করা। কারণ, বর্ণনা ও বিশ্লেষণে যদি সততা রক্ষা না হয়, তবেই ইতিহাস তার গতি ও বৈশিষ্ট্য হারায়। বিষয়টি আরও ভালভাবে বোঝার জন্য আমরা বিশ্বখ্যাত রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদূনের শরণাপন্ন হতে পারি। ইতিহাসের মৌলিক বিশ্লেষণ করে তিনি বলছেন:
“অতঃপর ইতিহাস এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বিশ্বের সকল জাতি ও গোত্রের নিকট সমভাবে আদরণীয়। এর জন্য দেশ-ভ্রমনের কষ্ট স্বীকার করতেও তারা দ্বিধা করে না। বুদ্ধিমান-নির্বোধ নির্বিশেষে সকলেই একে ভালবাসে। রাজন্যবর্গ ও নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিগণ এর প্রতি সমধিক আগ্রহী। পণ্ডিত-মূর্খ সকলেই নিজনিজ অভিরুচি অনুযায়ী এর মধ্যে উপদেশ অনুসন্ধান করে। কেননা, ইতিহাস বাহ্যত অতীতকালের ঘটনাবলী ও রাষ্ট্রসমূহের বিবরণ মাত্র। তাও সে এমন উদাহরণ ও বক্তব্যসহ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত করে, যাতে আমরা অতি সহজেই এ সকল বিষয়কে আমাদের আলোচনা ও দৃষ্টান্ত দানের মধ্যে ব্যবহার করতে পারি। আমরা বুঝতে পারি যে, কালচক্রের আবর্তন সকল বিষয় এবং বস্তুকেই নিয়ত পরিবর্তন করছে। একটি রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব ঘটছে, তার ব্যাপক বিস্তৃতি পৃথিবীর সমৃদ্ধি আনয়ন করছে, আবার কালের অমোঘ বিধানে তার পতন আসন্ন হচ্ছে এবং পরিণামে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসের অন্তর্নিহিত শক্তি এ বাহ্য বিবরণের তুলনায় অধিকতর ব্যাপক ও তাৎপর্যমণ্ডিত। এটা আমাদের সম্মুখে বিষয় ও ঘটনাবলীর কারণ এবং বিকাশ ও বিনাশের মৌলিক উপাদানসমূহকে উদ্ঘাটিত করে। এ কারণেই ইতিহাস যথার্থভাবে বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত এবং তাকে বিজ্ঞানের বিষয় হিসাবে গণ্য করা উচিৎ। বস্তুত বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিকগণ এ সত্যকে সম্মুখে রেখেই ঘটনাবলীর বিবরণ সংগ্রহ ও তা গ্রন্থাকারে বিন্যস্ত করে গেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে অনেকেই উক্ত ঘটনাবলীর সাথে মিথ্যা কাহিনী ও কল্পিত বর্ণনার সংযোজন করেছেন। বিচার বিশ্লেষণের পরিবর্তে ধারণা ও শ্রুতিনির্ভর কল্পনা ইতিহাস বর্ণনায় তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদগণ ক্রমশ এ ধারাকেই অক্ষুণ্ণ রেখেছেন এবং তাদের কল্পিত ও অতিরঞ্জিত বিবরণই আমাদের নিকট এসে পৌঁছেছে। এতে অনুসন্ধানের চেষ্টা নেই। বিচার-বিশ্লেষণের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে কলুষমুক্ত করবার কোন প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় না। এর ফল দাঁড়িয়েছে যে, তারা অন্ধবিশ্বাসের শিকারে পরিণত হয়েছেন এবং বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন লোকদের বিবরণের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। এ কারণেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের এমন ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। কিন্তু সত্য কখনও লুক্কায়িত থাকে না এবং বিচক্ষণ জ্ঞানীর নিকট মিথ্যার মুখোশ খসে পড়তে দেরি হয় না। সুতরাং ঐ সকল ইতিহাস রচকদের বর্ণনা যতই রসঘন ও মুখরোচক হোক না কেন, দূরদর্শীদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার অন্তর্নিহিত অসারতাকে সহজেই আবিষ্কার করে সত্যকে উদ্ধার করতে সক্ষম।…………………ইতিহাস অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের অন্যতম। এর উপাদানগুলো যেমন উপকারী, তেমনি এর উদ্দেশ্য অত্যন্ত মহৎ। ইতিহাস আমাদেরকে মানবজাতির অতীত কার্যাবলী সম্পর্কে শিক্ষা দেয়, তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অবহিত করায়। ইতিহাস পাঠে আমরা মহান ব্যক্তিগণের মহৎ জীবনকাহিনী জানতে পারি। এটা আমাদের রাজন্যবর্গের শাসনব্যবস্থা ও তাঁদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্বন্ধে জ্ঞান দান করে। এর ফলে আমরা পারলৌকিক ও ইহলৌকিক কল্যাণের পথ অনুসরণ করতে এবং নিজনিজ অভিরুচি অনুযায়ী উপদেশ গ্রহণ করতে সক্ষম হই। এজন্যই ইতিহাস রচনায় বহুবিধ সূত্র, জ্ঞান ও বিস্তর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রয়োজন। ইতিহাসবিদকে অবশ্যই মননশীলতা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হতে হবে। মাত্র এ দুটি গুণ ইতিহাস রচয়িতাকে সত্যের অনুসারী ও স্খলন-পতন-ত্রুটি থেকে মুক্ত করতে পারে। কোন ঐতিহাসিক লব্ধ বিবরণকে মানবজাতির চরিত্র-বৈশ্ষ্ট্যি, রাষ্ট্রনীতির মৌলিক তাৎপর্য ও সভ্যতা–সংস্কৃতির উপাদানগত এবং সর্বোপরি পরোক্ষকে প্রত্যক্ষের ও অবিদ্যমানকে বিদ্যমানের মাপকাঠিতে যদি বিচার না করে তাঁর ইতিহাসগ্রন্থে তুলে ধরেন, তাহলেই তাঁর স্খলন-পতন ও সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া বিচিত্র নয়।”(৪)
ইবনে খালদুনের ভাষ্য থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি, বিবরণ আর বিশ্লেষণের সততার সাথেসাথে অতীত কার্যাবলী থেকে মানুষকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নেয়ার পথ পরিস্কার করা ইতিহাসের প্রধান দাবি। মনে রাখতে হবে, মানুষই ইতিহাসের স্রষ্টা; মানুষই ইতিহাস তৈরি করে। ইতিহাস সে মানুষকে আপন শিল্পতে প্রকাশ বা পরিচয় করিয়ে দেয় মাত্র। এ-কাজে মৌলিক উপাদান দু’টি: এক, ইতিহাস এবং দুই, ইতিহাস-লেখক। মৌলিক উপাদান দু’টির সততাই সঠিক ইতিহাসের মূল সম্পদ।
এমন ধারণাকে আত্মস্থ করে আমরা একটি ব্যতিক্রমী ইতিহাসের পর্দা সরাতে চাই আজ। এ উত্তর-চট্টগ্রামের এক বনেদী স্থানের নাম—ফটিকছড়ি। ফটিকছড়ি এক সময় থানা নামে পরিচিত হলেও এখন উপজেলা—যা আয়তনে নারায়নগঞ্জ জেলার চেয়েও বৃহৎ। এটাই দেশের সর্ববৃহত্ উপজেলা। এখানকার এক ক্ষণজন্মা মহান পুরুষ—মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী রহ.। ১৮৭৪ সালে তাঁর জন্ম দৌলতপুর ইউনিয়নের বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারে পিতা মরহুম আমজাদ আলী চৌধুরীর কনিষ্ঠ সন্তান হিসাবে। পিতা আমজাদ আলী চৌধুরী ছিলেন তৎকালে চট্টগ্রামে সমাদৃত পণ্ডিত-সমাজের গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য। তিনি ‘আমজাদ উল্লাস’ গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন। ১৮৮২ সালে মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর বয়স যখন মাত্র আট বছর, পিতা আমজাদ আলী চৌধুরী এ পৃথিবী থেকে চলে যান। আট বছরের পিতৃহীন শিশু আলতাফ মিয়া চৌধুরীকে মাতা মরহুমা রাহাতুন্নিসা চৌধুরানী সর্বোচ্চ দায়িত্ব নিয়ে লালন-পালন করে সে জামানায় চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করাতে সক্ষম হন। যে সময়ের কথা বলছি, ইতিহাসের পাতা থেকে যাদের সে-সময়ের অভিজ্ঞতা হয়নি, তারা আশ্চর্য হতে পারেন। কারণ, ইংরেজ আমলে সমগ্র ভারতে বিশেষত আমাদের পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষার যে চিত্র ফুটে উঠে—তা চমকে দেবার মতো। বিশেষত ১৮৫৭’র আজাদী আন্দোলন বা সিপাহী বিদ্রোহের পর মুসলিমদের শিক্ষাখাতে যে মর্মবিদারী পথ অতিক্রম করতে হয়েছে, সেটাকে এক দীর্ঘ শিক্ষা-দুর্ভিক্ষ বলা যায়। সে-সময়কার কিছু চিত্র তুলে না ধরলে নয়:
“মুসলিম শাসনামলে সম্রাট, নওয়াব, জমিদার, জায়গীরদার ও ধনী ব্যক্তিবর্গের অর্থানুকূল্যে মুসলিমদের জন্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। মুসলমানদের রাজনৈতিক চেতনার বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস নানাভাবে বন্ধ করে দেয়। ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়ের পথ হাতছাড়া হয়ে যায়। এই আইন অনুযায়ী, সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব পরিশোধের নির্ধারিত সময়ের শেষ দিন সূর্যাস্তের আগপর্যন্ত জমিদার তার কর বা খাজনা পরিশোধ করতে না পারলে তার জমিদারী নিলামে তোলা হতো। এই আইন সূর্যাস্ত আইন নামেও পরিচিত। জমিদারের নায়েব গোমস্তারা পরিকল্পিতভাবে খাজনা দেওয়া থেকে বিরত থাকতো এবং নিলামে ওঠা জমিদারী কিনে নিয়ে নিজেই জমিদার বনে যেতো। সূর্যাস্ত আইনের ফাঁকে প্রতারিত জমিদাররা প্রায় ক্ষেত্রেই ছিল মুসলিম এবং প্রতারক গোমস্তারা ছিল হিন্দু। এসব প্রতারণামূলক কাজে ইংরেজ কর্মকর্তাগণ প্রেরণা ও প্রশ্রয় দিতেন। এটিও তাদের 'Divide and Rule' নীতিরই অংশ ছিল।
…………….১৮৫৭ সালে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মিলিত অংশগ্রহণে সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এই বিদ্রোহের পর উপমহাদেশের শাসনভার কোম্পানির হাত থেকে সরাসরি রানী ভিক্টোরিয়া গ্রহণ করেন। ইংরেজরা তাদের শাসনভিত্তি দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে জোরেশোরে ইংরেজী শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা শুরু করে। এই কার্যক্রমে হিন্দুরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিলেও ইংরেজ শিক্ষা তথা ইংরেজদের সহযোগিতার প্রশ্নে দো-মনা হয়ে পড়ে মুসলিমরা। এরই মধ্যে গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে অফিস-আদালতে ফার্সির স্থলে ইংরেজী সরকারি ভাষা হিসেবে চালু হলে তারা আরও বিপাকে পড়ে যায়।
…………….ইংরেজী শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মুসলিমদের এই ঘৃণা চলে বহুদিন ধরে। এমনকি একসময় ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করলেও কয়েক যুগ ধরে চলে ইংরেজ সরকারের চাকরি গ্রহণে বিতৃষ্ণা। আর সেই সাথে মুসলমানদের নিচে ফেলে হিন্দুদের উপরে ওঠানোর ইংরেজদের জাতিবিভেদমূলক সাম্প্রদায়িক কূটকৌশলও বজায় থাকে। এমন অবস্থা দেখেই ইংরেজ রেভারেন্ড ও জে লং বলেন,
“অসংখ্য প্রাসাদের ধ্বংসস্তুপ ও শোচনীয় দুরবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সহজেই বোঝা যায়, এদেশে মুসলমানরা নিশ্চিত ধ্বংসের পথে দ্রুত আগাইয়া যাইতেছে। একসময় যাহারা একটি বিশাল রাজ্য শাসন করিয়াছেন, আজ তাঁহাদের বংশধরগণ অতি কায়ক্লেশে জীবন যাপন করিতেছেন। বর্তমানে বাংলার কোন সরকারি অফিসে উচ্চপদস্থ মুসলমান কর্মচারী পরিদৃষ্ট হয় না। অথচ, মুসলমান দফতরী ও পিয়নে সব পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।”(৫)
১৮৫৭ থেকে মাত্র ১৬ বছর পরে এসে আমরা পাই ১৮৭৪ সাল অর্থাৎ, মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর জন্মসাল। তাহলে আমরা বুঝতে পারছি, উপরের চিত্রে ইংরেজ আমলে মুসলিম-শিক্ষার যে করুণাবস্তা দৃশ্যমান ছিলো, সেটার নির্মম শিকারে মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর বাল্যশিক্ষাও জর্জরিত ছিলো। এর ওপর পূর্ববঙ্গের মফস্বল এলাকা ফটিকছড়ির কথা বলাই বাহুল্য। তৎকালীন সময়ে ফটিকছড়ির শিক্ষাব্যবস্থার কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে সামগ্রিক ভারতের বিশেষত তৎকালীন বাংলার ঐতিহাসিক তথ্য থেকে ধারণা করতে পারি, সে-সময় ফটিকছড়িতে প্রাইমারি-শিক্ষা অর্জনের ব্যাপারও ছিলো রীতিমতো বিরল। তা’ছাড়া বৃহত্তর ফটিকছড়িতে প্রাথমিক স্কুল কয়টি ছিলো বা কোথায় ছিলো—তারও কোন সঠিক তথ্য নেই। নাজিরহাট বাজারের মধ্যখানে রাস্তার পশ্চিমপার্শ্বে যে মধ্যদৌলতপুর সরকারি প্রাইমারি স্কুলটি ছিলো, সেটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৫ সালে যা আশির দশকে সরিয়ে বাজারের উত্তরাংশে নিয়ে আসা হয়। সম্ভবত এটিই এতদঞ্চলের সর্বপ্রাচীন প্রাথমিক স্কুল যা মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর বাড়ি থেকে মাত্র ৫০০ গজের মধ্যে। অন্যটি হালদার পশ্চিম পাড়ে (তৎকালীন হাটহাজারী থানার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের অধীন) অবস্থিত খায়রিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৫ সালে। অথচ মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর জন্ম এখানেই, ১৮৭৪ সালে। সম্ভবত তিনি দূরের কোন প্রতিষ্ঠানে অথবা ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মধ্যদৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে থাকতে পারেন। শিক্ষার অপ্রতুলতার কথা বাদ দিলেও আর্থিক অভাব-অনটনের কথা বাদ পড়ার নয়। হতদরিদ্র কৃষক-সমাজের করুণকাহিনী আজও ইতিহাসের পাতা জুড়ে অবস্থান করছে। ১৭৭০ সালে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। সময়টি বাংলা ১১৭৬ সন হওয়ায় এ দুর্ভিক্ষ ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত হয়। অতি বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় সমগ্র দেশজুড়ে চরম অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। ত্রুটিপূর্ণ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা ও খাদ্যবাজারে দালাল ফড়িয়া শ্রেণীর দৌরাত্ম্যের ফলে অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ে। এমন দুর্ভিক্ষের পর ধাক্কা সামলাতে বছরের পর বছর লেগে যেতো। ক্ষতির জ্বালা পোহাতে হতো যুগযুগ ধরে। এরকম আরও ছোটখাট দুর্ভিক্ষ তো লেগেই ছিলো। ভূমিহীন, স্বজনহারা, আয়-রোজগারহারা কৃষক-শ্রেণী পেট সামলাবে, না কি শিক্ষা গ্রহণ করবে—সে দ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে পারেনি তাঁরা। সেদিক থেকে মাত্র আট বছর বয়সে পিতৃহারা শিশু আলতাফ মিয়া চৌধুরীর চতুর্থ ক্লাস পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণকে পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় অনেক অর্জন বলে ধরে নিতে হবে। এটুকু শিক্ষা নিয়ে তিনি পরবর্তীতে ফটিকছড়িতে মুন্সি(৬)উপাধি লাভ করে প্রধানত দলীল-লেখক ও সার্ভেয়ার হিসাবে জীবিকা নির্বাহের কাজ শুরু করেন বলে জানা যায় । তবে কখন তিনি পেশায় প্রবেশ করেন তা জানা যায়নি। ফটিকছড়ি উপজেলার সহকারী জজ আদালতের আইনজীবি সমিতির সাবেক সভাপতি ও ভাসানী ন্যাপের বিশিষ্ট নেতা মরহুম এডভোকেট লোকমান হোসেন আমাকে বলেছিলেন: মরহুম মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী ছিলেন একজন বিরল গুণের অধিকারী বহুমুখী প্রতিভার মানুষ। কাব্যজ্ঞানে যেমন তাঁর দখল ছিলো, তেমনি আইন বিষয়ে তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিলো। এডভোকেট লোকমান হোসেনের ভাষায়: তিনি আদালতপাড়ায় যখন আসতেন তখন আমরা তরুণ, সবেমাত্র আইন পেশায় কাজ শুরু করেছি। বৃহত্তর ফটিকছড়িতে তাঁকে এক নামে ‘আলতাফ মুন্সি’ হিসাবে সবাই চিনতো। আদালতের উকিলরা তাঁকে ঘিরে ধরতো বিভিন্ন নীতিকথা, আইনের কথা, ঘটনা আর কাব্যজ্ঞান শুনতে। মরহুম মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী মহাকবি আলাওলের খুব ভক্ত ছিলেন এবং তাঁর বিভিন্ন শ্লোক প্রায়শই আবৃতি করতেন বলে জানা যায়। তিনি নিজেও ছিলেন স্বভাবকবি; ছন্দাকারে কথা বলতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। স্থানীয়ভাবে তিনি পণ্ডিত হিসাবেও খ্যাত ছিলেন। বাংলাদেশের শত-সহস্র আলিমের উস্তাদ, বিখ্যাত শাইখুল হাদীস মাওলানা ইসহাক আল গাযী রহ. বলেছিলেন: মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী রহ. একজন শক্ত ঈমানের মানুষ ছিলেন। মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর হাতেই জামিয়া বাবুনগরের প্রতিষ্ঠাতা আরেফ বিল্লাহ মাওলানা হারুন বাবুনগরী রহ.-র বাল্যকালে বাংলা শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। হযরত হারুন বাবুনগরীকে দেয়া প্রথম সবক ছিলো: এলম শিখ আমল কর। তাই, হযরত বাবুনগরী রহ. মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীকে শিক্ষক হিসাবে অত্যধিক সম্মান করতেন। মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর ইন্তিকালে হযরত হারুন বাবুনগরী রহ. নিজহাতে কবর খনন করেন এবং নিজেই জানাযার নামাযের ইমামতি করেন বলে মুন্সি আলতাফ মিয়ার চতুর্থ পুত্র মাওলানা শামসুল আলম চাটগামী রহ. আমাকে বলেন। মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর আরেকটি বড় পরিচয় হলো, তিনি উপমহাদেশের ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ.-র একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন এবং চট্টগ্রামে হযরত শাইখুল ইসলামের কোন অনুষ্ঠান হলেই তিনি পায়েদলে ছুটে যেতেন । ১০৩ বছরের দীর্ঘ হায়াৎ শেষে ১৯৭৭ সালের ২৬শে অক্টোবর (১১ই কার্তিক, ১৩৮৪ বাংলা) মরহুম মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তিকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি র-জিঊন।
আশির দশকের শেষের দিকে মরহুম মুন্সী আলতাফ মিয়া চৌধুরীর হাতের লেখা ১১ পৃষ্ঠার কিছু পুরনো নথি খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর রেখে যাওয়া পুরনো কাগজের ভিড়ে। লেখাটি তিনি লিখেছিলেন দ্বিতীয়বার হজ্ব থেকে ফিরে ১৯৬২ সালে যখন তাঁর বয়স ৮৮ বছর। সে কথা তিনি নিজেই লিখে গেছেন। তিনি প্রথমবার হজ্ব সম্পাদন করেন ১৯৫১ সালে। প্রাপ্ত নথিতে দেখা যায়, তাঁর লেখাগুলো ক্ষুদ্রাকৃতির এবং টানা হস্তাক্ষরের। ভাষা ও বানান মধ্যযুগীয় রীতির। স্থানে-স্থানে লেখাগুলোকে বুঝে নিতে কষ্ট হয়েছে লৈখিকশৈলী ও এ-কালের অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহারের কারণে। সঙ্গত কারণে, সময় লেগেছে সম্পাদনা করতে গিয়ে—অপ্রচলিত শব্দের অর্থ বা উদ্দেশ্য খুঁজতে গিয়ে—ভাষারীতি বজায় রেখে বক্তব্যের ভাব সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে। এ পুস্তিকায় সংযুক্ত তাঁর মূললিপির ছবি দেখলেই বিষয়টি বোধগম্য হবে। লেখাটি খুঁজে পাবার পরে পড়েছিলো এক যুগ। এরপর বিষয়টি ফটিকছড়ির সুপ্রাচীন প্রতিষ্ঠান জামিয়া বাবুনগরের ফিকাহ বিভাগের প্রধান ও শাইখুল হাদীস উস্তাযে মুহতারাম মুফতী মাহমূদ হাসান (দা,বা)কে জানানো হলে হযরত যতোশীঘ্র সম্ভব নথিটি সম্পাদনা করে প্রয়োজনীয় তথ্যনির্দেশিকা দিয়ে উপস্থাপন করার নির্দেশ দিয়ে অধীনকে ইহসানের ছায়ায় আবদ্ধ করেন। বিষয়টিতে হযরত উস্তাযে মুহতারামের আগ্রহ এবং নির্ভেজাল মনযোগের ফলশ্রুতি আজকের মুদ্রিত পুস্তিকা—এতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ তাঁর ইখলাসকে কবূল করুন।
মরহুম মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী তাঁর নথিতে প্রধানত তিনটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন: ১.তাঁর বংশ-পরিচয়, ২. মহাকবি আলাওল এবং ৩. চট্টগ্রামের ইতিহাস। বংশ-পরিচয় পর্বে তিনি চট্টগ্রামের বহুলপরিচিত বার আউলিয়ার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, তাঁর বংশের পূর্বপুরুষ সৈয়দ মুহাম্মাদ রউফ আউলিয়াদের সাথে আরবদেশ থেকে চট্টগ্রামের কুতুবদিয়ায় আগমন করেন। এরপরের চিত্র বর্ণনাত্মক। দ্বিতীয় ধাপে তিনি এনেছেন মহাকবি আলাওলের কথা। আলাওল সম্পর্কে তাঁর বর্ণনা অনেকের কাছে অপরিচিত ঠেকবে বলা যায়। কিন্তু তাঁর বর্ণনাকে যাঁচাই-বাছাই করে দেখলে আশ্চর্য হতে হয় যে, বড় কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী ছাড়াই তাঁর উল্লেখ করা ঐতিহাসিক তথ্যগুলো ফেলনা নয়। ধরা যাক, মহাকবি আলাওলের জন্মস্থান সম্পর্কে। মরহুম মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী আলাওলের জন্মস্থান বলে চট্টগ্রামকে চিহ্নিত করেছেন। ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, তাঁর জন্ম ফরিদপুরের ফতেয়াবাদে। আবার ড. মুহাম্মাদ এনামুল হক বলেছেন, আলাওলের জন্ম চট্টগ্রামে। কেউকেউ তথ্য দিয়েছেন ফরিদপুরের কথা বলে। বিষয়টির ভুল ভাঙ্গে ১৯৩৫ সালে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক ও আব্দুল করীম সাহিত্যবিশারদের গবেষণাপ্রবন্ধ “আরকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য (১৬০০-১৭০০)” প্রকাশিত হবার পর। কবির জন্মস্থান নিয়ে উক্ত গবেষণায় তাঁরা লিখেন,
“……….কিন্তু এই ফতেয়াবাদ (ফরিদপুর) যে আলাওলের জন্মস্থান এ কথা কে বলিল? কবি নিজে এ কথা বলেন নাই, কিংবা ফরীদপুরে অদ্যাপি আলাওলের কোন নাম গন্ধও আবিষ্কৃত হয় নাই; তাঁহার নামহীন পিতা সম্বন্ধেও সেই কথা। এই অবস্থায়, মহাকবি আলাওল ফরীদপুরবাসী ছিলেন, লোকের মন হইতে এই ভ্রান্ত ধারণা একেবারেই দূর করিয়া দেওয়া উচিৎ। তবে আলাওলের জন্মস্থান কোথায়? তাঁহার জন্মস্থান যে চট্টগ্রাম জেলায় ছিল, তাহাতে সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই। কেননা আলাওল কবিকে আজ পর্যন্ত চট্টগ্রামবাসী মুসলমানেরাই বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন এবং তাঁহার সমুদয় কাব্যের প্রাচীন হস্তলিপি ও তাঁহার কীর্ত্তি-চিহ্ন চট্টগ্রামেই আবিস্কৃত হইয়াছে। আমরা স্থানীয় অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিয়াছি,--চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানায় “জোবরা”নামক একটি গ্রাম আছে। এই গ্রামেই আলাওলের প্রতিষ্ঠিত সুবৃহৎ দীর্ঘিকা (যাহা এখনও “আলাওলের ডীঘি” নামে পরিচিত) এবং এই বিখ্যাত দীঘির পূর্ব্বধারে চারি কানি পরিমিত স্থানব্যাপী কবির বাস্তুভিটা ও তাহার উত্তর-পূর্ব্ব কোণে কবির পাকা কবর অদ্যাপি বর্ত্তমান থাকিয়া তাঁহার অমর স্মৃতি বহন করিতেছে।”(৭)
মহাকবি আলাওলকে নিয়ে বিভ্রান্তিও আছে, যেমন দেখলাম জন্মস্থান নিয়ে; তেমনি তাঁর বিভিন্ন কবিতা বা ছন্দের মর্মার্থ নিয়েও ভিন্নভিন্ন ব্যাখ্যা দেখা যায়। ধরা যাক: “মুল্লুক ফতেয়াবাদ গৌরলে প্রধান, তথাতে জলালপুর অতি পূণ্যস্থান।”এখান থেকে কেউ কবির জন্মস্থান ফরিদপুরে, কেউ চট্টগ্রাম বলেছেন। জালালপুর চট্টগ্রামের ফতেপুর ইউনিয়নের পূর্বনাম বলে মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী উল্লেখ করেছেন। আর জোবরা গ্রামটি ফতেপুর ইউনিয়নের অধীন। বিভ্রান্তি সম্পর্কে মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী বলেন:
“পাঠকবন্ধুগণ, আলাওল-বাক্যের ভাব না বুঝিয়া যাহার মনে যাহা লয় তাহা বর্ণনা করিয়াছেন। আলাওল কবির প্রকৃত মনোভাব না বুঝিয়া ভুল বর্ণনা করিয়া যারযার মনোভাব ব্যাখ্যা করিয়াছেন। অধম বহু পণ্ডিত-সমাজে (মজলিশ) উপস্থিত হইয়া পণ্ডিত-সমাজের ভুল পরিলক্ষিত করি। তম্মধ্যে অধম অজ্ঞান-অন্ধকারের যাহা মনে হয়, তাহাতে মহাকবি আলাওলকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কবি বলিয়া অনুভব করি।”
মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী মধ্যযুগের ‘সতী ময়না’ কাব্যের রচয়িতা দৌলত কাজী, রোসাঙ-রাজ সুধর্ম্মার প্রধান উযীর মাগন ঠাকুর ও মহাকবি আলাওলের যেসব ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন—তা নিঃসন্দেহে আবিষ্কারমূলক। ইতিহাস-গ্রন্থে এভাবে কেউ বর্ণনা করেছেন বলে জানা নেই। অধম অবশ্য কোন বিজ্ঞ ইতিহাসচারীও নই। ‘সতী ময়না’ নিয়ে মহাকবি আলাওলের সাথে দৌলত কাজীর কথোপকথন; আলাওলের মুক্তি নিয়ে মাগন ঠাকুরের ভূমিকা, সাথে কবির ভ্রমনকাহিনী ও ছান্দিক প্রশ্নোত্তর; আলাওলের কারাবরণের প্রেক্ষাপট, আলাওল দীঘি খননের ইতিহাস ইত্যাদি এ অবধি উপস্থাপিত ইতিহাসের অনুপস্থিত অংশ বলে মনে হয়। ইতিহাস-গবেষণায় মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর লিখিত নথি এক নতুন দিগন্ত উম্মোচন করবে বলে বিশ্বাস। তিনি নিজেই বলেছেন, লেখাটি তাঁর মরহুম পিতা আমজাদ আলী চৌধুরীর নষ্ট হয়ে যাওয়া গ্রন্থ `আমজাদ উল্লাস’ অবলম্বনে লেখা। আমাদের দুর্ভাগ্য, গ্রন্থটি উই পোকায় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমরা ঐতিহাসিক অনেক দুর্লভ তথ্য, তত্ত্ব এবং সে যুগের বয়ান থেকে বঞ্চিত রয়ে গেলাম। আমার জানামতে, এ সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য উৎস হচ্ছে, ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ‘আরকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ গবেষণা-প্রবন্ধটি। এর দুই প্রণেতার একজন হলেন, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক এবং অপর জন মরহুম আব্দুল করীম সাহিত্যবিশারদ। ড. এনামুল হক সাহেবের জন্ম ১৯০২ সালে, মরহুম সাহিত্যবিশারদের জন্ম ১৮৭১ সালে এবং ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম ১৮৮৫ সালে। সেদিক থেকে বলা যায়, মরহুম আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ অন্যদের চেয়ে আলাওলযুগের অধিকতর নিকটবর্তী। মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর জন্ম আগেই বলেছি, ১৮৭৪ সালে। তাই যদি হয়, বলা যায়: মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর পিতা অর্থাৎ ‘আমজাদ উল্লাস’ গ্রন্থের রচয়িতা মরহুম আমজাদ আলী চৌধুরী যিনি ১৮৮২ সালে ইন্তিকাল করেন, আলাওলযুগের সর্বাধিক নিকটবর্তী—মধ্যযুগের সাহিত্য, ব্যক্তিত্ব ও ঘটনাবলী সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী। সেদিক থেকে আমরা মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর লেখা নথির তথ্যকে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় গবেষণার অনুম্মোচিত অধ্যায়ের অভাবনীয় উপাদান বলে চিহ্নিত করতে পারি। পুরো নথিটি পড়লে বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, মুন্সি আলতাপ মিয়া চৌধুরীর সাহিত্যানুরাগ কতোটা গভীর ছিলো। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কাণ্ডারী কবি দৌলত কাজী, মহাকবি আলাওল এবং তাঁদের রচনার প্রতি মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর মনযোগ আমাদেরকে বিমুগ্ধ করে। কিন্তু ঐতিহ্যে বিধৌত ‘হাজার বছরের চট্টলা’র প্রত্যন্ত অঞ্চলের সদা প্রচারবিমুখ, নিভৃতচারী এক সাহিত্যসেবী মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর কথা বাংলা সাহিত্যের দহলিজে নিতান্ত অবহেলায় বা অজ্ঞাতে কখনও তালিকাভুক্ত হয়নি। যে সময়টাতে মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী জন্মেছিলেন—সেটা নজরুল-রবীন্দ্র-ফররুখ যুগ ছিলো না। সে ছিলো দৌলত কাজী, আলাওল আর মাগন ঠাকুরদের প্রান্তের যুগ। শুধু সাহিত্য বলে কথা নয়, ইতিহাসের যে গুপ্তধন মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর কলমে উঠে এসেছে, সেটা আমাদের প্রথাগত ঐতিহাসিকদের সীমান্ত পেরিয়ে এক ব্যতিক্রমী জগৎকে মনে করিয়ে দেয়। তাঁর কথা অতিক্রম করে আমরা উপলব্ধি করি, তাঁর মরহুম পিতা ‘আমজাদ উল্লাস’ গ্রন্থের রচয়িতা মরহুম আমজাদ আলী চৌধুরীও যে মধ্যযুগীয় সাহিত্য ও ইতিহাসের নীরবে সেবা করে গেছেন—তা হয় তো প্রজন্মান্তরে অন্তরালে থেকে যাবে। জানি না এসব মনীষীদের কথা অদূর ভবিষ্যতে আদৌ আলোচিত হবে কি না।
মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর লেখার সর্বশেষ অংশ হচ্ছে—চট্টগ্রামের ইতিহাস। হাজার বছরের চট্টগ্রাম নিয়ে যতো বিতর্ক আছে—জানি না পৃথিবীর অন্য কোন জায়গা নিয়ে এতো বিতর্ক আছে কি না। উৎপত্তি, নামকরণ আর আবাদকরণ নিয়ে ইতিহাসের পাতায় প্রচুর বিতর্ক। এমন কি নাম-বিতর্কে চট্টগ্রামের বত্রিশটি নাম পাওয়া যায়। লিখিত ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, দশম শতাব্দীর আগের চট্টগ্রাম নিয়ে স্পষ্ট কিছু নেই। কখন কিভাবে মানুষ এখানে এলো, কারা এলো, কোথায় এলো—সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। আমি ইতিহাসের কিছু সূত্র: ১৯০৮ সালে কলিকাতা থেকে প্রকাশিত L.S.S. O’malley-র লেখা Eastern bengal district Gazetteers. Chittagong, ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সুনীতিভূষণ কানুনগো’র লেখা A history of Chittagong (From ancient times down to 1761), ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত জনাব ওহীদুল আলমের লেখা চট্টগ্রামের ইতিহাস, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা—‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ দেখেছি, তা থেকে লৈখিক ইতিহাসের ধারা মোটামুটিভাবে দ্বাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করা গেছে বলে ধরা যায়। কিন্তু ইতিহাস কেবল লৈখিক সীমান্তে আবদ্ধ থাকতে পারে না। যেখানে লিখিত ইতিহাসের ধারা অনুপস্থিত সেখানে কি অনুসন্ধান বা তথ্য প্রদান থমকে থাকবে? সাধারণ জ্ঞান সে-কথা বলে না। না থাকুক লৈখিক ইতিহাস, জনশ্রুতি আছে; মৌখিক সাক্ষ্য আছে; আছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। সেগুলো থেকে আমরা উপাদান সংগ্রহ করে লৈখিক ইতিহাসের অংশ করতে পারি। বিখ্যাত পরিভ্রাজক ইবনে বতূতা বিশ্বভ্রমন করেছেন। তাঁর সব তথ্যই কি লৈখিক ইতিহাস থেকে সংগ্রহ করা? যেখানে গেছেন, সেখানকার মানুষের কাছ থেকে শোনাকথা, স্বচক্ষে দেখা ইত্যাদি থেকে প্রাপ্ত তথ্যই এখন লিখিত ইতিহাসের অনস্বীকার্য অংশ। জনশ্রুতি বলে সেটাকে উড়িয়ে দেয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না। চট্টগ্রাম বার আউলিয়ার দেশ—এটা সবাই জানে; এটা এখন ইতিহাসের অনিবার্য অংশ। কিন্তু কে দেখেছে বার আউলিয়াকে? বার আউলিয়ার পূর্ণ পরিচয় কে বা কারা দিতে পেরেছে? কোন সনে, কোন জায়গায় বার আউলিয়া এসেছিলেন? লিখিত ইতিহাসে কি এসব লেখা ছিলো? বা আদৌ আছে? তবুও বার আউলিয়া সত্য; তাঁদের আগমন সত্য—এ সত্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা জনশ্রুতি বা মৌখিক সাক্ষ্য থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ঠিক এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা মুন্সি আলতাপ মিয়া চৌধুরীর লেখা চট্টগ্রামের ইতিহাস খতিয়ে দেখতে পারি। তিনি তাঁর বংশ পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন:
“অতি প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষ সায়্যিদ মুহাম্মদ রউফ তাঁহার পুত্র নজর মুহাম্মদ চৌধুরীকে সঙ্গে লইয়া আরবদেশ হইতে বর্তমান চট্টল-ভূমিতে বার জন কুতুব আউলিয়ার সঙ্গে শরের জাহাজযোগে সমুদ্রপথে কুতুবদিয়া পদার্পণ করেন।……..চট্টলভূমি বার আউলিয়া আবাদ করিয়াছেন। কুতুবদিয়ার পার্শ্ববর্তী প্রথম আবাদী স্থানের নাম ছিল ‘গৌরল’। উক্ত স্থানে আরব জাতি প্রথম কিল্লা স্থাপন করেন। পরে উক্ত স্থান সমুদ্রে ভাঙ্গিয়া নেওয়াতে তাঁহারা চাষখোলা নামক স্থানে স্থানান্তরিত হন। পরবর্তীতে উক্ত চাষখোলাও ভাঙ্গিয়া সমুদ্রে বিলীন হইয়া যাওয়াতে আরব দেশীয় বার আউলিয়া বাজালিয়া নামক আবাদী স্থানে স্থানান্তরিত হন।”
তাঁর নথির অন্য এক জায়গায় তিনি লিখেন:
“অতি প্রাচীনকালে চট্টলভূমি জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ে সজ্জিত ছিল। সে-সময় চট্টগ্রাম ছিল জিন-পরীর আবাসভূমি। এমনই এক সময় আরব হইতে বার জন আউলিয়া-কুতুব শরের জাহাজযোগে সমুদ্রপথে কুতুবদিয়া নামক স্থানে পদার্পণ করেন। আরবগণ কুতুবদিয়ার পার্শ্ববর্তী স্থান ‘গৌরল’ আবাদ করিয়া তথায় কিল্লা স্থাপন করেন এবং চাষখোলা, বাজালিয়া, মহিষখালি, আন্দরকিল্লা আবাদ করতঃ আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ স্থাপন করেন। এমতাবস্তায়, সমুদ্রের ভাঙ্গনে গৌরল, চাষখোলা ও বাজালিয়ার কতেক অংশ সাগরে পরিণত হয়। কিন্তু কুতুবদিয়া নামক দ্বীপটি সাগরের বক্ষে এ যাবৎ বিদ্যমান আছে এবং উক্ত স্থানে আউলিয়ার পদচিহ্ন আল্লাহ পাক বর্তমান রাখিয়াছেন। আরব জাতি শেখ বংশীয় বার আউলিয়ার আবাদকৃত ভূমি আজ বার আউলিয়ার স্থান নামে পরিচিত, তাহার অপর নাম—ইসলামাবাদ।”
আগেই বলেছি, মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী তাঁর তথ্যগুলো তুলে এনেছেন তাঁর পিতা মরহুম আমজাদ আলী চৌধুরীর রচিত ‘আমজাদ উল্লাস’ গ্রন্থ থেকে। উল্লেখ্য, গ্রন্থটির রচনাকাল পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর প্রাপ্ত মৃত্যুকাল ১৮৮২ হলে অনুমান করা যায়, উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে গ্রন্থটি লেখা হয়ে থাকতে পারে। উপরের তথ্যদ্বয়ে আরব থেকে আগত বার আউলিয়ার কথা বলা হয়েছে। ইতিহাসগ্রন্থগুলোতে প্রারম্ভিকতার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকে আরব নাবিক ও বণিকগণ চট্টগ্রামের সমুদ্র-উপকূলীয় অঞ্চলে অবতরণ করেন এবং বসতি স্থাপন করেন। মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী আরবদের চট্টগ্রামে আগমনের যে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন, তেমনটা ইতিহাসসূত্রে উল্লেখ করা হয়নি সত্য, কিন্তু আরবদের আগমনের বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণীত। এখন তাঁরা কি বার আউলিয়া? না কি অভিযাত্রিক বণিক?—তা নিশ্চিত করা যায় না। এমনও হতে পারে, আগত বার আউলিয়াই বণিক হিসাবে চট্টগ্রাম-উপকূলে অবতরণ করেন। কারণ বাণিজ্য করা ও বাণিজ্যের জন্য দূরদেশে অভিযানে যাওয়া আরবদের সহজাত বৈশিষ্ট্য ছিলো। এ মতটি মেনে নিলে আরব আর বার আউলিয়ার মধ্যে বিতর্ক থাকে না। আর যে উপকূলীয় অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে, ভৌগলিক কারণে সেটা কুতুবদিয়া হওয়াই সর্বাধিক সম্ভব। আজও কুতুবদিয়ায় বিখ্যাত ওলী কুতুব উদ্দীনের মাজার রয়েছে। হতে পারে তিনিও বার আউলিয়ার অন্যতম। চট্টগ্রাম-বিজয়ে বার আউলিয়ার ভূমিকা ও ‘চাটি’ বা ‘চেরাগ’ থেকে চাটিগাঁ ওরফে চট্টগ্রাম নামকরণ হওয়ার তথ্যকে কিছকিছু ইতিহাসলেখক কিংবদন্তী(৮)বা জনপ্রিয় জনশ্রুতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ নিয়ে পরবর্তীতে আর কোন অনুসন্ধানের গরজ অনুভব করেননি তাঁরা। তাঁরা কিংবদন্তী বা জনশ্রুতি বলে তথ্যের প্রাসঙ্গিকতা, ধারাবাহিকতা ও গভীরতাকে সংকীর্ণ করার চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়। কারণ সম্ভবত এই, বিষয়টির একটি ধর্মীয় দিক আছে। ‘বার আউলিয়া’র পরিবর্তে বার জন মানুষ বা বণিক বা অভিযাত্রী বললে ঐতিহাসিকদের জন্য হয় তো সহজ হতো। হতে পারে তাঁরা ইতিহাসের সঠিক স্রোতকে ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার চরিত্র দেয়ার অভিসন্ধিতে এমন করেছেন। এমন হলে বিষয়টি যে বিকৃতিকরণের একটি চেষ্টা—তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে চট্টগ্রামের মুসলমানদের মূল যে আরবাগত তা হলফ করে বলা যায়। যেমন বলা হয়েছে:
The Muslims of Chittagong are of mixed descent and considerable physical differences are noticeable among them. That Chittagong was regularly visited by the Arab traders is historically true and the possibility of Arab impact on Chittagong cannct be ruled out. Some people especially in and around the city may rightly claim their semitic origin. With the consolidation of Muslim rule in Chittagong Muslims of other parts of Bengal flocked to the district and made settlements there, The Turks, the Pathans, the Mughals dominated over the district and a great portion of them chose the district as a place of their residence. There was a good deal of intermarriage between Muslims coming from outside the district and natives. This facial admixture contributed greatly to the formation of Muslim community in Chittagong.(৯) (চট্টগ্রামের মুসলমানরা দৃশ্যত মিশ্রবংশের এবং তাদের মধ্যে শারীরিক স্বতন্ত্রতা উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষণীয়। ঐতিহাসিক সত্য হলো, আরব ব্যবসায়ীরা নিয়মিত চট্টগ্রাম আসতো এবং চট্টগ্রামের উপর আরবীয় প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। সঙ্গতকারণে, চট্টগ্রামের ভেতর এবং আশেপাশের মানুষ তাদের জাতিগত উৎস সঠিকভাবে দাবি করতে পারে। চট্টগ্রামে মুসলিম শাসন সুসংহত হওয়ার সাথেসাথে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। তুর্কি, পাঠান, মুঘলরা এ জেলার উপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং তাদের একটি বড় অংশ জেলাটিকে তাদের বসবাসের স্থান হিসাবে বেছে নেয়। জেলার বাইরে থেকে আগত মুসলমান এবং স্থানীয়দের মধ্যে আন্তঃবিবাহের একটি ভালো বন্ধন ছিল। এ ধরনের বন্ধন চট্টগ্রামে মুসলিম-সমাজ গঠনে ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখে।)
অন্যত্র বলা হয়েছে:
The Muhammadans are of mixed descent, and considerable physical differences aro noticeablo among them. The high cheek-bones, hook noses, and narrow faces of many of the inhabitants of the town of Chittagong proclaim their Arab extraction.(১০) (মুসলমানরা মিশ্র বংশোদ্ভূত এবং তাদের মধ্যে যথেষ্ট শারীরিক পার্থক্য লক্ষণীয়। চট্টগ্রাম শহরের অনেক বাসিন্দার চক্ষু থেকে গাল পর্যন্ত উঁচু হাঁড়, বাঁকা নাক (বর্শী আকৃতি) এবং সরু মুখ তাদের আরবীয় বংশোভুত হওয়াকে প্রকাশ করে।)
মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী লিখেছেন, “অতি প্রাচীনকালে চট্টলভূমি জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ে সজ্জিত ছিল। সে-সময় চট্টগ্রাম ছিল জিন-পরীর আবাসভূমি।“কেউ যদি এমন লিখেন, আধুনিক মননের দাবিদাররা বলতে পারেন: এগুলো কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অবৈজ্ঞানিক সব কথাবার্তা; এগুলোর কোন ভিত্তি নেই। জিনজাতি নিয়ে অতি বিজ্ঞানমনষ্ক কিছু লোক বলে থাকেন: জিন-পরী-ভূত বলে কিছু নেই। এগুলো মধ্যযুগীয় সংকীর্ণ মনের বহিঃপ্রকাশ। তাদের এসব কথা খোদ বিজ্ঞানের উপরই এক ধরনের আঘাত। তাদের কথায়, দৃশ্যমান হলেই বিশ্বাসযোগ্য ও বিজ্ঞানময় আর অদৃশ্য হলেই সেটা অবিশ্বাসযোগ্য ও অবৈজ্ঞানিক। লালন এমন অভিযোগ করে বলেছিলেন: চর্মচক্ষে দেখিনি যারে, কেমনে ভজিব তারে? শত বছর পরে বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লালনকে প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন:
দেখিবে আবার ঘুচিলে তাহার আঁখির অন্ধকার।
জিনজাতির অস্তিত্বের কথা পবিত্র কুরআনেও রয়েছে, “আমি সৃষ্টি করিনি জিন এবং মানুষকে (আমার) ইবাদৎ ভিন্ন অন্য কিছুর জন্য।”—সূরাহ আয্ যা-রিয়াৎ। বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর বিন খাত্তাব রজি.-র একটি বর্ণনায় মানুষ সৃষ্টির দু’হাজার বছর পূর্বে জিনজাতিকে সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।(১১) তখন থেকেই পৃথিবীতে তাদের বসবাস। ওদের বাসস্থান হলো, গভীর জঙ্গল, গভীর সমুদ্র ও মানুষের পরিত্যক্ত স্থান। পবিত্র হাদীস থেকে জানা যায়, জিনরা নোংরা ও গন্ধময় জায়গায় থাকতে পছন্দ করে, যেখানে মানুষ ময়লা এবং খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলে রাখে। সেদিক থেকে মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী সে-সময় চট্টগ্রাম ছিলো জিন-পরীর আবাসভূমি বলে যে তথ্য দিয়েছেন তা কতোটুকু অবৈজ্ঞানিক বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন—সে বিচার বিবেকবান পাঠকের হাতে রইল। বলতে পারেন, সে-সময়কার চট্টগ্রাম কি জিন-পরীর উপযুক্ত আবাসভূমি ছিলো? আসুন তাহলে দেখি, প্রাচীন চট্টগ্রাম কেমন ছিলো। জনাব ওহীদুল আলম তাঁর `চট্টগ্রামের ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন:
বর্তমান পলোগ্রাউন্ডকে ব্রিটিশ যুগে নেজামত পল্টন বলতো, কারণ তখন সেখানে ছিল সেনানিবাস। পরীর পাহাড় যেখানে বর্তমান কোর্ট অবস্থিত, সেখানে একখানা পুরাতন দালানে বুলক ব্রাদার্সের এক সাহেব থাকতেন, ঐ স্থান ভয়ানক জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। দিনের বেলায় ফিরিঙ্গী বাজারের এক মুসলমানকে সেখানে বাঘে হত্যা করে। তখন টাইগার পাস ভীষণ সংকটময় স্থান ছিল। চট্টগ্রাম শহর থেকে পশ্চিম দিকে যাবার জন্য এই ছিল একমাত্র পথ। এ পথ ছিল তখন বাঘ ও ডাকাতের আড্ডা। পথিক হয় বাঘের কবলে না হয় ডাকাতের কবলে পড়তো।…………চট্টগ্রাম রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে শুরু করে পলোগ্রাউন্ডের উত্তর পার্শ্বের পাহাড়, সেন্ট্রাল রেলওয়ে অফিস, পশ্চিম পাহাড়তলী রেলওয়ে ওয়ার্কসপ পর্যন্ত–এই বিরাট অঞ্চল গহিন বনে আচ্ছন্ন ছিল ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত।(১২)
ঊনিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত যদি চট্টগ্রামের কেন্দ্রস্থলের এ অবস্থা থেকে থাকে, তবে আদি চট্টগ্রামে যখন মনুষ্য আবাদের শুরু (অষ্টম শতাব্দী) তখন কেমন ছিলো? মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীর কথায় আদি চট্টগ্রাম জিন-পরীর আবাসভূমি ছিলো, জঙ্গলাকীর্ণ ছিলো—কথাগুলো কি অবাস্তব মনে হয়? অবৈজ্ঞানিক মনে হয়? বার আউলিয়ার এক চাটি আলোর অলৌকিক বিষয়টিকে মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী যেভাবে সীমানা নির্দেশ করে তুলে ধরেছেন, তা এককথায় অসাধারণ। ইসলামে আউলিয়াদের কারামাত বা অলৌকিকত্ব প্রকাশকে স্বীকার নেয়া হয়েছে। লৌকিক হলেই সত্য আর অলৌকিক হলে মিথ্যা বা অবৈজ্ঞানিক—এমন ধারণা পরিত্যাজ্য। ইতিহাসের অনেকসূত্রে বদর আউলিয়ার কথা এসেছে। সব সূত্রেই বদর আউলিয়াকে সর্দার বা নেতা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরীও বদর ওলীকে জিন-পরীদের সাথে যুদ্ধে আরবদের (আউলিয়া) সেনাপতি বলে উল্লেখ করেছেন এবং জিন-পরীদের সাথে সম্পাদিত সোলেহনামাতে প্রতিনিধিত্ব করেন বলে উল্লেখ করেছেন। চট্টগ্রামের চরণদ্বীপ, খরণদ্বীপ, ফতেয়াবাদ, ফতেপুর এলাকাগুলোর নামকরণের যে কারণ তিনি তুলে ধরেছেন—সেসব অন্য কোথাও আমরা দেখিনি।
পরিশেষে বলা যায়, বংশ-পরিচয়ের সূত্রে মহাকবি আলাওল ও চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী যে তথ্য দিয়ে গেছেন, তা নিশ্চয় করে আগামী প্রজন্মের গবেষণার নতুন উপাদান সরবরাহে ব্যতিক্রমী ভূমিকা রাখবে। সন্দেহ নেই, তাঁর বর্ণনাতে ধারাবাহিকতার ছন্দ পতন ঘটেছে আর সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, যে বয়সে তিনি কলম ধরেছেন, সে বয়সে স্মৃতি থেকে আদি ইতিহাসের ধারা বর্ণনা দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আশা করি, ইতিহাসের শর্তাবলীর মতোই তাঁর রচনা আমাদেরকে পথ দেখাবে; আমাদের বর্তমানের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে তুলবে হাজার বছরের চট্টলার ধারাবাহিক ইতিহাসকে; মহাকবি আলাওল, দৌলত কাজী এবং মাগন ঠাকুরদের অমূল্য সম্ভারকে। মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী রহ. শুধু যে, সাহিত্যের সেবা করেছেন তা নয়, তাঁর জীবনের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালে বাংলাদশের মুক্তি-সংগ্রামে জনমত সংগঠিত করতে নানা ছন্দ-কবিতা রচনা করে তা পাঠ করে শোনাতেন। ১৯২৫ সালে সম্পাদিত ফটিকছড়ির জামিয়া আরবিয়া নছিরুল ইসলামের (প্রকাশ: নাজিরহাট মাদরাসা বা নাজিরহাট বড় মাদরাসা) প্রখ্যাত ওয়াকফনামা তিনিই প্রণয়ন করেন। ১৯৭৭ সালের ২৬শে অক্টোবর এ মনীষী ১০৩ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। মহান আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করি, আল্লাহ আমাদের শ্রদ্ধেয় দাদাকে মাগফিরাত দান করে ওপার-জীবনে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন; তাঁর কবরকে নূরে রহমত দিয়ে আলোকিত করে দিন। আমীন।
মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী
মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী বাড়ি
নাজিরহাট পৌরসভা, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
১২ই জুমাদাস্ সানিয়াহ ১৪৪৩,
২রা মাঘ ১৪২৮ বাংলা,
১৬ই জানুয়ারি ২০২২।
তথ্য নির্দেশিকা:
(১) উইকিপিডিয়া
(২) উইকিপিডিয়া
(৩) ইন্টারনেট
(৪) আল মুকাদ্দিমা,
কিতাবুল
ইবার, পৃ: ৬৭, ৭৫ প্রথম খণ্ড,
বাংলা
সংস্করণ, দিব্য প্রকাশ, জুন ১৯৮২, ঢাকা।
(৫) ইন্টারনেট
(৬) মুন্সি (ফার্সী: مُنشی ; বাংলা: মুন্সি) মূলত
একটি ঠিকাদার, লেখক, বা সচিবের জন্য ব্যবহৃত ফার্সী শব্দ এবং পরবর্তীতে মুগল
সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ ভারতে নেটিভ ভাষা শিক্ষক, বিভিন্ন বিষয় বিশেষত প্রশাসনিক নীতি,
ধর্মীয়
গ্রন্থ, বিজ্ঞান এবং দর্শনশাস্ত্রের
শিক্ষকদের জন্য ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে ব্রিটিশ ভারতে ভাষার উপর কর্তৃত্ব অর্জনের
জন্য সম্মানিত শিরোনাম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এটি তাদের খ্যাতি হিসাবে গণ্য করা হয়।
আধুনিক ফার্সী ভাষায়, এ শব্দ প্রশাসকদের, বিভাগের প্রধানদের বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।
(৭) আরকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য (১৬০০-১৭০০), গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স, কলিকাতা, প্রকাশ: ১৯৩৫ সাল, পৃ: ৪৫-৪৬ ।
(৮) ‘চট্টগ্রাম’ নামের উৎপত্তির সবচেয়ে জনপ্রিয় কিংবদন্তী এই, প্রাচীনকালে চট্টগ্রাম জ্বীন-পরীদের আবাসস্থল ছিল। বারজন
আউলিয়া একদা এই সবুজদেশে উপস্থিত হন। এই পরীদের
বিতাড়িত করতে তারা প্রদীপ জ্বাললেন এবং প্রদীপের আলোতে জ্বীন-পরীরা পলায়ন করলো।
এভাবে জ্বীন-পরীদের বিতাড়িত করে আউলিয়াগণ এই দেশকে মানুষের বসতির উপযোগী করলেন।
সেই হতে এই দেশের নাম হয়েছে চাটিগাঁ। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে স্থানীয় ভাষায় ‘চাটি বা চেরাগ’
অর্থ
প্রদীপ। শহরের জামাল খাঁ অঞ্চলে ‘চেরাগী পাহাড়’ নামে একটি উঁচু মাটির স্তুপ আছে। (চট্টগ্রামের ইতিহাস, ওহীদুল আলম, পৃ: ১, বইঘর, চট্টগ্রাম, প্রকাশ: ১৯৮৯।), ……..the
Muhammadans changed it to Chatigaon with reference to the chati or earthen lamp
which the saint Pir Badar lit to drive away the evil spirits infesting the
place. (Eastern Bengal District Gazetteers. Chittagong, BY L.S.S. O’Malley, P-
1, Indian Civil Service. Calcutta, The Bengal Secretariat Book Depot,
Pub-1908.)
(৯) A History of Chittagong (From Ancient Times down to 1761) Vol-1, Dr. Suniti Bhushan Qanungo, Page: 21-22, Deparlmert of History, Uuiversity of Chittagong Pub. 1988, Chattogram.
(১০) Eastern
Bengal District Gazetteers. Chittagong, BY L.S.S. O’Malley, P: 55, Indian Civil
Service. Calcutta, The Bengal
Secretariat Book Depot, Pub-1908.
(১১) জিন ও ফেরেশতাদের বিস্ময়কর ইতিহাস, আল্লামা ইবনে কাসীর ও আল্লামা জালাল উদ্দীন সুয়ূতী, সংকলন ও সম্পাদনা: মাওলানা এ. এস. এম আজিজুল হক আনসারী, পৃ: ২৭, প্রকাশ: ২০১৬, ঢাকা।
(১২) পৃ: ৬-৭ ।
আমাদের বংশ-পরিচয় ও চট্টলার ইতিহাস
মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী রহ.
“অধম-হীন আলতাপের বংশাবলীর পূর্ণ বিবরণ” জানিবার উদ্দেশ্যে অধমের অন্যতম দুই পুত্র জেড, আই চৌধুরী (মুহাম্মাদ জহুরুল ইসলাম চৌধুরী) ও এস, আই চৌধুরী (মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) জিজ্ঞাসা করাতে তাহাদের নিকট অধমের মৌরশী-বংশের কিঞ্চিৎ বিবরণ লিখিতে বাধ্য হইলাম। জ্ঞানী আলাওল(১) পণ্ডিতের বাক্যে লিপি আছে:
“বিনা জিজ্ঞাসনে যে গুণী কহে কথা,
তাঁর বাক্য মাটির তুল্য জানিও সর্বদা।”
অধম-নালায়েক-হীন ব্যক্তির বংশের পূর্বপুরুষ আরবদেশ হইতে চট্টল-ভূমিতে আসিয়াছেন। আমরা জাতিতে শেখ বংশীয় আরব জাতি বটে। অতি প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষ সায়্যিদ মুহাম্মাদ রউফ তাঁহার পুত্র নজর মুহাম্মাদ চৌধুরীকে সঙ্গে লইয়া আরবদেশ হইতে বর্তমান চট্টল-ভূমিতে বার জন কুতুব আউলিয়ার সঙ্গে শরের জাহাজযোগে(২) সমুদ্রপথে কুতুবদিয়া পদার্পণ করেন। ইতঃপূর্বে রোসাং বা আরাকানে মগধরাজ্য(৩)স্থাপিত ছিলো। আরাকানের পূর্ব নাম ছিল—রোসাঙ। রোসাঙ কর্ণফুলী নদীর আঁকেবাঁকে পূর্ব-দক্ষিণ তীরে স্থিত ছিল। তখনকার দিনে রোসাঙে রাজা সুধর্মার(৪) রাজত্ব ছিল। মহাকবি আলাওলের পিতার পূর্বপুরুষ বার আউলিয়ার সঙ্গে চট্টলভূমিতে আসেন। চট্টলভূমি বার আউলিয়া আবাদ করিয়াছেন। কুতুবদিয়ার(৫)পার্শ্ববর্তী প্রথম আবাদী স্থানের নাম ছিল ‘গৌরল’। উক্ত স্থানে আরব জাতি প্রথম কিল্লা স্থাপন করেন। পরে উক্ত স্থান সমুদ্রে ভাঙ্গিয়া নেওয়াতে তাঁহারা চাষখোলা নামক স্থানে স্থানান্তরিত হন। পরবর্তীতে উক্ত চাষখোলাও ভাঙ্গিয়া সমুদ্রে বিলীন হইয়া যাওয়াতে আরব দেশীয় বার আউলিয়া বাজালিয়া নামক আবাদী স্থানে স্থানান্তরিত হন। বর্তমানে বাজালিয়ার(৬) কিছু অংশ বিদ্যমান আছে। তাঁহাদের পদার্পণস্থান কুতুবদিয়া বর্তমানে সাগরবক্ষে স্থিত আছে যাহাতে একটি প্রদীপঘর বা বাতিঘর(৭) রহিয়াছে। আল্লাহ পাকের কুদরতে কুতুবদিয়া নামক দ্বীপটি এখনও বিদ্যমান রহিয়াছে। উক্ত বাজালিয়া হইতে উত্তর দিকে চট্টলভূমির উপর আরব জাতি (বার আউলিয়া) কিল্লা স্থাপন করিয়া তারও উত্তর দিকে (উত্তর চট্টগ্রাম) আবাদ করিতে-করিতে ফতেয়াবাদ(৮)পর্যন্ত জঙ্গল কাটিয়া আবাদ করিয়াছেন। তারও উত্তরে পূর্বমুখী আবাসভূমি জীনপরীগণের দখলে ছিল। তথায় বার আউলিয়াগণ আবাদ করিতে উদ্যত হইলে তাঁহাদের সঙ্গে জীনপরীগণের যুদ্ধ বাঁধে এবং আবাদ-প্রচেষ্টায় বাধা পড়ে। বদর আউলিয়া নামে একজন অলী বার আউলিয়ার সেনাপতি ছিলেন। তিনি ফতেয়াবাদ ও বর্তমান ফতেপুর(৯)নামক স্থান দখল করিয়া তথায় রাজধানী স্থাপন করেন। সেখানে মজলিশ কুতুবের দীঘি স্থিত আছে। বর্তমানে দীঘিটি মজলিশের দীঘি বলিয়া পরিচিত। উক্ত ফতেপুরের পূর্বনাম ছিল—জালালপুর। ফতেপুরের উত্তরাংশে আলাওল কবির দীঘি বিদ্যমান আছে।
অধম অজ্ঞান-অন্ধকার ও বিদ্যাহীন ব্যক্তি হই। অধম কোন কবি নহি; কাব্যজ্ঞান অধমের নাই; সামান্য বিদ্যা শিক্ষা লাভ করিয়াছি মাত্র। অধমের পক্ষে চট্টগ্রামের ইতিহাস লিখিতে গেলে নিজের ক্ষুদ্র ইতিহাস লিখা সম্ভবপর নহে। তাই অধমের পক্ষে চট্টলের আদি বৃত্তান্ত লিখিতে গেলে অধম ক্ষুদ্রজ্ঞানে কবিগণের কাব্যভাব বুঝিয়া উঠিতে অক্ষম। জ্ঞানী কবি আলাওল কবির রচিত কয়েকটি পুস্তক অধমের নযরে পড়িয়াছে। তাহাতে বুঝিয়া নিতে পারি যে, আলাওল মহাকবির নাম নহে, তাঁহার উপাধি মাত্র । ‘আলা’ শব্দের অর্থ অতি উচ্চদরের অলি আর ‘ওল’ শব্দের অর্থ হইল এমন ব্যক্তি যিনি উচ্চস্তরের মানব। অধম নালায়েক যোগ্য নহি তাঁহার গুণীবাক্যের ব্যাখ্যা করা, একান্ত অসম্ভবও বটে।
তাই অধম অযোগ্য মানবের কবিজ্ঞান না থাকায় চট্টল ইতিবৃত্তি ক্ষণিক ক্ষান্ত দিয়া অধমের বংশ-পরিচয়—যাহা অধমের পিতা মরহুম আমজাদ আলী চৌধুরী: যিনি চট্টলের একজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন, তাঁহার হস্তলিখিত ‘আমজাদ উল্লাস’ বইখানি হইতে লিপিবদ্ধ করিতেছি। অধম পুস্তকটির দর্শন লাভ করিয়াছি এবং বিষয়বস্তু হদয়ঙ্গম করিয়া বংশ-পরিচয় উল্লেখ করিতেছি। পুস্তকটি অধম ছাপাইবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত উই পোকায় নষ্ট করিয়া ফেলায় ছাপাইবার সুযোগ পাই নাই। উক্ত কারণে অধমের চট্টল ইতিবৃত্তি ক্ষান্ত দিয়া ছেলেগণের কথিত মতে অধমের বংশের সামান্য বাক্য লিখিতেছি। অধমের পূর্ব মৌরশেরা (পূর্বপুরুষ) আরবের অধিবাসী বার আউলিয়ার সঙ্গে এই চট্টলভূমিতে আসিয়া নিজ হাতে জঙ্গল কাটিয়া আবাদ করিয়া আসিতেছেন।
অধীনের মৌরশ সৈয়দ মুহাম্মাদ রউফ কর্তৃক আবাদকৃত দুইটি স্থান চরণদ্বীপ ও খরণদ্বীপ নামে আখ্যায়িত আছে। উক্ত দ্বীপে তাঁহার নামে সৈয়দখালী নামে একটি খাল বা নদী আছে। সৈয়দ মুহাম্মাদ রউফ পায়ে দলে যাহা আবাদ করিয়াছেন, তাহা চরণদ্বীপ ও যাহা খরম পায়ে দিয়া আবাদ করিয়াছেন, তাহা খরণদ্বীপ নামে অভিহিত আছে। চট্টলভূমিতে উক্ত স্থান এখনও বিদ্যমান রহিয়াছে। উক্ত বুজুর্গ অলীর (সৈয়দ মুহাম্মাদ রউফ) এক পুত্র: তাঁহার নাম—নজর মুহাম্মাদ চৌধুরী তৎপুত্র সাকির মুহাম্মাদ চৌধুরীকে সঙ্গে লইয়া চট্টলের চানগাঁও নামক স্থানে আগমন করেন। সেইখানে নজর মুহাম্মাদ চৌধুরীর একটি দীঘি—‘নজরার দীঘি’ নামে এখনও খ্যাত ও স্থিত আছে। বর্তমানে চানগাঁওয়ে নজর মুহাম্মাদ চৌধুরীর নামে নজর-সাকির নামক একটি তরক রহিয়াছে। যাঁহারা তরক, লাখেরাজ, বাহানী ও বাজেয়াপ্তী(১০)তালুক(১১) স্থিত রাখিয়াছে গভর্নমেন্ট তাঁহাদিগকে চৌধুরী খেতাব দান করিয়াছে। বর্তমানে ‘তরক’ ছাড়া অনেক চৌধুরীর সৃষ্টি হইয়াছে। অধমের পিতায় বলিতেন: হিসাব ছাড়া মুহুরী, তরক ছাড়া চৌধুরী। বর্তমানে এমন অনেক দেখা যাইতেছে। অধমের পিতা আরও বলিতেন:
হিসাব ছাড়া হিসাব না জানে; কিতাব না জানে, সেই কি পোদ্দার?(১২)
লেখা না জানে, পড়া না জানে—সে কিসের সর্দার?
হিসাব ছাড়া মুহুরী তরফ ছাড়া চৌধুরী বর্তমানে অনেক দেখা যাইতেছে। চানগাঁওতে বর্তমানে যে নাছির মুহাম্মাদ চৌধুরীর বাড়ি রহিয়াছে তথায় নজর-শাকির তরফের মালিকের নাম নজর মুহাম্মাদ চৌধুরী লিখিত ছিল। নজর মুহাম্মাদ চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্রের নামে ‘নাছির মুহাম্মাদ চৌধুরী বাড়ি’ প্রকাশ রহিয়াছে। ছোলেমান চৌধুরী উক্ত নাছির মুহাম্মাদ চৌধুরীর কন্যার ঘরের আওলাদ হয়। উক্ত ছোলেমান চৌধুরীর বসতবাড়ির পূর্বপার্শ্বে নজরার দীঘি বর্তমান আছে। উক্ত দীঘির পশ্চিম-পাড়ে শাহ মুহাম্মাদ নামক একটি পাকা মাজার আছে। ‘শাহ মুহাম্মাদ’—যিনি মূলত সাকির মুহাম্মাদ: ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত ডাইনজুরী নামক স্থানে চানগাঁও হইতে আসিয়া বসতবাড়ি স্থাপন করত বসবাস করিতে থাকেন। সাকির মুহাম্মাদ চৌধুরী ডাইনজুরী গ্রামে পরলোক গমন করিলে তাঁহার কথিতমতে চানগাঁও নজরার দীঘির পশ্চিম-পাড়ে দাফন করা হয়। তাঁহার পাকা মাজারে (কবরে) শাহ মুহাম্মাদের নাম লিখা রহিয়াছে; অধম উক্ত মাজার জিয়ারত করিয়া নিজচক্ষে দেখিয়াছি—নাছির মুহাম্মাদ চৌধুরীর মাজার। বাড়ির সামনে বড় পুকুর আছে। পুকুরের দক্ষিণ-পাড়ে একটি মসজিদ স্থিত আছে। উক্ত পুকুরের দক্ষিণাংশসহ নজরার দীঘি স্থিত ছিল। বড় পুকুরের পশ্চিম-পাড়ে নাছির মুহাম্মাদ চৌধুরীর মাজার রহিয়াছে। অধীন তাহা জিয়ারত করিয়াছি। অধমের দুই পুত্র এম, জেড, আই চৌধুরী (জহুরুল ইসলাম চৌধুরী) ও এম, এস, আই চৌধুরী (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) উক্ত বাড়িতে জায়গীর থাকিয়া চট্টগ্রামে শিক্ষা লাভ করিয়াছে। ফটিকছড়ি থানার ডাইনজুরী গ্রামে সাকির মুহাম্মাদ চৌধুরীর একটা বড় পুনী (পুকুর)(১৩) আছে। বর্তমানে আমি নিজে উক্ত পুনী ভরাট করিয়া ফেলিয়াছি। উক্ত পুনীকে ১২০০ মঘির জরিপের ১ দাগ খুটি নির্ধারণ করিয়া ডাইনজুরী মৌজা জরিপ হইয়াছে। আগের বর্ণনামতে সাকির মুহাম্মাদ চৌধুরীর পুত্র নাহির মুহাম্মাদ চৌধুরী; নাহির মুহাম্মাদ চৌধুরীর পুত্র তাহির মুহাম্মাদ চৌধুরী; তাহির মুহাম্মাদ চৌধুরীর পুত্র ওয়াজ মুহাম্মাদ চৌধুরী এবং ওয়াজ মুহাম্মাদ চৌধুরীর চার পুত্র যথাক্রমে: সোনা গাজী, ভূঁইয়া গাজী সিকদার, ইমামুদ্দীন ও মুহসিন আলী। ভূঁইয়া গাজী সিকদার অধমের পিতামহ বা দাদা হন। তাঁহার দুই পুত্র যথাক্রমে: আমজাদ আলী চৌধুরী ও ফতেহ আলী চৌধুরী। মরহুম আমজাদ আলী চৌধুরী অধমের পিতা হন।
অধমের পিতার সাত পুত্র ছিল। তম্মধ্যে চার পুত্র মারা যাওয়ায় আমরা তিন পুত্র বাঁচিয়া ছিলাম। আমার বড় ভাই মরহুম হাসমত আলী চৌধুরী, মেঝ ভাই মরহুম মকবুল আলী চৌধুরী এবং আমি সকলের কনিষ্ঠতম অধম আলতাফ মিয়া(১৪) চৌধুরী। মেঝ ভাই মরহুম মকবূল আলী চৌধুরী পেশায় আর,এস,এন চৌধুরীর স্টীমারে জাহাজের সারেং(১৫) হিসাবে কর্মরত ছিলেন। অধমের ছয় পুত্র ও দুই কন্যা বিদ্যমান আছে। আমাদের পূর্বপুরুষ তোমাদিগকে (ওয়ারিসান) নিয়া আমরা আরব হইতে আসিয়া চট্টলে হাতছোলা আবাদী জমির তরফ দেওয়ানত আলীর মালিক ছিলাম। উক্ত তরক বাকি করের নিলামে চট্টগ্রামের ফতেহ আলী নাজির খরিদ করাতে তাহার বিরুদ্ধে আমার দাদা মরহুম ভূঁইয়া গাজী সিকদার মামলা করেন। বিলাত হাইকোর্ট পর্যন্ত মামলা চালাইয়া ভূঁইয়া গাজী সিকদার সম্পত্তিহারা হন। তৎপর উক্ত ফতেহ আলী নাজিরের পুত্র করম আলী মিয়ার সঙ্গে আপীল মামলায় কতেক সম্পত্তি উদ্ধার করিয়া উক্ত তরকের তালুক বন্দোবস্তী করিয়া করম আলী মিয়াকে বহুব্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। অবশেষে তাহার পুত্র আব্দুল জলীল মিয়া হইতে জমিদারী চলিয়া যায়। তাহার তরক দেওয়াত আলীর কতেক অংশ আরবান আলী সওদাগর ও কতেক অংশ আব্দুল বারী চৌধুরী খরিদ করেন।
মাত্র আট বৎসর বয়সে (১৮৮২ সালে) অধমের পিতা মারা যান। উক্ত পরিস্থিতিতে অধমের মাতা (মরহুমা মোসাম্মৎ রাহাতুন্নিসা চৌধুরানী) পিতৃহীন বালককে প্রতিপালিত করিয়া সামান্য চতুর্থ ক্লাস পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করাইয়াছেন। অধমের বর্তমান বয়স (লিখার সময়কাল ১৯৬২ সাল) ৮৮ বৎসর। এই বৃদ্ধাবস্তায় অধম কলম ধরিতে সাহসী নহি। অধমের উক্ত শিক্ষার দ্বারা কলম চালাইয়া ‘মুন্সি’ উপাধি লাভ করিয়া আপনারা (পুত্র-কন্যা) সকলের প্রতি বিদ্যা শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ আল্লাহ তায়ালা আমাকে দান করিয়া অদ্যাবধি বর্তমান রাখিয়াছেন। ইহাই অধমের লাখ-লাখ শোকরিয়া। আল্লাহ পাক যেন আমাকে ঈমানের সাথে উঠাইয়া নেন—সকলের কাছে সেই দোয়া চাই। বর্তমান সময়ে অধমের মস্তিষ্ক দুর্বল বলিয়া কলম চালাইতে অক্ষম বিধায় অধীন হজ্ব হইতে আসিয়া এম, জেড, আই চৌধুরী (তৃতীয় পুত্র) হাবিব ব্যাঙ্কের ডিপুটি কন্ট্রোলারের বাসায় অবস্থান করিতেছি। আপনারা (এম,জেড,আই চৌধুরী ও এম,এস,আই চৌধুরী) আমাদের বংশের কথা জিজ্ঞাসা করাতে সামান্য-ক্ষুদ্র লিপি করিলাম মাত্র।
পূর্বে কথিত চট্টল ইতিবৃত্তি ও আলাওল কবির পাণ্ডিত্য ভাষায় লিখিত গ্রন্থগুলি হইতে আমি যাহা হৃদয়ঙ্গম করিয়াছি; যাহা অধমের স্মরণাগত আছে—তাহার পুনরাবৃত্তি উল্লেখ করিতেছি। পাঠকবন্ধুগণ আলাওল-বাক্যের ভাব না বুঝিয়া যাহার মনে যাহা লয়, তাহা বর্ণনা করিয়াছেন। আলাওল কবির প্রকৃত মনোভাব না বুঝিয়া ভুল বর্ণনা করিয়া যারযার মনোভাব ব্যাখ্যা করিয়াছেন। অধম বহু পণ্ডিত-সমাজে (মজলিশ) উপস্থিত হইয়া পণ্ডিত-সমাজের ভুল পরিলক্ষিত করি। তম্মধ্যে অধম অজ্ঞান-অন্ধকারের যাহা মনে হয়, তাহাতে মহাকবি আলাওলকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কবি বলিয়া অনুভব করি। মহাকবি আলাওল বাধ্য হইয়া রোসাঙ্গে কারাবরণ করিতেছিলেন। রোসাঙ্গের রাজা সুধর্ম্মার হস্তে বন্দীশালায় আবদ্ধ থাকিয়া আল্লাহ পাকের গুণাগুণ কীর্তন করিতেছিলেন। রোসাঙ্গের মূখ্য উজীর (প্রধানমন্ত্রী) মাগন ঠাকুর(১৬) তাহা শুনিতে পাইয়া বুঝিতে পারিলেন, তিনি একজন পণ্ডিত লোক; তাঁহার কোন দোষ নাই। রোসাঙ্গের আওতায় দেশ ভ্রমনে বাহির হইয়াছে। মাগন ঠাকুর আলাওল মহাকবির পাণ্ডিত্যের কথা রোসাঙ্গের সভাসদ(১৭)দৌলত কাজীর(১৮) মুখে শুনিয়াছিলেন। তিনি আলাওলকে কখনও দেখেন নাই। তাই, দৌলত কাজী পণ্ডিত তাঁহার রচিত ‘সতী ময়না’ নামক পুস্তকটির এগার মাসের বর্ণনা দিয়া বাকি এক মাসের বর্ণনা দিতে অপারগ হইয়া চট্টলের আলাওল পণ্ডিতের নিকট অবশিষ্টাংশ রচনা করিয়া দিতে অনুরোধ করিলে মহাকবি আলাওল দৌলত কাজীর রচিত পুস্তকটি দেখিয়া ভাবিত হইলেন। দৌলত কাজী গুরু সম্বোধনে আলাওলকে জিজ্ঞাসা করিলেন: গুরুজী! বৃদ্ধাবস্তায়ও আপনার মনোভাব আনন্দে উল্লাসিত কেন? মহাকবি আলাওল বলিলেন: গুরুজী, আপনি বর্তমান সময়ে উক্ত পুস্তকে যাহা লিপি করিয়াছেন তাহা আপনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তখন আলাওল একটি বাক্য বলিলেন:
বৃদ্ধকাল হইলে জান মনে জন্মে ভয়, তে কারণে ছেল ছাড়ি লাঠিকে ধরয়।।
তনোবৃদ্ধ হয় জান মনোবৃদ্ধ নয়, যৌবককালের কথা প্রাণে উল্লাসায়।।
তথাতে জালালপুর অতি পূণ্যস্থান।”
উক্ত পদ্যটি আলাওল কবি পদ্মাবতী নামক পুস্তকের ভূমিকায় নিজ পরিচয় ইঙ্গিতে প্রকাশ করিযাছেন। তখন আলাওল রোসাঙ নামক স্থানে যাহা বর্তমানে আরাকান বা আকিয়াব নামে পরিচিত, মগধ রাজার হস্তে বন্দী হইয়া কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন। মগধ রাজার মূখ্য-উজীর সংস্কৃতি-পণ্ডিত মাগন ঠাকুর আলাওলকে বন্ধঘরে দেখিতে গিয়া দেখিলেন: অতি সুন্দর পুরুষ। বন্দীত্বের কারণ বুঝিতে আলাওলের নিকট জিজ্ঞাসা করিলে আলাওল কবি পাণ্ডিত্যভাষায় উত্তর দিলেন। উত্তর শুনিয়া মাগন বুঝিলেন, উনি একজন অভিজ্ঞ জ্ঞানী কবি। তিনি আলাওলকে বলিলেন: আপনি আমার সঙ্গে ভ্রমনে যাইবেন। আলাওল বলিলেন, আমি একজন দোষী ব্যক্তি; বন্দীঘরে আছি; আপনাকে আমি চিনি না। আপনার সঙ্গে বাহির হইলে হয়ত আমার ফাঁসি হইবে। তখন মাগন ঠাকুর নিজ পরিচয় দিয়া বলিলেন: আমি রোসাঙ রাজার উজীর, আমার
সঙ্গে বাহির হইলে কোন দোষ হইবে না। তখন আলাওল বন্দীঘর হইতে বাহির হইতে সম্মত হইলেন এবং মাগন ঠাকুরের সাথে ভ্রমনে বাহির হইলেন। ভ্রমনে বাহির হইয়া মাগন ঠাকুর আলাওলকে ‘পণ্ডিত’ উপাধি দিয়া বলিলেন: দেখেন, পথের ধারে একটি চাই বসানো আছে; তাহাতে মাছও ঢুকিয়াছে। মাগন বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করিতে আলাওলকে অনুরোধ করিলেন। মহাকবি আলাওল ভাবিলেন: আমি যে পণ্ডিত তাহা মাগন জানিল কেমন করিয়া? তিনি পাণ্ডিত্যভাষায় বলেন: স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ দুইটি বাক্য আছে, তদ্বারা ঐ চাইটির বাক্য আরম্ভ হয়। আলাওল বলেন:
ব্যঞ্জনবর্ণের ‘চ’ লই স্বরবর্ণের ‘আ’ ‘ই’,
মেঘ-বৃষ্টি হইলে তারে জলে ফেলাই দি।
জলে ফেলাই দিলে তার পেটে হয় ছা,
হীন আলাওল কহে সাহেব, ভাবি মনে চা।
মাগন বুঝিল, রোসাঙ রাজসভায় দৌলত কাজী বলিয়াছেন, তাঁহার দেশে একজন পণ্ডিত আছেন। তাঁহার নাম—আলাওল। মাগন তখন পথে একটি লঙ্কা (মরিচ) পতিত দেখিয়া আলাওলকে সেইটির পরিচয় দিতে বলিলে আলাওল বলিলেন:
হীন আলাওল কহে, তারে বলে ঝাল।”
মাগন তখন ভাবিলেন, এই লোক তো মহাজ্ঞানী! অতঃপর মাগন একটি পরিত্যক্ত স্বর্ণের বাকলা (বাক্স বা কৌটা) দেখাইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, উহা কি? আলাওল উত্তর করিলেন:
চক্ষু আছে মুখ আছে, নাই তার দন্ত।
পূর্বে খাইত খানা, এখন নাহি খায়,
তাকতো মূর্খে বুঝিবে, পণ্ডিতেও ধন্ধ খায়।।”
উড়ি পড়ে জলের ধারে, জলে আধার খায়।
জলের ধারে পড়ি তারা বলে টকটক,
হীন আলাওল বলে: বলে তারে বক।”
তখন মাগন তাঁহাকে লইয়া আরাকান রাজসভায় চলিয়া গেলেন এবং রাজার নিকট আলাওলের প্রশংসা করিলেন। অবশেষে আলাওলকে রাজসভায় একটি চাকরি দিয়া সভাভুক্ত করিলেন। মহাকবি আলাওল পদ্মাবতীর উপমা বলিয়া সভায় আনন্দিত করিলেন এবং মাগন তাঁহার কিচ্ছা রচনা করিয়া পদ্মাবতী পুঁথি সৃষ্টি করিলেন।
অতি প্রাচীনকালে চট্টলভূমি জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ে সজ্জিত ছিল। সে-সময় চট্টগ্রাম ছিল জিন-পরীর আবাসভূমি। এমনই এক সময় আরব হইতে বার জন আউলিয়া-কুতুব শরের জাহাজযোগে সমুদ্রপথে কুতুবদিয়া নামক স্থানে পদার্পণ করেন। আরবগণ কুতুবদিয়ার পার্শ্ববর্তী স্থান ‘গৌরল’ আবাদ করিয়া তথায় কিল্লা স্থাপন করেন এবং চাষখোলা, বাজালিয়া, মহিষখালি, আন্দরকিল্লা আবাদ করতঃ আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ স্থাপন করেন। এমতাবস্তায়, সমুদ্রের ভাঙ্গনে গৌরল, চাষখোলা ও বাজালিয়ার কতেক অংশ সাগরে পরিণত হয়। কিন্তু কুতুবদিয়া নামক দ্বীপটি সাগরের বক্ষে এ যাবৎ বিদ্যমান আছে এবং উক্ত স্থানে আউলিয়ার পদচিহ্ন আল্লাহ পাক বর্তমান রাখিয়াছেন। আরব জাতি শেখ বংশীয় বার আউলিয়ার আবাদকৃত ভূমি আজ বার আউলিয়ার স্থান নামে পরিচিত, তাহার অপর নাম—ইসলামাবাদ। উক্ত আন্দরকিল্লাস্থ মসজিদে আউলিয়া-কুতুবগণ স্থান লইয়া উত্তরমুখী আবাদ করিতে আরম্ভ করিলে জিন-পরীগণ বাধা প্রধান করে। আউলিয়াগণ মসজিদকে কিল্লা করিয়া যুদ্ধ করিয়া ফতেয়াবাদ পর্যন্ত আবাদ করাতে উক্ত স্থানের নাম—ফতেহ আবাদ, যাহা বর্তমানে ফতেয়াবাদ নামে পরিচিত। ফতেপুরের উত্তর সীমা: আলাওল দীঘি পর্যন্ত আবাদ করার পর জিন-পরীদের বাধার মুখে তদুত্তরে আউলিয়াগণ আর অগ্রসর হইতে পারেন নাই। পরে এই ফতেয়াবাদেই মজলিশ কুতুবের(১৯) রাজধানী স্থাপিত হয়। তখন আরবগণের যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন, হযরত বদর আউলিয়া। অবশেষে জিন-পরীগণের সঙ্গে বদর আউলিয়া এই মর্মে সোলেহনামা করেন যে, আন্দরকিল্লার উত্তরে চাটি পাহাড়ে (বর্তমানে চেরাগীর পাহাড় নামে পরিচিত) একটি প্রদীপ জ্বালাইয়া যতদূর উহার আলো যাইবে ততদূর পর্যন্ত জিন-পরীগণ জায়গা ছাড়িয়া দিবে। অবশিষ্ট স্থান জিন-পরীগণ দখলে রাখিবে। অতঃপর উভয়পক্ষের মধ্যে সোলেহনামা লিখিত হইয়া দস্তখত হইল।
আল্লাহর অপার মহিমা কেহ বুঝিতে পারে না। উক্ত চাটি পাহাড়ের চূড়ায় প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের আলো কুদরতের অপার মহিমাবলে উত্তরে রামগড়; দক্ষিণে কক্সবাজারের মুখ আরাকান তক; পশ্চিমে সন্দ্বীপ এবং পূর্বে লেঙ্গাই পাহাড় তক পৌঁছিয়া যায়। প্রকাশ থাকে যে, পশ্চিমে কাটিরহাটের কোঠের পাড় হইতে পূর্ব আব্দুল্লাহপুর কোঠের পাড় পর্যন্ত জিন-পরীগণের কিল্লা ছিল। অন্য কোন উপায় না দেখিয়া সোলেহনামামতে জিন-পরীগণ কিল্লা ছাড়িয়া চলিয়া যায়। অবশেষে বার আউলিয়া চট্টলভূমি আযাদ ও আবাদ করিতে সক্ষম হন। পরাগল খাঁ আউলিয়া হাটহাজারী থানা, সুলতানুল আউলিয়া রাউজান থানা এবং ঈছা খাঁ আউলিয়া ইছাপুর(২০) হইতে রহিমপুরতক(২১) আবাদ করেন। হাদী বাদশা আউলিয়া ফটিকছড়ি থানা এবং অন্যান্য আউলিয়া অন্যান্য থানা আবাদ করেন। অধমের যাহা স্মরণ আছে তাহার দ্বারা চট্টল ইতিবৃত্তির সামান্য বর্ণনা করিলাম। হয়ত ইহাতে আমার ভ্রমও হইতে পারে।
অক্ষরে না ধরে নাম সাম বিনন্দিয়া।”
মজলিশ কুতুবের অনুমতি লইয়া আলাওল দীঘি খনন করেন যাহা বর্তমানে আলাওল দীঘি নামে পরিচিত। দীঘি খননের জন্য আলাওল যখন ইচ্ছা প্রকাশ করেন, স্বপ্নযোগে তাঁহাকে নিষেধ করা হয়। তথাপি আলাওল পাঁচ দল(২২) খনন করিলে আবারও স্বপ্নে বাধা দিয়া বলা হয়, দীঘিতে জল হইবে না। এইবার আলাওল ছয় দল খনন করিতে উদ্যত হন। এমতাবস্তায়, আল্লাহ পাকের কুদরতে দেখিলেন দীঘির মধ্যখানে একটি নতুন কবর। উহা দেখিয়া মাটিয়ালগণ দীঘি খনন করিবে না বলিয়া জানাইয়া দিল। আলাওল তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন: আমি কবরটি তুলিয়া দিলে আপনারা খনন করিতে রাজি আছেন কি না? আলাওলের কথা শুনিয়া মাটিয়ালগণ খনন করিতে স্বীকৃত হইল। অতঃপর আলাওল নিজহাতে কোদাল লইয়া উক্ত কবরে কোপ দিলে আল্লাহ পাকের কুদরাতে কবর ফাঁক হইয়া গেলে তথায় এক মৃতদেহ কাফনসহ শায়িত দেখিতে পাইলেন। অকস্মাৎ লাশটি ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়া উঠিয়া বসিলে আলাওল ভীত হইয়া পড়েন। তৎক্ষণাৎ লাশটি উঠিয়া যাওয়ার সময় আলাওলকে অভিশাপ দিয়া বলিল, হায়রে নির্বংশীয়া! তোমার জন্য আমি পাঁচ দল নিচেও থাকিতে পারিলাম না। তখন মাটিয়ালগণ আলাওলকে বলিল, ইনি কোন অলিউল্লাহ হইবেন; আপনি তো ভুল করিয়াছেন। আপনি তাঁহার পা চাপিয়া ধরিয়া ক্ষমা চাহিয়া লন। আলাওল উক্ত লাশটির পা ধরিয়া ক্ষমা চাহিলে তাঁহার কথায় কর্ণপাত না করিয়া লাশটি আলাওলকেসহ হেঁচড়াইয়া লইয়া যায়। উল্লেখ্য যে, আলাওল দীঘি হইতে পূর্বমুখী একটি শুকনা খাল ছিল; উহা ‘পোড়াওখালী’ খাল নামে পরিচিত ছিল। খালটি গিয়া হালদা নদীতে পড়িয়াছে। হালদা নদীর নিকটে গিয়া লাশটি আলাওলকে বলিল, তুমি আমাকে ছাড়িয়া দাও! আমি তোমাকে দোয়া করিব; তোমার দীঘিতে পানি হইবে। তোমার নাম কেয়ামততক জারি রহিবে; তোমার কোন আওলাদ থাকিবে না। লাশটি আরও বলিল: দীঘির উত্তরপাড়ে একটি মসজিদ দিবে। মসজিদে তোমার নাম দিবে। তুমি আমার উপদেশ মানিয়া লও; তুমি সমুদ্রভ্রমনে বাহির হইয়া যাও! তখন আলাওল উক্ত লাশকে ছাড়িয়া দিলে লাশটি গায়েব হইয়া যায়। আলাওল তাঁহার কথিতমতে দীঘির পাড়ে মসজিদ স্থাপন করিয়া দেশ-ভ্রমনে ব্রতী হইলেন। আলাওল মজলিশ কুতুবের অনুমতি লইয়া নৌকাযোগে কতেক সৈন্যসহযোগে ভ্রমনে বাহির হইয়া রোসাঙ রাজ্যের সীমায় পৌঁছিয়া যান। রোসাঙ রাজার চৌকিদারগণ আলাওল ও সৈন্যদেরকে দেখিয়া বিদেশী চর বলিয়া সন্দেহ করিল। ইহাতে রোসাঙ রাজার চৌকিদারগণের সাথে আলাওলের সৈন্যদের যুদ্ধ শুরু হইলে আলাওলের সৈন্যগণ নিহত হয় এবং আলাওল রোসাঙ রাজার হাতে ধৃত হইয়া কারাগারে আবদ্ধ হইলেন। আল্লাহ পাকের মর্জি কে বুঝিবে! আলাওল কারাগারে আল্লাহ পাকের দরবারে অবনত হইয়া রোদন করিতে আরম্ভ করিলেন। পরবর্তীতে উজীর মাগন ঠাকুরের সাক্ষাৎ লাভ করিয়া নিজের পাণ্ডিত্যগুণের বদৌলতে আলাওল রোসাঙের রাজসভায় স্ভাসদ পণ্ডিতের স্থান লাভ করতঃ ইতিহাসে মহাকবির আসন গ্রহণ করিলেন।
১) মহাকবি হিসাবে স্বীকৃত আলাওল ছিলেন মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর জন্মসাল ও জন্মস্থান নিয়ে সাহিত্য-পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারো মতে তিনি ১৫৯৭ সালে জন্ম গ্রহণ করেন । আবার কারও মতে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন ১৬০৭ সালে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে আলাওলের জন্মস্থান ফরিদপুর জেলার তৎকালীন ফতেহাবাদ পরগনার জালালপুর গ্রামে। আবার ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের মতে তাঁর জন্মস্থান চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুরের জোবরা গ্রামে। তবে মহাকবি আলাওলের রচনা, স্মৃতি ও স্মারকস্থান বিশ্লেষণ করে ধারণা জন্মে, তাঁর জন্মস্থান চট্টগ্রামে। তৃতীয়পক্ষ বলছেন, আলাওল ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করে থাকলেও তাঁর জীবন কেটেছে চট্টগ্রাম এবং আরাকানে। চট্টগ্রামে স্থিত আলাওল দীঘি, আলাওলপাড়া, আলাওল মসজিদ ইত্যাদি আলাওলের অবস্থানের কথা প্রমাণ করে। ঘটনাচক্রে দেখা যায়, ফরিদপুরের ফতেহাবাদে যেমন জালালপুর গ্রাম ছিল তেমনি চট্টগ্রামের ফতেয়াবাদের উত্তরে অবস্থিত ফতেপুরের পূর্বনামও জালালপুর ছিল। আর জোবরা গ্রামটিও ফতেপুরের অন্তর্ভুক্ত। আলাওলের পূর্ণনাম—সৈয়দ আলাওল। তিনি আরাকান রাজসভার অন্যতম কবি হিসাবে আভির্ভূত হলেও মধ্যযুগের বাঙ্গালী কবিগণের মধ্যে‘শিরোমণি আলাওল’রূপে শীর্ষস্থানের অধিকারী ছিলেন। মহাকবি আলাওল আরবী, ফার্সী, হিন্দী, ব্রজবুলি ও মঘীভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ১৬৭৩ সালে মতান্তরে ১৬৮০ সালে তাঁর ইন্তিকাল হয়।
২) প্রাচীনকালের এক ধরনের কাঠের তৈরি জাহাজ বা নৌযান।
৩) মগধ বলতে বর্তমান ভারতের দক্ষিণ বিহারের পাটনা, গয়া জেলা এবং বাংলার কিছু অংশকে বোঝাত। গয়ার নিকটবর্তী গিরিব্রজ বা রাজগৃহ এর রাজধানী ছিল। মগধ প্রাচীন ভারতে ষোলটি মহাজনপদ বা অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম। ষোলটি মহাজনপদের মধ্যে মগধ বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মগধ সাম্রাজ্যের সময়কাল হল ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ ঈসায়ীপূর্বাব্দ পর্যন্ত । ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক ও মৌলভী আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ ত্রিশের দশকে রচিত ‘আরকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন: মঘদের পূর্বপুরুষেরা কোন এক সময়ে মগধ রাজ্য থেকে আরাকানে এসে কিছুকাল রাজত্ব করেন।
৪) রোসাঙের তৎকালীন শাসক বা রাজা। মূল নাম: সান্দ থুধম্মা (Sanda Thudhamma); ইতিহাসে চন্দ্র সুধর্মা হিসাবে পরিচিত। শাসনকাল: ১৬৫২-১৬৮৪।
৫) কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি দ্বীপ উপজেলা। নানান রকম বৈচিত্র্য পরিপূর্ণ এই দ্বীপটির আয়তন প্রায় ২১৬ বর্গ কিলোমিটার। এই দ্বীপে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সমুদ্র সৈকত, লবণ চাষ, বাতিঘর এবং কুতুবুদ্দীন আউলিয়ার মাজার। জানা যায়, স্থানীয়ভাবে ‘দিয়া’ অর্থ দ্বীপ।সে অর্থে কুতুবুদ্দীনের দিয়া বা দ্বীপ।ওলী কুতুবুদ্দীন বার আউলিয়ার অন্যতম কি না জানা যায় না।
৬) বর্তমানে বাজালিয়া নামক কোন স্থানের অস্তিত্ব নেই।
৭) ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার জাহাজ চলাচলের উপযোগী করে চট্টগ্রাম নৌবন্দর গড়ে তোলে। প্রাথমিকভাবে দুটি অস্থায়ী জেটি তৈরি করা হয়েছিল। এরও বহ আগে থেকে চট্টগ্রামে জাহাজ চলাচল করতো। এই কারণে ব্রিটিশদের চট্টগ্রাম নৌবন্দর উন্নয়নের বেশ আগে থেকে কুতুবদিয়ায় বাতি ঘর তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমান বাতিঘর ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে কর্ণফুলি নদীর মোহনার ৪০ মাইল দূরে কুতুবদিয়াতে এই বাতিঘরটি নির্মাণ করা হয়। ক্যাপ্টেন হেয়ার-এর পরিচালনায় এবং ইঞ্জিনিয়র জে,এইচ,টুগুড -এর নকশায় এই বাতিঘর নির্মাণ করা হয়। ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে এই বাতিঘরটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। সেই সময়ে এর নির্মাণ ব্যয় ছিল ৪৪২৮ টাকা। এই বাতিঘরের ভিত্তিভূমিতে পাথর স্থাপন করা হয় এবং ভিত্তির উপর গড়ে তোলা হয় ১২০ ফুট উচ্চতার টাওয়ার। টাওয়ারটির মাটির নিচে একটি কক্ষ ছিল। ভূপৃষ্ঠ থেকে টাওয়ারে অংশে ছিল ১৫ ফুট উচ্চতার ১৫টি কক্ষ। সে সময় প্রায় ২২০ কিলোমিটার দূর থেকে এর আলো রাতের জাহাজ-নাবিকরা দেখতে পারতো। পাকিস্তান আমলে এই টাওয়ারটি নতুন করে নির্মাণ করা লৌহ কাঠামোর উপর। এই টাওয়ারের প্রাচীন আলোক-উৎপাদন প্রক্রিয়া বাতিল করে আধুনিক পদ্ধতি চালু করা হয়। পরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পাকিস্তান আমলেই এই বাতিঘরটি অকেজো হয়ে পড়েছিল। পরে ক্রমাগত সমুদ্রের ভাঙ্গনের মুখে এই বাতিঘরটি বিলীন হয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুতুবদিয়ার দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নে একটি নতুন বাতিঘর নির্মিত হয়েছে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে। এই বাতিঘরটি তৈরি করা হয়েছে ইস্পাতের কৌণিক দণ্ড ব্যবহার করে। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ঘূর্ণিঝড়ে একমাত্র ওয়্যারলেস যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে গেছে।
৮) হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের অধীন একটি এলাকা।
৯) 'ফতেহ' শব্দ থেকে 'ফতেহপুর' এবং তা থেকে 'ফতেপুর' নামের উৎপত্তি। ফতেপুর অর্থ, বিজয়ের স্থান। ফতেপুর ও ফতেয়াবাদের পাশাপাশি অবস্থান। ফতেয়াবাদ নামটিও ফতেহ আবাদ থেকে উৎপত্তি। যার অর্থ বিজয়স্থান আবাদ। ফতেপুরের জোবরা মৌজায় বর্তমানে মাইজপট্টিতে সুলতান রোকন উদ্দীন বারবক শাহের রাজধানী ছিল। ফতেপুরের পশ্চিম পট্টির পাহাড়ে ছিল আরাকানী মগ রাজার রাজধানী। ১৫২৫ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের সুলতান নশরত শাহ উত্তর চট্টগ্রামসহ দক্ষিণের শঙ্খ নদীর তীর পর্যন্ত আরাকানী মগ রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয় করেন। বর্তমানে ফতেপুর ইউনিয়ন হাটহাজারী উপজেলার আওতাধীন ১১নং ইউনিয়ন পরিষদ। এটি জাতীয় সংসদের ২৮২নং নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রাম-৫ এর অংশ।
১০) লাখেরাজ : আরবি শব্দ, অর্থ নিষ্কর বা করমুক্ত । মুগল শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল লাখেরাজ ভূমি অথবা কর বা খাজনা মওকুফকৃত জমি। হিন্দু শাসনামলেও বিভিন্ন কারণে অনুগ্রহপুষ্ট ব্যক্তিদের রাজকীয় কর্তৃত্ব দ্বারা নিষ্কর ভূমি অনুদান প্রদানের নিয়ম প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় স্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তীর্থস্থান, মন্দির ইত্যাদির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত ছিল। মুগল শাসকদের অধীনে এই ঐতিহ্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব লাভ করে। বাজেয়াপ্তী: বাজেয়াপ্তকৃত।
১১) জমিদারী. ভূসম্পত্তি, ভূমধ্যধিকার; সরকার বা জমিদারের নিকট হতে বন্দোবস্ত করে নেয়া ভূসম্পত্তি। ভূসম্পত্তির একটি বিশেষ অংশের মালিককে তালুকদার বলে অভিহিত করা হয়। সুলতানি, মোঘল এবং ব্রিটিশ আমলে তালুকের ভূস্বামীদের তালুকদার বলা হতো। তালুকদার বাংলাদেশ, ভারতে মুসলিম এবং হিন্দুদের পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
১২) সোনা রূপা মুদ্রাদির বিশুদ্ধতা পরীক্ষক; জিনিসপত্র বন্ধক রেখে ধার দেয় যে ব্যক্তি, মহাজন।
১৩) আর, এস জরিপের ৬৮১১ নং দাগ, যা বড়পুকুর হিসাবে পরিচিত। ডাইনজুরী থেকে বাবুনগর মাদরাসা রোড দিয়ে উত্তরমুখী কবরস্থানসংলগ্ন; বর্তমানে নাল জমি। এ জমি পরবর্তীতে মরহুম মুন্সি আলতাপ মিয়া চৌধুরীর তৃতীয় পুত্র মরহুম মুহাম্মাদ জহুরুল ইসলাম চৌধুরী জামিয়া আরবিয়া নছিরুল ইসলামের কাছে (নাজিরহাট বড় মাদরাসা) বিক্রি করেন, তবে পিতার ইচ্ছানুযায়ী কবরস্থানটি সমাজের সাধারণ মুসলমানদের দাফনের জন্য ওয়াকফ করেন।
১৪) মুন্সি আলতাফ মিঞা চৌধুরীর মূল নাম ছিল তাঁর পিতা ও ভাইদের অনুকরণে আলতাফ আলী চৌধুরী। পরবর্তীতে লোকসমাজে ‘মুন্সি’উপাধি লাভ করার পর তিনি তৎকালীন বৃহত্তর ফটিকছড়ি থানায় (উত্তরে মানিকছড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত) অন্যতম প্রধান গণ্যমান্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। এরপর থেকে মানুষ তাঁকে সম্মানজনক সম্বোধন ‘মিয়া’ বলে অভিহিত করতে থাকলে তাঁর নাম হয়ে যায়—মুন্সি আলতাফ মিয়া চৌধুরী। বিষয়টি পুরাতন খতিয়ান ও দলীলে দেখা যায়।
১৫) নদী বা সমুদ্রগামী স্টীমার বা জাহাজের প্রধান মাঝি বা পরিচালক; সমুদ্রগামী জাহাজের প্রধান মাল্লা।
১৬) তৎকালীন রোসাঙ-রাজ রাজা সুধর্মার প্রধান উযীর। মনে রাখা প্রয়োজন, মাগন ঠাকুর কোন অমুসলিম ব্যক্তি নন। তিনি মূলতঃ মুসলিম। তিনিই মহাকবি আলাওলকে বন্দীশালা থেকে মুক্ত করে আশ্রয় প্রদান করেন। ড. এনামুল হক ও আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদের গবেষণানুসারে, মাগন আরবের কুরাইশী শেখ-বংশজাত সিদ্দীকি গোত্রভুক্ত মুসলমান ছিলেন। তাই তিনি ‘কোরেশী মাগন ঠাকুর’ নামেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর নিঃসন্তান পিতামাতা দীর্ঘদিন আল্লাহর দরবারে ‘মাগিয়া’ (আরাধনা করে) সন্তান লাভ করায় আদর করে তাঁকে ডাকা হয়—মাগন। আর ঠাকুর তৎকালীন রোসাং-রাজ প্রদত্ত সম্মানজনক উপাধি। কবি মাগন ঠাকুরের পিতাও ‘বড় ঠাকুর’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। লেখার শব্দ ব্যবহারে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে, মাগন ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল চট্টগ্রামে। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, তিনি আরবী, ফার্সী, বর্মী ও সংস্কৃত ভাষা জানতেন।বাংলা ভাষায় তাঁর কতোখানি অধিকার ছিলো, “চন্দ্রাবতী” কাব্যই তাঁর জ্বলন্ত নিদর্শন।
১৮) দৌলত কাজী (কাজী দৌলত) নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন মধ্যযুগের একজন বাঙালি কবি। তিনি ১৭শ শতাব্দীর প্রারম্ভে কোন এক সময় চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে সুলতানপুরের কাজী পাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি আরাকান রাজসভার কবি ছিলেন, যদিও তার লেখার ভাষা ছিলো বাংলা। মধ্যযুগের অন্যান্য কবিদের মত তার কাজে তার পৃষ্ঠপোষক সম্পর্কে বর্ণনা থাকলেও নিজের সম্পর্কে তিনি কিছুই লিপিবদ্ধ করে যাননি। তিনি ‘সতী ময়না’ ও ‘লোর চন্দ্রানী’ কাব্য রচনা করে বাংলার শক্তিমান কবিদের মাঝে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন। সম্ভবত ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। গবেষকদের মতে আরাকান রাজ্যের আকিয়াবের কোনো এক স্থানে তাঁর কবর রয়েছে।
১৯) তৎকালীন জালালপুরের রাজা। মহাকবি আলাওলের পিতা এই মজলিশ কুতুবেরই মন্ত্রী ছিলেন।
২০) বর্তমান ফটিকছড়ি উপজেলার উত্তরাংশের জাহানপুর ইউনিয়নের পূর্বনাম। ইছাপুর থেকে যে রাস্তা দক্ষিণে গিয়ে হাটহাজারী উপজেলার মেখল ইউনিয়নে যুক্ত হয়েছে, সেটাই ইছাপুর রাস্তা হিসাবে পরিচিত। পরবর্তীতে মেখলের সেই সংযোগস্থলটিই ইছাপুর রাস্তার মাথা নামে পরিচিত হয়ে উঠে। প্রকৃতপক্ষে হাটহাজারীতে ইছাপুর নামে কোন স্থান নেই।
২১) হাটহাজারী উপজেলার মেখল ইউনিয়নের একটি গ্রাম—রহিমপুর।
২২) চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় দল অর্থ স্তর। অর্থাৎ, পাঁচ দল মানে পাঁচ স্তর
সমাপ্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন