আজকের ভাবনা

জামায়াতে ইসলামের সাথে কওমীদের ঐক্য কি আদৌ সম্ভব?

ভাবনা-৫০

বাংলাদেশে ইসলাপন্থীদের ঐক্য নিয়ে আলোচনার হায়াত অনেক দীর্ঘ এক সময় ঐক্যের শেকল-সূরাত নিয়ে বিস্তর বাহাস হতো কারণ, যাদের নিয়ে ঐক্যের ডাক দেয়া হয় তাদের মতান্তরের ক্ষেত্র ছিলো বিষমবাহু দ্বারা বেষ্টিত ফলে আলোচনার মৃত্যু না হলেও সবল হতে পারেনি ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফতে রাব্বানী, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (ইডিপি) ও ইমারত পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ সংক্ষেপে আইডিএল। এই ঐক্যবদ্ধ দলের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ ও ভাইস চেয়ারম্যান মাও. মুহাম্মদ আবদুর রহীম। আইডিএল ১৯৭৯ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ২০টি আসনে জয়লাভ করে যার মধ্যে জামায়াত পায় ৬টি আসন। এ সময় মাওলানা আব্দুর রহীমের নেতৃত্বে পার্লামেন্ট অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে আইডিএল ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এ জোট স্থায়ী ছিলো। পরে জামায়াতের কৌশলগত রাজনীতিসৃষ্ট মতভিন্নতার কারণে জোট ভেঙ্গে যায়। বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের একটি বৃহৎ বলয় হলো কওমী-জগৎ কওমী মাদরাসাভিত্তিক আলিম-উলামা নিয়ে কওমী-জগতের অস্তিত্ব কওমীরা পরিচয়ের দিক থেকে ঐতিহ্যগত ইসলামের ধারক ও বাহক কথিতমডারেট ইসলামের ধারণাকে তাঁরা স্বীকার করেন না তাঁদের কাছে সেটা আপোষকামীতা বা বিকৃতকরণের আধুনিক প্রকাশ তাই তাঁদের সাথে অন্য দলের ঐক্যপ্রশ্নে সরলরেখা প্রলম্বিত হয় না এখানে আরও একটি বিষয় ধর্তব্য তা হলো, কওমী-জগতের কাছে বিশ্বাসগত বা ইসলামের মৌলিক শর্তসমূহের নিরাপত্তা অগ্রাধিকার বলে বিবেচিত যেসব ঐক্য তাঁদের কাছে সন্দেহজনক বা ইসলামের মৌলিক শর্তসমূহকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয় না বলে সন্দিগ্ধ হয়, সেখানে কওমীদের উপস্থিতি থাকে না বা সাময়িককাল পরে সরে যায় অনেকে তাঁদেরকে দুনিয়াবিচ্ছিন্ন একটি গোষ্ঠী বলে বিবেচনা করতো কিছুদিন আগেও কওমীদের সম্পর্কে সাধারণের একটি বৃহদাংশের ধারণা ছিলো: তাঁরা মেধাহীন, দরিদ্র জনগোষ্ঠী থেকে উদ্গত বিজ্ঞান ও রাজনীতি তাঁদের কাছে সদূর প্রবাসী কিন্তু কালের উত্তরণে সে ধ্যানধারণা এখন কেবল ইতিহাস এখনকার কওমী-প্রজন্ম সবকিছুকে জানতে চায়; বুঝতে চায় উদারনৈতিক চিন্তার উম্মেষ ঘটেছে বলা যায় এখানে এক সন্ধিক্ষণের ধ্বনি শোনা যায় যা কওমীদেরকে বাস্তবতার উপলব্ধি ও ঐতিহ্যের দ্বন্দ্বকে তুলামূলক ধারণার ভিত্তিতে পা ফেলার পথ দেখায় তবুও তাঁরা কথিত মডারেট ইসলামকে মানতে অনিচ্ছুক এর বড় কারণ তাঁদের সনাতনী সতর্কতা

৮০র দশক থেকে যখন এ দেশের কওমীরা রাজনীতি সচেতন হওয়া শুরু করলো, নির্বাচনে দাঁড়ানোর সাহস সঞ্চয় করলোসেদিন থেকে কওমী আলিম-উলামা সম্পর্কে সাধারণের ধারণা বদলাতে শুরু করে আমীরে শরীয়াত মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযুর রহ. কর্তৃক গঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের কথা নবপ্রজন্ম না জানলেও ইতিহাসে তা রক্ষিত আছে আমার এখনও মনে আছে, হাফেজ্জী হুযুর যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়ান অনেকেই কটাক্ষের তীর ছুঁড়েছিলেন ১৯৮১ ও ১৯৮৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাফেজ্জী হুযুরের যথাক্রমে তৃতীয় ও দ্বিতীয় স্থান লাভ কওমীদের মাঝে নতুন রাজনীতিক চেতনার উম্মেষ ঘটায় সে সময় এমন ধারণা বহুল পরিচিতি পেয়েছিলো যে, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে প্রকৃতপক্ষে হাফেজ্জী হুযুর রহ. প্রথম হয়েছিলেন কিন্তু জেনারেল এরশাদ সেটাকে পরিবর্তন করে দেন এ ধারাবাহিকতায় জাতি কওমীদের শক্তি, সামর্থ্য ও দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে বুঝতে পারে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ মুজিবহত্যা পরবর্তী প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করলে ইসলামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার কারণে কওমীদের কাছে ঐক্যের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তাঁরা তাঁদের সহজ মিত্র বলে পরিচিত বিএনপির সাথে চার দলীয় জোট গঠন করে যেখানে জামায়াতও অন্যতম শরীক দল ছিলো পরিস্থিতির কারণে সে-সময় কওমীরা জোট গঠন করলেও জামায়াতকে নিয়ে স্বস্তিতে ছিলো না ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতা গ্রহণ করলে ইসলামপন্থীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে বিশেষত, ২০১৩ সালে সংগঠিত শাপলার গণহত্যার পর আওয়ামী লীগ একদিকে মামলা-হামলা দিয়ে হেফাজতে ইসলামকে দমনে প্রবৃত্ত হয় পাশাপাশি কওমীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে সরকারপন্থী দালালশ্রেণী তৈরিতে মনযোগী হয় তাতে তারা কিছু-কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়এতে আওয়ামী লীগের প্রতি চরম মাত্রায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে কওমী-জগৎ অবশেষে ছাত্রদের কোটাবিরোধী ও সরকার পতনের আন্দোলনে স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করে কওমী আলিম ও ছাত্ররা তাঁদের মধ্যে কমবেশি পঞ্চাশ জন শহীদও হন বলে জানা যায়

এমন পরিস্থিতিতে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নেই, প্রশ্ন উঠতে পারে: জামায়াতের সাথে কওমীদের ঐক্য সম্ভব কি না? উচিৎ কি না? কেন এখন জামায়াতের সাথে ঐক্য অনিবার্য হবে? কেমন ঐক্য হবে? এসব প্রশ্নের সুরাহা না করে সামনে পা ফেলা সহজ হবে না এখানে বলে রাখি, প্রথমেই জানতে হবে কওমীদের অভ্যন্তরীণ বাহাসকে (Internal debate) যা সবসময় তাঁরা মৌলনীতি, দৃষ্টান্ত ও যুক্তির মাপকাঠিতে পরিমাপ করে তা না জেনে নিজ থেকে জামায়াতের সম্মেলনে হাযির হয়ে ঐক্য-ঐক্য করলেও ঐক্য হবে না অভ্যন্তরীণ বাহাসে কওমীরা কোন-কোন বিষয়ে বহুধা-বিভক্ত হয়ে পড়লেও এক সময় এমন জায়গায় এসে ঐক্যমত্য হয় যা তাঁদেরকে অনড় করে তোলে যেমন, সুন্নাহ ও বিদআতপ্রশ্নে; ধর্মনিরপেক্ষতাপ্রশ্নে; বামপন্থী রাজনীতিপ্রশ্নে তাই, কওমীদের পাঠাভ্যাসেতাকরারবা সমষ্টিগত পাঠ-পর্যালোচনার গুরুত্ব যেমন অপরিসীম তেমনি তাঁদের সমষ্টিগত কোন সিদ্ধান্তে অভ্যন্তরীণ বাহাসের গুরুত্বও অনস্বীকার্য এদিকটি এড়িয়ে গেলে চলবে না।

কওমীদের সাথে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য ইসলামী দলের ঐক্য নিয়ে কথা কম হয়নিবলেছি, স্বাধীনতার পর থেকে হয়ে আসছেযদ্দূর মনে পড়ে ৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঐক্য নিয়ে হযরত হাফেজ্জী হুযুরের সাথে বসেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতৃবৃন্দতখন মাঠ পর্যায়ে আমীর ছিলেন আব্বাস আলী খানবিষয় ছিলো, ঐক্যকিন্তু হাফেজ্জী হুযুরের সাথে কয়েক দফা বৈঠক হলেও সফলতা আসেনিতখন শুনেছিলাম, হযরত হাফেজ্জী হুযুরের শর্তানুসারে জামায়াত নেতৃবৃন্দ আরও বসার কথা দিয়েও আর আসেননিপরে হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ. লিখলেনসতর্কবাণীপুস্তিকাযা হোক, সেই শেষবারের মতো জামায়াতের সাথে ঐক্যের দফারফা হয়ে যায়পরবর্তী সময়ে কখনও ডানপন্থী কখনও ইসলামী দলগুলোর ঐক্য নিয়ে কথা উঠলেও তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি১৯৯৯ সালে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি ইসলামী ঐক্যজোটের সমন্বয়ে চার দলীয় জোট গঠিত হলেও সেটা ছিলো নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক জোট

অতিসম্প্রতি স্বৈরাচারিনী খুনি শেখ হাসিনার পতনের পর জামায়াতকে নিয়ে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য নিয়ে আবারও কথা উঠেছেতবে এবারের চিত্রটা একটু ভিন্নজামায়াতের বর্তমান আমীর আহুত একটি বৈঠক হয় তাদের ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়েপত্রিকার ভাষ্যমতে, সেখানে কওমী ঘরানার ১৫ থেকে ২০ জন আলিম নেতৃবৃন্দ যোগ দেনপত্রিকার শিরোনাম ছিলো: জামায়াতের নেতৃত্বেই ইসলামী রাষ্ট্র গঠন সম্ভব: কওমি আলেমরা’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫শে আগস্ট ২০২৪)সেখানে যুগ্মমহাসচিব পদবিধারী হেফাজতের একজন সদস্যও ছিলেনতাঁদের কথায়:

আমিরে জামায়াত সব মারকাজের আলেমদেরকে একত্রিত করে সবাইকে ধন্য করেছেন। আমাদের এই ঐক্য বা হাজারো ঐক্য কোনও কাজে আসবে না, যদি আমরা ব্যালটের যুদ্ধে একত্রিত হতে না পারি। আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক দেশ। তাই আমাদেরকে গণতান্ত্রিক সিস্টেমে আগাতে হবে।…….‘দল-মত-নির্বিশেষে আমাদের এক হতে হবে। আমাদের অতীতের সব ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে। …….‘আমরা ঐক্য ঐক্য বলতেছি। কিন্তু আমরা তো ঐক্যবদ্ধ ছিলামই। মাঝে কিছুদিন আমরা দূরে সরে গেছিলাম।বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা সকলেই নির্যাতিত হলাম। এখন আমাদের সবাইকেই আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের সব থেকে বড় ইসলামী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। মুহতারাম আমিরে জামায়াতের সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী মানুষ। তাই আমার বিশ্বাস, তিনিই পারবেন আমাদের সবাইকে এক প্লাটফর্ম-এ দাঁড় করাতে, ইনশাআল্লাহ।……‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ডাকে আমরা সবাই একত্রিত হতে পেরেছি, সে জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। আমার জানা মতে, জামায়াতে ইসলামীর আমির প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখেন। তিনি একজন মুখলিস ব্যক্তি। যদিও সরাসরি প্রশংসা করা ঠিক না, তবুও জানার জন্য বলছি। তাই আমার মন বলে যে, তার দ্বারাই একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ।

এখানে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করতে হয়প্রথমত, যাঁরা জামায়াত আহুত সম্মেলনে গেছেন তাঁরা কি স্বউদ্যোগে গেছেন না কি প্রতিষ্ঠানিকভাবে গেছেন? তাঁরা যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গিয়ে থাকেন তবে হেফাজত বা কওমী-মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়েই কি গেছেন? সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলে তা প্রকাশ করা হয়নি কেন? জামায়াত আহুত সম্মেলনে তাঁরা যে ঐক্যের কথা বলেছেন তা কি হেফাজত বা কওমী-মাদরাসা কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত? তাঁরা যদি ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে জামায়াতের নেতৃত্বে শরীক হবেন তবে কওমী-মহল কি জামায়াতের নেতৃত্ব মেনে নেবার কথা বলেছে? এসব প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া প্রয়োজনআমরা অতীতে দেখেছি, কওমীরা জামায়াতের নেতৃত্ব দূরে থাক জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্টতাও মানতে নারাজযেমন, হেফাজতে ইসলামের বর্তমান আমীর এবং কওমী-জগতের মুরুব্বী মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর ২০২১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠে প্রকাশিত বক্তব্য 

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে হেফাজতের আঁতাতের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের আদর্শিক কোনো সম্পর্ক নেই। বরং কওমি আলেমরা জামায়াতের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে সব সময়দেওবন্দের অন্যতম অলি আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানি জামায়াতের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। আমরা তাঁর অনুসারী হিসেবে এখনো জামায়াতের বিরুদ্ধে কথা বলি। তাই জামায়াতের সঙ্গে কওমিদের কোনো ঐক্য হতে পারে না। আদর্শিক কারণেই কওমিদের সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। রাজনৈতিক স্বার্থে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করেছে। কিন্তু হেফাজতের সঙ্গে জামায়াতের এখনো কোনো জোট হয়নি। হেফাজতের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই বলে দাবি করেন তিনি।

জামায়াতে ইসলামীর সাথে ঐক্যপ্রশ্নে প্রথমেই কতোগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হবেপ্রথমত, কওমীদের কাছে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থানদ্বিতীয়ত, জামায়াতপ্রশ্নে কওমীদের ঐতিহ্যগত বিরোধিতার পুনর্মূল্যায়ন এবং তৃতীয়ত, জামায়াতের সাথে ঐক্য কি শর্তযুক্ত হবে না কি শর্তমুক্ত হবে? জামায়াত ঐক্যের স্বার্থে কওমীদের কতোটুকু ছাড় দিতে প্রস্তুত হবে? কারণ, অতীতে যতোবার ঐক্যের প্রশ্ন উঠেছে ততোবার উক্ত সমস্যাগুলোই অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছেকওমীদের কাছে জামায়াতের রাজনীতিক ধারণা পরিস্কার নয়এখানে আরও একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্যতা হলো, জামায়াতের রাজনীতি সাধারণ রাজনীতি নয়জামায়াতে ইসলামী তাদের বিশেষায়িত একটি মিশনারী রাজনীতিতে(Missionary Politics) বিশ্বাসী যা কওমীদের কাছে আপত্তিকরতারা কেবল নির্বাচনমুখী রাজনীতি করে না, পাশাপাশি তারা তাদের রাজনীতিক আদর্শমওদূদী মতবাদ প্রচার করে থাকেঅভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, তাদের মন-মস্তিষ্কে মওদূদী মতবাদের প্রভাব বেশ পরিপুষ্টসে জন্য কওমীরা সাধারণত জামায়াতকে মূলধারার ইসলামী দল বলে স্বীকার করতে নারাযকওমীরা যেসব পঠন থেকে তাঁদের মূ্ল্যবোধ আহরণ করে থাকে জামায়াত সেগুলোকে সযত্নে এড়িয়ে যায়তাঁরা নিজেদেরকে কথিত মডারেট ইসলামের অনুসারী হিসাবে দেখতে স্বস্তি বোধ করেপক্ষান্তরে, কওমীরা জামায়াতের মওদূদী মতবাদভিত্তিক ধ্যানধারণাকে পরিহার এবং প্রতিরোধ করেএখানেই জামায়াতের সাথে কওমী-জগতের ঐক্য বাধাগ্রস্থ হয়হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ.- প্রকাশিতসতর্কবাণী হেফাজত আমীর হযরত মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর বর্ণিত বক্তব্য এর প্রধানতম দলীল

এখন প্রশ্ন হলো, কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে বৃহত্তর স্বার্থে কওমীরা জামায়াতের সাথে ঐক্য গড়তে পারে কি নাএখানে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ আছেপ্রথমে কওমীদেরকে দুটি বিষয়ে পরিস্কার অবস্থান নিতে হবেএক, জামায়াতকে কি তারা একটি ধর্মীয় জোটসঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করবেন না কি নিছক রাজনীতিক সঙ্গী হিসাবে নেবেন? আমি আগেই বলেছি, কওমীদের অভ্যন্তরীণ বাহাসের কথাসেখান থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবেযদ্দূর মনে হয়, জামায়াতকে কওমীদের ধর্মীয় জোটসঙ্গী হিসাবে বেছে নেয়া দুষ্কর হবেকারণ, এখানে কওমীরা অনড় অবস্থান গ্রহণ করবেতবে, রাজনীতিক সঙ্গী হিসাবে বেছে নেয়া অধিকতর সহজ হবে যেখানে মিশনারী রাজনীতির সুযোগ থাকবে নাযেমন, ২০০২ সালে পাকিস্তানে গঠিতমজলিসে মুত্তহিদা আমল(এএমএ)’ কথা এখানে উদাহরণ হিসাবে নেয়া যেতে পারে জোটের শরীকরা ধর্মীয় হলেও উদ্দেশ্য ছিলো জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে নির্বাচনে প্রতিরোধ করা জোটের শরীকরা ছিলো: জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, তাহরিকে জাফরিয়া পাকিস্তান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (ফজলুর রহমান), জমিয়তে আহলে হাদীস এবং জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানতাঁরা সে বছর পাকিস্তান জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৪২ টি আসনের মধ্যে ৬৩টি আসনে এবং সিনেটে ১০০টি আসনের মধ্যে ৬টি আসনে জয়ী হয়ে খাইবার পাখতুন খাহ্প্রদেশে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে২০১৮-তে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী জোট থেকে বেরিয়ে যায় ছাড়া আমাদের দেশে গঠিত ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ বা আইডিএল কথা তো আছেই১৯৫৪ সালের পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে গঠিত যুক্তফ্রন্টের কথাও উল্লেখ করা যায়তখন আওয়ামী মুসলিম লীগ(মাও.ভাসানী), কৃষক-শ্রমিক পার্টি(শেরে বাংলা), নেজামে ইসলাম পার্টি(মাও.আতহার আলী), বামপন্থী গণতন্ত্রী পার্টি(হাজী মোহাম্মদ দানেশ) খিলাফতে রব্বানী পার্টিসহ মোট পাঁচটি দল জোটগতভাবে শাসক দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেএতে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসনে জয়লাভ করে মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে

জামায়াতের রাজনীতির আরেকটি বিশেষ দিক যা অন্যদের কাছে বিরক্তিকর বলে বিবেচিতসেটা হলো, তাদের আধিপত্যবাদী মানসিকতাকারও সাথে তাদের জোট হলে দল হিসাবে তারা অপেক্ষাকৃত কতো বড় বা ছোট সেটা বিবেচনায় না নিয়ে তাদের আধিপত্যকে অগ্রাধিকার দিতে সচেষ্ট থাকেএদিকটাও তাদের জোটসঙ্গীকে বিব্রত করে২০১০ সালে চট্টগ্রামের পোলোগ্রাউন্ড মাঠে চারদলীয় জোটের এক সম্মেলন হয়সেখানে সভাপতিত্ব করেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াবিএনপি তুলনায় তাদের আকার ছোট হলেও তারা মঞ্চের সামনের জায়গাটা সকাল দশটা থেকেই দখল করে বসে থাকে নিয়ে বেশ বিশৃঙ্খলা হয় ধরনের মানসিকতা জোটসঙ্গীদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহবাসের অন্তরায়স্বাধীনতা পরবর্তী জোট আইডিএল দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হয়েছিলো জামায়াতে ইসলামীর মানসকিতার কারণে বলে আমাকে নিশ্চিত করেন চারদলীয় জোটের চট্টগ্রাম জেলার সাবেক সমন্বয়ক জনাব আব্দুর রহমান চৌধুরী এবং বিশিষ্ট লেখক সাবেক জমিয়ত সম্পাদক মাও. আব্দুর রহীম ইসলামাবাদীতাঁরা দুজনেই সে সময় তরুণ বয়সে আইডিএল পরিণতি দেখেছিলেন

পরিশেষে বলতে হয়, কওমীদের সাথে জামায়াতের ঐক্য একদিনে একটি মাত্র সভা থেকে ডাক দিলেই হয়ে যাবে নাএগুলো আবেগধর্মী অদূরদর্শী শব্দগুচ্ছ ছাড়া আর কিছু নয়এখানে অনেক কিছুর যোগ-বিয়োগ বাকি রয়ে গেছেসেগুলো সম্পন্ন না করে হৈ-হল্লার ঐক্য  কেবল পেপারে উঠে বক্তাকে প্রশস্তি দেবে, অশ্ব ডিম্বই প্রসব করবে।  আমার মনে হয় না, জামায়াতের সাথে কওমীদের কোন ফলদায়ক ঐক্য হবার সিদ্ধান্ত আসবেকারণ, অনৈক্য বিরোধিতার শেকড় অনেক গভীরে, অনেক অতীতে।  আরও একটি বিষয় আমাদের সামনে রাখতে হবেতা হলো, জামায়াত প্রচলিত রাজনীতির মাঠে অনেক পারদর্শী যেখানে কওমীদের অবস্থান শূণ্যের কাছাকাছিএই অসম অবস্থানও বিবেচনায় রাখতে হবেচারদলীয় জোটের কথা মনে করুন, জোটে থেকে জামায়াত বিএনপি থেকে দর কষাকষি করে অনেক কিছু অর্জন করতে পেরেছে কিন্তু ইসলামী ঐক্যজোট পারেনিঅথচ চারদলীয় জোটের ভূমিধস জয়ে কওমীদের সিংহভাগ অবদান ছিলোঅভিযোগ ছিলো: জোট জয়ী হবার পর জামায়াত এদিকে যেমন নিজেদের অবস্থান সুসংহত করায় সচেষ্ট থেকেছে অন্যদিকে জোট সরকারে কওমীদের যেনো কোন প্রভাব সৃষ্টি না হয় সেদিকেও জামায়াতের তদবীর ছিলোবিষয়গুলো কওমীদের অভ্যন্তরীণ বাহাসে উঠে আসবে না, তেমন ভাবা হাস্যকরতাই, ঐক্য নির্বাচনমুখী হলেও মূলরস যে কওমীদের গলা সিক্ত করবেসে গ্যারান্টি কোথায়? হতে পারে বেলো শেষে দেখা যাবে, পানিটুকু উবে গেছে খালি কলসিই কেবল কওমীর ভাগ্যকে অলংকৃত করেছেআমি ব্যক্তিগতভাব মনে করি, জামায়াতের সাথে কওমীরা ঐক্যে না গিয়ে সম্ভব হলে কেবল সমভাবাপন্ন দল নিয়ে একটি ঐক্য গড়া উচিৎ সেটা নির্বাচনমুখী হবে কথা নেই, সমাজমুখী হোকসম্পর্ক ক্ষমতার সাথে না হোক, মানুষের সাথে হোক

01.09.2024 Mail: gr.islamabadi@gmail.com 




শাপলা: এক রক্তাক্ত আমানত

-------------------------------------------

মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী
শিক্ষক, লেখক ও কলামিস্ট

(অনুসন্ধান)


২০১৮ সালের ৪ঠা নভেম্বর, রোববার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মিলিত কওমী মাদরাসার সমন্বয়ে গঠিত হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়াহ কর্তৃক আয়োজিত আলোচিত 'শোকরানা মাহফিল'-এ সরকার-প্রধান শেখ হাসিনার সামরিক সচিব মেজর জয়নাল আবেদীনের দেয়া একটি বক্তব্যকে ঘিরে পুরো কওমী-জগৎ উত্তপ্ত। উক্ত সমাবেশে সামরিক সচিব 'অপ্রাসঙ্গিক' স্বীকার করে দাবি করেন : ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা-চত্বরের ঘটনা নিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। সেদিন হতাহতের কোন ঘটনা ঘটেনি। তিনি আরও দাবি করেন, কথিত নিহতদের সরকারিভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা জীবিত এবং মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন। এর আগেও সরকার শাপলা-হত্যাকাণ্ডের অসারতার পক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছে। তবে সেগুলো তারা বলেছেন নিজস্ব পরিমণ্ডলে। সময়ে-সময়ে সেসব বক্তব্যের প্রতিবাদও করা হয়েছে কওমী আলিম-সমাজ ও হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে। কিন্তু এবারের বিষয়টি ভিন্ন; ভিন্ন তার চরিত্রে এবং পরিবেশে। এবারের প্রসঙ্গটি এসেছে সম্পূর্ণ কওমী আলিম-সমাজের একটি অনুষ্ঠানে এবং তাঁদের একটি অংশের সরব উপস্থিতিতে।

উল্লেখ্য, আলোচিত শোকরানা মাহফিলে কওমী আলিম-সমাজের বৃহত্তর অংশ অংশগ্রহণ না করলেও যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা কওমী মহলের একেবারে অপরিচিত মুখ নন। আলোচিত মাহফিলটিকে ধর্মীয় বিবেচনা দিয়ে মূল্যায়ন করার চেয়ে কৌশলগত মূল্যায়নে বিবেচিত করাটা আমার কাছে শ্রেয় মনে হয়। আয়োজকবৃন্দের মাঝেও মাহফিলটিকে ধর্মীয়ভাবে নেবার কোন লক্ষণ প্রস্ফুটিত হয়নি। মাহফিলের প্রস্তুতি, সংবর্ধনার পক্ষ-বিপক্ষ চিহ্নিতকরণ ইত্যাদির দৃষ্টিকোণে মনে হয়েছে, আয়োজকদের কাছে যেমন ছিলো মাহফিলটি কৌশলগত, তেমনি সরকারের কাছেও ছিলো রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক।

প্রথম থেকেই বলা হচ্ছিলো, মাহফিলটি হবে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মন্তব্যমুক্ত। কেননা, দাবি করা হয়, মাহফিলটি কওমী শিক্ষা বোর্ড হাইয়াতুল উলিয়া'হেফাজতের নয়। কিন্তু মঞ্চে হাযির ক'জন ব্যক্তির রাজনৈতিক বক্তৃতা, মাওলানা রুহুল আমীন সাহেবের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে 'কওমী-জননী' খেতাবের প্রস্তাব, মাওলানা হাসনাত আমিনীর পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসার কামনা এবং সর্বোপরি শাপলার হত্যাকাণ্ড নিয়ে সামরিক সচিবের বিতর্কিত মন্তব্য ইত্যাদি কথিত শোকরানা মাহফিলকে এক ব্যতিক্রমী পরিচয়ে পরিচিত করেছে। সন্দেহ নেই, এসব বক্তব্যে দেশব্যাপী কওমী ও সাধারণে বিতর্ক ও নিন্দার জন্ম দেয়। কওমী-জগতের বহুলাংশ এ ধরনের বক্তব্যকে কওমী স্বকীয়তা ও আত্মমর্যাদাবোধের উপর সরাসরি আক্রমণ বলে মনে করছে।

বিশেষত, সামরিক সচিবের শাপলার ট্র্যাজেডি নিয়ে দেয়া বিতর্কিত বক্তব্য শাপলাকে নতুন করে আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসেছে। তদুপরি, সামরিক সচিবের বক্তব্য-মন্তব্যের পরে মঞ্চে উপস্থিত কওমী আলিমদের কেউই এ বিষয়ে মন্তব্য বা প্রতিবাদ না করায় দেশব্যাপী কওমী-অঙ্গনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সাধারণ মনে করছে, কওমী-জগৎ সরকারের ভাষ্যানুসারে শাপলা হত্যাকাণ্ডের অসারতাকে স্বীকার করে নিচ্ছে। বিশেষ করে, কওমী ছাত্র-সমাজ এ ধরনের তীর্যক মন্তব্যকে নীতিগত কারণে মেনে নিতে নারায বলে তৃণমূলে দৃষ্ট হচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, মাহফিল-পরবর্তী আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমীসহ হাতে গোনা কয়েকজন কওমী নেতৃবৃন্দ বাদে কেউই সামরিক সচিবের উক্ত বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি। এমন কি তখন পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন আমীরেরও কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিব জনাব জয়নুল আবেদীন সেদিন শাপলা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যা বলেন, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। অন্তত এখানে তিনি সরকার-প্রধানের উপস্থিতিতে একটি বার্তা দেশবাসী ও কওমী-জগতকে দিতে চেয়েছেন। তা হলো, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সরকারের অবস্থানগত পরিবর্তন হলেও শাপলার বিষয়ে অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির কোন পরিবর্তন হয়নি। সরকারের আগের অবস্থান তখনও বহাল। অর্থাৎ, শেখ হাসিনার ভাষায় 'সেদিন কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি, ওরা রঙ মেখে শুয়েছিলো, পুলিশ দেখে উঠে দৌড় দেয়'—কথাগুলোই নিখাদ বাস্তবতা। উল্লেখ্য, সামরিক সচিবের মুখনিঃসৃত এ অবস্থানে কওমী-জগৎ অতোটা আহত হননি, যতোটা হয়েছেন উপস্থিত কওমী নেতৃবৃন্দের বিস্ময়কর নীরব-সম্মতিতে।

যা হোক, আমরা আজকে সামরিক সচিবের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করবো। বলাবাহুল্য, ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা-চত্বরে সমাবেশ হয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের উদ্যোগে। হত্যাকাণ্ড ঘটে ঐ দিন দিবাগত রাতে। ঘটনার দু'দিন পরে অর্থাৎ, ২০১৩ সালের ৯ মে বৃহস্পতিবার হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ শাপলার হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাদের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক বক্তব্য প্রকাশ করে। বিবৃতিটি হেফাজতে ইসলামের নিজস্ব প্যাড ও সাইটে প্রকাশিত হয়। বাস্তবেই কী ঘটেছিল ৫ই মে'র রাত্রে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে?শিরোনামে উক্ত ভাষ্যের শুরুতে বলা হয়:

মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গত ৫ মে দিবাগত রাতের অন্ধকারে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে জড়ো হওয়া ধর্মপ্রাণ আলেম ও নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের (যার একটি বড় অংশ বয়োবৃদ্ধ ও মাদরাসার শিশুছাত্র) ওপর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ, র্যাব ও আধা-সামরিক বাহিনী বিজিবির ১০ হাজার সদস্যের চালানো নৃশংস হত্যাযজ্ঞকে বিশ্ববাসী গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করলেও বাংলাদেশ সরকার তা বেমালুম অস্বীকার করছে! ঘটনার পরদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ও দলের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দেন: শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতকর্মীদের ওয়াশআউট অভিযানে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। নিহত হওয়া তো দূরের কথা, কেউ আহতও হয়নি। রেকটু পরে বলা হচ্ছে:

মূল কিলিং হয়েছে দুই পর্যায়ে। হেফাজতকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য অভিযান শুরুর পর মঞ্চ দখলের আগমুহূর্তে অর্থাৎ, যে ১০ মিনিটের কথা বলা হয়েছে, তখন খুব কাছ থেকে সরাসরি হেফাজতকর্মীদের গুলি করা হয়। এতে অনেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ ঘটনার অবতারণা করে যৌথবাহিনী সফল হয়। সহকর্মীদের মাটিতে লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে হেফাজতকর্মীরা ছোটাছুটি শুরু করেন। ১০ মিনিটেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় সমাবেশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে বড় কিলিংগুলো হয় সোনালী ব্যাংক ভবনের সিঁড়ি ও বারান্দা, বাংলাদেশ ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ডিসিসিআই, আমিন মোহাম্মদ ভবন, পিপলস ইন্স্যুরেন্স ভবন, ইউনুস সেন্টার, সারা টাওয়ার, ঢাকা ব্যাংকসহ ওই এলাকার বিভিন্ন বড় বড় দালানের সিঁড়ি ও বারান্দায়। এসব স্থানে পলায়নপর হেফাজতকর্মীরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। পুলিশ মাইকে ইত্তেফাক ও হাটখোলা ধরে যাত্রাবাড়ীর দিকে পালিয়ে যেতে বলেছিল। সে নির্দেশ তারা মানেননি। ভয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেনএই ছিল তাদের অপরাধ।....বঙ্গভবনের আশপাশ এলাকায় দৌড়ে গিয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের অনেককে সরাসরি গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ।

ঘটনায় হতাহতদের সংখ্যা সম্পর্কে বলতে গিয়ে হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক প্রদত্ত উক্ত ভাষ্যে বলা হয়েছে:

মতিঝিলের আশপাশের হাসপাতালগুলোতে হতাহত বহু লোককে নেয়া হলেও পুলিশের হুমকিতে তারা নাম প্রকাশ করে বিস্তারিত বলতে অপারগতা জানিয়েছেন। সর্বোচ্চ তিন হাজার লোক নিহত ও নিখোঁজ থাকার কথা জানিয়েছে আয়োজক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে তারা লিখিত বিবৃতিতে এ সংখ্যা ২ হাজার বলেছিল। ৬ মে রাতেই সংশোধিত সংখ্যা ৩ হাজার বলে জানায়।

এ তো গেলো হেফাজতে ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক ভাষ্যের কথা। এবার আসতে পারি নির্ভরযোগ্য কিছু আন্তর্জাতিক সূত্র ও সংবাদ-মাধ্যমের তথ্যে। তথ্যের জন্য উইকিপিডিয়া'র (Wikipedia) কথা এখন নেট-দুনিয়ায় সর্বজনজ্ঞাত। ২০১৩ সালে সংঘটিত শাপলা-হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংযোজন করা হয়েছে সেখানে। সেদিনের ঘটনায় হতাহত সম্পর্কে বলা হয়েছে:

According to government estimates, the number of casualties in this operation was 11, including a few law enforcement members, while the Daily Star reported 5 deaths. Opposition parties initially claimed that 2000- 3000 of protesters had been killed, while Hefazat claimed about 1000 deaths. Human Rights Watch disagreed with Hefazat's claims, but agrees that a massacre took place.

 “(the security forces) shot live ammunition and rubber bullets into unarmed crowds, conducted sweeping arrests, and used other forms of excessive force during and after protests that began in february and continue... opened fire on crowds, often without warning..."

Some victims were bystanders, including a number of shopkeepers near the Baitul Mukarram, while most were hefazat supporters, including children, who were killed by a blow to the head or gunshot wounds. Doctors at the Dhaka Medical College Hospital confirmed that many of those dead had been shot in the head. One policeman was also attacked in reprisal. According to Human Rights Watch, eyewitnesses saw 25-30 bodies that were confirmed dead. This included British activist and journalist David Bergman, who saw 24 bodies. The Guardian reported 22 confirmed deaths, while an investigation conducted by Aljazeera revealed that 14 bodies of "bearded men" with gunshot wounds were buried, after the protests, at Dhaka's state-run cemetery. Human rights group Odhikar reported 61 deaths, but refused to reveal the names of the victims out of security concerns for their families. The UK Home Office estimates a total of no fewer than total of 50 deaths. Many individuals, including orphan children, were missing, which may have contributed to the discrepancies in casualties."

[সরকারী তথ্যমতে অভিযানে নিহতের সংখ্যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ ১১। অবশ্য ডেইলি স্টারের রিপোর্টে বলা হয়েছে নিহতের সংখ্যা ৫। বিরোধীদলগুলো বলেছে, ২০০০-৩০০০ জন নিহত হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম দাবি করেছে: নিহতের সংখ্যা ১০০০। মানবাধিকার সংস্থাগুলো হেফাজতের এ দাবিতে একমত পোষণ করেনি, তবে স্বীকার করেছে যে, হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

মানবাধিকার সংস্থার দেয়া তথ্যানুসারে: "(নিরাপত্তা বাহিনী) নিরস্ত্র জনতার উপর তাজা-গোলাবারুদ ও রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে, ব্যাপকহারে গ্রেফতার করেছে এবং ফেব্রুয়ারী থেকে চলমান এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধ অতিমাত্রায় শক্তিপ্রয়োগ করেছে। কোন প্রকার সতর্কীকরণ ছাড়াই তাদের উপর গুলি চালিয়েছে..."

হতাহতদের মধ্যে রয়েছে কিছু পথচারী, বাইতুল মোকাররমের নিকটবর্তী দোকানকর্মী। হতাহতদের অধিকাংশ হলো, হেফাজত-সমর্থক যাদের মধ্যে শিশুও ছিলো, মাথায় আঘাতে বা গুলিতে মারা যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করেছেন, নিহতদের অধিকাংশই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। একজন পুলিশও হামলায় মারা গেছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-র দেয়া তথ্যানুসারে, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মোতাবেক ২৫-৩০ জন নিহত হয়েছে। বৃটিশ অধিকারকর্মী ডেভিড বার্গম্যান নিজে ২৪ টি মৃতদেহ দেখেছেন। বৃটেন থকে প্রকাশিত দ্য গার্ডিয়ান বলছে, মৃতের সংখ্যা ২২। সংবাদ সংস্থা আল জাযিরা বলছে তারা বিক্ষোভ-পরবর্তী ২৪ টি এমন মৃতদেহ কবর দিতে দেখেছে যাদের মুখে দাড়ি ছিলো, সেগুলো গুলিবিদ্ধ ছিলো। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার ৬১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। কিন্তু তাদের পরিবারের নিরাপত্তার খাতিরে নিহতদের পরিচিয় প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বৃটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক মনে করছে, ন্যূনতম ৫০ জন মারা গেছে। এতীম সিশুসহ অনেকেই উক্ত অভিযানের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছে।]

বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেএমন একটি সংস্থা DESH RIGHTS২০১৩ সালের জুলাই মাসে সংস্থাটি শাপলা-হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে। The Dhaka massacre 6 May 2013: A Briefing নামে ঐ পর্যবেক্ষণে (পৃ:২) তারা বলছে:

“Human rights groups have confirmed this incident to be a massacre, and with time qualitative and quantitative information surrounding the incident is emerging despite a concerted official disinformation campaign. An early report by The Economist puts numbers killed at 50 citing EU diplomats. However, video footage and pictures have emerged, which, in addition to eyewitness reports indicate that at least 500  

have been killed. Video footage show scenes of chaos in which bodies are strewn around and protesters falling dead when police shoot live rounds. Verified films published on the Desh Rights website attests to this. We also published a survivor testimony of bodies being placed in dumptrucks by the authorities and removed from the scene.”

[মানবাধিকার সংস্থাগুলো নিশ্চিত করেছে, ঘটনাটি একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। আর ঘটনা সংঘটনের সময়কাল ও হতাহতের সংখ্যা বিচারে ঘটনাস্থলের চারদিকের তথ্য থেকে সেটা বোঝাই যাচ্ছিলোযদিও প্রশাসনের তথ্য-গোপন করার চেষ্টা ছিলো। দ্য ইকোনোমিস্ট-র প্রাথমিক এক রিপোর্টে য়ুরোপিয়ান য়ুনিয়নের কূটনীতিকদের বরাতে নিহতের সংখ্যা ৫০ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যা হোক, বিভিন্ন ভিডিও-চিত্র আর ছবি দেখে যা অনুভব করা যায়, সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের দেয়া বিবরণ যোগ করা হলে কমপক্ষে ৫০০ জন নিহত হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। গোলযোগের সময় গৃহিত ভিডিও-চিত্রগুলোতে দেখা যায়, চতুর্দিকে পুলিসের গুলিতে বিক্ষাভকারীদের দেহ লুটিয়ে পড়ছে। যাচা-বাছাইকৃত ভিডিও চিত্রগুলো দেশ রাইটসের নিজস্ব সাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা যেসব আহতদের জীবিতাবস্থায় সরিয়ে ফেলার জন্য ট্রাকে তোলা হয় তাদের জবানবন্দীও প্রকাশ করেছি।]

যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ-মাধ্যম Ceasefire magazineতারা ২০১৪ সালের ৫ মে শাপলা-হত্যাকাণ্ডের ওপর একটি বিস্তৃত পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে। তাদের শিরোনাম ছিলো--Who said this would be investigated?’ Bangladesh and the May 2013 Massacreঅর্থাৎ, ' কে বলছে, এ ঘটনার তদন্ত করা হবে? বাংলাদেশ এবং ২০১৩ সালের মে'র হত্যাকাণ্ড।' পর্যবেক্ষণটিতে ceasefire magazine বলছে:

The day before, the protesters had marched from six points around the city, an estimated million strong, wearing national flags and asserting their rights to protest against religious defamation, discrimination and violence against their community amongst other matters. Many had been attacked by ruling party cadres and government forces, with firearms and more intimate bladed and blunt weapons, mounted on riot cars and motorcycles. Protesters seeking refuge in the national mosque were attacked by gunmen on motorcycles. The savagery on show was witnessed by the nature of the injuries inflicted, survivor testimonials and social media video footage. Several of the deceased had been brought to Shapla Chottor on stretchers, while the walking wounded and dying filled the hospitals that would accept them. According to a deaf-mute grave digger interviewed by Al Jazeera (before they lost interest) several bodies found themselves buried in a pauper’s graveyard. Later in the night, a passerby shared a heart-trembling eye-witness account of his patheticness in the face of police lines shooting at traditionally garbed protesters then pulling them out of the smoke and handing them to Awami League ruling party cadres to beat.

[ ৫ মে দিনের বেলায় বিক্ষোভকারীরা ঢাকা শহরের ছয়টি পয়েন্ট থেকে মিছিল নিয়ে জমায়েত হয়। তারা সংখ্যায় ছিলো লক্ষ পরিমাণ, জাতীয় পতাকায় মোড়ানো। তারা ধর্ম-অবমাননা, বৈষম্য আর তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের প্রতিবাদ ও আরও কিছু বিষয়ে দাবি জানাচ্ছিলো। তাদের অনেকেই সরকারদলীয় ক্যাডার, নিরাপত্তা বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। আক্রমণকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র, ছুরি আর ভোঁতা-অস্ত্র নিয়ে মোটরবাইক আর দাঙ্গা-প্রতিরোধী গাড়িতে চড়ে আক্রমণ চালায়। হেফাজত-সমর্থকেরা জাতীয় মসজিদে আশ্রয় নিলে মোটর সাইকেল আরোহী বন্দুকধারীরা সেখানেও গুলি চালায়। সামাজিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও, ক্ষতচিহ্নের ধরন, আহতদের বর্ণনা সেদিনের বর্বরতার সাক্ষী হয়ে আছে। এর মধ্যে কয়েকজনের মৃতদেহ স্ট্রেচারে করে শাপলা-চত্বরে নিয়ে যাওয়া হয়, অন্যদিকে আহত ও মৃত্যু-পথযাত্রীতে হাসপাতাল ভর্তি হয়ে যায়। আল জাযিরা একজন কবর খননকারী থেকে জানতে পেরেছে, কিছু মৃতদেহকে বেওয়ারিশ হিসাবে মাটি দেওয়া হয়েছে। পরে, রাতের বেলায় একজন প্রত্যক্ষদর্শী পথিক এক ভীতিকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। নিজের চোখে দেখা হৃদয়কম্পিত সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন: পুলিশ লাইনের সামনে চিরাচরিত পোষাকপরা হেফাজত-সমর্থকদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এরপর তাদেরকে টেনে-হিঁচড়ে নির্যাতনের জন্য আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের হাতে তুলে দেয়া হয়।]

বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক এমন একটি এনজিও International Human Rights Defenders and Press Society (IHRDPS)২০১৩ সালের ৮ মে সংস্থাটি শাপলা-হত্যাকাণ্ডের ওপর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টির শিরোনাম ছিলো Genocide by Bangladesh government toward Muslim community ( মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের গণহত্যা)। এটি বেশ কিছু দিন গুগলে থাকলেও পরে অজ্ঞাত-কারণে সরিয়ে ফেলা হয়। রিপোর্টটি মার্কিন সংবাদ-মাধ্যম CNN-এ প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে বলা হয়:

"5 May, 2013. A lot of people were on the street of capital to save Islam. But anti-Islamic govt. could not tolerate that. They move out of journalists from those places. Powered off the electricity. And then about at 3 am fired to the innocent and unarmed Muslims. A lot of people were died. Anti-Islamic govt. carried off dead bodies of many Muslims. The broadcast of Islamic TV channel of Bangladesh named ‘Islamic Television’ was closed. Another TV channel named ‘Diganto Television’ was also closed due to their support on behalf of Muslim community. Before sun rises, the street was washed, so that no proof of genocide remains there.

Some Conscious, Pious and patriot police gave us some secret news. As the govt. has carried off dead bodies from the spot to unknown place, the general public is not informed about the real number of dead persons. But those police have informed us that the number of dead persons is more than 2500. According to the voice of those police, this genocide was performed by four groups-Police, RAB, BGB and Professional Shooters. People were fully uninformed about Professional Shooters. They were on the roof of polyhedral buildings and used Sniper Rifle, which was used first time in Bangladesh

At first, RAB, police and BGB started fire together. At the same time Professional Shooters shooted by following the head and chest. During the same time; tear shell, hot water and sound grenades were thrown toward the innocent and unarmed Muslims. Some workers of ‘Hefajot-e-Islam Bangladesh’ tried to resist it. But they did not able to do that due to fire from all sides in dark night.

A lot of Muslims died in spot, some became seriously injured and others were able to run away from the street. This genocide continued for about one and half hour. No person was arrested, because the govt. ordered to kill directly, informed by those police members.

These police members also informed us that the dead bodies of Hefajot-E-Islami workers’ was carried out by 9 trucks and was thrown in three rivers. By this time, a lot of dead bodies were obtained from the river ‘Turag’ by general public. ...... We also informed by those patriot police that there is a possibility of genocide in every Madrasah of Bangladesh.

These news ware informed us by three police members, who were in the spot of genocide on 5 May night. Including them some of police members were crying there secretly, but they had nothing to do."

[২০১৩ সালের ৫ মে বিপুল-সংখ্যক মানুষ ইসলাম রক্ষার দাবিতে রাজধানীতে সমবেত হয়। কিন্তু ইসলামবিরোধী সরকার সেটাকে সহ্য করতে পারেনি। ঘটনাস্থল থেকে প্রশাসন সাংবাদিকদেরকে বের করে দেয়। বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ হরে দেয়। এবং রাত তিনটার সময় নিরীহ-নিরস্ত্র মুসলিমদের উপর গুলি চালানো শুরু করে।এখানে একটা বড় সংখ্যায় মানুষ মারা যায়। ইসলামবিরোধী সরকার অনেক মুসলিমের মৃতদেহ সরিয়ে ফেলে। বাংলাদেশের একটি ইসলামী টিভি চ্যানেল 'ইসলামিক টিভি'র সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়

ঘটনাস্থল থেকে। 'দিগন্ত টিভি' নামে আরেকটি বেসরকারী চ্যানেলের সম্প্রচার ও রিপোর্টিং বন্ধ করে দেয়া হয় হতাহতদের দৃশ্য প্রচারের কারণে। সূর্য ওঠার আগেই রাস্তাগুলোকে এমনভাবে ধুয়ে ফেলা হয় যেনো গণহত্যার চিহ্ন না থাকে।

কিছু সচেতন, ধার্মিক ও দেশপ্রেমী পুলিশ আমাদেরকে গোপন কিছু তথ্য দিয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য মতে, সরকার অজ্ঞাত-স্থানে লাশ সরিয়ে ফেলার কারণে জনসাধারণ নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা জানতে পারেনি। তবে সেসব পুলিশ-সদস্যরা জানায়, এ-দিন নিহতদের সংখ্যা ২৫০০ হাজারের বেশি হবে। তারা আরও জানায়, পুলিস, র্যাব, বিজিবি ও পেশাদার খুনি--এই চার দলের মাধ্যমে গণহত্যা সংঘটন করা হয়। মানুষ পেশাদার খুনিদের উপস্থিতি সম্পর্কে কোন ধারণাই পায়নি। পেশাদার খুনিরা অবস্থান নেয় বহুতল ভবনের ছাদে। তারা ব্যবহার করে স্নিপার রাইফেল--যা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয়

গণহত্যার শুরুতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি একসাথে গুলি চালাতে শুরু করে। সাথে-সাথে পেশাদার খুনিরা উপর থেকে হেফাজত সমর্থকদের মাথা ও বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এক-ই সময়ে এসব নিরস্ত্র মানুষের উপর টিয়ার সেল, গরম-পানি আর সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় কিছু হেফাজত-সমর্থক প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও রাতের আঁধারে চারদিক থেকে গুলি আসায় কিছু করা সম্ভব হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরাট সংখ্যক মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হয়, অনেকেই মারাত্মকভাবে আহত হয় আর বাকিরা দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

প্রায় দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত এই গণহত্যা চলে। গোপনতথ্য দেয়া ঐ পুলিশ সদস্যরা জানায়, অপারেশনে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। কারণ, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরাসরি হত্যা করার নির্দেশ ছিলো। ঐ পুলিশ সদস্যরা আরও জানায়, হেফাজতে ইসলামের নিহতদের মৃতদেহ নয়টি ট্রাকে করে তিনটি নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এরপর তুরাগ নদী থেকে জনসাধারণ বেশ কিছু ভাসমান লাশ উদ্ধার করে। এসব পুলিশ আমাদেরকে আশঙ্কার কথা জানায় যে, ভবিষ্যতে প্রতিটি মাদরাসা আক্রান্ত হতে পারে। তথ্যগুলো যে সব পুলিশ সরবরাহ করেতারা সেদিন রাতে ঘটনাস্থলে (৫ মে) ডিউটিরত ছিলো। তারা আরও জানায়, বেশ কিছু পুলিশ-সদস্য ঘটনার ভয়াবহতায় কেঁদে ওঠেন। কিন্তু তাদের কিছুই করার ছিলো না।]

Human Rights Watch (HRW) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বব্যাপী বহুল পরিচিত একটি মানবাধিকার সংস্থা। তারা ফী-বছর প্রত্যেক দেশের মানবাধিকার-পরিস্থিতি নিয়ে স্বতন্ত্র প্রতিবেদন তৈরি করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১৩ সালের ১লা আগস্ট বাংলাদেশের উপর (ফেব্রু-মে) একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করে। রিপোর্টটির শিরোনাম হলো Blood on the Streets যার বাংলা অর্থ হলো--রাস্তায় রক্ত। সেখানে শাপলা-হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বলা হচ্ছে:

"The worst violence took place near Dhaka's central mosque, Baitul Mokaram. Protesters set fire to shops, two office buildings, and a bus, and clashed with police. The security forces retaliated with tear gas, rubber bullets, and live fire. Video footage shows police officers using heavy sticks to beat apparently unarmed protesters lying on the street. Hundreds of people were taken to nearby hospitals. A 25-year-old Hefazat-e-Islam volunteer described the incident to Human Rights Watch:

We took shelter in the Baitul Mokarram mosque. The police called us to come out. When we did, they fired at us. Bullets hit my face, and when I fell down they came and shot me in my knee and abdomen and shoulder. They shot from barely 10 feet [3 meters] away. All were rubber bullets with lead balls. I was not armed, I did not have a stick. I was hit 19 times. I said to them, “Why are you shooting at me? I'm a volunteer.” Now I cannot see anything from my right eye, and after an operation I can see only a little bit from my left eye. Some of the victims were bystanders, like shopkeeper Raqibal Huq, who died of a gunshot wound to the head. Most were Hefazat supporters like 20-year-old Saidul Islam who was killed by a sharp blow to the head, and 20-year-old Sadam Hussein, whose corpse had gunshot wounds and large cuts to the back.

[সহিংস ঘটনাটি ঘটে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের কাছে। বিক্ষোভকারীরা দু'টি দোকান, দু'টি বিল্ডিং এবং একটি বাসে আগুন দেয়। সেখানে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের উপর পাল্টা টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট ও তাজা গোলাবারুদ ব্যবহার করে। ভিডিও-চিত্র থেকে দেখা যায়, পুলিশ মোটা লাঠি দিয়ে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদেরকে রাস্তায় ফেলে পেটাচ্ছে। প্রায় শ'খানিক আহতকে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পঁচিশ বছর বয়সী একজন হেফাজত কর্মী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে সংঘর্ষের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন--" আমরা বায়তুল মোকাররমে আশ্রয় নিলাম। পুলিস আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে বললো। আমরা বেরিয়ে আসতেই তারা গুলি চালাতে শুরু করলো। আমার মাথায় বুলেট আঘাত করলো। আমি পড়ে গেলাম। পুলিস এসে আমার হাঁটুতে, তলপেটে, কাঁধে গুলি করলো। তারা মাত্র দশ ফুট দূর থেকে আমাকে গুলি করছিলো। এর সবই ছিলো রাবার বুলেট সাথে সীসার গুলি। আমি নিরস্ত্র ছিলাম; আমার কাছে কোন লাঠি ছিলো না; আমাকে উনিশবার গুলি করা হয়। আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম: তোমরা আমাকে গুলি করছো কেন? আমি তো স্বেচ্ছাসেবক। আমি এখন ডান-চোখে দেখতে পাই না। অপারেশনের পর বাম-চোখে সামান্য দেখতে পাই।

আক্রান্তদের কেউকেউ ছিলেন পথচারী। তাদের মধ্যে রকিবুল হক একজন, যিনি মাথায় গুলির আঘাতে মারা যান। নিহতদের অধিকাংশ ছিলো হেফাজত-কর্মী। আক্রান্তদের বেশির ভাগই হেফাজত-কর্মী। এমনই একজন ২০ বছর বয়সী সাইদুল ইসলাম--যে মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারা গেছে। সমবয়সী সাদ্দাম হোসেনের লাশ পড়েছিলো ক্ষতবিক্ষত অবস্থায়। তার ছিলো গুলির আঘাত আর পিঠে গভীর কাটাচিহ্ন।]

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ'র ঐ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে:

"Journalists and protestors who witnessed the event told Human Rights Watch that on several occasions the security forces opened fire at close range even after unarmed protesters had surrendered. The security forces did not just fire rubber bullets, but also shotgun pellets. Many witnesses spoke of seeing corpses. As already noted, video footage shows police and RAB men beating what appear to be severely injured protesters.

One journalist remembers shaking 25-30 bodies and checking their pulses and is convinced some were dead. Another reporter saw RAB soldiers dragging four bodies near the offices of Biman Bangladesh airlines and loading them onto a truck. When he went to inquire about them, a soldier hit him with a stick on the side his head. The same journalist later checked the pulse of a boy who was lying on the steps of the Sonali Bank and was told by a police officer that the boy was dead. He remembers seeing a lot of bruising around his neck and chest."

[ প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন সাংবাদিক ও বিক্ষোভকারী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানান, বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীরা নিরস্ত্র অবস্থায় আত্মসমর্পণ করার পরও নিরাপত্তা-বাহিনী খুব কাছ থেকে গুলি চালায়। নিরাপত্তা-বাহিনী যে কেবল রাবার বুলেট ছুঁড়েছে তাই নয়, শর্ট গান দিয়েও গুলি চালায়। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী মৃতদেহ দেখেছেন। যেমনটি বলা হয়েছে, ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে: পুলিস ও র্যাব সদস্যরা মারাত্মকভাবে আহতদেরকে যেখানে পেয়েছে বেধড়ক পিটিয়েছে।

একজন সাংবাদিক জানিয়েছেন, তিনি পড়ে থাকা ২৫ থেকে ৩০ জনের শিরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যাদের কয়েকজন তখন মৃত। একজন রিপোর্টার দেখেছেন, কিছু র্যাব সদস্য চারটি মৃতদেহকে টেনে-হিঁচড়ে ট্রাকে তুলছে। তিনি যখন তাদের কাছে মৃতদেহ সম্পর্কে জানতে চান একজন র্যাব সদস্য রিপোর্টারের মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। পরবর্তীতে সেই রিপোর্টার সোনালী ব্যাঙ্কের সিঁড়িতে

পড়ে থাকা একটি বালকের পালস পরীক্ষা করার সময় একজন পুলিস কর্মকর্তা ছেলেটি মারা গেছে বলে দাবি করেন। ঐ রিপোর্টার বলেন, প্রচণ্ড মারের কারণে ছেলেটির ঘাড় ও বুকের হাঁড় ভেঙ্গে গেছে।]

'অধিকার'--বাংলাদেশের বহুল পরিচিত একটি মানবাধিকার সংস্থা। রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের অধিকার প্রশ্নে তারা নিজস্ব প্রতিবেদন ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে থাকে। ১৯৯৪ সালে শুরু হওয়া সংস্থাটি জাতীয়ভাবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে ২০১৩ সালের ১৩ ই মে শাপলা হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিস্তৃত সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ এবং সে বছরের আগস্ট মাসে অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে উক্ত বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টের জন্য গ্রেফতারের কারণে। বলাবাহুল্য, অধিকার কর্তৃক প্রকাশিত 'হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর সমাবেশ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন' শীর্ষক আঠাশ পৃষ্ঠার রিপোর্টটি (বাংলা সংস্করণ, প্রকাশ: ১০ ই জুন, ২০১৩) শাপলা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য দলীল। উক্ত রিপোর্টির চুম্বকাংশ এখানে তুলে ধরছি:

সন্ধ্যার পরও হেফাজতের নেতারা সমাবেশে বক্তৃতা করছিলেন। তবে রাত আনুমানিক ৮.০০ টায় এশার নামাযের আগে এই বক্তৃতা থেমে যায়। এরপর রাত আনুমানিক ৮.৩০ টায় পুলিসের সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের মতিঝিল থানা ও এর আশেপাশে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে পুলিস হেফাজত কর্মীদের লক্ষ্য করে গুলি করে। নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে তখন পুলিসের গুলিতে ৭ জন হেফাজত কর্মী নিহত হন। হেফাজতের নেতারা তখন মাইকে পুলিসকে গুলি না করার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। রাত আনুমানিক ১১ টায় শাপলা চত্বরের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হেফাজতের কর্মীরা যে যেখানে ছিলেন সেখানেই রাস্তার মাঝে বসে পড়েন, অনেক হেফাজত কর্মী গায়ের পান্জাবি খুলে অথবা সঙ্গে থাকা ব্যাগ কিংবা জুতা কাপড়ে পেঁচিয়ে মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। আবার অনেকেই সেখানে বসে জিকির করতে থাকেন।

এদিকে পুলিস, র্যাপিড একশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব), আর্মড পুলিস ব্যাটেলিয়ন ( এবিপিএন) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে সেখানে হামলার পরিকল্পনা করে। যৌথবাহিনীর সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে রামকৃষ্ণ মিশন (আর কে মিশন) রোডটি বাদ দিয়ে দৈনিক বাংলা মোড় থেকে ১টি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকে বের হয়ে মূল মঞ্চের দিকে ১টি, এই মোট ৩টি দলে ভাগ হয়ে একযোগে শাপলা চত্বরে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরই শুরু করে টিয়ারগ্যাস, গুলি, সাউন্ডগ্রেনেডসহ বিরতিহীন আক্রমণ (পৃ: ৩-৪)।"

৬ ই মে রাত আনুমানিক ১২.৩০ টায় মতিঝিলের প্রতিটি রাস্তার বৈদ্যুতিক সংযোগ করে দিয়ে চারদিক অন্ধকার করে দেয়া হয় এবং এই সময় সমাবেশ করার জন্য ব্যবহৃত মাইকের সংযোগও কেটে দেয়া হয়। যৌথবাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় রাত আনুমানিক ২.১৫ টায় হেফাজত কর্মীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শাপলা চত্বর ও এর আশে পাশে থাকা নিরস্ত্র এবং ঘুমন্ত হেফাজত কর্মীদের উপর নির্বিচারে গরম পানি, টিয়ারস্যাল, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড এবং গুলি ছুঁড়তে থাকে। যৌথবাহিনী রাতের ঐ অপারেশনের তিনটি সাংকেতিক নাম দেয়। পুলিসের পক্ষ থেকে বলা হয় 'অপারেশন শাপলা', র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয় 'অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট' এবং বিজিবি'র পক্ষ থেকে বলা হয় 'অপারেশন ক্যাপচার শাপলা'(পৃ: ৫)।

"৬ মে রাতের ঘটনাটির বীভৎসরূপ যেন প্রকাশিত না হয়ে পড়ে, সেই কারণে সরকার ভোররাত আনুমানিক ২.৩০ টায় ইসলামিক টেলিভিশন এবং ভোররাত আনুমানিক ৪.৩০ টায় দিগন্ত টেলিভিশন নামের চ্যানেল দু'টি বন্ধ করে দেয়। এই চ্যানেল দু'টি মূলত বিরোধী দলীয় চ্যানেল হিসেবেই পরিচিত ছিল ও এই ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট করছিল। বর্তমানেও টিভি চ্যানল দু'টি বন্ধ রয়েছে" (পৃ: ৫)।"

অধিকার'র রিপোর্টে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফটো-সাংবাদিকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উল্লেখ করা হয় এভাবে:

"তিনি ফকিরাপুল মোড়ে পৌঁছানোর একটু আগেই দেখতে পান কালো পোষাক পরা বেশ কিছু লোক ও ইংরেজিতে প্রেস লেখা জ্যাকেট পরা কয়েকজন সাংবাদিক দাঁড়িয়ে আছেন। সাংবাদিকদের কাছে গিয়ে জানতে পারেন সেখানে দুই হাজারেরও বেশি পুলিস, র্যাব, এবিপিএন ও বিজিবি সদস্য রয়েছে। একজন জয়েন্ট কমিশনার পর্যায়ের অফিসার তাদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এই দলের সঙ্গে

একটি রায়ট কার ও ১ টি জল কামান ছিল। তখন তিনি বুঝতে পারেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় ধরনের কোন অপারেশন শুরু হবে, তাই তিনি অপারেশন দেখার জন্য সেখানে থেকে যান। তিনি দেখেন, অপারেশন দলের কমান্ডিং অফিসার তার দলকে উত্তেজিত করার জন্য বলছে, "আপনারা কি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন?" দলের প্রত্যেক সদস্য সমস্বরে বলে ওঠে, " ইয়েস স্যার"।.........রাত আনুমানিক ২.২০ টায় যৌথবাহিনীর রায়ট কারে মাইক থাকা সত্ত্বেও তারা হেফাজত কর্মীদের সরে যেতে না বলে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে শাপলা চত্বরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এতে রাস্তায় অবস্থানরত হেফাজত কর্মীরা টিকতে না পেরে পিছু হটতে শুরু করে।......রাত আনুমানিক ২.৪৫ টায় নটর ডেম কলেজ পার হয়ে টয়েনবি সার্কুলার রোডে অবস্থিত দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার অফিসের সামনে এসে যৌথবাহিনীর সদস্যরা হেফাজত কর্মীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এবং সরাসরি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে শাপলা চত্বরের কাছে এসে দেখে চত্বর খালি হয়ে গেছে। কারণ, ইতিমধ্যেই দৈনিক বাংলা মোড় থেকে আরেকটি অপারেশন দল আগেই শাপলা চত্বরে এসে পৌঁছে হেফাজত কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল। হেফাজত কর্মীরা তাদের জীবন রক্ষায় তখন মতিঝিলের বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়েন।

এমন সময় তিনি দেখেন একজন হেফাজত কর্মীকে পুলিস ধাওয়া করছে। ধাওয়া খেয়ে লোকটি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়েছেন। একজন পুলিস সদস্য তাকে গুলি করতে উদ্যত হওয়ায় আরেকজন পুলিস সদস্য তখন গুলি করতে বারণ করেন। কিন্তু গুলি করতে উদ্যত পুলিস সদস্য বারণ না শুনে লোকটির পেটে গুলি ছোঁড়ে। লোকটি পেটে হাত চেপে ধরে রক্তাক্ত অবস্থায় কোন একটি গলিতে ঢুকে পড়েন (পৃ: ১৩-১৪)।"

শাপলার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে অধিকার তাদের রিপোর্টের শেষের দিকে 'আমাদের বক্তব্য' নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপসংহার যোগ করেছেন যা রিপোর্টকে অত্যন্ত অর্থবহ করে তুলেছে। সেখানে তারা বলেছেন:

"অধিকার হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতা কর্মীদের হত্যার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। অনেক মানুষের হতাহতের বিষয়ে জানা গেলেও এক শ্রেণীর 'শিক্ষিত' ব্যক্তিদের এই ব্যাপারে নীরবতায় অধিকার উদ্বেগ প্রকাশ করছে।

সরকারের মতিঝিলে অভিযান চালানোর আগে সে এলাকায় বৈদ্যুতিক সরবরাহ বন্ধ করা ও অভিযান চলাকালে বিরোধী দলীয় দুটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া এবং অন্যান্য মিডিয়াতে এ বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদ অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে সরকার হতাহতদের ও নৃশংসতার বিষয়টি গোপন করতে চাচ্ছে। তাই এ বিষয়ে আমরা সরকারের কাছে কোন স্বচ্ছতাই আশা করতে পারি না।

উপরোক্ত বাস্তবতা থাকা সত্ত্বেও সব ধরনের পক্ষপাতিত্ব ও অপপ্রচারকে পাশ কাটিয়ে বিষয়টির যথার্থ তথ্যানুসন্ধানের জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা প্রয়োজন। সুপ্রীম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত কমিটি করা প্রয়োজন এবং সমাজকে সংঘাতমূলক পরিস্থিতি থেকে বের করে আনা প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো তদন্তকালীন সময়ে দেখা প্রয়োজন, সেগুলো হলো-

১। মোট নিহত ও আহত মানুষের সংখ্যা এবং তাদের অবস্থান সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

২। কোথায় নিহতদের কবর দেয়া হয়েছে তা জানার অধিকার তাঁদের স্বজনদের রয়েছে। নিহতদের শেষকৃত্য করার অধিকারও তাঁদের স্বজনদের রয়েছে, যা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

৩। এই সমাবেশে অনেক শিশুরাও যোগ দিয়েছিল সরকার এটা জানা সত্ত্বেও কেন এই সমাবেশে ভারী অস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে এবং কেন নির্বিচারে হত্যায় উম্মত্ত হয়েছে? এটা অত্যন্ত অসহনীয় যে, সরকার শিশুদের ব্যাপারে সংবেদনশীল নয়। যেসব ব্যক্তিরা গুম হয়েছেন কিংবা নিখোঁজ রয়েছেন তাঁদের বিষয়ে খোঁজ করা জরুরি (পৃ: ২৮)।"

অধিকার সর্বশেষে তাদের যে চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণটি যুক্ত করেছে তা অবশ্যই শাপলার ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হয়ে থাকবে:

 “This is the first incident of large-scale indiscriminate killing in Dhaka city, after 42 years of independence of Bangladesh in 1971, by the State agents. (১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৪২ বছর পরে এটাই হচ্ছে ঢাকা শহরে সবচেয়ে বড় আকারের বাছবিচারহীন হত্যাকাণ্ড যা রাষ্ট্রযন্ত্র সংঘটিত করে।)

এবার আমরা বিশ্বের তিন প্রভাবশালী সংবাদ-মাধ্যমের দিকে দৃষ্টি দেবো। দেখি, তাদের রিপোর্টে শাপলার হত্যাকাণ্ড নিয়ে কী বলা হয়েছিলো। সংবাদ-মাধ্যম তিনটি হলো যথাক্রমে কাতারভিত্তিক 'আল জাযিরা', যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক 'দ্য ইকোনোমিস্টস' এবং বৃটেনের 'দ্য গার্ডিয়ান`কাতারের Aljazeera শাপলা-হত্যাকাণ্ড নিয়ে দু'টো রিপোর্ট করে। একটি ২০১৩ সালে ৭ ই মে, অপরটি ২০১৩ সালের ১৪ ই মে। প্রথম রিপোর্টে তারা Protests paralyse Bangladesh capital (বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের রাজধানী অচল করে দিয়েছে) শিরোনামে বলছে, ঘটনার প্রথম দিনেই মারা গেছে ২৪ জন। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে:

"Tirana Hassan, an emergencies researcher with Human Rights Watch who has just returned from Bangladesh, said the findings of its investigation into protests since last year were very alarming.

"We've documented alarming patterns of protesters being killed by the use of live fire by Bangladeshi forces." she told Al Jazeera from Brussels.

"There are tens of thousands of people taking to the street, but what we documented was live fire being used -and the fatalities all had bullet entries into the head and chest.”

"That's very worrying because it's not just that the police are trying to control the crowds, they're firing live rounds of ammunition in a way that is bound to kill," she said."

[তিরানা হাসানযিনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-র সাথে সম্পৃক্ত একজন গবেষক, সদ্য বাংলাদেশ থেকে য়ুরোপে ফিরে বললেন, পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গেলো বছর থেকেই বিক্ষোভ ভীতিকর হয়ে ওঠে।

মিসেস হাসান ব্রাসেলস থেকে আল জাযিরাকে বলেন:, "আমরা বিক্ষোভকারীদের জন্য ভীতিকর দিকগুলোকে নথিভুক্ত করেছি যারা বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সরাসরি চালানো গুলিতে মারা গেছেন।"

"হাজার হাজার মানুষের জমায়েত ছিলো রাস্তায়। কিন্তু আমরা নথিভুক্ত করেছি যে, সেখানে সরাসরি গুলি চালানো হয় এবং নিহতদের সকলেই মাথা ও বুকে গুলিবিদ্ধ ছিলো।"

মিসেস তিরানা আরও বলেন, " সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো, পুলিস জমায়েতকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে সরাসরি গুলি চালায়, ফলশ্রুতিতে মানুষের মৃত্যু ছাড়া কোন পথ খোলা ছিলো না।"]

দ্বিতীয় রিপোর্টে আল জাযিরার শিরোনাম ছিলো: Video suggests higher Bangladesh protest toll. অর্থাৎ, ভিডিও বলছে বাংলাদেশে নিহতের সংখ্যা উচ্চ। তারা লিখছে

Al Jazeera has obtained video footage suggesting that the Bangladesh government has been providing inaccurate death tolls from recent violence. According to official figures, 11 people had died during fighting between police and protesters from Hifazat-e-Islam, an Islamic group, on May 6, a day protesters refer to as the "Siege of Dhaka". Human Rights Watch, a US-based rights group, said that the exact number of deaths resulting from the protests are "unclear".

....... "Independent news sources put the figure at approximately 50 dead, with others succumbing to injuries later," HRW said in a statement on Saturday.

............ Abdul Jalil, a deaf and mute grave digger at Dhaka's state-run cemetery, communicated that he buried 14 bodies of bearded men with gunshot wounds after the protest, all at night.

[আল জাযিরা একটি ভিডিও হাতে পেয়েছে যা দেখে বলা যায়, বাংলাদেশ সরকার সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতের সংখ্যাকে লুকাতে চেষ্টা করছে। সরকারী ভাষ্যানুসারে, ৬ ই মে--অবরোধের পরদিন হেফাজতে ইসলাম ও পুলিসের সাথে সংঘর্ষে ১১ জন মারা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, শাপলার ঘটনার হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা এখনও অস্পষ্ট।

"......নিরপেক্ষ সূত্র থেকে পাওয়া খবরে বলা যায়, মৃতের সংখ্যা ৫০-র কাছাকাছি।"যেমনটি হি.রা.ও জানাচ্ছে।

"........আব্দুল জলীল নামে একজন মুক-বধির কবর খননকারী (ইশারায়) জানায়, সরকারের পরিচালনাধীন একটি কবরাস্থানে তিনি বিক্ষোভের রাতে মুখে দাড়িযুক্ত ১১ টি মৃতদেহ মাটি দিয়েছেন যারা বন্দুকের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন।"]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী পত্রিকা The Economists ২০১৩ সালের ৭ ই মে শাপলা-হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের খবরের শিরোনাম ছিলো, Violance on the streets অর্থাৎ, সড়কে সহিংসতা। প্রতিবেদনটিতে তারা লিখছে:

It took place in the commercial district of Dhaka, Bangladesh’s capital. At least 37 were killed and hundreds more injured in clashes between security forces and members of an extreme Islamic group, Hefajat-e-Islam.

.........Details of precisely what happened on May 6th remain unclear. Graphic pictures and video footage of the violence show bloodied bodies strewn on the streets of Dhaka’s Motijheel commercial district. The government closed two pro-Islamic television stations that had been broadcasting live images of the attacks. That leaves only one pro-opposition television channel (BanglaVision) functioning.

[ ঘটনা ঘটে রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকায়। নিহতের সংখ্যা ন্যূনতম ৩৭ জন এবং নিরাপত্তা-বাহিনীর সাথে চরমপন্থী দল হেফাজতে ইসলামের সংঘর্ষে আহত শতাধিক।

......৬ ই মে আসলে কী ঘটেছিলো তা সবিস্তারে স্পষ্ট নয়। সহিংসতায় তোলা ছবি, ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে আছে। সরকার দু'টো ইসলামপন্থী টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয় যারা আক্রমণের খবর ও ছবি সরাসরি সম্প্রচার করছিলো। সে-সময় বিরোধী সমর্থক টিভি চ্যানেল কেবল বাংলা ভিশন সচল ছিলো।"]

বৃটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা The Guardian.২০১৩ সালের ৬ ই মে সংবাদপত্রটি 'Bangladesh protest violence leaves more than 30 people dead' ( বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ তিরিশ জনের বেশি লোকের প্রাণহানি) নামে শাপলা হত্যাকাণ্ডের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়:


"At 2.30am local time on Monday, about 5,000 law enforcement personnel, including members of the police and paramilitary troops, proceeded towards the gathering of at least 70,000 Hefazat activists.

In the darkness, with power to the area cut, police reportedly charged into the gathering, lobbing tear gas and stun grenades and firing into the crowd.

Earlier, they had ordered the Hefazat activists to leave using megaphones. At least 22 people died in the clashes, most of them supporters of Hefazat, according to police and hospital sources. Doctors at Dhaka Medical College Hospital said many of those dead had been shot in the head."

 [সোমবার, স্থানীয় সময় ভোররাত ২.৩০ টা। পুলিস, প্যারামিলিটারি বাহিনীসহ ৫০০০ নিরাপত্তা-বাহিনী কমপক্ষে ৭০,০০০ হেফাজত কর্মীর সমাবেশের দিকে অগ্রসর হয়। চারদিকে অন্ধকার, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে নিরাপত্তা-বাহিনী টিয়ারগ্যাস, গ্র্যানেড ব্যবহার করে ও গুলি চালিয়ে করে সমাবেশ আক্রমণ করে। আগে তারা হেফাজত কর্মীদেরকে মাইক বন্ধ রাখতে বলে। হামলায় কমপক্ষে ২২ জন মারা গেছে। তাদের অধিকাংশই হেফাজত সমর্থক। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডাক্তাররা জানিয়েছেন, নিহতদের বেশির ভাগই মাথায় গুলিবিদ্ধ ছিলো।]

এবার আমরা দেখবো, দেশীয় সংবাদ-মাধ্যমের রিপোর্ট। শাপলা হত্যাকাণ্ড নিয়ে দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার রিপোর্ট এখানে প্রণিধানযোগ্য।  ২০১৩ সালের ৭ ই মে পত্রিকাটি 'যুদ্ধ বিধ্বস্ত রূপে মতিঝিল-পল্টন' শীর্ষক একটি সরেজমিন রিপোর্ট ছাপে। রিপোর্টটি তৈরি করেন দুই প্রতিবেদক নুরুজ্জামান ও উৎপল রায়। ৫ ই মে'র রাত থেকে ৬ ই মে'র দিনের আলো পর্যন্ত মতিঝিল ও আশেপাশের হাল-হাকীকত তুলে ধরা হয় রিপোর্টে। রিপোর্টে বলা হয়,

"রাস্তায় দুই পাশে ছাই আর ধ্বংসাবশেষ। রাস্তায় ইট পাথর ছড়ানো -ছিটানো। বিদ্যুতের খুঁটি ভাঙ্গা। ডিভাইডারগুলো ভেঙ্গেচুরে একাকার। দোকান, গাড়ি, আসবাব পুড়ে পুড়ে আছে রাস্তায়। রক্ত, কাদামাখা হাজার হাজার জুতার স্তুপ। রক্তমাখা টুপি, পান্জাবি পড়ে আছে এখানে-সেখানে। দু'দিন আগেও রাস্তাজুড়ে সেখানে ছিল সবুজ গাছের সারি। টবসহ তুলে ফেলে রাখা হয়েছে রাস্তায়। ৫ ই মে'র সহিংসতা ও রাতের যৌথ বাহিনীর অভিযানের পর এ চিত্র ছিল রাজধানীর মতিঝিল ও পল্টন এলাকার। এ যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত কোন এলাকার দৃশ্য। সকাল থেকে দিনভর সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা পুরো এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের কাজ করলেও পুরো স্বাভাবিক হয়নি।

সকালে দেখা যায় পিচ ঢালা পথে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য গুলির খোসা। সঙ্গে ঝোপ ছোপ রক্তের দাগ। সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা তা সরিয়ে ফেলেন।  সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ট্রাকযোগে বিভিন্ন ভাগাড়ে ফেলে দেয়া হয়। পরিচ্ছন্ন কর্মীরা জানান, রূপালী ব্যাংক ভবনের সামনের রাস্তায় ছোপ ছোপ রত্তের দাগ ছিল। অনেক জায়গায় রক্তাক্ত মাংসের টুকরা পড়ে ছিল। এ ছাড়া হাজার হাজার স্যান্ডেল, ব্যাগ, পান্জাবি, গেন্জি ও পানির বোতল সরিয়ে ফেলেছেন তারা। এর মধ্যে যত্রতত্র অবস্থায় ছিল অসংখ্য গুলি ও টিয়ার শেলের খোসা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার দিবাগত রাত আড়াইটা থেকে রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত মুহুর্মুহু গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। একই সময়ে নানা বয়সী মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসে। এর ঘণ্টাখানেক পর সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল মতিঝিল এলাকা। সূত্রমতে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান ও মুহুর্মুহু গুলিতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে।"

মজার ব্যাপার হলো, শাপলার হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদ-সম্মেলন করে বলা হয়: কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। যেমন, ২০১৩ সালের ৬ ই মে'র সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়:

"গতকাল রাতে (৫ ই মে) হেফাজতের শত শত লাশ গুম হয়েছেবিএনপির নেতা এম কে আনোয়ারের এমন দাবির বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী কোনো প্রাণহানি না ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে হেফাজতের কর্মীদের মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে বের করে দিয়েছে। সেখানে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

আজ বিকেলে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হানিফ এ দাবি করেন। দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।...... আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘মতিঝিলে একটি সফল অভিযান পরিচালনার জন্য র্যাব, পুলিশ ও বিজিবিকে অভিনন্দন জানাই। কোনো হতাহতের ঘটনা ছাড়াই হেফাজতকে ঢাকা থেকে বের করে দেওয়ায় রাজধানীবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। ............ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা হেফাজতের ওপর কোনো হামলা করেনি দাবি করে হানিফ বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা করলে স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিহত করে। আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী হেফাজতের ওপর হামলা করেনি (দৈনিক  প্রথম আলো)।

শাপলা-হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের এ অবস্থান এখনও বহাল আছে। সরকার-প্রধান শেখ হাসিনাও হত্যাকাণ্ড পরবর্তীকালে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে 'কোন হতাহত হয়নি' বলে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেন। বরঞ্চ তিনি আরও ক'কদম বাড়িয়ে "হেফাজত কর্মীরা গায়ে রঙ মেখে শুয়েছিলো, পুলিশ দেখে দৌড় দেয়"  মর্মে উপহাসসূলভ বক্তব্য দিয়ে জাতিকে অবাক করে দেন।

এবার আমরা দেখবো, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক অবস্থান। ৭ ই মে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি কেন্দ্রীয় বক্তব্য আসে জাতীয় কয়েকটি দৈনিকে। বক্তব্যের শিরোনাম ছিলো হাজার নেতা-কর্মীর শাহাদাত॥ আহত ১০ সহস্রাধিক, নিখোঁজ অসংখ্য'হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরীর যুগ্ম আহ্বায়ক মাওলানা জাফরুল্লাহ খান কর্তৃক প্রেরিত উক্ত বিবৃতিতে বলা হয়:

"পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথবাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের যুগপৎ হামলায় রাজধানীর মতিঝিলস্থ শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে রোববার গভীর রাতে ঘুমন্ত আলেম-ওলামাদের ওপর নির্বিচারে গুলী, বোমা, গ্রেনেড, টিয়ারশেল এবং রাবার বুলেট নিক্ষেপের মাধ্যমে প্রায় ৩ হাজার আলেম-ওলামা ও হেফাজত নেতা-কর্মীদের হত্যা এবং শহীদদের লাশ গুমের তীব্র নিন্দা-প্রতিবাদ ও শহীদদের রূহের মাগফেরাত কামনা করে বিবৃতি দিয়েছেন সংগঠনের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ"(দৈনিক সংগ্রাম)। উল্লেখ্য, হেফাজতে ইসলামের এ অবস্থানও এখনও বহাল আছে, কোন পরিবর্তন হয়নি বক্তব্য প্রত্যাহার করে।

২০১৩ সালের ৭ ই মে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে আরও একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়। সম্ভবত, সেটি চট্টগ্রাম থেকে পাঠানো হয়। হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী ও মাওলানা মাইনুদ্দীন রূহী কর্তৃক প্রেরিত উক্ত বিবৃতির শিরোনাম ছিলো--'শাপলা চত্বরের ঘটনা ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা ॥ সারা দেশে তাওহীদি জনতাকে রাজপথে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ'  বিবৃতিটিতে বলা হয়:

"হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ডাকে রোববার ৫ মের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে সরকারের পেটোয়াবাহিনী, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও শাহবাগী নাস্তিকরা সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়ে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা সংঘটিত করেছে। বিভিন্নস্থানে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের কোনও সম্পর্ক নেই। সরকার নজিরবিহীনভাবে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে পুলিশ, বিজিবি র্যাব ছাড়াও প্রচুর সংখ্যক বিদেশী-সশস্ত্র ও লোক দিয়ে আচমকা সমাবেশস্থলে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা সেই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞে কমপক্ষে দুই সহস্রাধিক নেতাকর্মী শাহাদাত বরণ করেছেন। আহতের সংখ্যা আড়াই হাজারের মতো। অনেক লাশ গুম করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের ময়লা বহনের গাড়িতে করে বিপুলসংখ্যক লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমাদের বহু নেতাকর্মীর এখনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। সংগত কারণে আহত ও নিহতের চূড়ান্ত পরিসংখ্যান এই মুহূর্তে জানানো সম্ভব হচ্ছে না"(দৈনিক সংগ্রাম)।

উল্লেখ্য,  ঘটনা পরবর্তীকালে অভিন্ন ভাষায় হেফাজতে ইসলামের পক্ষে আরও যেসব নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন দৈনিকে বিবৃতি দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন: ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, উপদেষ্টা মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী, সদস্য সচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব, যুগ্ম-আহ্বায়ক মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী, মুফতী তৈয়্যেব, মাওলানা আবুল হাসনাত আমিনী, মাওলানা মনজুরুল ইসলাম, প্রচার সেলের প্রধান মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াছেল, মাওলানা শফিক উদ্দিন, মাওলানা মহি উদ্দিন ইকরাম, মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, মাওলানা শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা রিয়াজতুল্লাহ, মাওলানা ওয়ালিউল্লাহ আরমান, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা আলতাফ হোসাইন প্রমুখ।

সম্মানিত পাঠক, আমরা এখন আলোচনার গোধূলিতে এসে পৌঁছেছি। আলোচনার দীর্ঘ পরিক্রমায় আমরা দেখে এসেছি শাপলা-হত্যাকাণ্ডের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তথ্যসূত্রের বিবরণ; সরেজমিন-প্রতিবেদন। আশা করি, এসব তথ্য-উপাত্ত সুপ্রিয় পাঠকবর্গকে যেমন সন্দেহমুক্ত করবে, তেমনি তাঁদের বিশ্বাসের অনুকূলে দলীল হিসাবে বেঁচে থাকবে। যাক, সংবর্ধনা সভায় সরকারের সামরিক সচিবের বক্তব্যের সত্যতাও আমরা খুব কাছ থেকে দেখে এলাম। ২০১৩ সালের ৫ ই মে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা-চত্বরে রাতের

আঁধারে একটি পূর্বনির্ধারিত হত্যাকাণ্ডের বাস্তবতাকে অস্বীকৃতির যে ভয়াবহ ও বেদনাত্মক নকশা আমরা তখন থেকেই দেখে আসছি তা আজও যে সরকারের অনু-পরমাণুতে প্রবাহিতসেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর চেয়ে ঢের ভয়াবহ লেগেছে সচিবের বক্তব্য-পরবর্তী সংবর্ধনা-মঞ্চে উপস্থিত কওমী-জগতের একটি পরিচিত অংশের নীরব সম্মতির দৃশ্য দেখেযা বহির্জগতে এমন বার্তা দেয় যে, শাপলার-চেতনার প্রশ্নে কওমীদের ঐ অংশটিও সরকারের গভীর পরিকল্পনার সাথে অভিন্নমত পোষণ করেন।

এখানে আমরা একটি মৌলিক-প্রশ্নের সমাধানে ব্রতী হতে চাই। প্রশ্নটি হলো, শাপলা-ট্র্যাজেডিকে কেন ওরা কওমীদের মন থেকে মুছে দিতে চায়? প্রশ্নটি উপলব্ধি করছি শাপলা-ট্র্যাজেডি'র পর থেকে। এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য আমরা কওমীদের জানতে হবে শাপলাতে আমরা এসেছিলাম কেন? বলাবাহুল্য, পার্থিব কোন উদ্দেশ্য বা রাজনৈতিক ফায়দার জন্য হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে কওমী-জগৎ ঢাকা অবরোধে যায়নি। সবাই জানেন, ঐ সময়টাতে অনলাইনে একশ্রেণীর নাস্তিক ও ইসলাম-বিদ্বেষী ব্লগার ইসলাম, কুরআন, মহানবী সা. ইত্যাদি নিয়ে কুরুচিপূর্ণ অপবাদ দিতে থাকে; মন্তব্য করতে থাকে। এ বিষয়ে কওমী-জগৎ বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঐ নাস্তিকগোষ্ঠীর পেছনে সরকারের মদদ ও আশ্রয় জাতির কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নাস্তিক ব্লগার পাপিষ্ঠ রাজিব খুন হলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে 'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ' আখ্যা দেয়ার মধ্য সরকারের চরিত্র ফুটে ওঠে [আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ব্লগার রাজীব দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ। রাজীব চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর রক্ত দিয়ে উজ্জীবিত করে গেছেন তরুণ প্রজন্মকে (প্রথম আলো ১৬.০২.১৩)]।  

শুধু তাই নয়, ২০১৩ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারী যখন পাপিষ্ঠ রাজিব খুন হয় সরকার প্রধান শেখ হাসিনা সেদিন বিকালে রাজিবের বাসায় গিয়ে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে বলেনএই যে তরুণ সমাজ তারা মনে হল একাত্তরের পর আবার সমগ্র বাঙালী জাতির চেতনায় এতটা উন্মেষ ঘটাতে পেরেছে। আর সেই চেতনা যখন তারা এমন জাগ্রত করলো সে সময় প্রথম শহীদ সে। এবং এটা সবাই ধরেই নিতে পারে কারা করছে। তবে এটুকু কথা দিতে পারি এদের ছাড়বো না(প্রথম আলো)।  তাহলে, জাতি কী বুঝলো? জাতি বুঝলো, যারা মহান আল্লাহ তায়ালা, কুরআন, মহানবী সা. ইত্যাদি স্পর্শকাতর বিষয়ে কুরুচিপূর্ণ কথা বলবে তারাই একাত্তরের চেতনার ধারক আর যাঁরা এদের বিরোধিতা করবেন তারাই দেশের শত্রু।

এমতাবস্থায় ২০১৩ সালের ৬ ই এপ্রিল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম-সমাজের ধর্মীয় ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে, জাতীয় সংহতি রক্ষার প্রয়াসে এবং বিভক্তি থেকে দেশক্ষার তাগিদে আল্লামা আহমদ শফী দা.বা.-র আহ্বানে ও নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ঢাকামুখী লংমার্চের ডাক দেয়। দেশের একমাত্র সুসংগঠিত সামাজিক শক্তি কওমী-জগতের আহ্বানে সেদিন ঢাকা অভিমুখী সকল সড়কে সর্বস্তরের জনমানসে যে অভূতপূর্ব প্রেরণার সৃষ্টি হয় তা স্বচক্ষে দেখার দূর্লভ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিলো। রাস্তার দু'পাশের বাসাবাড়ি থেকে পর্দানশীন মহিলারা পর্যন্ত বেরিয়ে লংমার্চের মুসাফিরদের মুখে দু'ফোঁটা শরবত তুলে দিতে যে আকুতি বিছিয়ে দেয় তা যুগের পর যুগ ইতিহাসের পাতাকে কেবল অশ্রুসিক্তই করবে না বরঞ্চ এই জনপদের হৃদয়ে-হৃদয়ে ইসলাম আর ইসলামের মহানবী সা.-র প্রতি নিঃসৃত অনন্ত ভালবাসার মিনার হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সেদিন যে চেতনা এই জনপদের আকাশ-বাতাস প্রত্যক্ষ করেছিলো তার মূল-প্রেরণাদাতা ছিলো হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। একথা অনস্বীকার্য। এই চেতনাহাজারের বছরের চেতনা, যা আরবের হেরার আলোর অনস্বীকার্য ও অনিবার্য উত্তরাধিকার। সন্দেহ নেই, এ উত্তরাধিকারের পথ ধরে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে কওমী-জগৎ ঢাকা-অবরোধে যোগ দেয় ২০১৩ সালের ৫ ই মে'র মর্মান্তিক দিনে। জড়ো হয়েছিলো শাপলা-চত্বরে সেই আসমানী চেতনা হেফাজতের লক্ষ্য নিয়ে ১৩ দফা দাবির ব্যানারে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হেফাজতে ইসলামের এই চেতনা ঐতিহ্যবর্জিত ছিলো না, স্বল্পকালের কোন বিশ্বাস বা আচারনির্ভর সংস্কৃতিও ছিলো না। উপমহাদেশে এই চেতনার প্রথম উম্মেষ ঘটে ১৫ শ শতকে মুজাদ্দিদে আলফে সানী আল ইমাম শেখ আহমাদ আল ফারূকী আস্ সারহিন্দি রহ. (১৫৬৪-১৬২৪)-র পরাক্রমশালী মোগল সম্রাট আকবরের 'দ্বীন-ই-ইলাহী'র বিরুদ্ধে ইসলামের শাশ্বত-ইনকিলাবের মধ্য দিয়ে। এরপর এই সংগ্রামী চেতনার দ্বিতীয় উম্মেষ ঘটে ১৭ শতকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলা শহীদ রহ-র ইংরেজ-বিরোধী অভিযানে। যদিও পলাশীর আম্রকাননে বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজের দৃশ্যমান পরাজয় ঘটে কিন্তু চেতনা থাকে অপরাজেয়। সেই চেতনার তৃতীয় উম্মেষ ঘটে ১৮ শতকে যখন ভারতে শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.(১৭০৩-১৮২৩)

ইংরেজ শাসিত ভারতকে 'দারুল হারব' বা শত্রু-কবলিত দেশ ফতোয়া দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের ঘোষণা দেন এবং সেই ফাতওয়ার উপর ভিত্তি করে মহীশুরের সিংহখ্যাত ফতেহ আলী সুলতান টিপু শহীদ রহ. ইংরেজ-বিরোধী সশস্ত্র জিহাদে নেতৃত্ব দিয়ে ১৮৯৯ সালের ৪ ঠা মে মহীশুরের যুদ্ধে শহীদ হন নিজের বিশ্বস্ত মীর সাদিকের বিশ্বাসঘাতকতায়। এরপর আসে ১৮৩১ সালের ৬ ই মে সংঘটিত 'বালাকোটের জিহাদে'এদিন সেই হেরার চেতনার চতুর্থ উম্মেষ ঘটে যখন বালাকোটের প্রান্তরে সায়্যিদ আহমাদ শহীদ রহ. (১৭৮৬-১৮৩১)-র নেতৃত্বে ইসমাঈল শহীদ রহ.সহ ৩০০ মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন। অবশেষে ১৮৫৭ সালের মহাবিপ্লব খ্যাত মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজের নেতৃত্বে ইতিহাসে জায়গা করে নেয় সেই সংগ্রামী চেতনার পঞ্চম উম্মেষ। ১৮৫৭ সালের চেতনার পথ ধরেই ১৮৬৬ সালে ভারতের সাহারানপুর জেলার বস্তি দেওবন্দে 'দারুল উলূম দেওবন্দ' প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ঘটে সেই মহান চেতনার ষষ্ঠ উম্মেষ।  বৃটিশ-শাসিত ভারতে হাজী শরীয়তুল্লাহর 'ফরায়েজী আন্দোলন' এবং তিতুমিরের ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম উপরোক্ত সংগ্রামী চেতনারই ধারক ও বাহক হয়ে  ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল পাতায় জ্বলজ্বল করে চলেছে। এবং এই ধারাবাহিক চেতনার অনিবার্য পরিণতি শাপলার চেতনাশাপলার আত্মদান।

যুগেযুগে উক্ত চেতনা শিকার হয়েছে বহুমুখী ষড়যন্ত্রের। সেটাকে থামাবার, নির্মূলের চেষ্টা হয়েছে বিভিন্নভাবে। শাপলার চেতনার ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। শাপলার চেতনা নতুন কিছু নয়হেরার চেতনা, কওমী চেতনা। এ চেতনা অন্যায়কে মেনে না নেবার চেতনা, অসুন্দর আর অন্ধকারের সাথে আপোষ না করার চেতনা। এ চেতনা জুলম আর অধর্মের বিরুদ্ধে বিরতিহীন সংগ্রামের চেতনা। বৃটিশ আমলে লেখা ইংরেজ লেখকদের বইগুলো পড়লে বোঝা যায় বেনিয়াগোষ্ঠীর সব শক্তি আর ক্ষমতা প্রয়োগ করেও এ চেতনাকে থামানো যায়নি,  নির্মূল করা যায়নি। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের লেখা 'আওয়ার ইন্ডিয়ান মুসলমানস' সে কথার অনবদ্য এক দলীল।

বাংলাদেশেও সেক্যুলার আর নাস্তিক্যবাদীগোষ্ঠী এই চেতনাকে মুছে দিতে চেষ্টা করেছে বারবার, নির্মূল করতে চেয়েছে রাষ্ট্রীয় বল-প্রয়োগে। কারণ, শাপলাকে মুছে দিতে পারলে কওমী আর কওমী থাকবে না। দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। নতুন জন্ম দেয়া দালালশ্রেণীর মাধ্যমে চেষ্টা করা হচ্ছে শাপলার চেতনা বিনাশের। কিন্তু প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়েছে  নির্লজ্জভাবে, পরাজিত হয়েছে আদর্শের ময়দানে। তারা তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে বেকসুর মানুষ হত্যার মাধ্যমে, অন্যায় রক্তপাতের মাধ্যমে। কিন্তু যে চেতনায় আমরা হেরার আলোকে আলিঙ্গন করতে শিখেছি--সেই চেতনার কেশাগ্রও ওরা স্পর্শ করতে পারেনি। যুগেযুগে সেই চেতনার ধারক-বাহক হয়ে জন্ম নিয়েছে মুজাহিদ আলিম-সমাজ, যাঁরা সকল লোভ-লালসার হাতছানিকে পাযে দলে হেরার চেতনাকে রক্ষা করে গেছেন এবং যাচ্ছেন এখনও। সামরিক সচিবের সেদিনের বক্তব্য সেই চেতনা-শত্রুদের ঐতিহাসিক ধারাবাহিক পরিণতি বৈ কিছু নয়। মঞ্চে বসে যাঁরা সেই অপচেষ্টাকে নীরবে বিনা প্রতিবাদে যেতে দিয়েছেন তাঁরা ইতিহাসের সৌভাগ্যের মালা পরতে পারেননি, দুর্ভাগ্যের পাতাতেই নাম লিখিয়েছেন। ইতিহাস একদিন সেই বিচার অবশ্যই করবে।

পরিশেষে, মনে রাখতে হবে শাপলা একটি চেতনার নাম; এক রক্তাক্ত আমানতের নাম। হাজার স্বীকৃতির পোষাকে সেই চেতনাকে আড়াল করা যাবে না। কওমী-জগতকে এই আমানত-রক্ষা করে যেতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই। আসুক আরও হাজার রক্তাক্ত শাপলা। তবুও এ চেতনাকে আমরা কোনদিন ভুলবো না। মনে রাখতে হবে, শাপলার চেতনাকে হারালে কওমী-জগৎ অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে।

২০১৮ সাল Mail: gr.islamabadi@gmail.com


ভাবনা-৪৯

কওমী মাদরাসার বিশাল বলয় নিয়ে কওমী-জগৎ মূলত কওমী মাদরাসার আলিম-উলামা ও ছাত্ররা এ জগতের মূল-বাসিন্দা স্বীকৃতমতেবাংলাদেশে কওমী মাদরাসার যাত্রা ১৯০১ সালে হাটহাজারী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেই থেকে এ দেশের মাটিতে সুগভীর শেকড় গেড়েছে কওমী জগৎ দারুল উলূম হাটহাজারীর স্বপ্নদ্রষ্টা ও মূল পরিকল্পনাকারী শাইখুল কুল মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ রহ. এবং তিন সহযোগী সুফী আজীজুর রহমান রহ., মাওলানা আব্দুল হামীদ মাদারশাহী রহও মাওলানা হাবীবুল্লাহ কুরাইশী রহ.’র আন্তরিক প্রচেষ্টায় নববী-নকশার যে ইসলামী শিক্ষার গোড়াপত্তন ঘটেতাই আজ কালজয়ী কওমী মাদরাসা-শিক্ষাব্যবস্থা হিসাবে স্বীকৃত ও পরিচিত কালে-কালে এসব কওমী মাদরাসা থেকে এমনসব ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব জন্ম নিয়েছেনযাঁরা কেবল ধর্মীয় বলয়ে নয়জাতীয় পর্যায়েও ঈর্ষণীয় অবদান রেখে গেছেন এঁদের মধ্যে মাওলানা আতাহার আলী সিলেটী রহ., মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ., মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযুর রহ., মাওলানা সিদ্দীক আহমদ রহ., মাওলানা হাজী ইউনুস সাহেব রহ., মাওলানা আহমদ শফী রহ., মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী রহ., মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী রহপ্রমুখ আলিম নেতৃত্ব  তাঁদের গড়ে ওঠার কাহিনী হয়তো আমাদের সামনে নেইআছে বিশাল অবদানের সামান্য কিছু স্মৃতি বলতে দুঃখ হয়আমাদের এখানে ইতিহাস থাকে অজানাস্মৃতি থাকে অচেনা আর মূল্যায়ন হয় অদেখা কতো বড়বড় মানুষ এ মাটিতে জন্মেছেনকেউ তাঁদের খবর রাখেনি পরপ্রজন্ম চেনে না আপন পূর্বসূরীদের ফলেযে বুক সাহসে আকাশে ওড়ার কথা ছিলোহীমন্যতায় সে বুক আছড়ে পড়ে মাটিতে আজ আমরা নিথর-নিরব-নির্বল

কেন কওমীদের মধ্যে নেতৃত্ব গড়ে ওঠার হার প্রায় শূণ্যের কাছাকাছিঅবহেলায় কি এ ফলনা কি নেতৃত্ব গড়ার দুর্বলতার বিষফলবলতে দ্বিধা নেইইদানীং আমাদের যাঁরা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে বড় হতে পেরেছেনপরিচয়ে পরিচিত হতে পেরেছেনতাঁরা জানি না কি এক অজানা কারণে আত্মকেন্দ্রিকতায় ডুবে গেছেন অলক্ষে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত তাঁরা নিজে বড় হবার চেয়ে অপরকে বড় করে তোলার মধ্যে সৃষ্টিসুখের উল্লাস যে কতো মধুরসে কথা আমরা বুঝি না আমাদের কেউকেউ আছেনকওমীর ডালভাত খেয়েকওমীর পাটিতে শুয়ে বড় হয়ে আজ কওমীকেই ভুলে গেছেন ক্যারিয়ার’ গড়তে তারা এখন য়ুরোপ-আমেরিকায় সুখের নীড় গড়েছেন তাদের যদি সবিনয়ে প্রশ্ন করা হয়কওমী মাদরাসায় যাঁদের সাহায্যের টাকায় খেয়েপড়ে আজ কওমকে পেছনে ফেলে বিদেশের মাটিতে সুখের নীড় গড়ে তুলেছেনতাঁদের জন্য এই কি প্রতিদানআপনার বস্তার চাল খেয়ে কেউ যদি অপরের মাটি কাটতে যায়তাকে কি বলবেনইংরেজরা যখন আমাদের শাসন-শোষণ করেআমাদের সম্পদ লুট করে বৃটিশ-নগরী গড়ে তোলে,তাদের আমরা বলিলুটেরা  আর যারা আমাদের ডালভাত খেয়ে আমাদের মেধা চুরি করে বাইরে ক্যারিয়ার গড়ে তোলেতাদের কি বলবোজবাব পাঠকদের কাছে সান্ত্বনা পেতাম যদি দেখতামতাঁরা বাইরে গিয়ে এখানকার সন্তানদেরও ক্যারিয়ার গড়ায় সহযোগিতা করছেন কিন্তু হচ্ছে কি এসবএ আত্মকেন্দ্রিকতার কি কোন কৈফিয়ত আছেআমাদের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একটি প্রবাদ আছেছাগলে বিয়ায় শিয়ালে খায় কওমীরাও বলতে পারেনকওমীরা বিয়ায় বিদেশে খায় আমি বলছি নাআপনি সুযোগ পেলেও দেশে পচে মরুন তা হবে কেনদেশের সন্তানদের জন্যও কিছু করুন। নিজে খান অন্যকেও খাওয়ান। সেটাকে তো আত্মকেন্দ্রিকতা বলছি না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আপনি যানসেখানে থাকুন কিন্তু আপনার মাতৃভূমিকেআপনার কওমী প্রতিষ্ঠানটিকে ভুলে যাবেন না। পারলে কিছু মেধাবীকে নিয়ে গিয়ে গড়ে তুলুন সেখানে যা কিছু ভালো আছে, যেমন: পরিচালনাজ্ঞান, ব্যবস্থাপনাজ্ঞান, তাফসীর, হাদীস-গবেষণা, ফিকাহ-গবেষণা ইত্যাদি অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশে পাঠানকওমীদের অনেক উপকার হবেদেশে আপনার বিরাট পরিচয়, ভালোআর দশ জনকেও পরিচিত করিয়ে দিন, তাতে আপনি কিন্তু আরও বড় হবেন, ছোট হবেন নাচেরাগের আলো ধার দিলে কি আলো কমে? আত্মকেন্দ্রিকতা কিন্তু এক ধরনের সংকীর্ণতা, উদারতার ঘোরতর শত্রু

নেতৃত্ব গড়ে তুলতে বড়দের বড় ভূমিকা রাখতে হয়তা না হলে, নিচ থেকে নেতৃত্ব গড়ার পথ সংকীর্ণ হয়ে যায়দারুল উলূম দেওবন্দের ৫৮ বছরের পরিচালক হাকীমুল ইসলাম কারী তয়্যিব সাহেব রহ.’ কথা কারও অজানা থাকার কথা নয়আজও দারুল উলূমের দেয়ালে-দেয়ালে তাঁর অবদান প্রস্ফুটিত হয়ে আছেতাঁর বিভিন্ন ওয়াযের সংকলনখুতবাতে হাকীমুল ইসলামসাত খণ্ডে সমাপ্ত, বাজারে পাওয়া যায়সেখানে এক বক্তব্যে তিনি বলেছেন, বড়দের বদান্যতায় কেমন করে তিনি গড়ে উঠলেনতাঁর কথায়: তিনি ছিলেন আজাদীর বীর সিপাহসালার শাইখুল হিন্দ মাহমূদ হাসান দেওবন্দী রহ.’ ছাত্রকারী সাহেব যখন দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করলেন, নিজেকে আলিম ভাবার ধৃষ্টতা দেখাতে পারেননিখুব লজ্জাশীল ছিলেনকিন্তু হযরত শাইখুল হিন্দ মানিক চিনতে ভুল করেননি কারী সাহেব রহ. বলছেন: হযরত শাইখুল হিন্দ যখন কোন প্রোগ্রামে যেতেন, অবশ্যই তাকে ডেকে নিতেন এবং মঞ্চে পাশে বসিয়ে রাখতেন হযরত শাইখুল হিন্দ বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে দশ মিনিট সময় রেখে দিয়ে বলতেন, এখন আযীয কারী তয়্যিব সাহেব বয়ান করবেন একদিন হলো কি, ঝড়ে কারী সাহেবের কাপড় এমন ভিজে গেলো, গায়ে রাখাটাই দুষ্কর হয়ে পড়লো প্রোগামে গিয়ে কারী তয়্যিব সাহেব কাপড় বদলে একটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে শাইখুল হিন্দের পাশে বসে রইলেন যথারীতি হযরত শাইখুল হিন্দ দশ মিনিট আগে বয়ান শেষ করে বলে দিলেন, আমার পাশে এক নওজোয়ান দরবেশকে আজ নিয়ে এসেছি বাকি দশ মিনিট তিনিই বয়ান করবেন হাকীমুল ইসলাম কারী তয়্যিব সাহেব রহ. বলেছেন: হযরত শাইখুল হিন্দ এভাবে গড়ে না তুললে তিনি মঞ্চে কখনোই সাবলীল হতে পারতেন না  এভাবেই আমাদের বড়রা তাঁদের অনুজদের গড়ে তুলেছেন এখানে আত্মকেন্দ্রিকতার লেশমাত্র ছিলো না; ছিলো না বলেই দারুল উলূম নামের জ্ঞানের কারখানা থেকে জ্ঞানীরা, সংস্কারকরা, খতীবরা, মুজাহিদরা গড়ে উঠেছেন একে-একে

নেতৃত্ব বলতে আসলে কি বোঝায়? সোজা কথায় আমি যদি বলি, নেতৃত্ব মানে এমন এক দায়িত্ব যা একটি জাতি বা গোষ্ঠীর মন-মেজাজ বুঝে তাঁদের কল্যাণ সাধনে নির্ধারিত পথ পদ্ধতিতে অগ্রসর হওয়া এবং জাতি বা গোষ্ঠীকে আদর্শিকভাবে সংগঠিত করা রাখাআধুনিক দৃষ্টিতে ইসলামের পরিকাঠামোয় নেতৃত্ব বলতে বলা হচ্ছে:

قیادت کا بنیادی مقصد انسانوں کی درست رہنمائی اور ان کے مسائل کا آسان حل فراہم کرنا ہوتا ہے-باشعور، باصلاحیت اور دیانت دار قیادت نہ صرف انسانی مسائل کے حل میں ہمیشہ مستعد و سرگرم رہتی ہے بلکہ معاشرے کی خوشحالی، امن اور ترقی میں بھی کلیدی کردار ادا کرتی ہے-قیادت متعین مقاصد کے حصول کے لئے عوام کو بلاجبر و اکراہ ایک طے شدہ سمت پر گامزن کرنے کانام ہے-تاثیر و کردار کے مجموعہ کوقیادت کہتے ہیں-کسی بھی اسلامی ریاست کیلئے ایک صالح قومی قیادت و لیڈر شپ لازمی و ابدی امر ہے جو اپنے دائرہ اختیار اور ریاست کی حدود میں حدود اللہ اور حدود العباد کاپوری طرح سے نفاذ ممکن  بناتی ہے -  اگر دنیا میں صالح قیادت کے قیام کااصول اور فرد کے باہمی تعلق کی حدود و قیود واضح کردی جائیں تو انسان کے لئے یہ ممکن ہے کہ وہ معاشرتی، معاشی، مذہبی ظلم و جبر سے نجات پالے(প্রফেসর ড. গোলাম রসূল, পাকিস্তা)

(নেতৃত্বের মৌলিক উদ্দেশ্য হলোঅধীনস্থদেরকে সঠিকভাবে পরিচালিত করা এবং তাদের সমস্যার সহজ সমাধান প্রদান করা সচেতনমেধাবী এবং সৎ নেতৃত্ব শুধুমাত্র মানুষের সমস্যা সমাধানে সর্বদা পরিশ্রমী ও সক্রিয়ই নয়বরঞ্চ সমাজের সমৃদ্ধিশান্তি ও উন্নয়নেও মূল ভূমিকা পালন করে। নেতৃত্ব নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানুষকে একটি নির্ধারিত পথে অগ্রসর হতে উৎসাহিত করার ক্ষমতার নাম প্রভাব ও ভূমিকার সম্মিলনেই নেতৃত্ব  যে কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য একটি সৎ জাতীয় নেতৃত্ব অপরিহার্য ও চিরন্তন বিষয়যা আপন ক্ষমতার সীমার মধ্যে থেকে আল্লাহর আদেশ এবং বান্দার অধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব করে যদি পৃথিবীতে ন্যায়পরায়ন নেতৃত্বের মূলনীতি এবং নাগরিকের পরস্পরিক সম্পর্কের সীমা বুঝিয়ে দেয়া যায়তবে মানুষের পক্ষে সামাজিকঅর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

অন্যভাবে বলা হচ্ছে:

In Islam, the concept of leadership must act only to implement Allah’s laws on earth as the essence and primary responsibility of leaders. Leadership in Islam, as a trust (Amanah), and a sacred position that can solve the problems of humanity and guide them to the eternal betterment of here and hereafter. Although developments of several leadership models are just to solve the problem. On the other hand, leadership in Islam must think about humanity and the satisfaction of Allah the Almighty. The results of the field study indicate that there is a significant relationship between the spiritual values of leadership with Rabbani’s leadership practices. The results suggest that organizational direction requires divine or spiritual-based leadership. (www.intechopen.com) (ইসলামে নেতৃত্বের ধারণাটি অবশ্যই প্রাথমিক দায়িত্ব হিসাবে পৃথিবীতে আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবে। ইসলামে নেতৃত্ব একটি বিশ্বাস (আমানাহ) এবং একটি পবিত্র অবস্থান যা মানবতার সমস্যার সমাধান করতে পারে এবং তাদের ইহকাল ও পরকালের অনন্ত উন্নতির দিকে পরিচালিত করবে। যদিও বর্তমানে নেতৃত্বের বিভিন্ন প্রকারের সংস্করণ আছে, শুধুমাত্র সমস্যা সমাধানের জন্য। অন্যদিকেইসলামে নেতৃত্বকে অবশ্যই মানবতা এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা ভাবতে হবে। মাঠ পর্যায়ের ফলাফল নির্দেশ করে যেআল্লাহওয়ালাদের নেতৃত্বের অনুশীলনের সাথে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। ফলাফলগুলো নির্দেশ করেপ্রাতিষ্ঠানিক দিকনির্দেশনার জন্য আসমানী বা আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব প্রয়োজন।)

এখন এ নেতৃত্বের গুণাবলী শিষ্যদের মাঝে প্রবিষ্ট করা কাদের কাজ? স্বীকার করি, যে কেউ এসব গুণের অধিকারী হতে পারেন না যতোক্ষণ না তার মধ্যে নিজ থেকে জ্বলে ওঠার বাসনা জাগ্রত হয় আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দরসে এমন ছাত্র পাওয়া যাবে যারা পরশ পেলে জ্বলে উঠবে প্রয়োজন শুধু এদেরকে চিনতে পারা এবং লালন করা এ কাজ অবশ্যই বয়ঃজ্যেষ্ঠদের, শিক্ষকেদের  কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দিকে দৃষ্টি দেয়া হয় না সহজেআমরা কেবল গতানুগতিক দরসের কিতাবী পড়াকে মুখ্য করে থাকিএতে আমাদের অবিকশিত প্রতিভাগুলি আর বিকাশের সুযোগ না পেয়ে ভিনপথে চলে যায়দুর্ভাগ্যের ইতিহাস কিন্তু আমাদের খুব বেশি অতীতের নয়তাই যদি হতো, আমাদের পর্বসূরী নক্ষত্রগুলোকে আমরা দেখতে পেতাম নাযেমন ধরুন, আমীরে শরীয়ত হাফেজ্জী হুযুর রহ.’ কথাহাকীমুল উম্মাহ হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ.’ পরশ না পেলে আমরা কি পেতাম আমীরে শরীয়তকে? ধরুন, চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার হাজী ইউনুস সাহেব রহ.’ কথামাওলানা হাবীবুল্লাহ কুরাইশী রহ. এবং মুফতী আজীজুল হক রহ.’ পরশ না পেলে আমরা কোথায় পেতাম শাইখুল আরব ওয়াল আযমকে? মুফতী আজীজুল হক রহ.’ পরশ না পেলে কোথায় পেতাম আমরা  হযরত আলী আহমদ বোয়ালভী রহ. হযরত ইসহাক আল গাযী রহ.কে? মাওলানা জমীরুদ্দীন সাহেব রহ.’ পরশ না পেলে কোথায় পেতাম আমরা মুফতী আজীজুল হক রহ., মাওলানা হারুন বাবুনগরী রহ.কে? মুফতী আজীজুল হক রহ.’র সাহচর্য  বিনে কোথায় পাওয়া যেতো সুলতান আহমদ নানুপুরী রহ.কে এমন করে আরও অনেক নাম নেয়া যায়এরপর কেমন করে যেন সব এলামেলোর দিকে চলে গেলোআমাদের নক্ষত্রগুলো আর আকাশে দেখা গেলো নানতুন নক্ষত্রও মিলিয়ে যেতে লাগলোপাঠক, যাঁদের কথা বলে এলাম, তাঁরা যে কেবল ধর্মীয় নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, তা নয়তাঁরা বিভিন্ন ক্রান্তিকালে জাতিকেও দিশা দিয়েছেন তাঁদের অমূল্য বক্তব্য ও পরামর্শ দিয়ে ; নেতৃত্ব দিয়েছেন উদারভাবেইতিহাসে সেসব আজও জ্বলজ্বল করে

কওমী জগৎ আজ নেতৃত্ব-সঙ্কটে জর্জরিত কথা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না  পাঠক, এখানে এসেই নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যেতে চায়বারবার প্রশ্ন জাগে: কেন সঙ্কট? স্বীকার করতে হয়, আমাদের মূল জায়গাটা কিন্তু দারস বা শ্রেণীআমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা যদি ওখানে সচেতন হন, কারা কোন পথে যাবার যোগ্যতা রাখে, কিসে তার সহজাত প্রতিভা আছেসে বিবেচনায় লালন করেন, তবে একটি প্রজন্ম জন্ম নেবেআমাদের যা মেধা আছে, সে তুলনায় প্রতিভা অনেক কমফলে, মেধা আর প্রতিভার সমন্বয়ে নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পথ সংকুচিত হয়ে গেছেদারস যদি যুগের প্রয়োজনকে সামনে রেখে দিনদিন সংস্কার হয়, সৈনিকরা ততো উন্নত হয়যুদ্ধের মাঠে যেমন অস্ত্রের ব্যবহার হয় তেমনি বৃদ্ধিবৃত্তিক মাঠে বক্তব্য, ‍যুক্তি-তর্ক, উপাস্থাপনার কৌশল, সমাসাময়িক ভূ-রাজনীতিক সংলাপ-কৌশল ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়বর্তমান যুগে পরিভাষার যুদ্ধ একটি বড় যুদ্ধপ্রতিপক্ষের ছুঁড়ে দেয়া নতুন পরিভাষার বিরুদ্ধে ব্যাখ্যামূলক পাল্টাযুক্তি দিয়ে নিজেদের সৃষ্ট পরিভাষা দিয়ে অপরপক্ষকে ঘায়েল করার সক্ষমতা থাকতে হবে সৈনিকদেরতবেই তারা বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে টিকে থাকবে  যুদ্ধ কি জিহাদের এক প্রকার নয়? এসব অর্জনের ভিত্তি হবে দারস জন্য দারসের দুটি শর্ত অবশ্যই প্রযোজ্য: . মুদাররিস বা শিক্ষকের সমসাময়িক তথ্য তত্ত্বমিশ্রিত দারস . দারসের প্রতি ছাত্রদের দায়বদ্ধতা আন্তরিকতা এখানে বড় ভূমিকা কিন্তু মুদাররিসের যেমন আরোগ্যের ক্ষেত্রে ডাক্তারের আর মুদাররিসের দেখানো পথে নিজেকে তৈরি করার দায়িত্ব ছাত্রের যেমন পথ্য খাওয়ার জিম্মাদারী রোগীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেরুলে ছাত্রের দায়িত্ব বড় হয়ে দাঁড়ায় দারসের ভিত্তিকে উচ্চশিক্ষা গবেষণার মাধ্যমে নিজের মধ্যে যোগ্যতা সৃষ্টির দায়িত্ব একান্তই ছাত্রের অন্যথা হলে, সেটাই হবে ছাত্রের বড় খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা এখানে যদি যথার্থ অর্থে কাজ করা যায়, তবে আমাদের আফসোস করতে হবে না

সবাই যে নেতৃত্বের যোগ্য হবেন তেমন নয় আল্লাহ তায়ালা একেকজনের মধ্যে একেক যোগ্য দিয়ে থাকেন কারও কম, কারও বেশি তবে বান্দার চেষ্টায় আল্লাহ ইচ্ছা হলে অসম্ভব কিছু নয়, নিরাশ হওয়ারও কারণ নেই কেবল আল্লাহ জন্য নিবেদিত হয়ে মাখলুকের সেবার নিয়ত থাকলে নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা ও তামান্না অবৈধ নয় হযরত সুলায়মান . যদি আল্লাহ নিয়ামাতের শোকরিয়া আদায়ের জন্য বাদশাহী চাইতে পারেন, আমরা কেন স্রষ্টার আনুগত্য মানবতার সেবার জন্য নেতৃত্বের যোগ্যতা চাইতে পারবো না? মনে রাখতে হবে, নেতৃত্ব যেহেতু এক গুরুভার যার জন্য কিয়ামাতের দিন আল্লাহ দরবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে, তার জন্য যোগ্যতাও তেমন উচ্চদরজার হতে হবে এর অনিবার্য মূলশর্ত: খোদাভীতি পার্থিব যোগ্যতার দিকে তাকালে যে কয়টি বিষয় প্রধানত বাঞ্ছনীয়, তা হলো: . বুনিয়াদী শরীফ বংশের সন্তান হওয়া, . সাহেবে নিসবাত বা ইসলাহী সিলসিলার অন্তর্ভুক্ত হওয়া, . শিক্ষাগত তথ্যগত উচ্চযোগ্যতা থাকা, . উদার মানসিকতার অধিকারী হওয়া, . সচ্চরিত্রবান হওয়া, . মানুষের সাথে মিশার মানসিকতা থাকা এবং . মাখলুকের প্রতি ভালবাসা জাগ্রত থাকা এসব যোগ্যতার অভাব হলে ব্যক্তি নেতৃত্বের অযোগ্য বলে বিবেচিত হন হযরত উমর রজি.’ সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে: তুমি বাজারে যাওয়ার আগে বাজারের মাসআলা শিখে নাও, নচেৎ তুমি কাউকে ধোঁকা দেবে বা ধোঁকা খাবে নেতৃত্বের বেলায়ও তেমন যুক্তি একে শরীয়তের ভাষায় বলে: ইলমুল হা-ল্ আমাদের দেশে বলে: মন্ত্র না জেনে সাপের গর্তে হাত দিও না প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলে লেখার ইতি টানছি একবার এক ব্যক্তি হযরত থানভী রহ.’ দরবারে এসে বললো: হযরত আমি সিয়াসাত (রাজনীতি) করতে চাই অনুমতি দিন হযরত বললেন: না, তোমার জন্য রাজনীতি জায়েয হবে না লোকটি বললো, হযরত কী আশ্চর্য! আপনি কি দেখছেন না, হযরত মাদানী সিয়াসাত করছেন, নেতৃত্বও দিচ্ছেন! অথচ আমাকে বললেন: আমার জন্য রাজনীতি বৈধ হবে না তখন হাকীমুল উম্মাহ রহ. লোকটিকে যে অমূল্য কথাটি বললেন, তা কালান্তরে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবেহযরত বললেন:

پہلے تو مدنی بن جا پھر سیاست کر!

 

 

ভাবনা-৪৮

ভেতরে ও  বাইরে বাংলাদেশ নিয়ে এক সঙ্কট চলছে এখন যেটুকু বোঝা যায়, সঙ্কটের এখন মধ্যাহ্ন চলছে প্রতিনিয়ত আসা খবর থেকে আন্দাজ করা যায়, সঙ্কট আরও বৃহত্তর সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে হতে পারে, সঙ্কটের পারদ উঠতে-উঠতে বিপদসীমার দিকে চলে যাবে সঙ্কটের পুরোটা রাজনৈতিক হলেও প্রভাব কিন্তু রাজনীতিকে ছাপিয়ে যাবে বলে মনে হয় ইয়েমেন, ইরাকের উদাহরণ ভুলে যাবার কারণ নেই প্রথম দিকটা রাজনৈতিক হলেও পরবর্তীতে সুদাসল আদায় করেছে বেকসুর জনসাধারণ আফগানিস্তানের বিষয়টি ভূ-রাজনৈতিক, তবুও ধকল গেছে সবার উপর দিয়ে যে প্রকৃতিতে বাংলাদেশ সঙ্কটের দিকে আপাতত এগুচ্ছে, মনে হচ্ছে, সামনে বিপদ ভারী আল্লাহ না করুন, তেমন কিছু হলে এমনিতেই জর্জরিত দেশের মানুষ নিরঙ্কুশ পতনের দিকে এগিয়ে যাবে আমার মনে হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে এমন সঙ্কট এই প্রথম দেশের ভেতরে নির্বাচনবিমুখ বিভক্ত, আতঙ্কিত মানুষ, রাজনীতিক দীনতা আর বাইরেগণতান্ত্রিকপরিবেশ সৃষ্টিতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক চাপ অর্থনীতিকভাবে মানুষ এমনিতেই উচ্ছৃংখল দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে বিপর্যস্ত, আয়ের চেয়ে চাহিদা ভয়ানক গতিতে বেশি এবং কর্মহীনতা যত্রতত্রএমন পরিস্থিতিতে সঙ্কট ঘনীভূত হলে মানুষকে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর কাতারে দাঁড়াতে হবে ক্ষমতাশীনরা মানতে নারাজ বিরোধীদের কথা আর বিরোধীদের এক কথা: আগে পদত্যাগ, তারপরে কথা

দেশের সঙ্কটের সময় যখন কোন সমাধানে যাওয়া জটিল মনে হয়তখনি কওমীদের এগিয়ে আসা উচিৎ যাঁরা ১সরকারের সাথে সঙ্কট নিয়ে কথা বলবেনবিরোধীদলের সাথে কথা বলবেনএকটি মহাসমাবেশ ডেকে দেশের স্বার্থে সঙ্কট সমাধানে একটি সম্মিলিত বিবৃতি ও প্রস্তাবনা পেশ করবেন এবং ৪দেশব্যাপী একটি দোয়ার ব্যবস্থা করবেন এখানে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনকওমীরা কি সমাধান করতে পারবেনপক্ষ-বিপক্ষ কি তাঁদের কথা শুনবেদেখুনসমাধান কিভাবে হবে বা আদৌ হবে কি নাএগুলো কেউ আগাম বলতে পারেন না ভবিষ্যৎ তো কেবল আল্লাহর হাতে তাই বলে কি চেষ্টাতে মানা আছেমনে রাখতে হবেকওমীরা এ দেশেরই নাগরিকদেশ ও দশ নিয়ে তাঁদেরও দায়িত্ব আছেদায়বদ্ধতা আছে তাঁরা মৌলিকভাবে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করছেনতাতে কারও আপত্তি নেই সাথেসাথে যখন দেশ ও দশ সঙ্কটে পড়বেকওমীরা কি নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকতে পারবেদেশ ও দশকে সঙ্কট থেকে উদ্ধারের চেষ্টা কি ধর্মীয় দায়িত্বের সাথে সাংঘর্ষিকধরে নিলামকওমীদের কথা ওরা রাখলো না তাতে কিকওমীরা যে জাতীয় দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসলোসে তো জাতীয় ইতিহাসে লেখা থাকবে কেউ কওমীদেরকে নির্বাসনে থাকা অসচেতন প্রজাতি বলে কটাক্ষ করার সাহস পাবে না প্রস্তাবগুলো দায়িত্বশীলগণ ভেবে দেখতে পারেন বলা তো যায় নাআল্লাহ কাকে দিয়ে কি কাজ করান

বলতে দ্বিধা নেইজাতীয়ভাবে কওমীদের একঘরে থাকার অপবাদ দীর্ঘদিনের এখান থেকে মুক্তি মেলেনি বলে জাতীয়ভাবে তাঁদের মূল্যায়নও হয় না উর্ধতনমহল মনে করেনএঁরা মোল্লা মানুষমসজিদ-মাদরাসা নিয়েই এঁদের জিন্দেগী জাতির জন্য তাঁরা কিইবা করতে পারেনসে সক্ষমতা কি তাদের আছেআমরা কওমীদেরকে প্রমাণ করতে হবেআমাদের সে সক্ষমতা আছে এটা প্রমাণের মধ্যে লুকিয়ে আছে কওমীদের আত্মমর্যাদা ও বৃদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা কেবল দান-সদকা খাওয়া প্রজন্মের কটাক্ষমূলক তকমা লাগিয়ে বাস করা কি মর্যাদারএমনও দেখেছিধনাঢ্যদের  কেউকেউ মাদরাসায় এ জন্য সন্তানদের পাঠান না যেসেখানে গেলে অমর্যাদাকর রীতি গ্রহণ করতে হয় কেন এমন বলাবলতে দ্বিধা নেইএখানে আমাদেরও ঘাটতি আছে ইসলামে সাধাসিধা জীবনাচার আছেতাই বলে কি অমর্যাদাকর জীবন যাপন করতে হবেকওমীরা মূলত একটি দায়ীর জামায়াত এঁরা ইসলামের দিকে জাতিকে ডাকবেননির্দেশনা দেবেন সঙ্গতকারণেআমাদের কোন আচরণে যদি মানুষ সাধারণে অস্বস্তি বোধ করে এবং দ্বীনের দিকে আসতে দ্বিাবোধ করেতবে সে দায় আমাদের যেমন আপনি এমন এক লোকালয়ে গেলেন যেখানে সবাই পরিস্কার ও পরিপাটি কাপড় পরাকে পছন্দ করে কিন্তু আপনি গেলেন অপরিপাটি ও ঢিলেঢালা পোষাকে এতে সেখানকার বাসিন্দারা মানসিকভাবে এতোটাই বিগড়ে যাবেনদায়ী হিসাবে আপনার কথায় মনযোগ দিতে চাইবে না ফল কি দাঁড়ালোআপনার কারণে দ্বীনের মুখাপেক্ষী মানুষ দ্বীনের কথা শুনতে পারলো না এর দায় একান্তই দায়ীর মদীনার উদাহরণ দেখুনপ্রথম মুবাল্লিগ বা দায়ী হিসাবে মহানবী সামাদীনায় পাঠালেন হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের রজি:কে কিন্তু কে এই মুসআব ইবনে উমায়ের?  মুসআব ইবনে উমায়ের মক্কার সেই যুবক যে সবচেয়ে দামী আতরে ও পরিপাটি পোষাকে চলতেন তিনি ছিলেন অন্যান্য যুবকদের মডেল মদীনার অধিবাসীরাও ছিলো চাল-চলনে পরিপাটিপরিচ্ছন্নতার প্রতীক সঙ্গতকারণেমুসআব ইবনে উমায়ের রজি:র স্বভাবগত চালচলনের কারণে মদীনার বিত্তশালীনেতৃত্বাস্থানীয় শ্রেণীর কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাতে সহজ হয় তাঁর দাওয়াতে পরের বছর দশ হাজার মুসলিম মক্কায় আসেন রসুলুল্লাহ সা.’র কাছে ইসলাম গ্রহণ করতে যাঁদের মধ্যে মুয়ায ইবনে জাবাল রজি.’র মতো নক্ষত্রতুল্য সাহাবীও ছিলেন কওমীরাও যদি মাদরাসার পরিবেশ পরিপাটি-পরিচ্ছন্ন রাখেন তাতে কি সমস্যা হবেস্বভাবতই ধনাঢ্যশ্রেণী চাইবে তাদের সন্তান কওমীতে পড়ুক কিন্তু মিসকীন-মিসকীন ভাব নিয়ে নয় পোষাকে-আষাকে পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি হওয়া তো দোষের নয় সেদিকটায় কওমীদের প্রচুর দুর্বলতা আছে তবে ইদানীং কিছু পরিবর্তন যে হচ্ছে নাতা নয়

যাকবলছিলামদায়ী হিসাবে দাওয়াত গ্রহণকারীদের পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই সেদিক থেকে বলতে হয়জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের স্বার্থে কওমীদের বলায় ও আচরণে শিক্ষিত ও পরিপাটি হওয়া বাঞ্ছনীয় সেদিকটায় নযর দিতে পারলে জাতি কওমীদের পদক্ষেপকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করতে চাইবে জাতি যখন কওমীদের আন্তরিকতাকে গ্রহণ করবেজাতীয় পর্যায়ে কওমীদের অবদানের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হবে আজ দেশের এমন সঙ্কটের মুখে কওমী আলিম-উলামার কোন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসিত হবে কওমীদের মধ্য থেকে একটি প্রগতিশীল ও আধুনিক প্রজন্ম গড়ে উঠতে হবে যাঁরা সুন্নাহর মৌলিক অনুসরণকে সম্বল করে যুগের প্রয়োজনে আধুনিক ভাষা ও প্রযুক্তি রপ্ত করে জাতিকে এমন কিছু দেবে যা অন্যদের পক্ষে দেয়া সম্ভব হবে না 

মহাসমাবেশ  যে কেবল সঙ্কটকালে করতে হবে, তা নয়। মাঝেমাঝেই সমাবেশ করে জাতিকে দ্বীনের পথে দা’ওয়াত দিতে হবে, নির্দেশনা দিতে হবে। দেশের আলিম-উলামার দায়িত্ব গতানুগতিক নেতানেত্রীর মতো নয়। তাঁদের দায়িত্ব ব্যাপক। তাই তাঁরা একদিকে যেমন দায়ী হিসাবে মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে ডাকবেন অন্যদিকে শাসক ও বিরোধীদলের দুর্বলতা ও ত্রুটি চিহ্নিত করে দেবেন। সমাবেশ সম্মিলিত ব্যনারে যেমন হতে পারে তেমনি হেফাজতে ইসলামের নামেও হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, সমাবেশের মেজাজ যেন রাজনৈতিক হয়ে না যায়; উচ্ছৃংখল-বক্তৃতা ও গোপন সওদাবাজি যেন উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করতে না পারে।

১৫.০৬.২০২৩  

 


ভাবনা-৪৭

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ একটি নব্য-স্বাধীন দেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্পর্ক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত, একটি মুসলিম দেশ হিসাবে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়নের বিকল্প ছিলো না সঙ্গতকারণে, ১৯৭৪ সালে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ওআইসি সম্মেলনে তাজুদ্দীন আহমদ ও ভারতের তীব্র বিরোধিতা সত্বেও যোগদান করেন তাজুদ্দীন আহমদ ও ভারতের মত ছিলো: বাংলাদেশ যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শে গঠিত একটি রাষ্ট্র তাই তা ক্ষুণ্ন করে লাহোরে যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয় কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান তাতে কর্ণপাত না করে বাস্তবতার খাতিরে লাহোরের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সম্মেলনে যোগদান করেন বস্তুত, তাঁর সে সিদ্ধান্ত ছিলো অত্যন্ত দূরদর্শী ও সময়োপযোগী উল্লেখ্য, ১৯৭২-এ প্রথম দেশে ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রথম জনসমাবেশে দেয়া ভাষণে ঘোষণা করেন: ‘আমি মুসলমান; আমার বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র’ (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, পৃ: ৬০৫) তাঁর এ ঘোষণা বাংলাদেশকে একটি অনিবার্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর মরহুম আবুল মনসুর আহমদ তাঁর লেখাআমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরগ্রন্থে সে-কথা উল্লেখ করে গেছেন কিন্তু প্রশাসনের ভেতর লুকিয়ে থাকা উগ্রসেক্যুলার অপশক্তি ও বামধারার লোকজনের প্রভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে দেশে ইসলামী রাজনীতি ও আলিম-সমাজের তৎপরতার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়  মরহুম আবুল মনসুর আহমদ তাঁর গ্রন্থেরমুজিবহীন বাংলাদেশঅধ্যায়ে আরও লিখেন:

মুজিবের অনুপস্থিতিতে যে সব অশুভ ঘটনা ঘটিতে পারে বলিয়া আমার আন্দায ছিল, আসলে তার চেয়ে অনেক বেশী অশুভ ঘটনা ঘটিতে লাগিল সব ঘটিতে লাগিল চিন্তায় কাজে উভয়তঃইএটা শুরু হইল প্রবাসী সরকার দেশে ফিরিবার আগে হইতেইপ্রথম ঘটনাটা ঘটিল স্বাধীনতার প্রায় শুরুতেই-১৮ই ডিসেম্বরে দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা উদযাপনের জন্য দিল্লীর রামলীলা ময়দানে এক বিরাট জনসভা হইলসে সভায় ভারতের দেশরক্ষা মন্ত্রী জগজীবনরাম বক্তৃতায় বলিলেন: ‘এতদিন পাকিস্তানের গর্বের বিষয় ছিল, সে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রগত পরশু হইতে সে গৌরব বর্তাইয়াছে বাংলাদেশের উপরবাংলাদেশই এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রআকাশবাণীর খবর অনুসারে মি: রামের এই উক্তি সেই বিরাট জনসভায় বিপুলভাবে অভিনন্দিত হইয়াছিলকিন্তু বাংলাদেশের সদ্য-দীক্ষিত একজন অফিসার মি: রামের উক্তির তীব্র প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন: ‘মি: রামের স্মরণ রাখা উচিৎ ছিল বাংলাদেশ একটি সেকিউলার রাষ্ট্র, মুসলিম রাষ্ট্র নয়আমি বুঝিলাম, এটা যদি বাংলাদেশ সরকারের সরকারী অভিমত হয়, তবে বিপদের কথা

মরহুম আহমদ আরও লিখেন:

প্রবাসী সরকার ঢাকায় ফিরার সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণিত হইল যে, এটা সরকারী অভিমতদেশে ফিরিয়াই তারা যা দেখাইলেন, তাতে রেডিও-টেলিভিশনে কোরান-তেলাওয়াত , ‘খোদা হাফেয’, ‘সালামালেকুমবন্ধ হইয়া গেলতার বদলেসুপ্রভাত’, ‘শুভ সন্ধ্যা’, ‘শুভরাত্রিইত্যাদি সম্বোধন প্রথা চালু হইল’   

শুধু মরহুম আহমদই নন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক আওয়ামী লীগ সমর্থক , এল খতিব তাঁর লেখাকারা মুজিবের হত্যাকারী?’ (Who killed Mujib) গ্রন্থে ৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন: 

“দেশ স্বাধীন হবার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রতিদিন প্রচলিতইনশাল্লাহএবংআসসালামু আলাইকুমশব্দ দুটি শুনলেও রাগে ফেটে পড়তো” (১ম প্রকাশ: ১৯৯২, শিখা প্রকাশনী, ঢাকা)

এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজ ক্ষুদ্ধ হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলেতা না হলে, বাংলাদেশের প্রথম পাঁচ বছরের শাসনতান্ত্রিক, সামাজিক উন্নয়নের ইতিহাস ভিন্ন হতোপাঠক আশা করি বুঝতে পারছেন, স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে চিহ্নিত কুচক্রীমহলের ষড়যন্ত্রে কওমী আলিম-সমাজ কিভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েনশুধু তাই নয়, বেশ কিছু আলিম ব্যক্তিত্বকে কারারুদ্ধ করা হয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের দোহাই দিয়েএরপর ১৯৭৫ সালে পটপরিবর্তনের পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরোত্তম বহুদলীয় রাজনীতির পথ খুলে দিলে কওমী আলিম-সমাজ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পান যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ; দুর্ভিক্ষগ্রস্থ ও বিপর্যস্ত অর্থনীতি; দারিদ্র্যে বিবর্ণ সমাজসব মিলিয়ে অসহনীয় পরিবেশ আলিম-সমাজ নিরুপায় হয়ে মাদরাসাগুলোকে গড়ে তোলার দিকে প্রাথমিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন যদিও কওমী মাদরাসা দেশীয় মুসলমানের সাহায্য-সহযোগিতায় চলে কিন্তু নব্য একটি দেশে বিপর্যস্ত অর্থনীতির কারণে দেশীয় চাঁদা, দান ইত্যাদি সংগ্রহে সীমাবদ্ধতা বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাই তাঁরা অনন্যোপায় হয়ে শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শে দেশের বাইরে যেতে মনস্থ করলেন সে মোতাবেক ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম (সংগৃহিত তথ্যানুসারে) বাংলাদেশের সুপরিচিত কওমী মাদরাসা চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার তৎকালীন পরিচালক সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুজুর্গ-ব্যক্তিত্ব শাহ মুহাম্মাদ ইউনুস সাহেব রহ. (যিনি আলিম-সমাজে হাজী সাহেব হুজুর নামে পরিচিত ছিলেন) আরব আমিরাত সফরে যান। এরপর চট্টগ্রামের জিরি মাদরাসার মুফতী নুরুল হক সাহেব রহ.  সৌদি আরব ও দুবাই সফর করেন (১৯৭৮)। এরপর নিকটবর্তী কোন সময়ে (আনুমানিক ১৯৭৯-১৯৮০) দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মাওলানা কাসেম সাহেব ফতেহপুরী রহ. আরব আমিরাত সফর করেন। আনুমানিক ১৯৮০-১৯৮১ সালের মধ্যে চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাচীন দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ফটিকছড়ির জামিয়া আরবিয়া নছিরুল ইসলাম (নাজিরহাট বড় মাদরাসা)-এর পরিচালক আল্লামা হাফিয শামছুদ্দীন সাহেব রহ. সৌদি আরব সফর করেন। এখানে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে: কওমী আলিম-সমাজ যখন মধ্যপ্রাচ্যে যান তাঁরা সেখানকার ধনাঢ্যব্যক্তিবর্গ বা সংস্থা থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে পূর্ব থেকে সৃষ্ট নেতিবাচক ধারণানির্ভর প্রশ্নের সম্মুখীন হন। এখানকার কওমী-আলিমসমাজ সেখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে সকল-প্রকার নেতিবাচক ধারণার বিপরীতে ইতিবাচক ধারণা প্রদান করেন এবং তাদেরকে এ কথাটি বোঝাতে সক্ষম হন যে, বাংলাদেশ মোটেও হিন্দু-প্রভাবিত রাষ্ট্র নয়। এখানে হাজার-হাজার মাদরাসা, মসজিদ, মক্তব আছে। এখানে সাহায্যের প্রয়োজন আছে। এখানকার নব্বই শতাংশ মুসলমান। আরব-ভাইদের প্রতি এদেশের মুসলমানের আন্তরিক ভালোবাসা আছে। এখানে ধনী মুসলিমরাষ্ট্রগুলোর সাহায্যের প্রয়োজন আছে; এখানে মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করছে; এখানে দরিদ্র-মানুষের আধিক্য আছে; এখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে গভীর নলকূপ বসানোর প্রয়োজন আছে; এখানকার সরকারকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়া উচিৎ ইত্যাদি। প্রসঙ্গত বলতে হয়, সে-সময়কার পরিস্থিতিতে আরব-সমাজে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেয়ার বিষয়টা ছিলো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। এমন কি এখানকার বাস্তবতা প্রমাণে কওমী আলিম-সমাজ আরব-সাহায্যদাতা ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশ সফর করারও আমন্ত্রণ জানান। পরে দেখা যায়, কওমী-আলিমসমাজের প্রাণান্তকর চেষ্টায় আরব-সমাজের তৃণমূলে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বিদূরিত হয়। এভাবে সময়ের ব্যবধানে তৃণমূলের উক্ত পরিবর্তন আরব-সমাজের উচ্চস্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে কওমী আলিম-ব্যক্তিত্ববৃন্দের সাথে আরব-সমাজের উর্দ্ধতনমহলের বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাতের কারণে আরব-প্রশাসনেও বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণার উদয় হয়। এরই ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে পবিত্র মক্কা ও মদীনার সম্মানিত ইমামগণ ও সৌদি আরবের জাতীয় স্পীকার চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী এবং ফটিকছড়ির জামিয়া ওবাইদিয়া নানুপুর পরিদর্শনে বাংলাদেশ সফর ('৯০-এর দশক) করেন যা সরকারের পক্ষেও আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। ফলে, একদিকে যেমন দেশের দরিদ্র এলাকায় মানবিক সাহায্য আসতে শুরু করে পাশাপাশি কওমী আলিম-সমাজের এ ভিত্তিগত দা'ওয়াতের সুফল চলে যায় বাংলাদেশ সরকারের হাতে ('৭৬-৮১')তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের সংযোগ ও পাশাপাশি কওমী আলিম-সমাজের তৃণমূল পর্যায়ের সংযোগএ দু'য়ের সংমিশ্রণে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়। বাংলাদেশে আসতে শুরু করে বৈদেশিক সাহায্যের একটি বিশাল অংশ যা এখানকার পরিকাঠামো নির্মাণে অসামান্য অবদান রাখে। এর সাথে শুরু হলো মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমশক্তি রফতানীর ধারা। বলতে দ্বিধা নেই, এখনও কওমী আলিমসমাজের যে অংশ মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষত বিভিন্ন মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিন হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন তাঁরা সার্বক্ষণিকভাবে আরব-সমাজে দেশ ও জাতি সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরিতে সচেষ্ট। আমরা অনেকেই জানি না, তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অসংখ্য শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে ঢুকতে সক্ষম হয়েছেন। প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্মলগ্নে কওমী-সন্তানদের এ অসামান্য অবদান ইতিহাস একদিন সঠিকভাবেই বিচার করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, ইতিহাসের এ অনস্বীকার্য বাস্তবতাকে এ জাতি মূল্যায়ন করতে কেবল ব্যর্থই থেকে যায়নি উপরন্তু জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সংগ্রামে অবিভক্ত জাতিসত্ত্বার স্বাদ ভোগ করতেও অক্ষম থেকে গেছে।

পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই, অনেক আলিম-উলামারাও জানেন না, মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে কওমী আলিমদের কতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়ে গেছেসাধারণ শিক্ষিতরা মনে করেন, এঁরা মসজিদ-মাদরাসা নিয়েই থাকেন; দান-সদকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেনএঁদের জাতীয় অবদান- বা কি? সাধারণ মনে রাখে না: রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিমুক্ত আলিমশ্রেণী নিম্নমধ্যবিত্তের জীবন ধারণ করে রাষ্ট্রকে কিভাবে সাহায্য করেছে এবং করছেতাঁরা যখন মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে যান, বিভিন্ন মসজিদ-মাদরাসায় দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে দেশের প্রতিনিধি হয়ে আরব বণিকশ্রেণীর কাছে বাংলাদেশের সমস্যার চিত্র বর্ণনা তুলে ধরেন নিঃস্বার্থভাবেমাদরাসা-পড়ুয়া হিসাবে আরবী জানা থাকার কারণে কওমীদের পক্ষে আরবী-এলিটদের বোঝানো অনেক সহজ, যা অন্যদের পক্ষে কঠিনঅথচ তাঁরা কোন সরকারী সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া দেশের জন্য নীরবে অবদান রেখে যাচ্ছেন, তা কি অস্বীকার করা যায়? তাঁদের কারণে, দরিদ্রশ্রেণী নগদ অবকাঠামোগত সাহায্য পায়; এখানে মসজিদ-মাদারাসা গড়ে ওঠে; এতিমখানা গড়ে ওঠে; বাড়ি-বাড়ি নলকূপ বসে ইত্যাদিকিন্তু রাষ্ট্র তাঁদের কোন মূল্যায়ন করা তো দূরের কথা, অবদানের স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয় নাউপরন্তু তাঁদের ভাগ্যে জোটে প্রতিক্রিয়াশীল, স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের শত্রু ইত্যকার তকমাকিন্তু যারা কাগজে-কলমে দেশ বেচে দেয়, তারা হয় দেশপ্রেমিক-টুকু ভাগশেষ নিয়ে দেশ কতোদিন চলবে, তা কেউ জানে না

১৩.০৬.২০২৩

 

ভাবনা-৪৬

আমাদের কওমী মাদরাসার আলিম-ছাত্রদের বাংলা বলা-লিখার ব্যাপারটি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক কারণ, তাঁদের শিক্ষার প্রধান ও মূল মাধ্যম প্রথমত ও প্রধানত আরবী এবং পরে উর্দূ ও ফার্সীতে বাংলা যে তাঁরা একদম পড়েন না, তা নয় কওমী মাদরাসায় পঠিত সিলেবাসের লক্ষ্য অর্জন ও প্রয়োজনকে সামনে রেখে দেশীয় ভাষা বাংলা, ইংরেজি, অংক ইত্যাদি পাঠ্যভুক্ত আছে এক সময় সেটা প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নত করা হয়েছে একটা সময় ছিলো, কওমী মাদরাসায় বাংলা পড়া বা বাংলা বইপত্র রাখা খুব একটা ভালো চোখে দেখা হতো না প্রয়োজনকে সামনে রেখে এখন সে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তন হয়েছে মানসিকতারও তাই দেখা যায়, কওমীদের মধ্যে বাংলাচর্চা এখন আগের সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে বাংলা নিয়ে পশ্চাদপদতার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে এবং এর জন্য কওমীদেরকে একতর্ফা দোষও দেওয়া যায় না বিষয়টি বোঝা দরকার বলাবাহুল্য, বাংলার সাথে সংস্কৃতভাষার আত্মীয়তা গভীর বাংলায় অনেক শব্দ এসেছে সংস্কৃত থেকে সেগুলো তৎসম ও অর্ধতৎসম শব্দ নামে পরিচিত মোগল আমলে ভারতের সরকারী ভাষা ছিলো ফারসী পাশাপাশি আরবী ছিলো মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষাইংরেজ-আধিপত্যবাদের শুরুতে বিশেষত ১৮৫৭ ব্যর্থ স্বাধীনতা-সংগ্রামের পর বৃটিশরা যখন রাতারাতি সরকারী ভাষা ফারসী পরিবর্তন করে মুসলিম সম্প্রদায়কে অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলে, স্বভাবত ইংরেজদের সংস্কৃতি ভাষার প্রতি মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে একটা ঘৃণার আবহ তৈরি হয়স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইংরেজদের সহযোগিতা করাপথে এগিয়ে গেলে মুসলিম সম্প্রদায় আরও হতাশ হনসে সময় যে বাংলা-সাহিত্য চর্চা হয় তা ছিলো মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে এবং হিন্দু ধর্মপ্রভাবিতফলে ভিন্ন বিশ্বাসের কারণে মুসলমানদের মাঝে তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনাগ্রহ দেয়তাঁরা তাঁদের চর্চা হিসাবে ফারসী, আরবী উর্দূকে ব্যবহার করতে শুরু করেএখানে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রত্যয় ছিলো ন্যায়সঙ্গতঠিক আমরা যেমন উর্দূকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে বাংলাচর্চাকে প্রাধান্য দিয়েছি এবং বাঙ্গালিত্বের স্বতন্ত্রতাকে রক্ষার চেষ্টা করেছিএখানকার কওমী মাদরাসাতেও সে প্রভাব পড়ে যুক্তিসঙ্গতভাবেবাংলা-সাহিত্যে নজরুল-যুগের সূচনা না হলে আজও হয়তো বাংলা সাহিত্যের প্রতি বিরাগের ধারা অব্যাহত থাকতোকারণ, আপন বিশ্বাস সংস্কৃতি রক্ষার তাগিদের প্রেক্ষাপটে হিন্দু-বিশ্বাসপ্রভাবিত বাংলা-সাহিত্যকে মুসলিমরা কখনোই গ্রহণ করতে পারেনিএর উপর বঙ্কিমদের মতো উগ্রসাম্প্রদায়িক বাংলা-সাহিত্যচর্চা মুসলিম-সমাজে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করেএসব কারণেআদি বাল্যশিক্ষা পরিবর্তেমুসলিম বাল্যশিক্ষাশিশুপাঠের গোড়াপত্তন ঘটে

তে বাংলা-সাহিত্য মূলত দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েএর জন্য দায়ী হিন্দু সাহিত্যিকেরা যারা সচেতনভাবে মুসলিম উপাদানকে পরিহার করে গেছেন তাঁদের সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কারণেরবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রও এর ব্যতিক্রম ননমধ্যযুগে আরাকান রাজসভার সাহিত্যচর্চার ইতিহাস উম্মোচিত না হলে কেউ জানতো না: চট্টল-সন্তান মহাকবি আলাওল দৌলত কাজীরা মুসলিম-সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা-সাহিত্যও চর্চা করেছেনসঙ্গতকারণে, আমাদের বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাতেও আরবী, ফার্সী, উর্দূর পাশাপাশি বাংলাচর্চা প্রাথমিক অবস্থায় প্রয়োজনীয় গুরুত্ব পায়নিএর আরও একটি কারণ হলো, কওমী মাদরাসা মূলত একটি ধর্মীয় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আরবী, ফার্সী, উর্দূর মতো বাংলাতে যথেষ্ট পরিমাণ উপাদান না থাকা এরপর আসে গতানুগতিক বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গীর বিষয় এখানে সবাই কিন্তু দায়ী নয় ক্ষুদ্র হলেও কওমীদের একটি সচেতন অংশ কওমী অঙ্গনে বাংলা ভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাচর্চাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেনব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগউভয় দিক থেকে গতিতে মন্থর হলেও কওমীদের মধ্যে বাংলাচর্চা অব্যাহত থাকে বৃটিশ আমল থেকেপাকিস্তান আমলেও ছিলো এমন প্রচেষ্টা কেউ বাংলাতে কুরআন-হাদীসের অনুবাদগ্রন্থ করেছেন; কেউ তাফসীর, কেউ সীরাত, কেউ বা ইতিহাসগ্রন্থ করেছেনপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেও চলেছে উদ্যোগযেমন চট্টগ্রাম থেকে আঞ্জুমানে হেদায়তুল ইসলামএটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৬০ দশকে প্রখ্যাত শাইখুল হাদীস মাওলানা ইসহাক গাযী রহ.’ হাতেসেখান থেকে বেশ কিছু প্রকাশনা বের হয়১৯৭১ সালে যুদ্ধের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায় ছাড়া বিভিন্ন কওমী মাদরাসা থেকে স্মারক, পুস্তিকা মাসিক পত্রিকাও বের হতো যা আজও বর্ধিতাকারে অব্যাহত আছেএসবের মধ্যে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. কর্তৃক সম্পাদিত প্রকাশিত মাসিক মদীনার কথা না বললেই নয়বলতে দ্বিধা নেই, কওমী অঙ্গনে বাংলাচর্চার উন্নয়নের পেছনে মাসিক মদীনার প্রভাব ছিলো সর্বজনবিদিতএরপর আসে চট্টগ্রামের দারুল উলূম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী থেকে প্রকাশিত মাসিক মুঈনুল ইসলামের কথা১৯৩৪ সালে প্রখ্যাত বুযুর্গ আলিম দারুল উলূম হাটহাজারীর সাবেক পরিচালক মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেব রহ.’ তত্ত্বাবধানেইসলাম প্রচারনামে একটি সাময়িকী প্রকাশিত হয়১৯৫২ সাল থেকে সেটিমাসিক মুঈনুল ইসলামনামে আজও প্রকাশিত হয়ে আসছে১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মুখপত্র মাসিক আত তাওহীদ

কওমীদের বাংলাচর্চা নিয়ে সাধারণ শিক্ষিতমহলে নেতিবাচক মানসিকতা আছেতারা মনে করেন, কওমীরা মননে বলায় আধুনিক ননবাংলা বলায় তাঁরা দুর্বল; লেখায় প্রাইমারী পর্যায়ের এবং চিন্তায় অনগ্রসরযেহেতু কওমীমহল নির্দিষ্ট সীমানায় থাকে তাই তাঁরা হয়তো সমালোচনা সম্পর্কে যতোদূর জানা দরকার ততোদূর জানেন না বা অতোটা গায়ে মাখেন নাআসলেই কি কওমীদের সমালোচনা যথার্থ? আমার মনে হয়, সমালোচনার পুরোটা কওমীরা বহন করার কথা নয়তবে দায়টা নিদেনপক্ষে অর্ধেক তো নিতেই হবেকারণ, মাতৃভাষা হিসাবে বাংলার প্রতি কওমীদের দৃষ্টিভঙ্গী সিংহভাগ সুখকর নয়একটা অজানা অবহেলার দূরত্ব অস্বীকার করা যায় নাফলে ছাত্রেরাও সে প্রভাবে প্রভাবিত হয়ভালো আরবী, উর্দূ বা ফার্সী বললে বা লিখলে যে পরিমাণ বাহবা মিলে, বাংলার ভাগ্যে সে পরিমাণের সিকিভাগও জোটে নাএখানে প্রাতিষ্ঠানিক কিছু ব্যাপারও আছেযেহেতু শিক্ষার মূল মাধ্যম আরবী, উর্দূ তাই বাংলা যে স্বাভাবিকভাবে অপুষ্টিতে ভুগবেসে তো অবাঞ্ছনীয় নয়এরপরও অবহেলার যুক্তি টিকবে বলে মনে হয় নাকারণ, মাতৃভাষার প্রতি অগ্রহণযোগ্য অবহেলামনে রাখতে হবে, যে ভাষাতেই শিক্ষা গ্রহণ করুক না কেন, সবকিছু অন্তরে বিচরণ করে মাতৃভাষার আবরণেইআমরা ভুলে যাই, ভাল সাহিত্যচর্চার বুনিয়াদ কিন্তু মাতৃভাষার ওপর ভাল দখলের ভিত্তিতেআপনি ভালো আরবী সাহিত্যিক হবেন, তবে অবশ্যই আপনাকে মাতৃভাষাতে ভাল সাহিত্যজ্ঞান রাখতে হবেযে আপন মায়ের মমতা বুঝতে অক্ষম সে পুরো নারী জাতির মমতা কি করে বুঝবে? মাতৃভাষার প্রতি কওমীদের দূরত্বের মূল কারণ সংকীর্ণ মানসিকতাএখান থেকে মুক্ত হতে না পারলে সে ক্ষত পুষবে বলে মনে হয় নামানসিকতার মেরামত হলে চর্চার প্রসার হবে শুদ্ধপথে

এবার আসুন বলা নিয়েসমালোকেরা বলেন: ওনাদের উচ্চারণ মানের নয়; শব্দের আমদানী যথার্থ নয়ঠিক আছে ধরেই নিলাম, কওমীদের স্ক্রু টাইট নয়যাঁরা বলেন তাদের কি অবস্থা? তাঁরা কি শুদ্ধ বলেন? আমাদের নাগরিকদের সবচেয়ে শিক্ষিতশ্রেণী বলে যাঁদের জানি, সেই তাঁরা নিশ্চয় য়ুনিভার্সিটির শিক্ষক বা বিচারবিভাগের বিচারকবৃন্দবাংলা বলায় তাঁদের অবস্থা কি? প্রখ্যাত বিচারপতি জনাব শাহাবুদ্দীনের কথা মনে আছে? তিনি যখন ১৯৯ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন, তাঁর দেয়া প্রথম ভাষণের কথার মনে আছে? আমার এখনও মনে আছে, প্রচুর ভুল উচ্চারণে তিনি সেদিন বাংলাতে ভাষণ দিয়েছিলেনতখন খারাপ লাগেনি? টকশোতে বাংলাদেশের য়ুনির্ভাসিটির সেরাসব জ্ঞানীদের আলোচনা তো হরহামেশা শুনছিএকে তো ভুল বাংলা উচ্চারণ, তার পর সাধু-চলিত রীতির মিশ্রণ আঞ্চলিক উচ্চারণ-কি লঙ্কাকাণ্ড না দিল্লীকাণ্ড বোঝা মুশকিলএখন আরেক আপদ হলো, আমাদের শিক্ষিতেরা যা বলেন, সে কোন ভাষা প্রশ্ন করতে হয়যদি কথা বলেন দুই মিনিট, সেখানেবাট/সোমিলিয়ে ইংরেজি থাকে দেড় মিনিটআচ্ছা, তো বাংলা-ইংরেজি মেশানো বিলকুলবাংরেজি ভাষাতাই না! বিশিষ্ট প্রাগ্রসর রাজনীতিক বলে খ্যাত আন্দালিব রহমান পার্থ বা রেজা কিবরিয়ার কথা শুনেছেন? তাঁরা জ্ঞানী, স্বীকার করিকিন্তু তাঁদের কথাগুলো তো শ্রুতিমধুর নয়ই, এদেশের সাধারণ মানুষের বোধগম্যও নয়জনাব ওবায়দুল কাদের বা অন্য গতানুগতিক রাজনীতিকদের কথাগুলোকে বাংলানা বলে, ‘দাঙ্গাবললে সমস্যা থাকার কথা নয়ঢাকা য়ুনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রদের ইংরেজি লেখার কায়দাটা একবার দেখুন! তখন কি কওমীর সমালোচকদের জাতে লাগে না? আসলে কওমীদের প্রতি, মাদরাসায় পড়ুয়াদের প্রতি এক ধরনের অবৈধ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সমালোচনাগুলো হয়আমি বলছি না, কওমী-ঘাটতি তাই চলতে দেয়া দরকারনা, সে হবে কেন? অপরের ভুল কি আমার ভুলকে বৈধতা দেয়? বরঞ্চ অপরের ভুল থেকে সংশোধনের শিক্ষা নেয়া উচিৎ।

কওমীদের বাংলাচর্চার সংস্কৃতিটা সংস্কার করা প্রয়োজন। পাঠ্যক্রমে কেবল মাধ্যমিক পর্যায়ের সাধারণশিক্ষা রাখলেই বাংলাচর্চার দায়িত্ব আদায় হলোসে কথা ভুল। প্রত্যেক মাদরাসায় একটি করে বাংলা বিভাগ থাকা দরকার। সেখানে প্রতিভাবান ও অভিজ্ঞ শিক্ষক থাকতে হবে। তিনি মাদরাসার পাঠ্যসূচী ও সময়ের সাথে সমন্বয় করে একটি পরিকল্পনা করবেন যেনো সময়ের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে বিভিন্ন জামাতের ছাত্রদের বাংলাচর্চাকে বেগবান করা যায়। যেমন ধরুন, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়এ রকম ধাপে কোন-কোন বিষয়কে আনা যায়। মনে করি, প্রথম ধাপে ধ্বনির বিশ্লেষণ ও উচ্চারণস্থান বা মাখরাজ, দ্বিতীয় ধাপে বর্ণের উৎস ও বিশ্লেষণ এবং মাখরাজ, তৃতীয় ধাপে শব্দের গঠন ও শব্দচয়ন ইত্যাদি। এমন পরিকল্পনা-প্রশিক্ষণের সময় সবার ক্ষেত্রে অভিন্ন নাও হতে পারে, প্রয়োজনে মূলশিক্ষার অগ্রাধিকার বিবেচনায় সময় বেছে নেয়া যেতে পারে। রমজান মাসে যেমন বন্ধের সময় আরবী ব্যাকরণ বা কিরাতের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয় তেমনি অন্য বন্ধকেও কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠান যদি এসবে জড়িত না থাকে তবে তা সফল হবে বলে মনে হয় না। মাঝেমাঝে বাংলাচর্চা নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করলে ভালো ফল বেরুবে বলে আশা করা যায়। এর সবকিছু নির্ভর করবে প্রতিষ্ঠান-প্রশাসনের সদিচ্ছার উপর। কারণ, চাপ বিনে তাপ উৎপাদন হয় না।

১১.০৬.২০২৩


ভাবনা-৪৫

সম্প্রতি চলে গেলেন দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর পরিচালক মাওলানা ইয়াহইয়া সাহেব রহ. ২০২১ সালে এ সুপ্রাচীন মাদরাসার দায়িত্ব নিয়ে এ বছর তিনি চলে গেলেন এক সময় কওমী মাদরাসাগুলো বুজুর্গব্যক্তিত্বের পদভারে মুখরিত ছিলো এ যেনো বাগানভরা ফুলের এক সমাহার নানা ফুলের নানা খুশবুতে মোহনীয় হয়ে থাকতো কওমী অঙ্গন দারুল উলূম হাটহাজারী ছিলো এসব ফুলের কেন্দ্রবিন্দু। দুই দশক আগেও কওমী অঙ্গনে দেখা মিলতো অসামান্যসব ব্যক্তিত্বেরযাঁদের সান্নিধ্যে বেহেশতী ছোঁয়া তন্দ্রায়িত করে দিতোহঠাৎ করে কি এক প্রলয় ঘটে গেলোএকেএকে সবাই চলে গেলেন পেছনে শূণ্য পড়ে রইল শুষ্করুক্ষ অসহায় গুলশান আগের সে দৃশ্য যারা দেখেছেনতাঁদের ব্যথাই সবচেয়ে বেশি জাগে বর্তমান প্রজন্ম সে ব্যথা বুঝবে না আজও মনে পড়েযখন সে-সব মহানেরা বিচরণ করতেনবুকে অজানা সাহস অনুভব করতাম সেখানটায় আজ বেদনা-বিচ্ছেদের বিষাদ-সিন্ধু ৮০র দশকে যখন হাফেজ্জী হুজুরের খেলাফত আন্দোলনের জোয়ারে চারদিক থৈথৈ করছিলোদেখতাম দলেদলে বুজুর্গ আলিমের মজলিসওয়াজ মাহফিলখেলাফতের সমাবেশ ১৯৮৭/৮৮/৮৯র দিকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ মাঠে বসতো আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন শাইখুল আরব ওয়াল আজম হাজী ইউনুস সাহেব রহ., সুলতান আহমদ নানুপুরী রহ., আলী আহমদ বোয়ালভী রহ., উস্তাযুল আসাতিযা হযরত ইসহাক আল গাযী রহ., খতীব মাওলানা ওবায়দুল হক সাহেব রহ., মাওলানা তফাজ্জল হক সিলেটী রহ., মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ., মাওলানা আহমদুল্লাহ আশরাফ রহ., খতীবে ইসলাম মাওলানা মোজাহিরুল ইসলাম রহ.  প্রমূখ বুজুর্গ আলিমে দ্বীন সভামঞ্চকে আলোকিত করে রাখতেন বিদেশ থেকে আমন্ত্রিত হতেন আল্লামা তাকী উসমানী দা.বা., মাওলানা রফী উসমানী রহ., মাওলানা সালেম কাসেমী রহ., খতীবে ইসলাম মাওলানা আব্দুল মজীদ নদীম রহ., ফিদায়ে মিল্লাত মাওলানা আসআদ মাদানী রহ., মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকী শহীদ রহপ্রমূখ আলিমে দ্বীন মাওতাকী উসমানী ছাড়া এঁরা এখন আর কেউ বেঁচে নেইসবাই চলে গেছেন ওপারে তাঁদের শূন্যতা আর পূরণ হয়নিহবারও নয়

তিক্ত হলেও সত্যবর্তমানের কওমী অঙ্গনের চিত্র আগে কখনও কল্পনাতে আসেনি এ মরুকরণ মন মানতে চায় নাজানিএ পৃথিবীতে কেউ থাকেনিপরের জনেরাও থাকবার নয় কিন্তু যাঁদের চরণস্পর্শে কওমী মাদরাসাগুলো প্রাণচাঞ্চল্যে চঞ্চল হয়ে থাকতোতাঁদের অবর্তমান যেনো এক বিভীষিকা মরুর মাঝে পিপাসার্ত মুসাফির যেমন করে খুঁজেফিরে একবিন্দু জলতেমন করে সত্যান্বেষীরাও খুঁজে ফিরছে হারিয়ে যাওয়া অভিভাবকদেরকে কওমীর পৃথিবীতেযদি কোথাও দেখা মেলে। আমার মাঝেমাঝে দীর্ঘশ্বাসে মনে হয়এভাবে শূণ্য হয়ে পড়লে কেমন করে চলবে কওমী অঙ্গনএকদিন কিয়ামত হবেপৃথিবী অস্তিত্ব হারাবেসবই সত্যি “মাওতুল আলিম কামাওতুল আলম সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। ধ্বংসোম্মুখ পৃথিবী তো এটাকেই চায়। তাই বলেক্ষান্ত দেয়ানাতাতো হতে পারে না মানুষ আসবে মানুষ যাবেতাই বলে কি জীবন থেমে রবেএকবার ভাবুন তোসিদ্দীকে আকবর রজি.’র ইন্তিকালে খিলাফত কি থেমেছিলোফারুকে আযম রজি.’র শাহাদাতে ইসলামের অগ্রযাত্রা কি থমকে গিয়েছিলোতাহলে আমাদের মুহসিন উত্তরসুরীদের ব্যথিত বিদায়ে কওমী জগৎ কেন অসহায় হয়ে থাকবে জানিগাড়ি পথ ঠিকই চলবেকিন্তু অগ্রজদের মতো করে সম্ভব নয়তবুও একবুক আশায় এগুতেই হবে এ কওমী কাননকে বাঁচিয়ে রাখতে

আমাদের গুলশানে হরেক ফুল হরেক সুগন্ধ দিয়ে মাতোয়ারা করে রেখেছে মুসলিম উম্মাহকে কেউ তাফসীরকেউ হাদীসের গবেষণাকেউ ফিকাহকেউ রাজনীতিকেউ ইতিহাসএমনি আরও অনেকে বিভিন্ন শাখা-উপশাখায় আপন-আপন অবদান দিয়ে বিশ্বকে বিমোহিত করেছেন শাইখুল হিন্দ মাহমূদ হাসান দেওবন্দী রহ.’র পরে তাঁর দরস থেকে উঠে এসেছেন একঝাঁক বে-নযীর সৈনিকখাতিমুল মুহাদ্দিসীন আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী, হাকীমুল উম্মাহ আশরাফ আলী থানভীমাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানীমাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীমাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানীমাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধীমুফতী কিফায়তুল্লাহ দেহলভী প্রমূখ এঁরা একেকজন একেক পথের দিশারী হয়ে আজও অমর হয়ে আছেন দারুল উলূম হাটহাজারীর সদ্য মরহুম পরিচালক মাওলানা ইয়াহয়া রহ.’র ইন্তিকালের খবর শোনার পর থেকে বড়ো ব্যথিতহৃদয়ে কথাগুলো ভাবছিলাম হযরতের সাথে আমার যে কোন ঘনিষ্ঠতা ছিলোতা নয় এ এক হৃদয়ের আত্মীয়তা শুনেছিপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় মরহুমের অসাধারণ দক্ষতা ছিলো এমন মানুষই তো কওমীদের বড়ো দরকার ঠান্ডামাথার ব্যক্তি হিসাবেজাগতিক সমস্যাকে সহজপন্থায় মুকাবিলা করার গুণান্বিত পুরুষ হিসাবে তাঁর দক্ষতা ছিলো বলে শুনেছি। দুর্ভাগ্য আমাদেরআমরা তাঁকে হারালাম বড়ো প্রয়োজনের সময়আবেগ আর অদূরদর্শীতার ঝড়ো বাতাসে যখন কওমী জগৎ কম্পমানসে সময় মাওলানা ইয়াহয়া সাহেবের মতো একজন মানুষের দারুল উলূম হাটহাজারীর পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ অনেক বড়ো পাওয়া। সে পাওয়ার আবেদন না ফুরাতেই বিদায়ের ঘণ্টা আরও একবার কওমী জগতকে ধাক্কা দিয়ে গেলো

এখানেই আমাদের তরুণ আলিম-প্রজন্মের পথচলার আহ্বানগুরুভার কাঁধে নিয়ে সম্মুখে এগুবার প্রত্যয়কওমী-জগতকে নতুনত্ব দিয়ে সাজিয়ে বিশ্বায়িতকরণের উদাত্ত আবেদন। কেবল পূঁথিগত শিক্ষার নিগড়ে আবদ্ধ না থেকে গভীর লক্ষ্য থেকে মনিমুক্তা তুলে এনে কওমী জগতের গলায় জেওর পরাবার প্রত্যয়ে সজ্জিত হোক আমাদের নতুন  তরুণ-প্রজন্মের আলিমদের জিন্দেগী। তাফসীর থেকে ফলিত তাফসীর (Applied  Tafseer), ফিকাহ থেকে ফলিত ফিকাহ (Applied Fiqh ), তাফাসীরে হাদীসের বিশ্বায়ন (Globalization of Hadith and it’s explanation ), ইসলামী ইতিহাসের ভূরাজনীতিক বৈশিষ্ট্য (Geo-political characteristics of Islamic history), হিজরাতপূর্ব ইসলামী দর্শন (Islamic perspective before hijrah), হিজরাতোত্তর ইসলামী দর্শন (Islamic perspective after hijrah ), তূলনামূলক ধর্মতত্ত্ব (Comparative Theology )সবকিছুতে তাঁরা অর্জন করবেন পারদর্শিতা ও অভিজ্ঞতা। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে তাঁরা বুনিয়াদ ঢালবেন মৌলিক ও আধুনিক প্রতিষ্ঠানের। এই তো আমাদের আরাধ্য; চাওয়া। গতানুগতিক সংস্কৃতিকে আকায়েদের আবরণে আবৃত না করে মৌলিকত্বকে বিস্তৃত করার মানসে প্রযুক্তিবিধৌত কদম হোক তরুণ-প্রজন্মের আলিমদের সম্বল। সুন্নাহ’র অনুসরণকে ক্ষতবিক্ষত না করে আধুনিক জগতের কাছে ইসলামকে উপস্থাপনার প্রত্যয় হোক প্রতিজ্ঞার মূলধন। কিন্তু কারা হবেন সে সৈনিক? কারা সাহসে দণ্ডায়মান হয়ে হাতে তুলে নেবেন নয়া জামানার নিশান? নিরাশার মেঘ দূর করে সে সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখবে আমাদের কওমী সন্তানএ স্বপ্নকে অনাত্মীয় ভাবতে পারবো না কখনও। কেন ওরা পারবে না? পারতেই হবে। ওরা যে ইবনে খালদুনের উত্তরসুরী! ওরা যে ইমাম রাযীর রুহানী সন্তান; ওরা যে ইমাম গাযালীর পাহারাদার! ওরা যে জালালুদ্দীন রুমীর ফরযন্দ। আমরা আজ জড়ো হয়েছি খর্জুরবৃক্ষের নিচে দু’ফোটা রস আস্বাদনের নিমিত্ত। নিশ্চয়ই আমাদের কওমী সন্তানেরা আমাদেরকে নিরাশ করবে না। বিশ্বমণ্ডলে জ্ঞান আর বিজ্ঞানকে ইসলামের পোষাকে সজ্জিত করে পরিবেশন করার দায়িত্ব তো তাঁদেরই। তাঁরা তো কওমী কাননের পাহারাদারআগামীর সিপাহসালার।

০৬.০৬.২০২৩


ভাবনা-৪৪


শুনে খুব ভালো লাগছে ২০২১ সালের মুদিবিরোধী বিক্ষোভ-হরতালের কারণে কারাবন্দীরা মুক্তি পাচ্ছেন এখনও কয়েকজন বন্দী আছেন দেশের বিভিন্ন কারাগারে আল্লাহ চাহে তো সবাই মুক্তি পান এবং বিনাদোষে যারা কারাগারে ধুঁকেধুঁকে কাল কাটাচ্ছেন তাঁরাও মুক্ত হোনএ দোয়াই করিবলাবাহুল্য, ২০২১ সালের মার্চে মুদিবিরোধী বিক্ষোভ-সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শতশত কওমী ধারার আলিম-ছাত্রকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয় বলা চলে, সেটি ছিলো কওমীদের উপর সরকারের পক্ষ থেকে একটি পরিকল্পিত ক্র্যাকডাউন মুদির আগমনে সেদিন ২৬শে মার্চ শুক্রবার পবিত্র জুমার নামাযের পর জাতীয় মসজিদ বাইতুল মুকাররমে যা ঘটে তাতে স্পষ্ট বুঝে নেওয়া যায়: একটা গোলমালের প্রেক্ষাপট তৈরি করে কওমী বা হেফাজতকে শিক্ষা দেয়াপরিকল্পনা ছিলো কারণ, সরাসরি মুদির আগমনহেতু প্রতিবাদের কারণে কোন ব্যবস্থা নেয়া হলে তা কেউ ভালো চোখে দেখবে না তাই দরকার হয়ে পড়ে, একটি প্রেক্ষাপট তৈরির যেখানে হেফাজত বা কওমীদেরকে আক্রমণকারী হিসাবে চিত্রিত করা যাবে তেমনটাই করতে গিয়ে সরকারের অজ্ঞতা ও অদূরদর্শীতার কারণে বল চলে যায় প্রতিবাদকারীদের কোর্টে বাইতুল মুকাররমে ঘটিত ঘটনার বিভিন্ন ভিডিও-ক্লিপ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, সরকারদলীয় লোকেরাই উদ্ভুত গোলযোগের হোতা পরের দিন সুপরিচিত দৈনিক মানবজমিনের শিরোণাম ছিলো: “বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সংঘর্ষ, পুলিশের সঙ্গে অ্যাকশনে যুবলীগ-ছাত্রলীগ সম্ভবত সরকারের হিসাব ছিলো, উক্ত ঘটনার রেশ ধরে দেশের অন্যান্য স্থানেও গোলমাল হবে এবং ব্যবস্থা নেয়ার পথ সৃষ্টি হবে দুর্ভাগ্যবশত হয়েছেও তাই সরকারের ওধরনের পরিকল্পনাকে ভেতর থেকে সহায়তা করেছে হেফাজতের একটি অংশের হুজুগনির্ভর ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত ২৭ তারিখের ঘোষিত হরতাল নিয়ে আমি বিভিন্ন খোঁজ-খবর নিলাম বুঝতে পারলাম, সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করা হচ্ছিলো সমন্বয়হীনভাবে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছিলো, ঢাকায় মহাসচিব তা জানতেন না আবার ঢাকা থেকে মহাসচিবকে এড়িয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া হচ্ছিলো, কেন্দ্র সে ব্যাপারে ওয়াকিফহাল ছিলো না সম্মিলিত বৈঠক ডেকে সামগ্রিক আলাপের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন প্রমাণপাওয়া যায়নি বিশেষত, হরতালের সিদ্ধান্ত নিয়ে ধোঁয়াশা ছিলো সর্বত্রতা’ছাড়া, রহস্যজনক কারণে ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছিলো না। সেদিনকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে খোদ মহাসচিব যে অন্ধকারে ছিলেন তা তিনি কয়েকজনের কাছে ফোনে জানিয়ে ছিলেন বলে আমি নির্ভরযোগ্যসূত্রে জানতে পারি এমন পরিস্থিতি কেমন করে হতে পারলো; কারা দায়ী ছিলো, জানি না। সময়ে একদিন তা প্রকাশিত হবে

বাংলাদেশে আমাদের কওমীদের দ্বারা সংঘটিত আন্দোলনের গতিধারা পর্যালোচনা করলে কিছু পদ্ধতিগতদুর্বলতা চেখে পড়ে কারও কাছে ওগুলো দুর্বলতা বলে নাও মনে হতে পারে তাঁদের মতামতকে সম্মান করে আমি আমার মতামতটাকে তুলে ধরছি মাত্র আগে বলে রাখছি, সবকথা এখানে বলা সম্ভব নয় আন্দোলন নিয়ে আমাদের ঐতিহাসিক ও তত্ত্বগত লেখাপড়া নগণ্য বলা চলে যেমন ধরুন, একটি আন্দোলনের কল্পনাতে কতোগুলো শর্ত থাকতে হয়: আন্দোলনের উদ্দেশ্য, স্থান, কাল, দর্শন ও পদ্ধতি এগুলো মৌলিক বিষয় আমি অবশ্য এখানে প্রথাগত আন্দোলনের কথা বলছি না এখানে আন্দোলন মানে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্থান, কাল ও দর্শনের মাপকাঠিতে প্রশিক্ষিত কর্মী ও সমমনা জনমত সৃষ্টি করে বাস্তবায়নে পদ্ধতির প্রয়োগ দেশের বাইরে সংঘটিত আন্দোলন থেকেও আপনি উপযুক্ত উপাদান নিতে পারেন কিন্তু সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে নিজ স্থান, কাল ও কৌশলের ছাঁচেহুবহু বাইরের আন্দোলনকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করতে সমস্যা আছে ধরুন, আপনি আফগানিস্তানের তালিবান আন্দোলন বা জিহাদের কথা বলতে পারেন তাহলে প্রথমেই আপনাকে বুঝতে হবে স্থান হিসাবে এটা আফগানিস্তান নয় এখানে শত্রুপক্ষ দেশ দখলও করতে আসেনি এখানকার সমাজ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী আফগানিস্তানের মতো নয় এ বাস্তবতা আমাদেরকে বুঝতে হবে হ্যা, আপনি তাঁদের বৃদ্ধিবৃত্তিক কৌশল, গৃহীত সিদ্ধান্তে অনড় অবস্থান, প্রতিপক্ষের সাথে সংলাপের সামর্থ্য ইত্যাদি উপাদান নিতে পারেন কিন্তু কথায়-কথায় অগ্নিশর্মা হয়ে আক্রমণাত্মক হতে পারেন না যখন আপনি লক্ষ্য ঠিক করবেন, আপনাকে চিনতে হবে এখানকার সমাজকে; সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীকে; দেশীয় পরিবেশকে এবং জনসংখ্যার চিন্তাচেতনাকে অন্যথায়, আমার-আপনার মাধ্যমে অনাসৃষ্টি হবে, সৃষ্টি হবে না  তাই তো ইসলামের ফকীহবৃন্দ সর্বসম্মতে বলেন:

من لم يعرف بأهل زمانه فهو جاهل

(অর্থাৎ, যে তার চারপাশের মানুষকে জানে না সে মূর্খ)

আসুন এবার ইতিহাসের দুটো বিখ্যাত আন্দোলন নিয়ে কথা বলি একটি হলো, দ্বীনে ইলাহীর বিরুদ্ধে মুজাদ্দিদ আলফে সানী রহ.- আন্দোলন এবং অপরটি: আলিম-সমাজের ইংরেজবিরোধী আন্দোলন দেখুন, দুটো আন্দোলনের প্রতিপক্ষ, কাল, পরিবেশ, পদ্ধতি, চরিত্র ভিন্নভিন্ন কিন্তু মৌলিক লক্ষ্য অভিন্ন বাদশাহ আকবরের দ্বীনে ইলাহীযা ছিলো ইসলামের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ, মুজাদ্দিদ আলফে সানী রহ. তার মূলোৎপাটনে কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, গভীর উপলব্ধিতে আনা উচিৎ উপমহাদেশের বিখ্যাত আলিম গবেষক মাওলানা মানযূর নুমানী রহ. তাঁর লেখা تذکرہ مجّدد الف ثانی (তাযকিরায়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহ.) গ্রন্থে হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের কর্মতৎপরতার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন তিনি লিখেন: মুজাদ্দিদ সাহেব প্রথমে দৃষ্টি নিবন্ধ করেন দ্বীনে ইলাহী ভ্রান্ত বিশ্বাস দৃষ্টিভঙ্গীর উৎসের দিকেএতে তিনি দেখেন তিনটি উৎস থেকে দ্বীনে ইলাহীর ধারণা এসেছেসেগুলো: . প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি যারা সর্বশ্রেণীর ঐক্য রাজনীতিক স্বার্থের নামে ভুল ব্যাখ্যার কারণে নিজেদেরকে ইসলামী চিন্তাধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধর্মহীন (ধর্মনিরপেক্ষ), এর চেয়ে বেশি হিন্দুত্ববাদে প্রযুক্ত করে; . ওসব দরবারী আলিম (علمائے سو) যাদের অভিপ্রায় ছিলো ভালোভাবে পার্থিব স্বার্থ অর্জন, প্রশাসনের হর্তাকর্তা মন্ত্রীদের সন্তুষ্টি রক্ষাকল্পে অন্যায়কে ন্যায় বলে প্রতিষ্ঠিত করা এবং নিজ প্রবৃত্তির লালসা পূরণে ইসলামে অপব্যাখ্যার সুযোগ সৃষ্টি এবং . ঔসব পথভ্রষ্ট সুফী যারা শরীয়তকে দৃশ্যবাদীদের খেলনা গণ্য করে পবিত্র শরীয়ত হাকীকতের নামে নিজেদের কল্পিত এক ধুম্রজাল সৃষ্টি করে রাখে, যেখানে মানুষ নিজেকে খোদা গণ্য করতে পারে আবার খোদার পুত্রওএতে একজন আল্লাহওয়ালার জন্য কামিল হওয়া সত্ত্বেও গুনাহ প্রবৃত্তির প্রত্যেক শাখায় লিপ্ত হওয়ার পথ খোলা থাকে (পৃ:১৩৮, প্রকাশ:১৯৭৭, দারুল ইশাআত, করাচী, পাকিস্তান)হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব রহ. উক্ত তিন উৎসকে সামনে রেখে তাঁর যাবতীয় দাওয়াতী ইসলাহী মিশন শুরু করেন এবং আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে সফলতা অর্জন করেনএই হলো মুজাদ্দিদ আলফে সানী আন্দোলনের একটি ক্ষুদ্র ধারণাএরপর আসে উপমহাদেশের ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনবলাবাহুল্য, আন্দোলন আবার মুজাদ্দিদ সাহেবের আন্দোলনের সাথে ভিন্ন প্রকৃতিরকারণ, সম্রাট আকবরের জমানায় বহিঃশত্রুর প্রশ্ন ছিলো নাএখানে দখলদার ইংরেজশক্তির উপস্থিতি ছিলো; মুসলিমদের জন্য সরাসরি অবিশ্বাসীদের সাথে লড়াইয়ের ক্ষেত্র ছিলোতাই, শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী রহ. কর্তৃকদারুল হারববা শত্রুকবলিত দেশ ঘোষণার পর তৎকালীন ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়যেমন, মহীশুরের সুলতান ফতেহ আলী টিপুর যুদ্ধ, পলাশীর স্বাধীনতাযুদ্ধ, সায়্যিদ আহমদ শহীদের বালাকোটের জিহাদ, তিতুমীরের প্রতিরোধযুদ্ধ এবং সর্বোপরি ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধঅবশেষে ৫৭ স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্যর্থ হবার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে নেতৃত্বাস্থানীয় আলিম-সমাজ আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ঠিক করার লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণে মনযোগী হনতাঁরা লক্ষ করেন, ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে শতশত মেধাবী প্রতিভাবান আলিম শহীদ হয়েছেন; বাস্তুচ্যুত হয়েছেন; অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু বা পর্যুদস্ত হয়েছেন; সহায়-সম্পত্তি হারিয়েছেন অথবা কর্মহীন হয়েছেনএভাবে চলতে থাকলে একসময় দক্ষ জনবলের অভাবহেতু ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবেতাই তাঁরা সামগ্রিক চিন্তা গবেষণার আলোকে কতোগুলো কাজকে অগ্রাধিকার হিসাবে গ্রহণ করেনসেদিক থেকে মুসলিম সমাজের বিশ্বাস সংস্কৃতি রক্ষায় মনোনিবেশ করেনমূলত আলিম-সমাজের লক্ষ্য ছিলো, ধর্মীয় শিক্ষা সংস্কৃতি রক্ষা এবং পুনরুজ্জীবনের মধ্য দিয়ে সচেতন বিপ্লবী একটি প্রজন্ম গড়ে তোলা যারা একদিন স্বাধীনতা সংগ্রামকে চূড়ান্তরূপ দেবে লক্ষ্যে তাঁরা ১৮৬৭ সালে ভারতের সাহারানপুর জিলার দেওবন্দ বস্তিতে আজকের বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দের গোড়াপত্তন করেনসঙ্গতকারণে, ১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে শাইখুল হিন্দ মাহমূদ হাসান দেওবন্দী রহ.’ নেতৃত্বে আলিম-সমাজ কংগ্রেসে মুসলমানদে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানএর কারণ ছিলো, স্বাধীনতার চূড়ান্তরূপ অর্জন

তাহলে আমরা কি পেলাম? আমরা দুটো আন্দোলনের দুধরনের পদ্ধতি দেখলাম যা প্রতিপক্ষ স্থান, কাল হিসাবে ভিন্ন প্রকৃতিরআমাদেরকেও বিবেচনা করতে হবে আমাদের আন্দোলনের স্থান বাংলাদেশ, আর এখানে বিদেশী কোন সৈন্য এখনও আক্রমণ করেনিআমরা যখন আমাদের সমাজ-কাল ইত্যাদি নিয়ে ভাববো এবং ইসলামের ভাবাদর্শনের সাথে সমন্বয় ঘটাবো, আমাদের আন্দোলনও তখন পরিচ্ছন্ন পরিশীলিত হবেআমাদের বুঝতে হবে, আন্দোলন মানেই মার-মার, কাট-কাট ধাঁচের কর্মক্রিয়া নয়যাঁরা আমার মতামতের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন তাঁদেরকে বলবো: প্রখ্যাত আলিম মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মাদ সাহেব রহ,’ লেখা বিখ্যাত উর্দূ ইতিহাসগ্রন্থ علماء ہند کا شاندار ماضی (উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী)- ১ম খণ্ডের মুজাদ্দিদ আলফে সানী রহ.’ আলোচনায় مجّدد صاحب نے بغاوت کیوں نہیں کی” (কেন মুজাদ্দিদ সাহেব বিদ্রোহ করেননি?) অধ্যায়টি পড়ার জন্য।  উপরোক্ত দু’টো উদাহরণ থেকে আমরা সহজে বুঝতে পারি, হুজুগ বা আবেগকোনটাই আন্দোলনের গ্রহণযোগ্য উপাদান হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, জোশ দিয়ে দ্বীন বোঝা যায় না, হুঁশ দিয়ে বুঝতে হয়। অতীতে আমাদের আন্দোলনের ব্যর্থ দিকগুলোর দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, জোশ বা আবেগ আর হুজুগের উচ্ছৃংখল ব্যবহার দিয়ে আমরা নিজেদের কতো ক্ষতি করেছি। ২০২০সালের ভাষ্কর্য বা মুদি বিরোধী আন্দোলনও এ থেকে বাদ যেতে পারে না। শতশত আলিম-ছাত্র যে বেকসূর জেল খেটেছেন, কোন যুক্তিতে? কাদের নেতৃত্বের লালসার বলি হতে হয়েছে তাঁদেরকে? কারা সেদিন মরহুম জুনায়েদ বাবুনগরীকে ভুল পরামর্শ দিয়ে প্রভাবিত করেছিলেন? কাদের চাপে ২৭ তারিখে হরতালের ঘোষণা দিতে হয়েছিলো? সম্মিলিত সভা থেকে সে সিদ্ধান্ত আসলো না কেন? এমন আরও প্রশ্ন থেকে গেছে জানি না এর উত্তর কোন দিন মিলবে কি না।

তাই আজ বড়ো ব্যথিতচিত্তে ভাবছি, কেন বারেবারে আমাদের এমন হয়? হুজুগ দিয়ে আমরা আর কতোদিন হুজুগে কওমী বনে থাকবো? আমরা বারবার কারগার থেকে মুক্তি পাই কিন্তু হুজুগ থেকে মুক্তি পাই না সহসা। কেন? আবেগ দিয়ে সর্বস্ব বিচার করতে চাই। ভেবেছিলাম, এবারের কারামুক্তি আমাদেরকে হজুগমুক্তির পথ দেখাবে, জানি না কখন আমাদের বোধোদয় হবে বা আদৌ হবে কি না। আল্লাহ হা-ফিয।

-২৮.০৫.২০২৩



ভাবনা-৪৩

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর বৌদ্ধদের এতো নির্যাতনের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি একটি অদ্ভুত কথা শুনতে পাই রোহিঙ্গা-সংশ্লিষ্টজনদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে তারাও বলেন সে-কথা কথাটি হলো, রোহিঙ্গাদের মাঝে কোন ঝগড়াঝাটি হলে, মতবিতর্ক হলে বা মারামারি হলে তারা সালিশ হিসাবে মীমাংসা করার জন্য নিয়ে আসতো বৌদ্ধদের কাউকেসুদূর অতীত থেকে চলে আসছে প্রথাএতে বৌদ্ধরা বুঝতে পারে, এদের ভেতরটা কতোটা ক্ষয়ে গেছে যারা নিজেদের ঝগড়াঝাটি মীমাংসা করতে শত্রুপক্ষকে নিয়ে আসে, তাদের পরিণতির ভয়াবহতা হিসাব করতে হয় না রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা বুঝতে পেরেই বৌদ্ধরা আজ যা ইচ্ছে তাই করার সাহস দেখাতে পারছে  এই যদি হয় একটি জাতির বৈশিষ্ট্য সে কি কখনও স্বাধীন হতে পারে? বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের রাজনীতিতে হাল আমলে চলছে সেই আত্মঘাতী তৎপরতাদেখেশুনে মনে হয়, আমরা কোন স্বাধীন ভূখণ্ডের বাসিন্দা নই; কোন ঔপনিবেশিক মকামের মানুষজনতাই নিজেদের সমস্যা নিজেদের মেটাবার মুরোদ নেই, বিদেশকর্তাদের মুহতাজ হতে হয় রোগ হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নিস্বাধীনতার পর থেকে এসব রোগ-বালাই পিছু নিয়েছেরোগের প্রাদুর্ভাব দেখে মনে হতে বাধ্য, কালেকালে জীবাণু এতো গভীরে ঢুকে গেছে, নিরাময় যেনো অসাধ্য কিছু

যে জাতি শোষণের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, স্বাধীন জনমতের স্বপক্ষে যুদ্ধ করে নিজেদের স্বাধীন করেছে বলে দাবি করে, তারা যখন বহিঃশক্তির কাছে নিজেদের সমস্যা মিটমাট করতে ধর্ণা দেয়, প্রশ্ন করতে হয়: এই কি তবে স্বাধীনতা? আমাদের রাজনীতিকেরা প্রশ্নে কখনও দায় নেনাকেউকেউ স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দেনবিদেশমুখিতা আর বিদেশনির্ভরতা কিন্তু এক নয়একটি জাতিকে সুসংহত হতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের খাতিরে বিদেশমুখিতাকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতে হয়, অবশ্য পরিমিত হারে পৃথিবীতে বাঁচতে হলে এক অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়কিন্তু একটি জাতির জন্য বিদেশনির্ভরতা স্বাধীন চেতনার সাথে সাংঘর্ষিকতাই, প্রত্যেক সার্বভৌম দেশ ঘোষণা করে: তাদের একটি স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি রয়েছেএর ভিত্তিতেই একটি স্বাধীন দেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপন স্বকীয়তা বজায় রেখে অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করেঅথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পর থেকে আমরা পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার নামে বিদেশমুখিতাকে অতিক্রম করে বিদেশনির্ভর সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়েছিফলে, দেশের ভেতর থেকেই দেশের স্বার্থ বিলিয়ে দেবার অভিযোগ ওঠেযারা অভিযোগ করেন, ক্ষমতায় গেলে সে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেও ওঠেকিন্তু কেন? বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাকপ্রথমেই একটি বাস্তবতা মেনে কথা শুরু করতে হবেসেটা হলো, এখন দুএকটি বাদে প্রায় সব দেশে চলছে কথিত গণতেন্ত্রর ভিন্নভিন্ন রূপমোটামুটি বলা যায়, গণতান্ত্রিক শাসনএখন গণতান্ত্রিক শাসন বা সরকারের চরিত্র নিয়েও মতভিন্নতা বর্তমানভারতের কাছে তাদের যে পদ্ধতি গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত, সে দৃষ্টিকোণে মার্কিন গণতন্ত্র শুদ্ধ নয়তেমনি মার্কিন গণতন্ত্রের পদ্ধতিগত দৃষ্টিকোণে ভারতের গণতন্ত্রও বিশুদ্ধ নয়আবার তুরস্কের গণতন্ত্র দেখুনসবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েও রাষ্ট্রপতি হতে পারেন না ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায়এর উপর আছে প্রেসিডেন্ট সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের নিয়মএখন যে পদ্ধতিই হোক বাহ্যিকভাবে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত সরকারকে প্রচলিত গণতান্ত্রিক সরকার বলে গণ্য করা করা হয়বর্তমানে অবশ্য গণন্ত্রের প্রয়োগে অনেক শর্ত জুড়ে দেয়া হয়সব শর্ত পূরণ না হলেও অধিকাংশ শর্ত পূরণ হলে পাশ নম্বর দেয়া হয়

বর্তমান বিশ্বে নিরপেক্ষ নির্বাচন, জনমত প্রকাশের অধিকার জনসম্পৃক্ততা সুশাসনের অন্যতম বড়ো সূচক হিসাবে চিহ্নিতসেদিক থেকে আমাদের বাংলাদেশের নৈর্বাচনিক শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস বড়ো করুণ।  সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন, জনসম্পৃক্ততা, স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার, বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার প্রদান ইত্যাদি প্রচলিত সুশাসনের সূচক হিসাবে স্বীকৃতমূলত যে সরকার উক্ত বিষয়গুলোতে যতো শক্তিশালী, পররাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় সে সরকার তো বেশি শক্তিশালীপক্ষান্তরে, জনসম্পৃক্তহীন সুশাসনবিহীন সরকারের অবস্থান ততো দুর্বলএই যে বিদেশনির্ভরতা বা বিদেশীদের হস্তক্ষেপের কথা লা হচ্ছে, সেটা আসে নিজেদের নৈতিক অবস্থানের গভীর-অগভীরতার নিরিখেতাই, কোন সরকার যদি চায় পররাষ্ট্রের সাথে তার শক্তিশালী মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক থাকুক, তাহলে তাকে অবশ্যই জনসম্পৃক্ততা সুশাসনসম্পন্ন সরকার হতে হবে যেনো বাইরের শক্তি কোন দুর্বলতা খুঁজে না পায়দুর্বলতা থাকলে কেউ না কেউ সুযোগ নিতে চাইবেবনের বাঘ-সিংহ সব সময় দুর্বল শিকারীকেই খোঁজেসুতরাং, যে দেশে বিদেশী হস্তক্ষেপ হয় বুঝতে হবে সে দেশের সরকারের সুশাসন জনসম্পৃক্ততার সূচকের দুর্বলতা অধিক দেশে সুশাসন থাকলে বিদেশী হস্তক্ষেপের পরিস্থিতিতে জনগণ প্রতিবাদ করে সরকারের সাথে একাত্মতার জানান দেয়। এটাই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মূলশক্তি। তাবৎ বিশ্ব একে সমীহ করে। আর সুশাসনের অভাব হলে জাতি বিভক্ত হয়, বিদেশী হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচনপ্রশ্নে বিদেশী হস্তক্ষেপ বলে যে বলাবলি হচ্ছে, সেটি মূলত দেশে সামগ্রিকভাবে সুশাসনের অভাবহেতু। সঙ্গতকারণে, বিদেশীদের একতর্ফা দোষ দিয়ে আমরা খেয়া পার হবোসে চেষ্টা বৃথা। রোহিঙ্গা মুসলিমদের টানা উদাহরণ থেকে যদি আমরা শিক্ষা গ্রহণ না করি, নিজেদের ঝগড়ার মীমাংসায় বাইরের সালিশ নিয়ে আসার প্রবণতাকে রোধ করতে না পারি, তবে স্বাধীনতা তো অবশ্যই হারাবো। আমাদের কেউ দাম দেবে না।

২৩.০৫.২০২৩

 

 

 

 

 

 

 


ভাবনা-৪২


তুরষ্কের রাষ্ট্রপতি রিচেপ তয়্যিব এরদোয়ানের দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোটে বিজয়ী হবার উপর নির্ভর করছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক কিছু প্রথমে আমাদের মতো দূরদেশীয়রা ভেবেছিলেনএরদোয়ান সহজে বিজয়ী হবেন সহজ বিজয় না পেলেও প্রথম দফার ভোটে তাঁকে প্রায় বিজয়ী বলা যায় আমাদের বাংলাদেশ হলে তো শপথ নেবার আগেই আস্বাদিত হতো ক্ষমতার রস তুরষ্কের নৈর্বাচনিক নিয়মানুযায়ী এরদোয়ান এ যাত্রায় রাষ্ট্রের কুরসীতে বসতে পারছেন না সত্যতবে দ্বিতীয় পর্বের ভোটাভুটিতে অগ্রগামী প্রার্থী হিসাবে লড়বেন এটাও প্রচলিত গণতন্ত্রের এক রূপ এরদোয়ান ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের চিত্র বুঝিয়ে দেয় গণতন্ত্রের নামে বিশ্বে কতো রকমের হেরফের আছে মার্কিন গণতন্ত্র আবার আরেক ধরনেরসে বলাবাহুল্য এরদোয়ানের বিজয় হবে কি হবে নাসেটা নির্ভর করছে জটিল এক হিসাবের মারপ্যাঁচে এখানে জনগণের রায় বড়ো কথা নয়প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের যোগবিয়োগের খেলাই বড়ো কথা এ খেলা নিখাদ এক জুয়াখেলা মূলত কথিত গণতন্ত্রই জুয়ার এক নয়নাভিরাম ও প্রতারণামূলক আধুনিক সংস্করণ এ খেলায় এরদোয়ান জয়ী হয়েও দূরনিয়ন্ত্রকদের কারসাজিতে ভোগ করতে পারেন বেদনাবিধুর পরাজয় আবার মাত্র সামান্যসংখ্যক ভোট পেয়েও পেছনের সারির প্রার্থী বা নিকটতম প্রার্থী পেয়ে যেতে পারেন কুরসীর স্বাদ লাগবে কেবল স্বার্থ আর গদি দখলের নির্ভেজাল উম্মাদনা

এরদোয়ানের সম্ভাব্য বিজয় জড়িয়ে আছে কেবল তুরষ্কের জাতীয় উত্থানের সাথেএমন ধারণা বিভ্রমাত্মক নির্বাচনস্থল তুরষ্ক হলেও প্রভাবের জায়গাটা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বব্যাপী এখানেই এরদোয়ানের গুরুত্ব বোঝা সহজ এর প্রমাণআমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমাদের সর্বগ্রাসী এরদোয়ানবিরোধী প্রচারণা ও চেষ্টা-তদবির কেন পশ্চিমারা এরদোয়ানের অপসারণ চায়সবিস্তারে এখানে বলা কঠিন স্থান-স্বল্পতার কারণে ও পাঠকদের ধৈর্য্যচ্যুতির আশঙ্কায় তবে এটুকু জেনে রাখা দরকারএরদোয়ান আগের শাসকদের মতো পশ্চিমাদের মনোরঞ্জন করে নিজেকে কাগুজে মানচিত্রে বন্দী করে রাখেননি আপন ইতিহাসের মর্যাদা পুনর্বিন্যাসে এরদোয়ান প্রতিরক্ষাকে করেছেন উচ্চমার্গীয়সমরশিল্পকে করেছেন বহির্মুখীসীমান্তকে নিষ্কলঙ্ক রাখতে বিচ্ছিন্নতাবাদের লাগাম টেনে তৈরি করেছেন নিরাপদ মধ্যাঞ্চলসিরিয়ার যুদ্ধে অনুপ্রবেশ করে মধ্যপ্রাচ্যকে রাশিয়া ও ইরানের খপ্পর থেকে টেনেছেন ভারসাম্যের দিকেআর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজারবাইজানকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে একদিকে যেমন তুরষ্কের জাতিশাখাকে রক্ষা করেছেন অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার সাহায্যকে বাধাগ্রস্থ করে আজারবাইজানকে বিজয়ী করেছেন শুধু তাই নয়এরদোয়ান তার কূটনীতি দিয়ে আমেরিকার মতো পরাশক্তিকে একটি বৃত্তে আটকে রাখতে সমর্থ হয়েছেন যার দৃষ্টান্ত নেই বললে চলে যে মধ্যপ্রাচ্যে ছিলো মার্কিনের একচ্ছত্র আধিপত্য সেখানে ইরানকাতার ও রাশিয়ার সাথে মিলে এরদোয়ান মার্কিন প্রভাবকে সীমিত করে ইসরাঈলকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিতে সক্ষম হন এখন আমেরিকা চাইলেই মধ্যপ্রাচ্যে ছড়ি ঘোরাতে পারবে না ন্যাটোসদস্য হয়েও রাশিয়ার সাথে কৌশলগত সখ্যতা সৃষ্টি করে মার্কিননির্ভরতাকে দুর্বল করতে পারা এরদোয়ানের বিশাল কৃতিত্ব বলা চলে দক্ষিণ এশিয়াতেও তুরষ্ক হাত বাড়িয়েছে এসব বিবেচনা করে পশ্চিমাবিশ্ব আগে থেকেই এরদোয়ানকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে ২০১৬ সালে এরদোয়ানবিরোধী অভ্যুথান ব্যর্থ হবার পর প্রকাশ হয়ে পড়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের মুখোশ তাই তাদের একটাই লক্ষ্যএরদোয়ানের অপসারণ এরদোয়ান ক্ষমতায় থেকে গেলে পশ্চিমাদের স্বপ্নে লালবাতি জ্বলবেএ আশঙ্কা তাড়িয়ে ফিরছে তাদেরকে। কারণ-রি মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে পশ্চিমাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছেতার প্রধান কারণ এরদোয়ান

কূটনৈতিক রাজনীতিতে এরদোয়ানের দক্ষতা অনুকরণীয়। সৌদি কলামিস্ট জামাল খোশোকজীর হত্যাকাণ্ড ও কাতারকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের সাথে তুরস্কের আহত সম্পর্ককে কৌশলে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করেছেন এরদোয়ান নিপূণভাবে। আমেরিকা চেয়েছিলোতুরষ্কের সাথে সৌদির সম্পর্ক খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলুক। এফ-৩৫ জঙ্গীবিমানকে কেন্দ্র করে মার্কিন আচরণ বুঝতে এরদোয়ানের দেরি হয়নি। তাই যতো সম্ভব কমশত্রুর কৌশলকে কাজে লাগিয়ে এরদোয়ান সৌদি শাসক  এমবিএস সাথে সম্পর্ক মেরামত করে ফেলেন। বিষয়টি মার্কিনীদের কাছে ভালো লাগেনিলাগার কথাও নয়। ইরানের সাথে সৌদির সম্পর্ক সাপ-নেউলে। চীনের মাধ্যমে সে সম্পর্ক এখন মেঘ কাটিয়ে ওঠার দিকে। এখানেও কাজ করেছে এরদোয়ানের মস্তিষ্ক। আজ ইয়েমেনযুদ্ধ শেষের পথ খুঁজছে। বলাবাহুল্য, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রধান স্বার্থ: ইসরাঈলের নিরাপত্তা। সেখানে বিশেষত সিরিয়ার যুদ্ধে এরদোয়ান রাশিয়াকে সাথে নিয়ে ইরানকে অনেকটা বেকায়দায় রেখে যে চাল চেলেছেন আমেরিকা তাতে বড়োসড়ো মার খেয়েছে বলা যায়। আর আমেরিকা মার খাওয়া মানে ইসরাঈল মার খাওয়া। মার্কিন সমর্থিত কুর্দিদের যেভাবে এরদোয়ান কোণঠাসা করে ফেলেছেন, সেটা আমেরিকাকেও জখম করতে বাদ রাখেনি। বলা যায়, এরদোয়ান ছলে-বলে-কৌশলে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের যেভাবে নাকানি-চুবানি খাইয়েছেন সেটা পর্যবেক্ষকমাত্রই জানেন। এ জ্বালা-এ দহন ভুলতে পারছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও য়ুরোপিয়ান দেশগুলো। তাই তাদের সম্মিলিত লক্ষ্যএরদোয়ান হটাও! তুরষ্কে যারা এরদোয়ানের বিরোধী শিবির বলে পরিচিত, তারা মূলত পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের বাহক হিসাবে কাজ করছে। সঙ্গতকারণে বলা যায়, কোন কারণে এরদোয়ান নির্বাচিত না হলে তুরষ্কের জাতীয় জীবনে হয়তো বড়ো প্রভাব পড়বে কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে। এরদোয়ানের অনুপস্থিতিতে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যে সঙ্কটের সৃষ্টি হবে সেটার মাশুল হবে ভয়াবহ। তখন রাশিয়া, চীন আর ইরানের মতো দেশগুলোকে সামলানো কঠিন হবে। শুরু হতে পারে নতুন মানবিক ও নিরাপত্তা সঙ্কট। যুদ্ধের লেলিহান শিখা মধ্যপ্রাচ্যে ভিন্নমাত্রায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে বরাবরের মতো ফায়দা লুটবে পশ্চিমা দেশগুলো।  

মোদ্দাকথা হলো, এরদোয়ানের জয়-পরাজয় কেবল তুরষ্কের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিকতায়ও হবে এর তীব্র আবেদন ও প্রতিক্রিয়া। রিচেপ তয়্যিব এরদোয়ান তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে তিলতিল করে যে মহীরুহ সৃষ্টি করছেন, তা একটি মাত্র নির্বাচনে হাওয়ায় উড়ে যাবেএমন ভাবা হবে আহাম্মকীয়। জয়ী না হলেও এরদোয়ানের কর্মই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দিয়ে বিশ্বকে ব্যস্ত রাখবেতা হিসাব করে বলা যায়। তা’ছাড়া, শাসনে এরদোয়ান বহাল থাকা অবস্থাতে একশ’ বছরের লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে, এও পশ্চিমাদের দুশ্চিন্তার অন্যতম বড়ো কারণ। তাই পরাজয়ে এরদোয়ান হারিয়ে যাবেন না বরঞ্চ জয়ের আবেদন নিয়ে বিশ্ব-রাজনীতিকে প্রভাবিত করে যাবেন। এখানেই এরদোয়ান আমেরিকা ও পশ্চিমাদের কাছে ভয়ঙ্কর।   

২০.০৫.২০২৩


ভাবনা-৪১

স্মৃতিকে বিস্মৃত করার পুরনো অভ্যাসে আমরা হয়তো ভুলে গেছি: আজ ২০১৩ সালের নির্মম স্মৃতির ১০ বছর পূর্ণ হলো। সে দিবাগত রাতে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ঢাকা-অবরোধকে কেন্দ্র করে ঘটে যায় ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ঘটনা। অজানাসংখ্যক হেফাজত কর্মী-সমর্থকের আহত-নিহত হবার ঘটনা ঘটে সে রাতে। আজও সে ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি না হেফাজতের পক্ষ থেকে, না সরকারের কাছ থেকে। কি হলো, কেন হলোইত্যকার প্রশ্নে আজও মানুষের কৌতুহলের অভাব নেই। মূলপ্রশ্ন, পূর্বঘোষিত অবরোধ থেকে মধ্যবেলার পর আকস্মিক শাপলা-চত্বরে ঢোকার সিদ্ধান্ত এবং মাত্র আধ-ঘণ্টার ব্যবধানে সরকারের অনুমোদন পাবার রহস্যের আজও কূলকিনারা হয়নি। ঘটনার পর দায়িত্বশীল কারওকারও কাছে জানতে চেয়েছি বিষয়টি নিয়ে, কেউ মুখ খোলেননি। রাতেই শাপলা-চত্বর ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত হলেও শাপলা-চত্বরে তৎকালীন আমীর মরহুম আহমদ শফীকে আসতে না দিয়ে রাত যাপন করার রহস্যজনক সিদ্ধান্তের জট খোলা যায়নি এখনও। সেদিন রাতে যাঁরা হযরত জুনায়েদ বাবুনগরীর পাশে ছিলেন তাদের সাথে কথা বলেছি, তারা অকপটে জানিয়েছেন: হামলার আগে অর্থাৎ, আহমদ শফী সাহেব শাপলায় যাত্রা করার পূর্বে হযরত জুনায়েদ বাবুনগরী বারবার চেষ্টা করেছেন আমীরের সাথে কথা বলতে, রাতেই শাপলা-চত্বর ত্যাগ করে অনাকাঙ্খিক ঘটনা এড়িয়ে যেতে। কিন্তু তথ্যদানকারীদের মতে আমীরের পুত্র আনাসের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তাদের মতে আনাসের আড়ালে ছিলো: একটি শক্তিশালী চক্র, যারা যে কোনভাবেই শাপলাতে রাত যাপনের পক্ষে ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় অনেক আলোচনা হয়েছে; দায়িত্বশীলদের কেউ মুখ খোলেননি। প্রশ্ন উঠেছে, শহরের বাইরে অবরোধের পূর্বসিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ভেতরে ঢোকার সিদ্ধান্ত হলো কেমন করে? সন্দেহের তীর যাদের দিকে, তারা ব্যাখ্যা দিয়েছেন: বিষয়টি পরিস্থিতির নিরিখে আল্লামা আহমদ শফী রহ.-র নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অনুমোদিত হয়। কিন্তু কেউ-কেউ বৈঠকের বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। পরে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর ইন্তিকালের আনুমানিক বছরখানিক আগে গ্রামের বাড়িতে আসলে আমি গিয়ে সরাসরি তাঁর কাছে বিষয়টি জানতে চাই। প্রশ্নটি করার আগে আমি হযরতের খাদিমকেও সরিয়ে দেই। কারণ, হযরত বাবুনগরী ইতঃস্তত করছিলেন। তিনি আমাকে একান্তে বললেন, বিষয়টি যেন তৎক্ষণাৎ প্রকাশ করা না হয়। বুঝলাম, হযরত তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ না করতে বলছেন। তাঁর কথায়, আসলে কোন সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হয়নি। যারা কুশীলব বলে খ্যাত (হযরত নামও উল্লেখ করলেন যা এখানে প্রকাশ করছি না), তারা প্রথমেই পরিকল্পিতভাবে আমীর আহমদ শফী সাহেবের কাছ থেকে শাপলা-চত্বরে প্রবেশ করে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত লিখে স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। পরে অন্যদের তা দেখিয়ে দস্তখত আদায় করে। হযরতের বাকি কথাগুলো আর লিখলাম না।

আজ ১০টি বছর হারিয়ে গেলো শাপলা থেকে। এ দশ বছরে হেফাজত অনেকটা ভুলে যেতে বসেছে শাপলার স্মৃতি। পরের বছর ২০১৪ সালে কেউ পালন করেনি শাপলার মর্মান্তিক ঘটনার বর্ষপূর্তি। এমন ঘটনা বিরল। পঞ্চাশ বছর আগের ২৫শে মার্চের কালরাত্রির স্মরণ চলে ফীবছর কিন্তু শাপলার হয় না কখনও। এ আমাদের উদারতা(!) না কি বিশ্বাসঘাতকতাজানবার উপায় নেই। সে-সময় যারা কলকাঠি নেড়েছে, সওদাবাজি করেছে, তারা তো দিব্যি মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অপরাধ কেবল তাঁদের, যারা প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন। কওমীদের পক্ষ থেকে নানা বই-পুস্তক লেখা হয় কিন্তু শাপলার ইতিহাসটা লেখা হয় না। সবার কথা বলছি না, কেউ আছেন আতঙ্কে। তবে আমি নিরাশ হতে পারি না। আমার আশা এ মজলুম ঘটনার ইতিহাস একদিন লেখা হবে, কুশীলব আর সওদাবজিকরদের পরিচয় প্রকাশ পাবে। তা না হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পূ্বসূরীরা সমালোচিত হবেন, আল্লাহর কাছে তো দায়ি হবেন-ই। শাপলার ঘটনার পর আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন ছিলো; প্রয়োজন ছিলো নিজেদের দুর্বলতাগুলো সারিয়ে নেবার। কিন্তু তাতে কতোটুকু কি হয়েছেসেটা ফলেই বৃক্ষের পরিচয়। ২০২০ সালের মুদি ও মূর্তীবিরোধী প্রতিবাদ থেকে সে ধারণা পাওয়া যাবে। ইসলামের ইতিহাস তো সওদাবাজিকরদের মুনাফেকির ইতিহাস। সে-কথা কে না জানে? তবুও আমরা ঘরের দরোজা মেলে ঘুমাই; চোর আসে, মালামাল নিয়ে যায়; আমরা কেবল তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখি। মামলাও করি না।

১৮৫৭’র আজাদী আন্দোলন থেকে আমরা যদি নিজেদের রক্ষার কোন শিক্ষা না নিতাম, ১৮৬৭ সালে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা হতো না। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পেছনে সওদাবাজিকর আর কুশীলবদের কি ভূমিকা ছিলো, তা কারও অজানা নয়। আজও মির্জাফরের বংশধরেরা লজ্জায় রাস্তায় বের হতে সাহস পায় না। জানি না, শাপলার মির্জাফরদের বংশধরের কী পরিণতি হবে। যাঁরা ভুক্তভোগী তাঁদের শোকাহত পরিবারের বেদনার্ত স্মৃতির মিনারে দাঁড়িয়ে একটু অনুভব করলে আমার প্রশ্ন আর আপত্তির জায়গাগুলো আশ্রয় পাবে মনে করি। আল্লাহ সকল শহীদ ও মজলুমদের রহম করুন।

০৫.০৪.২০২৩ 


ভাবনা-৪০

প্রতিভা আর মেধার ফরখটা কি? শব্দগুলো আমরা যখন পাইকারিভাবে ব্যবহার করি, মনে কি হয় মানেটা কি? এমন অনেক শব্দ আমাদের লেখাপড়ায় আসে আর যায়, যাদের সঠিক পরিচয় জানা থাকে না। বাংলায় বলে নয়, আরবী, ফারসী, ইংরেজি ইত্যাদিতেও এমন ঘটনা ঘটে। যেমন ধরুন, ‘গণতন্ত্র’। উর্দূতে ‘জমহুরিয়াহ’ বলা হলেও আরবীতে কিন্তু ‘দীমোক্রাতিয়াহ’ (ديمقراطية )। অথচ ‘জমহূর’ আরবী শব্দ। তবে তো ‘দীমোক্রাতিয়াহ’ না বলে ‘জমহুরিয়াহ’ বললে দোষ কোথায়? এ প্রশ্ন আমার। আসলে ভাষার শব্দ-প্রচলনে লোকমুখে ও পরিবেশে ভাবের গভীরতার পরিমাপ প্রামান্য। ধরুন, পানি ও জল। আমাদের এখানে লোকমুখে ও পরিবেশে ‘পানি’র ভাব যতোটা আপন ও গভীর পশ্চিমবঙ্গে ততোটা নয়। আবার পশ্চিমবঙ্গে বিশেষত হিন্দু-সমাজে ‘জল’র ভাব যতোটা কাছের আমাদের এখানে ততোটা নয়। তাই দু’জায়গায় দু’রকমের প্রয়োগ আর বোঝাবুঝি। আবার ‘জল’ পশ্চিমবঙ্গে যতো কাছের হোক ওখানেও পানি আক্রমন করে প্রকাশ্যে। তাই, সেখানে ‘পান্তাভাত’ জলভাত হতে পারেনি; সরবত ‘পানসে’ লাগলেও ‘জলসে’ হবার সাহস দেখায়নি। এ হচ্ছে ভাষার শব্দ-ব্যবহার বা প্রচলনের মারপ্যাঁচ। এগুলো মাথায় না থাকলে আপনার লেখা বা বলা পানসে না হয়ে জলসে হয়ে বসে থাকবে। সূতরাং শব্দ-প্রচলনে ভাবের তারতম্য নখদর্পণে রাখতে না পারলে ব্যবহার ব্যর্থ হবে।

তাহলে ফিরে আসি মেধা আর প্রতিভার আলোচনায়। মেধার আভিধানিক অর্থ: বুদ্ধিধীশক্তিবোধশক্তিস্মৃতিশক্তি আর প্রতিভার আভিধানিক অর্থ হলো: ব্যক্তির সৃজনীশক্তিব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিমত্তাবিশিষ্ট গুণাবলী বিশেষ। অর্থের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি, কোন্ শব্দের ভাব ও গভীরতা কেমন। মূলত মেধা কেন্দ্র আর প্রতিভা কেন্দ্রের বিস্তার-ক্ষমতা। বুঝিয়ে বলি। মেধা হলো মূলধন আর সে মূলধনকে ব্যবহার করে আপনি ব্যবসাকে কতোটা বিস্তৃত করতে পারেন বা নতুন-নতুন ব্যবসা উদ্ভাবন করতে পারেন, সে-ক্ষমতা হলো প্রতিভা বা সৃষ্টিশীলতা। ধরুন, আপনি কলম নিয়ে বসলেন দু’কলম লিখবেন বলে। আপনার প্রচণ্ড স্মৃতিশক্তি আছে; প্রচুর তথ্যসূত্র বা রেফারেন্স আপনি অনর্গল দিতে পারেন অথবা আহামরি না হলেও মোটামুটি স্মৃতিশক্তি আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো: আপনার স্মৃতিশক্তি কমবেশি যাই থাকুক, সেটাকে ব্যবহার করে নতুন কি কি সৃষ্টি করতে পারলেন? জাতিকে কী নির্দেশনা বা প্রস্তাবনা দিতে পারলেন যা আপনার পরিবেশের সাথে সংশ্লিষ্ট? আপনার উপসংহার কতোটা সমৃদ্ধ হলো? তথ্যভর্তি লেখা দিয়ে আপনি প্রশংসিত কিন্তু শেষফল কী বের হলো? পাঠক আপনার কাছ থেকে নতুন কী পেলো? এখানে ব্যর্থ হলে লেখক হিসাবে আপনি পরিচিতি পেতে পারেন, সফল হতে পারেন না। মনে রাখতে হবে, যে কলম সংস্কার বা নির্দেশনার পথ প্রদর্শন করে না, সেটা যতো দামিই হোক মোটাতাজা দুগ্ধবিহীন গাভীর তুল্য। বাংলা-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অনেক অবদান আছে কিন্তু নজরুল যেভাবে কষে লাঙ্গল চালিয়ে মাটি ওলটপালট করে জমিকে নতুন চাষের উপযোগী করে তুলেছিলেনসে কি রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন? এখানেই নজরুলের প্রতিভা আর সৃষ্টিশীলতার পারদর্শিতা যা আজও অম্লান। তাই নজরুল বলতে পেরেছিলেন, “আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে চোখ হাসে মোর বুক হাসে!” নজরুল তৃণমূল থেকে উঠে আসা পোড়খাওয়া এক মহান সাহিত্য-সৈনিক। নজরুল-সাহিত্যের বড়ো সম্পদ সৃজনশীলতা যা ফররুখদের মতো বিখ্যাত কবিদের প্রভাবিত করে গেছে। আশা করি এবার বুঝতে পেরেছেন মেধা আর প্রতিভার পরিচয়।

আজ আমি কওমীদের মধ্যে সে প্রতিভাবান-প্রজন্মকে খুঁজছি যাঁরা মেধার পুঁজি নিয়ে সৃষ্টিশীলতাকে বিশ্বের দরবারে পথ দেখাবে। আক্ষেপ করে বলতে হয়, আমাদের কওমী-জগতে নতুন-নতুন ডিগ্রীধারীদের সংখ্যা কম নয়। কেউ আজহারী, কেউ নদভী, কেউ মাদানী আবার কেউ দেওবন্দ থেকে আসা কাসেমী। তাঁদের প্রচুর মেধা আছে বলে জানি, সম্মান করি। কিন্তু ঐ একটা জায়গায় আমাদের হায়-হায় রব তুলতে হয়। সৃজনশীলতার মাপকাঠিতে কারও সনদ চোখে পড়ে না। উস্তাযুল আসাতিযা মাওলানা ইসহাক আল গাযী রহ. বলেছিলেন: এ দেশের মাটিটাই এমন যে, এখানে স্বর্ণ পড়লেও কয়লা হয়ে যায় আর বিদেশের মাটিতে কয়লা পড়লেও স্বর্ণ হয়ে যায়। এ নির্মম বাক্যের মধ্যে হযরতের তিক্ত অতীতের যে মর্মান্তনা ফুটে উঠেসে ব্যথা বুঝবে ক’জন? এও সত্য, প্রতিভার অধীকারী হয়েও আমাদের সন্তানদের কেউ কেউ পরিস্থিতির কারণে, সঠিক মূল্যায়নের অভাবে, কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা-অবহেলায়, অর্থনৈতিক শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে হয়তো কক্ষবাসী হয়ে পড়ে নতুবা আপনক্ষেত্র ত্যাগ করে ভিন্ন পেশায় আশ্রয় গ্রহণ করে হারিয়ে যায়। তাই বলে কি আমাদের জমিটা অনাবাদযোগ্য হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে? কেউ কি এগিয়ে আসবে না ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করে? ইতিহাস কি বলে? চরম ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশের লালচক্ষুকে এড়িয়ে তুরষ্কের রিচেপ তৈয়ব এরদোগান কি মঞ্চে উঠে আসেননি? আজ একজন এরদোগানই কি বিশ্বকে প্রভাবিত করছেন না? আমরা কি পারি না সে দৃষ্টান্তকে কওমী জামা পরিয়ে মঞ্চে তুলে ধরতে? বিশ বছরের সশস্ত্র জিহাদ শেষ করে তালিবান কি আজ তাঁর সৃষ্টিশীলতা দিয়ে আফগানিস্তানকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না? বিশ্বব্যাংক রিপোর্টে তালিবানের অর্থনৈতিক রিপোর্ট কি প্রশংসিত হয়নি? একজন মুফতী তাকী উসমানীর কথাই ধরুন। পাকিস্তানে কি বিজ্ঞ আলিম-উলামার অভাব আছে? কিন্তু একজন তাকী উসমানী দাঁড়িয়ে গেছেন; ইসলামী ফিকাহকে যুগের প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড় করিয়ে জন্ম দিলেনইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেম যা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস-পর্যালোচনা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, পৌরনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বিচারব্যবস্থাপনা: কোথায় নেই মাওলানা তাকী উসমানীর পথনির্দেশনা? পাকিস্তানের শরীয়া আদালতের আপিল বিভাগের চেয়ারে বসে বিচারকের দায়িত্ব পালন করে এ কওমী সন্তান অন্যান্য মেগাবিচারকদের শিখিয়েছেন কি করে আইন বুঝতে হয়; ফয়সালা করতে হয়।

তাহলে আমাদের আজহারী, নদভী, কাসেমী, মাদানী ভাইয়েরা কোথায়? তাঁরা কি পারেন না কওমী জগতকে সৃজনশীলতা দিয়ে সাজাতে; তাঁরা কি পারেন না তাঁদের গবেষণা দিয়ে বিশ্বকে পথ দেখাতে? তাঁরা কি পারেন না তাঁদের দেখা জামিয়া আজহার, দারুল উলূম দেওবন্দ, জামিয়া মদীনা, জামিয়া নাদওয়ার ব্যবস্থাপনাকে কাজে লাগিয়ে কওমী-জগতকে সমৃদ্ধ করতে? বাইরে থেকে বড়োবড়ো গাভী এনে যদি দুগ্ধদোহন সম্ভব না হয় তবে কি সব মাঠে মারা গেলো না? আমাদের এতোএতো মেধাবী সন্তান আছে বলে দাবি করি, তবে কেন হেফাজত আন্দোলন তাঁদের কাছ থেকে কোন পথনির্দেশনা পায়নি? পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রয়োজন ছিলো তাঁদের উপস্থিতি। তাঁদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, গবেষণা হেফাজতের পদযাত্রায় কেন কাজে লাগানো যায়নি? এ দায় কি তাঁদের একার? আমি তো মনে করি, রাজনৈতিক হোমরা-চোমরাদের গদিতে না বসিয়ে ওঁসব প্রতিভাবানদের সামনে আনা গেলে হেফাজতের আজকে এ দশা হতো না। গবেষণা ও সৃষ্টিশীলতায় কওমীদের অবস্থান কতোটা হতাশাব্যঞ্জক তা বুঝতেও আমরা অক্ষম। দুর্ভাগ্য, আমাদের এখানে কারীর চেয়ে ক্যাসেটের দাম বেশি। এটাই হযরত গাযী সাহেব রহ-র মন্তব্যের এক সার। আসলে আমাদের এখানে দক্ষ ব্যক্তির মূল্যায়ন নেই; আছে জ্বী হুযুরমার্কা অদক্ষ মানুষের মূল্যায়ন। তাই, আমাদের বাগানের নাম গুলশান কিন্তু কাজেকর্মে সুনশান। বিখ্যাত দার্শনিক ও আলিম হাকীমুল ইসলাম কারী তয়্যিব সাহেব রহ. লিখে গেছেন:

صرف درس نظامی کے کتابے پڑھنے اور پڑھانے کانام دیوبندیت نہیں ہے

আজ আমরা প্রচণ্ডভাবে অনুভব করছি, একটি প্রবল জোয়ারের যার নিখিল প্রবাহে ভেসে যাবে সব প্রথাগত খড়খুটো; পড়বে নতুন পলিমাটি; শুরু হবে ‍পুরনো জমিতে সৃজনশীলতার নতুন চাষ; ফলবে এ যুগের মুজাদ্দিদদের সরব জন্মোৎসব; মিল্লাত পাবে পথপ্রদর্শক, দেশ পাবে ফসল ফলানো অভিভাবক; সমাজ পাবে সংস্কারের কারিগর আর মানুষ পাবে “নয়া জামানার ডাক”। আমরা কোনভাবেই পারবো না আমাদের নতুন প্রতিভাবান প্রজন্মকে হারিয়ে ফেলতে। যদি পরিবেশ-প্রতিষ্ঠানের প্রতিকূলতায় সে সম্ভব না হয়, তবে ভদ্রতার সাথে; বিনয়ের সাথে প্রতিভাবান প্রজন্মের হাত ধরে ব্যতিক্রমধর্মী কোন প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলে জাতি তাকে অভ্যর্থনা জানাবে। আল্লাহ হা-ফিয।

০৪.০৪.২০২৩ 

 


ভাবনা-৩৯

স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। এ স্বাধীনতা তার মৌলিক চাহিদাকে আবর্তিত করে নিত্য। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান ছাড়াও তার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিয়েছেন খোদ আল্লাহ। তবে মনে করার কারণ নেই: স্বাধীনতা মানে যাচ্ছেতাই করার অধিকার। মানুষকে সৃষ্টি করার সাথেসাথে ভালোমন্দ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা আল্লাহ দিয়েছেন। স্বাধীনতার ধাপ-উপধাপ চিন্তা করলে পাওয়া যায় স্তরভিত্তিক স্বাধীনতার অস্তিত্ব। যেমন: ব্যক্তি-স্বাধীনতা, পারিবারিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি। এগুলো সর্বআইনে, সর্বক্ষেত্রে স্বীকৃত। তেমনি এক স্বাধীনতা: রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা। আজ সে বিষয়েই আলাপ। একটি বা কয়েকটি জনগোষ্ঠী একত্রিত হয়ে নির্দিষ্ট কোন ভূখণ্ডকে তাদের বসবাসের জন্য নির্ধারিত করে ব্যবস্থাপনার কাঠামো প্রতিষ্ঠা করলে, সেই ভূখণ্ড ঐ জনগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীসমূহের জন্য একটি স্বাধীন দেশ বা ভূখণ্ড বলে বিবেচিত হয়। উক্ত ব্যবস্থাপনার আলোকে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতি বসবাসকারী মানুষ যে শর্তসাপেক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ও অধিকার পাবার নিশ্চয়তা প্রাপ্ত হয় সেটাই নাগরিক শর্ত। এ শর্তের কারণেই, নাগরিক বা জনগণ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে, প্রাণ দেয়। আমরা যে আজ বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে বসবাস করছি, সেখানেও উক্ত শর্ত প্রযোজ্য। দেশের সকল নাগরিক, আলিম-উলামা, আপমর মেহনতি জনতাসবাই উক্ত শর্তে আইনগত ও নৈতিকভাবে বন্দী।

আমাদের বাংলাদেশে ‘আলিম-উলামা’ নামে যে ধর্মীয় গোষ্ঠী অস্তিত্বশীল তাঁরা মূলত ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শী বলে পরিচিত। পারিভাষিকভাবে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে এই শ্রেণী জাগতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তব্যে অনুপস্থিত বলে মনে করেন অনেকে। আলিম-উলামার মধ্যেও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করেন, তাঁদের ওসবে অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই। ফলে, দেশে বসবাস করেও তাঁরা নিজদেশে পরবাসী বলে অনেকে মনে করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, উপরের আলোচনার নিরিখে একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে নাগরিকশর্ত ভঙ্গ করা বা তাতে অনীহা প্রকাশ করার আইনত ও নৈতিক যুক্তি আছে কি না? যেহেতু রাষ্ট্র আমাদেরকে নিরাপত্তা ও অধিকার প্রদানে বাধ্য সেহেতু দেশের আলিম-উলামা নাগরিকশর্তকে ভঙ্গ করার অধিকার রাখেন কি না?  প্রশ্নটি এ জন্যই তুললাম, দীর্ঘদিন থেকে রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় কর্তব্যে আলিম-উলামার দৃশ্যত দূরত্ব বজায় রাখার একটি অভিযোগ প্রচলিত। বিষয়টি নিয়ে আমাদের সম্মানিত আলিম-উলামা কোন বক্তব্য রেখেছেন বলে আমার জানা নেই। তবে ২০১৭ সালে আমি বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত “কওমী-জগৎ এবং সামাজিক শক্তির খতিয়ান” শীর্ষক গবেষণা-প্রবন্ধে বিষয়টি নিয়ে দেখাবার চেষ্টা করেছি, জাতীয় উন্নয়নে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভূমিকায় কওমী-জগতের বিশাল অবদান রয়েছে। প্রবন্ধটি এ সাইটের ‘মাদারিস’ পৃষ্ঠায় দেয়া আছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সামাজিক স্থিতিশীলতা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, মানবিক সাহায্য প্রদান ও সমাজ-সংস্কারের মতো জায়গাগুলোতে কওমী আলিম-উলামার নীরব ও ঈর্ষণীয় অবদান রয়েছে। ব্যাপার হলো, কওমী আলিম-উলামা এসব অবদানের কথা প্রচার করে বেড়ান না। তাই, জাতি সে সম্পর্কে অজ্ঞাত। এমন প্রেক্ষাপটে কেউকেউ আলিম-উলামাকে কথিত মূলস্রোতে সম্পৃক্ত করার দাবি তোলেন। মূলত, এ দাবি সম্পূর্ণ অসার ও ভিত্তিহীন। আদর্শিকভাবে তাঁরা আগে থেকেই মূলস্রোতে আছেন। সমালোচকেরা যদি নিজেদের অবস্থানকে ‘মূলস্রোত’ বলে দাবি করেন, তবে এক-ই যুক্তিতে আলিম-উলামা নিজেদের ধর্মীয় অবস্থানকে মূলস্রোত দাবি করার অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা রাখেন। ভূমিকা নীরব বলে জাতীয় অবদানে তাঁদের মূল্যায়ন করা হয় না।

এবার আসি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথায়। এখানে আলিম-উলামার ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা শোনার ও বলার আছে। শোনার কথা মোটাদাগে সবাই কমবেশি জানেন। সত্যিকথা হলো, অন্তত এ বিষয়ে আলিম-উলামার ভূমিকা দৃশ্যত প্রশ্নবিদ্ধ। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হবার আশঙ্কা তৈরি হলে দেশের রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহল যেমন ব্ক্তব্য রাখেন, প্রশ্ন তোলেন; আলিম-উলামা সে অবস্থান থেকে সরব হন না। এ দেশের সুযোগ-সুবিধা কি তাঁরা নিচ্ছেন না? তবে তাঁরা কেন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বপ্রশ্নে দূরত্ব বজায় রাখেন? নীতিগতভাবে আপত্তির জায়গাটি ন্যায্য। বলার হলো, এ বিষয়ে কিছু শাসকগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমমনা মিডিয়া স্বাধীনতার পর থেকে আলিম-উলামাকে তির্যকদৃষ্টিতে দেখে ও অপপ্রচার করে এসেছে। এরা প্রচার করে এসেছে, আলিম-উলামা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। এঁরা রাজনীতি করলে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়; দেশের হয়ে কোন কথা বললে সরকারবিরোধিতার তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়; কারও-কারও সম্পর্কে ভিত্তিহীন অপবাদ দেয়া হয় ইত্যাদি। এসব প্রতিকূলতার কারণে আলিম-উলামা বিতর্ক ও বিভক্তি এড়াতে কিছু বলা ও করা থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন। এ দায় সম্পূর্ণ তাঁদের নয়। বলাবাহুল্য, তাঁদের মূলদায়িত্ব দেশের সার্বভৌমত্বরক্ষা নয়; ইসলামী বিশ্বাস, শিক্ষা ও সংস্কৃতিরক্ষা। স্বাধীনতার দায়িত্ব মূলত সরকারের ও রাজনৈতিক দলের। তবে হ্যা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপদে পড়লে জাতীয় প্রয়োজনে তাঁরা যে ঘরে বসে থাকবেন না, সে তো কসম করে বলা যায়।

এখন প্রশ্ন হলো, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বপ্রশ্নে আলিম-উলামার কি কোন করণীয় নেই? আলবৎ আছে। আমি আগেই বলেছি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অধিকার পাবার শর্তে রাষ্ট্রের প্রতি আলিম-উলামার করণীয় শর্তাবদ্ধ। এখান থেকে নিষ্কৃতি পাবার কোন পথ নেই। আমি বলছি না, তাঁরা মূলদায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতো মিছিল-মিটিং করুক, বিক্ষোভ করুক। তাঁরা যা পারেন তা হলো:

১. সম্মিলিত একটি সুপ্রীম কাউন্সিল বা পরিষদ গঠন করা।

২. পরিষদের মাধ্যমে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের সাথে মতবিনিময় ও প্রস্তাব পেশ করা।

৩. পরিস্থিতির নির্মোহ পর্যবেক্ষণ করে জাতির কাছে বক্তব্য তুলে ধরা।

৪. স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বপ্রশ্নে জাতিকে লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে পরামর্শ দেয়া।

৫. পরিস্থিতি নিয়ে আপন-আপন এলাকায় জনগণকে সচেতন করে তোলা।

৬. শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করা।

এ ধরনের পদক্ষেপ আমলে নিয়ে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভূমিকা রাখার প্রয়াস হলে জাতি ও রাষ্ট্র ভালো কিছু পাবে বলে আশা করা যায়। অপরপক্ষে আলিম-উলামার বিরুদ্ধে অহেতুক অপপ্রচার বন্ধে সর্বমহলে চেষ্টা থাকার বিকল্প নেই। কারণ,জাতি বিভক্ত থাকলে বহিঃশত্রুর কাজ সহজ হয়ে যায়। আজ জাতি বিভক্ত বলে রাষ্ট্র ভেতরে-বাইরে নানাবিধ ষড়যন্ত্রের শিকার। এখানে আলিম-উলামার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জায়গা আছে। জায়গা নিরাপদ হলে ঘর বাঁধতে অসুবিধা কোথায়?

০৩.০৪.২০২৩


ভাবনা-৩৮

ঘনিয়ে আসছে জাতীয় নির্বাচন ২০২৪। এ অবশ্য বিধিবদ্ধ কথা। বাস্তবে আদৌ নির্বাচন হবে কি না, হলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না কি চলমান সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচন হবেইত্যকার বিষয় হিসাবে রাখা অনিবার্য। এখন রাজনীতিক দোলাচল যে চরিত্র বহন করছে তাতে আগাম কিছু বলা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, পর্দা নামের যে বাস্তবতা রাজনীতিতে সারাক্ষণ রাজত্ব করে সেটার এপাশে-ওপাশে কি চলছে, তা সাধারণের কাছে বোধগম্য নয়। এপাশের নাটক না হয় আমরা দেখলাম, ওপাশের দৃশ্য তো দেখা অসম্ভব। উপরে তো সবাই শেখ ফরিদ ভেতরে যদি ‘বোগল মে ইট’ থাকে, তা কি আমরা দেখি? তাই প্রচলিত রাজনীতি মানেই ছলনা, আলো নয় আলেয়া। সঙ্গতকারণে, এ জগতের জ্ঞান না থাকলে; ধূর্ত প্রাণীগুলোর গতিবিধি সম্পর্কে সচেতনতা না থাকলে স্বর্ণ খুঁজতে গিয়ে ছাই হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে প্রবল। মিথ্যার জঞ্জাল, প্রতারণার সমূদ্র আর প্রতিশোধের কুমতলবকে ডিঙ্গিয়ে তীরে পৌঁছানো দুষ্কর। তাই, আজ রাজনীতিতে সৎ, সাহসী ও নীতিবান মানুষের বড়ো অভাব। এখন নেই মাওলানা ভাসানী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমূখদের অনুসারী। এখন দেশ বড়ো নয়, দল বড়ো। দেশের স্বার্থে দলকে গৌণ করার নযীর বিরল। দেশের মানুষ কি ভাবলো আর কি ভাবলো নাতা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। এ চিত্র অস্বীকার করা যায় না।

বলছিলাম, নির্বাচনে কওমীদের ভূমিকা ‍নিয়ে। বিধিবদ্ধভাবে পাঁচ বছরের রাজনীতির নির্যাস নির্বাচন, যদি তাতে মানুষের স্বাধীন মতামত রক্ষার গ্যারন্টি থাকে। আজ দেড় যুগ হয়ে গেলো দেশের মানুষের সাথে সঙ্গী হয়ে আছে সাম্প্রতিক ইতিহাসের নিকৃষ্টতম প্রতারণা। তাই, মানুষ এখন আর ভোট দিতে চায় না। এ হলো বিগত দেড়যুগের রাজনীতির নির্যাস। এমন পরিস্থিতিতে কী হতে পারে কওমীদের ভূমিকা? তাঁরা কি নির্বাচনে ভোট দিতে যাবেন? আমার মনে হয়, এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা জরুরী। ভয় হলো, কওমীদের তো আবার আবেগ নামের এক ভয়ানক অস্ত্র আছে, একতরফা সিদ্ধান্ত নেবার শক্তিশালী স্বভাব আছে। তাই আমার বলা যে কার গায়ে কতোটা লাগবে, জানি না। প্রশ্ন তুলতে পারেন: কওমীদের কি ঐক্যবদ্ধ কোন রাজনীতিক ছাউনি আছে? যৌক্তিক প্রশ্ন। নেই, তবে বিক্ষিপ্ত হলেও একটি বিশাল শক্তি আছে যা কালের সন্ধিক্ষণে মিলিত হলে জাতীয় গতিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। এর অন্যতম নযীর ১৯৯১ সালে ৫ম ও ২০০২ সালে ৮ম জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে চার দলীয় জোটের ধসনামানো বিজয়। অতএব, কওমীদের শক্তি আছে কিন্তু সর্বক্ষণ নিয়ন্ত্রিত নয়। বিক্ষিপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে যায়, তবে আদর্শবিরোধী শিবিরে যোগ দেয় না কখনও। এমন অবস্থায় আগামী নির্বাচন কওমীদের জন্য আদর্শিক ও কৌশলতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা রাজনীতিতে ডানপন্থী বলে পরিচিত, তারা কওমীদের কাছে রাখতে চায় নিঃস্বার্থে নয়, নিজস্বার্থে। এটা কওমীদের বুঝতে সময় লাগে যতক্ষণ না ধোঁকা খায়। প্রচলিত রাজনীতিক দলগুলোর কওমী-শক্তির রস চিবিয়ে পান করার বাসনা গোপন নয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিতর্কিত স্বীকৃতি ও আশ্বাস কওমীরা যখন প্রথমবারের মতো বিবেচনার চিন্তা করে, সে প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যায় ২০২০ সালের মুদীবিরোধী প্রতিবাদে সরকারের অবিবেচকসূলভ সিদ্ধান্তে। অবশ্য এতে কওমীদের অভ্যন্তরীণ আত্মঘাতী সিদ্ধান্তও দায়িত্ব এড়াতে পারে না। সবকিছুর পরে বলা যায়, কওমীরা এখন ভীষণভাবে সরকারবিরোধী।

এখন প্রশ্ন হলো, আগামী জাতীয় নির্বাচনে কওমীরা কি করতে পারে? কওমীরা যা করতে পারে তা হলো:

১. দেশের সকল কওমী আলিমদের একটি সম্মেলন আহ্বান করে মতামত নেয়া ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ। সেটা অবশ্য দু’ভাবে হতে পারে: প্রথমত, বিভাগীয় সম্মেলন ও দ্বিতীয়ত, হাটহাজারীতে জাতীয় সম্মেলন।

২. নির্বাচন যদি বর্তমান সরকারের অধীনে হয় তবে ভোটদান থেকে বিরত থাকা উচিৎ কি না, ভেবে দেখা।

৩. নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কোন দলের লেজুড়বৃত্তি না করে স্বতন্ত্র কোন অবস্থান নেয়া যায় কি না, ভেবে দেখা।

৪. স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে ব্যর্থ হলে বিকল্প অবস্থান ঠিক করা।

৫. একটি ইশতেহার প্রকাশ করে নিজেদের অবস্থান ও কারণ সম্পর্কে জাতিকে অবহিত করা।

পরিশেষে বলতে হয়, দেশের কওমী আলিম ও ছাত্রসমাজ মূলত কওমী মাদরাসাভিত্তিক । এরাই দেশের একমাত্র সামাজিক শক্তি যাঁদের শেকড় মাটি ও মানুষের গভীরে বিস্তৃত। এরা যতোই বিক্ষিপ্ত থাকুকদুই কোটির কাছাকাছি ভোটব্যাংক জাতীয় নির্বাচনে কওমী-জগতের প্রধানশক্তি। বিক্ষিপ্ত  থেকেও আদর্শিক বন্ধনের জোরে এ শক্তি কাজে আসে অলৌকিকভাবে কালের প্রয়োজনে। এটা নিষ্ঠুর এক বাস্তব। তাই ভোটের আগে সবাই কওমীদের কাছে টানতে চায়। ইসলামবিরেরাধী পরিচিতি নিয়েও ইসলামপ্রীতি দেখাতে হজ্ব করতে  যায়। জানি না বিষয়গুলো আমাদের কওমীরা কতোটুকু অনুধাবন করেন। আমার মনে হয়হাতি যেমন দুই কানের কারণে তার শরীর দেখতে অক্ষম তেমনি কওমীরাও অসতেনতার পর্দার কারণে আপন শক্তি অনুধাবনে অক্ষম। কিন্তু প্রতিপক্ষরা কওমীদের শক্তি সম্পর্কে সজাগ। সজাগ বলেই লোভ-লালসা দেখিয়ে এ শক্তিকে বাগে আনতে চায়বিভক্ত করে দুর্বল করতে চায়। এমতাবস্তায় কওমীরা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয় তাতে জাতির কাছে লজ্জিত হতে হবে। আল্লাহ মাফ করুন।

০২.০৪.২০২৩


ভাবনা-৩৭

সাম্প্রতিক অতীতে ইন্তিকাল করা মরহুম ডা. জাফরুল্লা’র একেবারে শেষ বয়সে এসে কুরআন শিখার একটি ভিডিও চোখে পড়ায় আজকের লেখার অবতারণা। কে এই জাফরুল্লাহ চৌধুরী? জাফরুল্লাহ চৌধুরী চট্টগ্রামের এক সৌভাগ্যবান সন্তান। তাঁর জন্ম ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী কোয়েপাড়া গ্রামে। মূলত বাংলাদেশের চিকিৎসা-জগতের এক প্রতিকৃৎ মরহুম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে সক্রিয় এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব  মুক্তিযোদ্ধা। তা’ছাড়া তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামক স্বাস্থ্য বিষয়ক এনজিওর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮২ সালে প্রবর্তিত বাংলাদেশের জাতীয় ঔষধ নীতি’ প্রণয়ন ও ঘোষণার ক্ষেত্রে তিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেন। উইকিপিডিয়ার তথ্যে জানা যায়, তিনি বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস-এ এফআরসিএস পড়াকালীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে চূড়ান্ত পর্ব শেষ না-করে লন্ডন থেকে ভারতে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার নিমিত্ত আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন এবং এরপরে ডা. এম এ মবিনের সাথে মিলে সেখানেই ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। তিনি সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যজ্ঞান দান করেন যা দিয়ে তারা রোগীদের সেবা করতেন এবং তাঁর এই অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়।

ডা. জাফরুল্লাহর বিশ্বাস ও জীবনাচার নিয়ে খুব একটা জানা যায় না। তবে কোন কোন পত্রিকায় তাঁকে সাম্যবাদী বা বামপন্থী বলে প্রচার করা হয়েছে। জন্মগতভাবে তিনি একজন মুসলিম পরিবারের সদস্য। মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে এমন অনেকেই বামপন্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেনএম নযীর কম নয়। সেদিক থেকে মরহুম জাফরুল্লাহ চৌধুরী আক্ষরিক অর্থেই বামপন্থার সাথেসাথে সেক্যুলার জগতের একজন বাসিন্দা ছিলেনতা বলা যায়। যেমন ছিলেন শিক্ষাবিধ মরহুম অধ্যাপক আবুল ফজল। তিনি অবশ্য সেক্যুলারিজম নিয়ে অতিসরব ছিলেন। সে অর্থে ডা. জাফরুল্লাহ সরব ছিলেন না; নীরব ছিলেন। মরহুম আবুল ফজলের সাথে একটি বিষয় মরহুম জাফরুল্লাহ’র সাথে মিলে যায়। তা হলো, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ইসলামের দিকে স্বতঃস্ফুর্ত প্রত্যাবর্তন। তাঁর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে কুরআন শিখার ভিডিওটি দেখলে অনেক কিছু অনুভূত হয়। বোঝা যায়, তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কখনও “আলিফ-বা-তা”শিখায় ব্রতী হননি। তাঁর ছাত্র জীবন, কর্মজীবনের কোথাও তাঁর পারিবারিক বিশ্বাস ইসলামের উপস্থিতি ও আচরণ ধরা দেয়নি। মোটাদাগে বলা যায়, জাফরুল্লাহর জীবন ছিলো প্রধানত সেক্যুলারধর্মী। কিন্তু কেবল আল্লাহর রহমতে তিনি তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্তে আপন গৃহে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যখন একজন আলিমের মুখেমুখে “আলিফ-বা-তা” আরবী হরফগুলো পড়ছিলেন, মনে হচ্ছিলো, তাঁর মধ্যে কোন কপটতা বা লৌকিকতা  নেই। তাঁর চোখেমুখে ছিলো, ঘরে ফেরার অদম্য আনন্দ ও মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের নির্ভেজাল প্রত্যয়। আমার মনে হয়েছে, আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেছেন। মরহুম অধ্যাপক আবুল ফজলের মতোই তিনি তথাকথিত সেক্যুলারিজমকে ছুঁড়ে ফেলে রেখে গেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত।

আমাদের দেশের সেক্যুলাররা যেভাবে মুসলিমদের বিভ্রান্ত করতে নানা কৌশল অবলম্বন করে ঈমান নষ্টে দিনরাত সচেষ্ট, তাদের জাল ছিন্ন করে ইসলাম-ঈমান রক্ষায় মরহুম আবুল ফজল ও জাফরুল্লাহ চৌধুরী যে নযীর দেখিয়েছেন তা বর্তমান অবুঝ সেক্যুলারদের পথ দেখাতে পারে বলে বিশ্বাস। কথায় বলে না: শেষ ভালো যার সব ভালো তার! আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সতর্ক করে বলেছেন: তোমরা আল্লাহকে ভয় করার মতো ভয় করো, মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। এখানে সেক্যুলার হওয়ার কোন পথ খোলা নেই। দেশের মিডিয়াগুলো মরহুম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অনেক গূণের বয়ান দিয়েছে কিন্তু এড়িয়ে গেছে তাঁর কুরআন শিখার ব্যাপারটি। কারণ তাতে যদি সেক্যুলারিজমের গোমর ফাঁস হয়ে যায়? আলোচকেরাও তাঁদের টকশোতে সে-কথা বেমালুম চেপে গেছেন সজ্ঞানে।তাতে কি পরিত্যক্ত সেক্যুলারিজমকে রক্ষা করা যাবে? আমরা আশা করবো, মরহুম আবুল ফজল ও ডা. জাফরুল্লাহ’র মতো সন্তানদের দেখানো পথে অবুঝ সেক্যুলাররা শেষজীবনে হলেও ইসলামের আহ্বানে সাড়া দেবে।

৩০.০৪.২০২৩  



ভাবনা-৩৬

কিছু বলতে ডর লাগে। বুঝেন-ই তো, যদি বলার অপরাধে মামলা খাই? বাজারে গেলে কারও সাথে কিছু বলতে ডর লাগে। কে আবার কোন কথাকে কোথায় নিয়ে যায়, বলা তো যায় না! পত্রিকায় দেখি, অমুক গ্রেফতার ডিজিটাল আইনে। দোষটা কি? কি যেনো লিখেছে কে জানে? ওর আর রক্ষা নেই। তাই কিছু বলতে গেলে অদৃশ্য এক জালি যেনো চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। মনে হয়, কারাগারে আছি। সঙ্গতকারণে, কিছু বলতে গিয়ে মুখ হটে আসে। এই যে লিখছি, বুকে অজানা ভয়; সংকোচ। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় যখন ভাবি: আমি স্বাধীন। আমার কথা, মতামত আমি বলতে পারবো নির্দ্বিধায়। এমন কল্পনা করতে মাঝেমাঝে কণ্ঠ শুকিয়ে যেতে চায়। পরিবার মানা করে কিছু লিখতে, বলতে অজানা বিপদের আশঙ্কায়। যারা সরকারের বলে জানি ওরা আপন হলেও, সংকোচ করি। মেপে-মেপে বলতে হয়। কোনটা যে সরকারের পক্ষে আর বিপক্ষে, বোঝা দায়। আবার কোন দোষ না করেও ভুগতে হয়। ফোন করে বলবে: আমি অমুক সংস্থা থেকে বলছি। আপনি কি করেন? ইত্যাদি। ডর লাগিয়ে দেয়া আর কি। সবসময় নিরাপত্তাহীনতা লাগে। সাদাপোষাকে কেউ এলো না তো! কলিং বেল বাজলে সবাই আঁতকে উঠি। দৌড়ে গিয়ে আগে খাপ দিয়ে দেখি। এসে যদি বলে: থানায় যেতে হবে। রক্তচাপের জন্য অষুধ খাই না; খাই টেনশন না হতে। রমজান এলো, কাল থেকে। গেলো বছরের মতো এ  বছর আর হয়ে উঠছে না। বুঝতে পারছেন না! মধ্যবিত্ত হয়ে জন্মেছি, সে কি কম দোষের? কথায় বলে না, অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর। আগে মানুষজন সরকারকে দু’কথা বলে মন হালকা করার মওকা পেতো। এখন তাও খোলা নেই। বেপারীরা বলে, কিনছি বেশি দামে, কম দামে বেচবো কেমন করে? আমরা তো ছোট বেপারী। বড়োদের কেউ কিছু করে না। পরিষদ আছে, জনপ্রতিনিধি আছেকারও কাছে সান্ত্বনা নেই। ওরাও বা কি করবে? আমাদের না বলার আছে, না সওয়ার আছে। মাছের বাজার, গোশতের বাজারসে তো হিমালয় দেখা। কাপড় বলে ধুয়ে দাও আর পকেট বলে সয়ে নাও। গেলো বছর যা এনেছি দশ টাকায় সে এখন প্রমোশনে ত্রিশ টাকায়। বাক আমাদের তবুও স্বাধীন। বলতেই হবে। সেটা না বললে কি অমানুষ আর অকৃতজ্ঞ হবো না? ভাবছি, বাজারে যে দাম বেশিসে কথা বললে কি ডিজিটাল আইনে মামলা খাবো? বুঝতে পারছি না। দুরুদুরু বুকে লিখলাম দু’কলম।
২৩.০৩.২৩          

 


ভাবনা-৩৫

প্রচলিত ইসলামী রাজনীতি এবং মূলধারার ইসলামী রাজনীতি নিয়ে পার্থক্যের দর্শন আমি অনুভব করি বেশ আগে থেকেই এর মূল কারণ, ৮০র দশকের প্রারম্ভে আমীরে শরীয়াত হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-র নেতৃত্বে গঠিতবাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন’-এর সাথে আমার সম্পৃক্ততা হযরতের জীবদ্দশায় বিষয়টি নিয়ে ভাবার সুযোগ হয়নি কারণ, দুটো ভিন্নভিন্ন বিষয়ের অস্তিত্ব প্রকাশের আগে পার্থক্যের ধারণা করা অসম্ভব  যেমন, রাত বা দিন অস্তিত্ব লাভ করার পূর্বে রাত-দিনের ভিন্নতা নির্ণয় করা সম্ভব নয় এক-ই যুক্তিতে হযরত হাফেজ্জী হযুরের রাজনীতি বা অন্দোলনপরবর্তী ইসলামী রাজনীতির আকৃতি ও চরিত্র দর্শিত না হলে প্রচলিত ইসলামী রাজনীতি ও মূলধারার ইসলামী রাজনীতির পার্থক্য নির্ণয়ের ধারণার উম্মেষ হতো না যাঁরা সে-সময়ে খেলাফত আন্দোলনের চরিত্র ও আচরণ প্রত্যক্ষ করেননি, তাঁদের পক্ষে উক্ত তর্কের মর্ম উপলব্ধি করা দুষ্কর হবে ১৯৮১ সালের ১১ই নভেম্বর বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত হাফেজ্জী হুযুরের রাজনীতিক প্রক্রিয়াগুলোকে পর্যবেক্ষণ করলে একজন সচেতন মানুষের যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হবে, তা ইসলামী রাজনীতির মূলধারা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে হাফেজ্জী হুযুরের রাজনীতিক গতি-প্রকৃতিকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা যায়: এক. আন্দোলন, দুই. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন

হুযুরেরখেলাফত আন্দোলননামেই ছিলো ঐতিহাসিক এক সম্বন্ধ ও তাৎপর্য সচেতন পাঠকমাত্রেই জানেন, ইসলামের খেলাফত-ব্যবস্থা মুসলিম শাসন-ইতিহাসের সর্বোৎকৃষ্ঠ স্বর্ণযুগ সেই আবেগবাহিত এক আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯১৯ সালে ভারতে, তুরষ্কে উসমানীয় খেলাফত বহাল রাখার দাবিতে এ আন্দোলন চলে ১৯২৪ পর্যন্ত এরপর এক-ই নামে নতুন এক আন্দোলন গড়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশে হাফেজ্জী হুযুরের নেতৃত্বে স্বভাবতই, হাফেজ্জী হুযুরের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও উপমহাদেশবিখ্যাত ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে এমন আন্দোলনে দেশব্যাপী কৌতুহল ও আগ্রহের সৃষ্টি হয়  এ আন্দোলন যে দ্বিমতে আক্রান্ত হয়নি তা নয় সবকিছুকে অতিক্রম করে খেলাফত আন্দোলন বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসাবে তার নাম লেখাতে পেরেছেসেটা যেমন সমসাময়িক কালে পরিচ্ছন্ন রাজনীতির উদাহরণ হিসাবে মানুষকে আকর্ষণ করে, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মধ্যপন্থায় অবস্থান করে আত্মশুদ্ধিনির্ভর ও গঠনমূলক সংস্কারের পথ দেখায় বলাবাহুল্য, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে আলিম-সমাজের রাজনীতিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে বহুদলীয় রাজনীতি অনুমোদিত হলে ইসলামী রাজনীতির দ্বার উম্মোচিত হয় সেই ধারাবাহিকতায় মঞ্চে আসে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন তবে প্রকৃত বিচারে হাফেজ্জী হুযুরের জীবদ্দশায় খেলাফত আন্দোলন কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগুলোই মূলত বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির এক ব্যতিক্রমধর্মী অধ্যায় ১৯৮১-তে আনুষ্ঠানিক রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও মূলত হাফেজ্জী হুযুর রাষ্ট্রসংস্কারের চিন্তা করেন আরও আগে থেকে এর প্রমাণ মেলে ১৯৭৮ সালে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে বৈঠকে তিনি সংবিধানেবিসমিল্লাহির রহমানির রহীমযুক্ত করাসহ বিভিন্ন সংস্কারের জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের কিছু কর্তব্যের কথা তুলে ধরেন ঐ বছরের ২৯শে মে তাঁর মৌখিক বক্তব্যগুলো তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বরাবরে একটি একটি খোলা চিঠি হস্তান্তর করেন বাংলাদেশের কোন ইসলামী নেতার জন্য এ ছিলো ইতিহাসের প্রথম নযীর তাছাড়া, মন্ত্রী, প্রশাসনের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের কাছে হাফেজ্জী হুযুরের দাওয়াতী চিঠি দিয়ে খেলাফত আন্দোলনের কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন চাওয়া হতো হযরতের জীবনের শেষ পর্যন্ত এ ধরনের পদক্ষেপ অব্যাহত ছিলো সরকারী-বেসরকারী উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছেও পৌঁছানো হতো লিখিত দাওয়াত দেশব্যাপী দলের কর্মসূচীতে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন জেলা, থানা ও মাদরাসা সফর করে আন্দোলন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা ছিলো বিরামহীন ফলে, পুরো দেশে খেলাফত আন্দোলন নিয়ে অভূতপূর্ব উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় তৃণমূল থেকে উপরতলা অবধি সর্বক্ষেত্রে খেলাফত আন্দোলন ছিলো আলোচনার বিষয়

হাফেজ্জী হুযুরের আন্দোলনের বিস্ময়কর এক দিক ছিলোতাওবার রাজনীতি উপমহাদেশের রাজনীতিতে: সে ধর্মীয় হোক বা ধর্মনিরপেক্ষ, এ ছিলো ব্যতিক্রম এবং অভিনব আমার আজও মনে পড়ছে, তাওবার রাজনীতি প্রশাসন, পুলিশ এমন কি সমাজের সর্বস্তরে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেঢাকা স্টেডিয়ামের লাগোয়া বাইতুল মুকাররমের দক্ষিণ ফটকে দ্বিতীয় তাওবা দিবসের (আনু:১৯৮৩) ইতিহাজ্জ্বোল মহাসমাবেশের কথা বিস্মৃত হবার নয়তখন এরশাদের আমল সেদিন মঞ্চের সামনাসামনি ছিলাম আমি হাফেজ্জী হুযুর যখন তাওবার মুনাজাতে হাত তুললেন, দুনিয়া যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো সে এক হৃদয়বিদারী দৃশ্য! আলিম-উলামা, ছাত্র-জনতা, পুলিশের গগণবিদারী রোনাজারিতে ভেঙ্গে গেলো সব শৃঙ্খল মনে হচ্ছিলো, আসমানের ফরিশতারাও বুঝি নেমে এলো জমিনেসিলেটের প্রখ্যাত আলিম মাওলানা আব্দুল গাফফার সাহেব রহ. মতভিন্নতার কারণে ক্ষমা চেয়ে হযরতের দুপা জড়িয়ে যে ক্রন্দনবিজড়িত দৃশ্যের অবতারণা করেছিলেন, তা কখনও বিস্মৃত হবার নয়সর্বত্র হযরতের আহ্বান ছিলো: আমরা গুনাহগার; সকল অরাজকতা আমাদের গুনাহ কারণতাই, আসুন সকলে তাওবা করিহযরতের স্লোগান ছিলো: এক হও নেক হও; দুনিয়ার মুমিন এক হও নেক হওআত্মশুদ্ধির সাথেসাথে আল্লাহর জমীনে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নের যে রাজনীতি বা আন্দোলনের দৃষ্টান্ত হযরত হাফেজ্জী হুযুর সৃষ্টি করেন, তা এককথায় অভূতপূর্বযতোদূর মনে পড়ে, তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং এরশাদের সাথে সাক্ষাতে বলেছিলেন, আপনারা ক্ষমতায় থাকুনআমি ক্ষমতা কেড়ে নিতে আসিনিকিন্তু আল্লাহর জমীনে আল্লাহর হুকুম কায়েম করুন

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হযরতের হাফেজ্জী হুযুরের অংশগ্রহণ ছিলো আরেক ইতিহাসবাংলাদেশের কোন ইসলামী নেতার এমন পদক্ষেপ আর দেখা যায়নিপ্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদাতের পর ১৯৮১ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনতাঁর প্রতীক ছিলো, বট গাছ নির্বাচনে তিনি তৃতীয় স্থান লাভ করেন বটে কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অর্জিত ভোটের সংখ্যাধিক্যে হযরত হাফেজ্জী হুযুর আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেনতিনি উক্ত নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেনএরপর আসে ১৯৮৬ সালএবারও তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারী হিসাবমতে ১৫ লক্ষ ১০ হাজার ৫৬ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেনশতকরা হিসাবে তাঁর ভোটের হার ছিলো .৬৯ শতাংশতবে জনশ্রুতি ছিলো, আসলে হাফেজ্জী হুযুর সর্বাধিক ভোট অর্জন করেন কিন্তু কারচুপি করে তাঁকে দ্বিতীয় স্থান দেখানো হয়দু’-দুটো  প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় কেউকেউ এবং কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হুযুরকে দিয়ে দেশ চালানোর সক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলেনএখানে বিষয়টি পরিস্কার হওয়া প্রয়োজনহযরতের রাজনীতির আগাগোড়া পর্যবেক্ষণে কখনও মনে হয়নি তিনি নিছক ক্ষমতামুখী রাজনীতি করেছেনতার রাজনীতি ছিলো মূলত ইসলামের নির্দেশিত পথে ব্যক্তি, সমাজ রাষ্ট্রসংস্কারদল গঠন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণে তিনি যা চেয়েছিলেন, তা হলো: . আলিম-সমাজকে কেবল মাদরাসাকেন্দ্রিক না রেখে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে জাতীয় উন্নয়নে শরীক করা, . জাতীয়ভাবে আলিম-উলামার প্রভাব সৃষ্টি এবং দেশের নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখা এবং . দেশে নির্ভেজাল ইসলামী রাজনীতি ও নেতৃত্ব সৃষ্টিযেহেতু দেশে তৎকালীন সময়ে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচনব্যবস্থা চালু ছিলো, তাই কোন প্রকার অরাজকতা সৃষ্টি না করে উক্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে যতোদূর সম্ভব সংস্কার-আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং জনসাধারণকে ইসলামের নির্দেশআমর বিল মারূফ নাহী আনিল মুনকার”(সৎকাজের আদেশ অসৎকাজের নিষেধ)- সাথে পরিচিত করে তোলা ছিলো হাফেজ্জী হুযুরের রাজনীতিক কৌশল বিষয়গুলোকে উপলব্ধি করতে না পারলে হাফেজ্জী হযুরের রাজনীতির মূল্যায়ন সমূহকঠিন হবেরাজনৈতিক দল গঠন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে তিনি ঘরমুখো আলিম-সমাজকে যেভাবে সচেতন উজ্জীবিত করে গেছেন, তার প্রভাব আজও বহমান

এভাবেই দেশে কিছু সময়ের জন্য হলেও মূলধারার ইসলামী রাজনীতি দৃশ্যপটে হাজির হয় হযরত হাফেজ্জী হুযুরের নেতৃত্বেমূলত হুযুরের রাজনীতিক পদ্ধতিই মূলধারাইসলামী রাজনীতিএটা কেউ অস্বীকার করতে পারেন নাপ্রশ্ন করতে পারেন, মূলধারার রাজনীতির মাপকাঠি কি? আমাদের জন্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূলধারার রাজনীতির মাপকাঠি হলো, পঞ্চদশ শতকে শেখ আহমদ সিরহিন্দী মুজাদ্দিদ আলফে সানী রহ. বাদশা আকবরের দ্বীনে ইলাহীর মুকাবিলায় যে রাজনীতিক পদ্ধতি অনুসরণ করেনইতিহাসের অকাট্য গ্রন্থগুলো দেখুন, দেখবেন মুজাদ্দিদ আলফে সানীর গৃহীত পদ্ধতিই অনুসরণ করেছিলেন হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ.মুজাদ্দিদ সাহেব যেভাবে সরাসরি বাদশাহকে দাওয়াত দেন, তাঁর আমীর ওমারাকে চিঠি দিয়ে ইসলামের মূলধারায় ফিরে আসার আহ্বান জানান, হযরত হাফেজ্জী হুযুরও সেভাবে দাওয়াত পৌছে দেনমুজাদ্দিদ সাহেব মূলত রাসূলুল্লাহ সা.- অনুসৃত পথেই তাঁর কর্মসূচী এগিয়ে নেনআমার মনে হয়, আজও মার-মার, কাট-কাটধর্মী নেতিবাচক রাজনীতির পরিবর্তে হাফেজ্জী হুযুরের অনুসৃত মূলধারার রাজনীতি আমাদেরকে পথ দেখাবেআন্দোলনের পাশাপাশি আমাদেরকে এও বুঝতে হবে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বাইরের শত্রুকে নিমন্ত্রণ করে এবং আমাদের শক্তিকে নেতিবাচক পথে ক্ষয় করে দুর্বল করে দেয়সঙ্গতকারণে, বলতে হয়, হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ. যে মূলধারার ইসলামী রাজনীতির উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন, সেটাকে সঠিক মূল্যয়ন করা প্রয়োজনঅন্যথায়, বিপদ আমাদের পদেপদে সঙ্গী হবে।

২২.০৩.২৩

















ভাবনা-৩৪

গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিশ্বে এখন বহুল পরিচিত ও প্রচলিত একটি পরিভাষা বা মতবাদ মুসলিমদের সচেতন অংশ বিলক্ষণ জানেনকুরআনের আয়াতের অর্থউদ্দেশ্য ও ভাব বুঝতে প্রেক্ষাপট জানা জরুরী যা ‘শানে নুযূল’ হিসাবে পরিচিত বিনা শানে নুযূলে অর্থ ও উদ্দেশ্য জানা সম্ভব নয় তেমনি প্রচলিত পরিভাষা বা মতবাদের উদ্দেশ্য বুঝতে সেগুলোরও শানে নুযূল জানা অপরিহার্য এতে করে মূল সমস্যাসমস্যার সমাধানকল্পে প্রদর্শিত প্রতিক্রিয়া এবং প্রভাব জানা সহজ হয় আমাদের এখানে কথায়-কথায় গণতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা যারা বলেনসম্ভবত তারা জানেন না অথবা পড়ে দেখেননি গণতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার সৃষ্টিকারণযাকে বলছিশানে নুযূল এর ওপর একেকজনের একেক সংজ্ঞা কেউ বলেছেনঅমুক এটা বলেছেনতমুক ওটা বলেছেন ইত্যাদি ইতিহাসূত্রে জানা যায়মধ্যযুগে পাশ্চাত্যে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় খ্রীষ্টান চার্চের কর্তৃত্বপরায়নতার সাথে রাজার দ্বন্দ্ব এবং এর  বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সরূপ গড়ে ওঠে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা বিশেষত প্রাচীন গ্রীস এ ধারণার জন্মক্ষেত্র বলে পরিচিত সে-সময় ইতালীর দার্শনিক নিকোলো মেকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭মধ্যযুগীয় খ্রীষ্টীয় প্রভাব থেকে জাগতিক জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে ধর্মের উর্ধ্বে স্থান দিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্রের ধারণা প্রদান করেন বিগত একশো বছর ধরে রোমান ধর্মগুরু ও পোপদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তা থেকেই মূলত মার্টিন লুথারের (১৪৮৩-১৫৪৬প্রোটেস্টান্ট ক্যাথলিক সংস্কার আন্দোলন গড়ে ওঠে এগুলো ছিলো তৎকালীন খ্রীষ্টান-সমাজের নিজস্ব সমস্যা এর মূলে ছিলোচার্চের কর্তৃত্বপরায়নতা থেকে সাধারণ প্রশাসনকে রক্ষা এবং খ্রীষ্টধর্মকে সংস্কার করার আকাঙ্খা এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক নির্মল কুমার সেন বলছেনপোপ শাসিত রোমান ক্যাথলিক ধর্মপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ধর্ম সংস্কার অন্দোলনের সূচনা হয় জার্মানীতে মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে সামন্ততন্ত্রের অবসানকল্পে এটাই ছিলো বুর্জোয়াদের প্রথম সংগ্রাম লুথার ছিলেন জার্মানীর উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মশাস্ত্রের অধ্যাপক আবাল্য খ্রীষ্টান ধর্মের প্রতি অনুরাগী লুথারের কাছে পোপের কার্যকলাপ শাস্ত্রবিরোধী বলে মনে হয়েছিল পাপ মোছনের জন্য পোপের অনুচরদের ক্ষমাপত্র বিক্রয়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে পোপ এবং ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে লুথারের বিদ্রোহের সূচনা”(রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পৃ:৬০দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৮৬পশ্চিবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদকলিকাতা) এভাবেই রাষ্ট্র পরিচালনায় চার্চের কর্তৃত্ব নির্মূলে আন্দোলন চূড়ান্তরূপ পরিগ্রহ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রচিন্তার সূচনা  হয় এ পথ ধরে আসে প্রচলিত গণতন্ত্রের ধারণা গণতন্ত্রের মূল প্রবক্তাদের মধ্যে যাকে প্রধান ভাবা হয়, ‍তিনিভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮) তিনি বিশ্বাস করতেনধর্ম যার-যার ব্যক্তিগতশাসনে এর কোন অধিকার থাকতে পারে না গণতন্ত্রের আরও দুজন প্রবক্তা হলেনমোন্টেসক্যু (Montesqiueও রুশো (Rousseau) এ তিন দার্শনিকই ছিলেন ফরাসী পাকিস্তান শরীয়া আদালতের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারক ও প্রখ্যাত ফকীহ মুফতী তাকী উসমানী ভেলতেয়ারের দর্শন নিয়ে লিখছেন,ভলতেয়ারের মতাদর্শের আরেকটি কথাযেটা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেতা হচ্ছে এই যেধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত একটি বিষয় এবং এমন কোন অথরিটি নেইযা কাউকে অপরের ধর্ম সম্পর্কে সঠিক বা ভুল সাব্যস্ত করার প্রবক্তা করে তুলতে পারে। বরং এটা মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার মানুষ ইচ্ছা করলে মূর্তিপুজা করতে পারেইচ্ছা করলে কোন ঐশী-ধর্ম গ্রহণ করতে পারেইচ্ছা করলে ইহুদী বা খ্রীষ্টান হতে পারে। এটা নিছক তার নিজের বিষয় এখানে চার্চেরও হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন নেইসরকার তথা রাষ্ট্রেরও হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই হকুমতের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই” (ইসলাম ও রাজনীতি পৃ১০১১ম প্রকাশ ২০১৫মাকতাবাতুল হেরা ঢাকা) অপর দার্শনিক রুশো সামাজিক সন্ধির (১৭৬২ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেনস্বাধীন এবং মুক্ত মানুষের পারস্পরিক চুক্তিই রাষ্ট্রনৈতিক সংগঠনের ভিত্তি তাঁর এ মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লব সংঘটিত হয় এই তত্ত্বকে সম্বল করে ১৮৬৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলবাণী বলে খ্যাত ‘জনগণের সরকারজনগণের কর্তৃক এবং জনগণের জন্য’ প্রচার করেন এভাবেই আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বে কথিত গণতন্ত্র বা ডেমোক্রেসি (এখানে Demos থেকে এসেছে জনগণ এবং Kratos থেকে এসেছে ক্ষমতা বা শাসন) প্রচলিত রয়েছে সবকিছু পর্যালোচনা করে বলা যায়সেক্যুলারিজম ও গণতন্ত্র এক অপরের পরিপূরকও রক্ষক  তাহলে বোঝা গেলো, যেসব সমস্যার কারণে পাশ্চাত্যে ধর্মনিরপেক্ষতা আর গণতন্ত্র এসেছে, সেসব একান্তই তাদের সমস্যা, অন্যদের নয়। কিন্তু আজ অষুধ খেতে হচ্ছে পৃথিবীর তাবৎ বাসিন্দার। আমরা যখন বলি, বিদেশী হস্তক্ষেপ কাম্য নয়, প্রশ্ন করি: ধর্মনিরপেক্ষতা আর কথিত গণতন্ত্র তো বাইরের সমস্যাজনিত ফল, আমরা কেন প্রয়োগ করছি? বিদেশী হস্তক্ষেপ তো এগুলোর মধ্য দিয়ে আসছে। যারা ওগুলোর জন্ম দিয়েছে, প্রচার চালাচ্ছে, তারা তো বাইবেলে হাত রেখে শপথ নেয়। তখন কি সাম্প্রদায়িকতা হয়না? সেখানেও তো সংখ্যালঘু আছে। তাহলে আমরা কেন কুরআন ছুঁয়ে বা সামনে রেখে বা আল্লাহর নামে শপথ নিতে পারি না? আসলে মানসিকভাবে আমরা আজও ওদের গোলাম। স্বাধীনভাবে কথা বলার বা কাজ করার অধিকার তো আমাদের শাসক ও রাজনৈতিকেরা আগেই বিলিয়ে বসে আছেন। য়ূরোপে এখন খ্রীষ্টধর্মীয় রাজনৈতিক দল শক্তিশালী হয়েছে। ওখানে মৌলবাদী বলা হয় না কেন? ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায়, ওদেরকে সাম্প্রদায়িক বলা হয় না কেন? দোষ কি শুধু আমাদের ইসলামী রাজনীতি নিয়ে? এখানে ইসলাম নিয়ে কথা বললে স্বাধীনতাবিরোধী হয়। তাহলে ভোটের আগে টুপি মাথায় দিয়ে মুমিন সাজার কসরত কেন? এগুলো কি ধাপ্পাবাজি নয়? আমাদের সমস্যা সমাধান করতে হবে আমাদের ধর্মীয় ও জাতীয় মূল্যবোধ দিয়ে। বিদেশী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে নয়।
২০.০৩.২৩ 


ভাবনা-৩৩

বিদ্রোহী কবি; জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কলমের দ্রোহ যেনো পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়। নজরুলের জন্ম না হলে, বাংলা সাহিত্য কোন দিন যৌবন খুঁজে পেতো না। বৃদ্ধের মতো ন্যুব্জ হয়ে চলা বাংলা সাহিত্যকে নজরুল যে অমৃতরস পানে যৌবনত্ব দিয়ে গেছেনসে কাজ অন্য কেউ করে যেতে পারেননি। আমি সাহিত্যিক নই, সাহিত্যের খানিক খুশবু শুঁকেছি মাত্র। তাই নজরুল নিয়ে কথা বলার অধিকার কতোটুকু আছেসে প্রশ্নবানে আমাকে জর্জরিত করার মওকা সবার থাকলো। বাল্যে নজরুলের ছড়া-কবিতা পড়েছি বাল্যশিক্ষার দিনে। তখন নজরুলের পাশাপাশি কায়কোবাদ, গোলাম মোস্তফা, কাজী কাদের নেওয়াজ, কবি বন্দে আলী মিয়া, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি জসিম উদ্দিন, বেগম সুফিয়া কামাল, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমূখের কবিতা পড়েছি। এখনকার মতো মাজাভাঙ্গা কবিদের কবিতা পড়তে হয়নি কপালগুণে। কবি নজরুল ইসলাম অমূল্য যে তিন রত্ন দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে ঋণী করে গেছেন সেগুলো এক. সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, দুই. বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের কথা, তিন. বিদেশী বিশেষত আরবী-ফারসী শব্দের উদার ব্যবহার। সত্যি কথা বলতে কি, নজরুল বাংলা সাহিত্যে এক প্রবল ভূমিকম্প, যার আঘাতে অসমতল বন-জঙ্গল মাটিতে মিশে গিযে জন্ম নেয় সবুজ প্রকৃতি। নেমে আসে দমকা হাওয়া। রসহীন নিছক প্রেম-কাহিনীর বেড়াজালে আবদ্ধ বাংলা সাহিত্যকে তিনি দিলেন নতুন অভাবনীয় এক অমৃতরসযৌবনের ঝঞ্ঝা; চির উন্নত শিরের উদাত্ত আহ্বান আর বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের কথাযা আগে ভাবাও যেতো না। নজরুল শুধু যে সাহিত্যকে দিয়েছেন, তা নয়। নজরুল মানুষকে দিয়েছেন আত্মাধিকারের জন্য নিবেদিত হবার শিক্ষা; বঞ্চনার বিরুদ্ধে দ্রোহের আগুন জ্বালানোর দীক্ষা। “তুমি রবে তেতলার ‘পরে আমি রবো নিচে, তবুও তোমারে দেবতা বলিব সে ভরসা আজ মিছে।”এমন হুংকার সাহিত্যের দহলিজ থেকে কে দিয়েছে শুনি? “বল বীর বল উন্নত মম শির!” বলে যে বজ্রনিনাদ নজরুলকণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে আজও হৃদয়ের দেয়ালে-দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়, তাই তো আমাদের বাংলা-সাহিত্যের অদমনীয় অহংকার। তাঁর ছন্দমালা, শব্দচয়নসব কিছুতে নতুন অভ্যুদয় জ্বলেপুড়ে ছাই করে দিয়েছে গতানুগতিক সাহিত্যপ্রথাকে। নজরুল শিখিয়েছেন মুসলিম সাহিত্যসত্ত্বার মধ্য দিয়ে কেমন করে ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিতে হয়। ‘উমর ফারুক’ কবিতাটি তার উৎকৃষ্টতম উদাহরণ। বলা চলে, বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাহিত্যসত্ত্বার যে অবহেলিত হাল বিরাজমান ছিলো, সেখানে নজরুল এনেছেন প্রলয়ঙ্কর ইনকিলাব। যে বাংলা সাহিত্যকে একদিন সংস্কৃতপন্থীরা অবজ্ঞা করে দূরে সরিযে রেখেছিলো, সেই বাংলা সাহিত্য নজরুলের সংস্পর্শে পেলো নতুন জীবন। এক কথায়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যকে রেখে গেছেন এমন এক উচ্চতায়, যা কখনও এড়িয়ে যাবে না। আল্লাহ কবিকে মাগফিরাত দান করুন।

১৭.০৩.২৩            



ভাবনা-৩২

একশ্রেণীর কথিত বুদ্ধিজীবি ক্রমাগত বলে আসছেন, বাংলাদেশ নাকি ধর্মনিরপেক্ষ। তাদের কথায় দেশ যদি ধর্মনিরপেক্ষ হয়, মানুষগুলো কি হবে? এ প্রশ্নের উত্তর কি তারা দিতে পেরেছেন? ওনারা বলেন, সংবিধানে লেখা আছে। ঠিক আছে, লেখায় যদি সব হয়, তবে কেন ওনারা কথায়-কথায় তুলনা দেন: গোয়ালার গরু গোয়ালে নেই, খাতায় আছে?  প্রশ্ন করতে পারি, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি? এর চরিত্রই বা কি? তখন ওনারা বলে উঠেন: ধর্মনিরপেক্ষতার এই মানে, সেই অর্থ ইত্যাদি। বাংলাদেশের এক স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অন্যতম উপদেষ্টা প্রয়াত আকবর আলি খান লিখেছেন, “বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ইংলিশ-বাংলা অভিধান অনুসারে ইংরেজি সেক্যুলারিজম শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘নৈতিকতা ও শিক্ষা ধর্মকেন্দ্রিক হওয়া উচিৎ নয়, এই মতবাদ; ইহজাগতিকতা; ইহবাদ। ’গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের বারো অনুচ্ছেদে সেক্যুলারিজমের অনুবাদ করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। কোন অনুবাদ সঠিক? দুটোই ঠিক। ইংরেজি সেক্যুলারিজম শব্দটির দুটো অভিধা রয়েছে। সেক্যুলারিজম শব্দটি একটি জীবনদর্শন, আবার এটি একটি শাসনতান্ত্রিক মতবাদও বটে।”(অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি পৃ: ৮৯, দ্বিতীয় সংস্করণ: ২০১৭, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা।)  তিনি আরও লিখছেন, “তবে শাসনতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতা ইহবাদের চেয়েও পুরোনো মতবাদ। রোমান ক্যাথলিক গির্জার বিরুদ্ধে শাসকদের ক্ষমতার লড়াইয়ে এই মতবাদ বিকশিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন এ জন্য যাতে এক ধর্ম অন্য ধর্মের ওপর প্রধান্য লাভ না করে। কিন্তু ইউরোপে সবাই ছিলো খ্রিষ্টান। ঝগড়াটা এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের ছিলো না; ঝগড়া ছিলো খ্রিষ্টানদের বিভিন্ন উপদল বা সিলসিলার মধ্যে। ঝগড়া শুধু শাসনতান্ত্রিক ছিলো না; লড়াইটি ছিলো মূলত বৈষয়িক।ক্যাথলিক গির্জা ছিলো বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক। ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদ গড়ে ওঠে রাষ্ট্র কর্তৃক গির্জার সম্পত্তি দখল নিয়ে।”(সূত্র: ঐ) এবার বলুন, মূল সমস্যা কোথায়?  এক ঘরে ঝগড়া হলো, তাই সব ঘরে সালিস করতে হবে কোন যুক্তিতে? ঝগড়া হলো খ্রিষ্টান রাজ্যে; বিষয় হলো সম্পত্তির দখল অথচ সে ঝগড়ার বাগড়া দেয়া হচ্ছে অন্যঘরেএ আবার কোন হিসাব? ইতিহাসে দেখা যায়, চতুর্দশ শতাব্দীতে পোপ-শাসিত রোমান ক্যাথলিক ধর্ম-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জার্মান উইটেনবাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মশাস্ত্রের অধ্যাপক মার্টিন লুথারের (১৪৮৩-১৫৪৬) সংস্কার-আন্দোলন ছিলো মূলত গীর্জার আধিপত্যরোধের আন্দোলন। এখান থেকেই য়ুরোপে রাষ্ট্র এবং গীর্জার পৃথকীকরণের ধারণা আসে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধর্মহীন করার দাবি ওঠে। ফলে জন্ম নেয় নিখাদ ইহজাগতিক ধারণাধর্মনিরপেক্ষতা, যা একান্তই য়ুরোপের। আকবর আলী খানের লেখা থেকে বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার মূলরস কিন্তু ইহজাগতিকতা। এখানে বিচার হবে সামগ্রিক দৃষ্টিতে অর্থাৎ ইহলৌকিক ও পারলৌকিক চিন্তায় নয়, আংশিক ইহজাগতিকতার ভিত্তিতে। জনাব খানের কথায় আরও স্পষ্ট যে, সেক্যুলারিজম একটি জীবনদর্শন। অর্থাৎ, য়ুরোপের সমস্যাহেতু যে ধর্মনিরপেক্ষতা জীবনদর্শন হিসাবে বিবেচিত হবে, সেটা অন্যস্থানেও; অন্যধর্মাঞ্চলেও  প্রযুক্ত হবে। এখানেই আমাদের মূল আপত্তি। য়ুরোপ ধর্মনিরপেক্ষতাকে জীবনদর্শন মেনে যদি রাষ্ট্রনীতি গড়তে পারে তাহলে আমরা কেন ইসলামকে জীবনদর্শন মেনে রাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করতে পারবো না? এখানে আপত্তি তাদের, যারা ইসলামকে পূর্নাঙ্গ জীবনবিধান হিসাবে মানতে নারাজ। এ-ছাড়া, সেক্যুলারিজম মানে যদি এই হয়, কোন ধর্মকে অন্য ধর্মের উপর প্রাধান্য দিতে অস্বীকার করা, তবে তাও কোন মুসলিম জনগোষ্ঠী বিশ্বাসগতভাবে মানতে পারে না। কারণ, পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে

 (سورة فتح)هو الذي أرسل رسوله بالهدى ودين الحق ليظهره على الدين كله وكفى بالله شهيدا

(তিনিই তাঁর রসূলকে হেদায়েত ও সত্য ধর্মসহ প্রেরণ করেছেনযাতে একে অন্য সমস্ত ধর্মের উপর জয়যুক্ত করেন। সত্য প্রতিষ্ঠাতারূপে আল্লাহ যথেষ্ট।)

সুতরাং একজন মুসলমান একান্ত বিশ্বাসগতভাবে যেমন ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দর্শনকে জীবনদর্শন হিসাবে মানতে পারেন না তেমনি অন্যান্য ধর্মের তুলনায় ইসলামকে শ্রেষ্ঠ ও সত্য বিশ্বাস করতে বাধ্য। এর অন্যথা হলে, সে ইহজাগতিকতার ‍যুক্তিতে হোক বা অন্য কোন অজুহাতে হোক তার ঈমান বহাল থাকবে না। কারণ, কুরআনের স্পষ্ট সিদ্ধান্তের বাইরে যাবার কোন সুযোগ মুসলমানের জন্য রাখা হয়নি। সেদিক থেকে রাষ্ট্রনীতি বা জীবনদর্শন হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণের সুযোগ নেই। তবে হ্যা, অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা ও প্রদানে ইসলাম যে নির্দেশনা দিয়েছে তাও মুসলিম সমাজ মানতে বাধ্য। সঙ্গতকারণে, বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ যেখানে ৯১ শতাংশ মুসলিম বাস করে, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে আমরা সেক্যুলার হতে পারি না বা তাকে জীবনদর্শন ও রাষ্ট্রনীতি হিসাবে গ্রহণও করতে পারি না।

১৬.০৩.২৩ 


ভাবনা-৩১

ভোর হল গোল হল! জনগণ ওঠরে!!

না পারতেই লিখছি। ভেবেছিলাম অন্যকিছু লিখবো। কিন্তু পারলাম কৈ? কালকের পৌর-ভোট নিয়ে বসছি আবার। চর্বিত চর্বণ যেনো না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে ক’লাইন লিখছি। গতকাল প্রচারণা শেষ হয়ে গেছে রাত নামার পর। গেলো দশ-বারো দিনের অনর্গল জ্বালাময়ী, শিখাময়ী, সঙ্গীতময়ী, টানাময়ী নানা বাহারের প্রচারণা শেষে আজ পৌর এলাকা শান্ত। মনে হচ্ছে, মাইকওয়ালা যেমন ঘুমোচ্ছে, আমার কান দু’টোও তেমন গা এলিয়ে দিয়েছে। পোস্টারে-পোস্টারে ছেয়ে গেছে সব। শুধু আমাদের গায়ে-গতর ছাড়া কোথাও রক্ষা পায়নি। আইনত মানা হলেও বাইরের নেতারা কালো গ্লাসের দামী গাড়িতে করে এসে কিছু একটা করে চলে যাচ্ছেন। আইনের ফাঁক আর নেতাদের লম্বা-হাত বলে কথা আছে না! বাজারে আসতে-যেতে জানতে চাইলাম: কেমন চলছে? কারও মুখে স্বস্তি নেই। মনে হলো না, ভোটকেন্দ্রে মানুষ খুব একটা যাবে। সবার একটাই কথা, ভোট যাকেই দিন, প্রশাসন নিয়ে যাবে। ইভিএম তো আছেই, সব গিলে খাবে। আপনার টিপ যে কোন দিকে যাবে, সে কি কেউ জানে? কেউ বলছে, অমুক প্রার্থী শিক্ষিত-মার্জিত; হলে কি হবে, মার্কা তো ওটাই। আবার কেউ বলছে, শিক্ষাটিক্কা চেয়ে কি লাভ? শিক্ষিতরাই তো এক মার্কার ভোট নিয়ে অন্য মার্কায় ঢুকে যায়। তার চেয়ে কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিতরাই তো ভালো। কেউ বলছে, ভোট তো রাতেই হয়ে যাবে, সেন্টারে গিয়ে কি লাভ? এমন আরও কতো কথা! গতকাল হাটের দিনে দেখলাম, কম মূল্যে তেল-চাল কিনতে ঠাটা রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে নিম্নবিত্তের মহিলারা। পাশে আছে, পুরুষদের লাইন। আম-দোকান থেকে কেনার সাধ্য যে নেই! এসব ভোটের বুকে ছায়া ফেলছে। আগে প্রতীক ছিলো না, তাই দলের রাজনীতিও ছিলো না। এখন তো দল আছে, দল বা প্রতীকের বালাইও আছে। কিন্তু বিএনপি না থাকাকে বড়ো করে দেখছেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তাঁদের সাফ কথা: বিরোধীদল নেই, মজাও নেই। মানুষের এমন মনোভাব অকস্মাৎ নয়। তবুও সরকার করেই ছাড়বে। আমরা আর কোথায় যাবো? খবর নিয়ে জানলাম, শিক্ষিত প্রার্থীর চেয়ে অশিক্ষিত প্রার্থীর পাল্লা ভারী। কারণ তিক্ততা। শিক্ষিতের কাছে ওরা গেলোবার যে দাগা খেয়েছে, সে কি ভোলা যায়? মেয়র হলো ধানের শীষের মার্কা নিয়ে, মাত্র ক’দিনের মাথায় হয়ে গেলেন নৌকার মাঝি। পুরো পাঁচ বছর মানুষ গাল ভরে গাল দিয়ে গেছে। এখন উনি অসুস্থ। দোয়া করার জন্য বিদেশ থেকে মানুষ আনা ছাড়া উপায় নেই। কেউ খবরও নিতে চায় না। কথায় বলে না, নীতিহীনে মিত্র নাহি। যাদের গাঁটে পয়সা আছে, তারা কিন্তু নোট ছাড়তে পারেন আজকে। শুনছি, তর সইতে না পেরে কেউকেউ ইতোমধ্যে ছেড়েও দিয়েছেন। রাতের অবস্থা কেমন হয় জানি না। শেষরাতে আরও কতো যে নাজিল হয় খোদা মালুম। এক মেয়র প্রার্থী নাকি ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন: এবার না হলে তিনি স্ট্রোক করবেন। সঙ্গতকারণে ডরে আছি। সম্ভাব্য আত্মমার্ডার হলে গায়েবী মামলায় কে কে শ্রীঘরে যাবেন জানে উপরওয়ালা! অতএব, খুব সম্ভবত, বিনিদ্র-রজনী কাটাতে আমরা প্রস্তুত হচ্ছি, অন্তত জাতির মহাপ্রয়োজনে।
১৫.০৩.২৩     


ভাবনা-৩০

হাটে-বাজারে যেতে-যেতে মানুষের চেহারাগুলো দেখা হয়। কারও হাসিমুখ তেমন দেখি না। আগে দেখা-সাক্ষাতে শত পেরেশানির মাঝেও মানুষের মুখে থাকতো কিছুটা হলেও স্বস্তি। ১০ টাকার জিনিস না হয় ১২/১৩ টাকায় কিনতো। কিন্তু এখন? আমাদের গ্রামাঞ্চলে মাস কয়েক আগেও ছিলো ডিমের ডজন ৭৫/৭৬ টাকা। সেই ডিম এখন ডজন ১৪৫/১৫০ টাকা। ডিমের কথা বললাম এ জন্য, ডিম কিন্তু বিপদের পদ। নিদেনপক্ষে ডাল বা টমেটোর ঝোলের সাথে ঐ এক পদেই সারা যেতো অন্তত একবেলা আহার। খবরে দেখলাম, ঢাকায় গরুর কেজি গোশততে পড়েছে ৯০০ টাকা; ব্রয়লার পড়েছে ৩০০ টাকা আর ছাগলের গোশত কেজি প্রতি ১১০০ টাকা। এসব এখন মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে, গরীর তো দূর কি বাত। এখন বাজারে গিয়ে জিনিসের দাম জানতে হয় না, হাট-বাজারের মানুষের চেহারাতেই যেনো লটকানো আছে দ্রব্যমূল্যের চিত্র। আমি ভাবছি অন্যকথা। আচ্ছা, যারা সরকারী দল করে তাদের জন্য কি গোপন কোন হাট আছে? নইলে তাদের মুখে এতো অস্বস্তি দেখি না যে! তারা তো দিব্যি স্বাভাবিক চলছে, হাসছে, বসছে। তাই যদি না হবে, ওরাও তো দামের কষাঘাতে লুটে পড়তো। মন বলে, আছে তেমন এক গোপন বাজার, যেখানে কেজি প্রতি সয়াবিন ৫০/৬০ টাকা, গরুর গোশত কেজিতে ৩০০/৪০০ টাকা, ডিমের জোড়া ১৫ টাকা, ১০০/১৫০ টাকায় মিলে ভাল মাছ, আরও কতো কি! পকেটে আসছে খনির টাকা। তা না হলে, ওরা এমন হাসিমুখে চলছে কেমন করে? কোন অষুধ খেয়ে দুর্মূল্যের বাজারে দণ্ড সোজা করে চলতে পারছে?  আমরা তো পারি না। যদি থাকতো এমন বাজার, অন্তত দেখার সাধ মেটাতে পারতাম। আহ, কি স্বপ্নের বাজার! আজ মুরগীর দোকানী কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলছে, কর্জ করে আর ক’দিন চালাতে পারবো, জানি না। মাছ তো নয়, যেনো এক-একটি সোনার পাত। ‘মৎস্য জাদুঘর’ বলে যদি কিছু থাকতো, সে হতো নিশ্চয় হালের মাছের বাজার। দেখেই পরানে ঘা লাগে। পকেটে হাত দিতে মনে হয় কলজেতে লাগছে। ভাবতে হয়, বাজার থেকে কি বাড়িতে যাবো, না কি হাসপাতালে? গৃহিণী বাজারের ফর্দ ছোট করতে-করতে এমন করেছে যেনো পাঞ্জাবির বদলে ব্লাউজ সেলাই করতে এসেছি। এক কাজ করলে কেমন হয়? ক’টা টাকা খরচ করে যদি লাউড স্পীকার দিয়ে বলি: ভায়েরা আমার! কেউ যদি জানেন সরকারী ভাইদের গোপন বাজারের সন্ধান, আমার মোবাইলে দয়া করে মিসকল দিন। আমিই ফোন করে জেনে নেবো। কেমন হবে? পুলিশ বা র‌্যাব এসে ধরে নিয়ে যাবে? প্রধানমন্ত্রী বড়ো সত্য কথা বলেছিলেন: দুর্ভিক্ষ আসবে। আহ! আসতে আর হবে না, এসেই তো গেলো! বাজারের ফর্দ আর থলেটা দেখলেই ভাবি ৯৯৯-এ ফোন করি। কেউ কি এসে উদ্ধার করবে না? নামাজের পরে কবর জিয়ারত করতে গেলে ঈর্ষা হয়: আহ এঁরা কতোই না সুখী! মরে গিয়ে কমপক্ষে বাজারের গজব থেকে রক্ষা তো পেলো! আল্লাহ পানাহ। জানতে চান, মরতে রাজি আছি কি না? ভাই, বাজারের চাকায় পিষ্ট হয়ে মরার চেয়ে অন্য কোন তরীকায় মরলে ক্ষতি কি? মরতে তো একদিন হবেই।      

১৩.০৩.২৩ 

 


ভাবনা-২৯

 

বিশ্বরাজনীতির জটিল খেলা আরও জটিলতর হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। মার্কিন-ইসরাঈল অক্ষশক্তির আপ্রাণচেষ্টা সত্ত্বেও স্রোতের বিপরীতে আচমকা ঘটনা ঘটলো একটি। ঘটনায় ভূমিকম্প না হলেও রাজনীতিকম্প হয়েছে বেশ শক্তিশালী। ইতোমধ্যে অনেকে জেনে গেছেন, আন্তর্জাতিক প্রচার-মাধ্যমে চীনের মধ্যস্থতায় চিরবৈরী সৌদি আরব ও ইরান পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে আপাত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। বিশ্বমিডিয়ায় খবরটি বেশ সাড়া ও নাড়া ফেলেছে বলা যায়। ট্রাম্পের জামানায় আরব আমিরাত, সুদান ও ওমানের মতো দেশগুলোকে ইসরাঈলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ফাঁদে ফেলায় আমেরিকা কিছুটা এগিয়ে গেলেও বাইডেনের জামানায় সে প্রচেষ্টাকে একেবারে নাকানি-চুবানি খাওয়ানো হয়েছে। ট্রাম্প কিন্তু তার আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে আরব আমিরাতের সাথে ইসরাঈলের চুক্তিও করিয়ে নিয়েছিলেন। কাতার বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোন আরব দেশে ইহুদীরা দলেদলে এসে ফুটবলীয় উল্লাসে মেতে ওঠে। এগুলো সব আমেরিকার চেষ্টায় আরবদের সাথে ইহুদীদের গা লাগানোর কুশিশ। মার্কিন চেষ্টা শতভাগ সফল হয়েছে বলবো না, কিন্তু ময়লায় ফেলতে না পারলেও গায়ে ময়লা লাগাতে পেরেছে বলা যায়। মনে হচ্ছিলো, সে ঝাপটা এমবিএস’র উসিলায় সৌদিয়াকেও কিছুটা কাত করে ফেলবে। প্রসঙ্গত বলা যায়, ২০২০ সালে কুনওয়ার খুলদূনে শহীদ নামে একজন পাকিস্তানী সাংবাদিক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের একটি সাক্ষাৎকারের সূত্রে রিপোর্ট করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলিম দেশও পাকিস্তানকে ইসরাঈলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকে চাপ দিয়েছে। প্রতিবেদকের বর্ণনায়, সে দেশটি সৌদি আরব। ২০১৭ সালে একজন ইসরাঈলী কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে সংবাদ-মাধ্যম জানায়, এমবিএস’র যুবরাজ হিসাবে শপথ নেয়ার দিন নিরাপত্তার জন্য কয়েকটি ইসরাঈলী জঙ্গীবিমান সৌদি আকাশে টহল দেয়। অবশ্য রিপোর্টটি নিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ কোন উচ্চবাচ্য করেনি। বর্তমানে ইহুদী রাষ্ট্রটির বিমান চলাচলের জন্য সৌদি আকাশ উম্মুক্ত করে দেয়া আছে। এখানে আরেকটি কথা: ট্রাম্প থেকে বাইডেনে উত্তরণের প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরবের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক মানবাধিকারপ্রশ্নে অমসৃণ হয়ে যায়। কারণ, ট্রাম্প যেভাবে এমবিএসকে খালি চেক দিচ্ছিলেন, বাইডেন-প্রশাসন সেভাবে দিতে নারাজ। বিশেষত জামাল খাশোগ্জী হত্যাকাণ্ডে এমবিএসের জড়িত থাকা নিয়ে যে খবর প্রচার হয়, সেটাতে সৌদি আরব বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে নাখোশ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ইয়েমেনের যুদ্ধ নিয়েও বাইডেন-প্রশাসনের ভূমিকায় সৌদি আরব খুশি ছিলো না। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মিত্র ইসরাঈলও ইরানপ্রশ্নে সৌদি আরবের সাথে দহরম-মহরম সম্পর্ক গড়তে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। ভূ-রাজনীতি দিয়েও মধ্যপ্রাচ্য বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, লেবানন প্রভৃতি অঞ্চলে ইরানের উপস্থিতি মার্কিন-ইসরাঈলের জন্য সুখকর নয়। এর মধ্যে রাশিয়ার য়ুক্রেন আক্রমণে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি আন্তর্জাতিক মনযোগ বিভক্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়ে।

এমন পরিস্থিতিকে অত্যন্ত চতুরতার সাথে কাজে লাগায় চীন। চীন সৌদি আরবকে বোঝাতে সক্ষম হয়, মার্কিননির্ভরতা থেকে বেরিয়ে ইরানের সাথে সম্পর্ক সহজ করার মধ্যে সৌদি আরবের শক্তির ভারসাম্যতা অক্ষুণ্ন থাকবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রনির্ভর পররাষ্ট্র নীতিতে সৌদি আরব স্বস্তি বোধ করতে পারে না। সৌদি আরব চীনের যুক্তি বুঝতে পারে। তাই চীনের মধ্যস্থতায় ইরানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মধ্যে সৌদি আরব নিজেদের স্বার্থকে বুঝতে দেরি করেনি। সৌদি আরব আশা করছে, এর মধ্য দিয়ে ইয়েমেনেও সে ঝামেলামুক্ত হতে পারবে এবং চীন সেখানেও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকার চেষ্টা করবে। এখানে চীনের স্বার্থ বিলকুল স্পষ্ট। প্রথমত, বহুদিন থেকে চীন বিশ্বপরাশক্তি হিসাবে জানান দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে আছে। দরকারটা কেবল সুযোগের। চীনের সমঝোতায় সৌদি-ইরান সম্পর্ক যদি স্বাভাবিকের দিকে যেতে শুরু করে সে হবে এক বিরাট অর্জন। তখন চীনের বৈশ্বিক ও বাণিজ্যিক দুয়ার বিস্তৃত হবে, সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়ত, চীনের নজর পড়বে ইয়েমেনযুদ্ধ ও য়ুক্রেনযুদ্ধের দিকে। কপাল ভালো থাকলে, দু’টোই পেলে তো পোয়াবারো, নচেৎ একটিতেও চীনের সোনায় সোহাগা হবে। তখন চীনের পরাশক্তি হিসাবে দাঁড়াতে কারও সুপারিশ লাগবে না। সিরিয়ার দিকে চীন তাকাবে কি না, বলা যায় না। কারণ, বিশ্বরাজনীতি নিয়ে তার উচ্চাবিলাষে কোন সন্দেহ নেই। আমার মনে হয়, যে চীন দীর্ঘদিন ধরে নিজের খেয়ে নিজের ভাবনায় মত্ত থাকার নীতিতে অবিচল ছিলো, এখন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ও সুযোগে মধ্যপ্রাচ্যেও ঢুকে যেতে পারে। কারণ, সিরিয়ার অন্যতম খেলোয়ার রাশিয়া ও ইরান চীনের মিত্র। তাই যদি হয়, বুঝতে হবে আগামীর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি যা এখনও মার্কিন ও ইসরাঈলনির্ভর, নতুন রঙে উপস্থিত হতে পারে যেখানে ইসরাঈল তার স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে। প্রভাব কমতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও য়ুরোপীয় দেশগুলোর। চীন অবশ্যই চাইবে, ‍যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেরকে দুর্বল করে মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে। সেখানে সাথে পাবে ইরান, রাশিয়া ও তুরষ্ককে। এতে সৌদি আরবের মতো কিছু আরব দেশ চীনকে সমর্থন করতে পারে। এখানেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশ এবং ইসরাঈলের ভয়। চীনের মধ্যস্থতা নিয়ে কূটনৈতিক স্বাগত জানালেও ভেতরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাঈল যে মোটেও স্বস্তিতে নেই, তা বলাই বাহুল্য।

১২.০৩.২৩           


ভাবনা-২৮

অনলাইন ঘাঁটতে গিয়ে ২০১৩ সালের একটি রিপোর্ট দেখে বেশ কৌতুহল জাগলো। মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি গবেষণাসংস্থা Pew Research Center ঐ বছরের ৩০শে এপ্রিল The World’s Muslims: Religion, Politics and Society নামে একটি জরিপভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর নির্বাচিতসংখ্যক মানুষের মতামতের ভিত্তিতে তারা রিপোর্টটি তৈরি করে। যতোদূর মনে পড়ে, আমাদের দেশের কোন মিডিয়া খবরটি প্রকাশ করেনি। সময় দেখে বোঝা যায়, ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের মর্মান্তিক ঘটনার ২৫ দিন পরে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। একটি মার্কিনভিত্তিক গবেষণা-প্রতিষ্ঠান থেকে এমন খবর প্রকাশে রীতিমতো অবাক হতে হয় বৈ কি। পুরো রিপোর্টটি পড়ে, তাদের প্রদর্শিত অনেক রেখাচিত্র বা গ্রাফ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়নি: রিপোর্টটি তৈরিতে অনেক খড়খুটো পোড়াতে হয়েছে। এ ধরনের অনুসন্ধান চাট্টিখানি কথা নয়। প্রকাশিত রিপোর্টে মহাদেশ, উপমহাদেশ ও দেশভিত্তিক জরিপ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে মুসলিমবিশ্বের কতোখানি মানুষ দেশে ইসলামী শরীয়ার বাস্তবায়ন চায়। আমার মতো অনেকেই জরিপটি দেখে অবাক হতে পারেন। জরিপে সামিল আছে, দক্ষিণ-পূর্বয়ুরোপের ৪টি দেশ (রাশিয়া,কসভো,বসনিয়া ও আলবেনিয়া), মধ্য-এশিয়ার ৫টি দেশ (কিরগিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কিয়ে, কাজাকস্তান ও আজারবাইজান), দক্ষিণ-পূর্বএশিয়ার ৩টি দেশ (মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া), দক্ষিণ এশিয়ার ৩টি দেশ (আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ), মধ্য পূর্ব-উত্তর আফ্রিকার ৭টি দেশ (ইরাক, ফিলিস্তীন, মরক্কো, মিসর, জর্ডান, তিউনিসিয়া ও লেবানন), এবং সাব-সাহারা আফ্রিকার ১৬টি দেশ (নাইজার, জিবোতী, কঙ্গো, নাইজেরিয়া, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, মোজাম্বিক, কেনিয়া, মালি, ঘানা, সেনেগাল, ক্যামেরুন, লাইবেরিয়া, চাদ, গিনিয়া বিসাউ ও তানজানিয়া) নিয়ে মোট ৩৮টি দেশের তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। শতকরা কতো হারে কোন দেশের কতো মানুষ শরীয়া আইনের শাসন পরিচালনার পক্ষে মতামত দিয়েছেন তা রীতিমতো আশ্চর্যজনক। প্রদর্শিত গ্রাফচিত্রে প্রতিটি দেশের পাশে হার দেখানো হয়েছে। দেখানো হয়েছে, আমাদের বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ মানুষ দেশে শরীয়া আইন চায়। এখানে ক’টি কথা বলা দরকার। কেউ মনে করবেন না, একটি মার্কিন গবেষণা-প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ ধরনের জরিপ মুসলিমদের সন্তুষ্ট করতে প্রকাশ করা হয়েছে। এসবে দু’টো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তা হলো, ১. পাশ্চাত্য দেশগুলোর মুসলিমবিরোধী যেসব এজেন্ডা চালু আছে, সেগুলোর পর্যায়ক্রমিক ধাপ উত্তরণে ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ গ্রহণের উপাত্ত সরবরাহ করা এবং দুই. সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিভিন্ন প্রভাব বিস্তার করে মুসলিম সেন্টিমেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করা। প্রধানত, এসব গবেষণাপত্রকে ভিত্তি করে ঘোষিত নতুন বিশ্বব্যবস্থা (New World Order) বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসরাঈল ও পাশ্চাত্যের নিরাপত্তা বিধান করা। ২০১৩ সালের সালের পর থেকে বাংলাদেশে ক্রমবিরাজমান পরিস্থিতি থেকে আমরা জরিপের প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি করতে পারি। বিষয়টির অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। বলাবাহুল্য, আমেরিকাসহ পাশ্চাত্য বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রায়নের যে প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাতে এ ধরনের জরিপের ফলাফল তাদের কাছে বেশ হতাশাব্যঞ্জক, সন্দেহ নেই। কারণ, আফগানিস্তানের আদলে অন্যান্য মুসলিম দেশে যদি কথিত গণতন্ত্রের পরিবর্তে ইসলামী ইমারাহ প্রতিষ্ঠায় জনগণ ঝুঁকে পড়ে, সেটা হবে পাশ্চাত্যের জন্য আত্মঘাতী। তাই তারা প্রচলিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হলেও কোন প্রকার ইসলামদর্শী সরকারকে ক্ষমতায় আসতে দিতে নারাজ। এখানে তাদের মূল অস্ত্রসেক্যুলারিজম। তারা অবশ্যই গণতন্ত্র চায়, এবং সেটা যেনো সেক্যুলার গণতন্ত্র হয়। আলজেরিয়া ও তুরষ্ক তার বড়ো প্রমাণ।  

১১.০৩.২৩     


ভাবনা-২৭

পৃথিবীকে, পৃথিবীর সমাজ-ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে একটি সংস্থাজাতিসঙ্ঘ, যার মূলনাম: United Nations ওদের ইতিহাস ঘাটতে যাচ্ছি না। পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে সংস্থাটি কিছু কর্মসূচী ঠিক করে দেয়। সাম্প্রতিককালের তেমন একটি কর্মসূচী হলো: লৈঙ্গিক বা লিঙ্গ সমতা, যা তারা নিবন্ধিত রাষ্ট্রগুলোতে বাস্তবায়ন করতে চায়। এটাকে তারা বলছে, Gender Equality। তাদের ভাষায়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে Equal rights and opportunities for girls and boys অর্থাৎ, বালক-বালিকা বা পুরুষ-মহিলার সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করা। যেহেতু জাতিসঙ্ঘ বলেছে, তাই নিবন্ধিত রাষ্ট্রগুলোও এ ধরনের স্লোগানকে আত্মস্থ করে ব্ক্তব্য রাখছে। তেমনি আমাদের বাংলাদেশও। বুঝে হোক, না বুঝে হোক সরকারের হর্তাকর্তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে নসিহত করছেন, লিঙ্গ সমতা নাকি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবেই নাকি শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে। জানা থাকা দরকার, আমরা যাকে জাতিসঙ্ঘ (আসলে এটা জাতিসঙ্ঘ না হয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘ হওয়া উচিৎ) বলি, মূলত সেটি জাতি-ব্যবস্থার (UN System) একটি প্রতিষ্ঠান। যেমন আমরা মুসলিমরা ইসলাম-ব্যবস্থার একটি প্রতিষ্ঠান। এটাকে ইংরেজিতে Islam System বলে ডাকা যেতে পারে। জাতি-ব্যবস্থার অধীন জাতিসঙ্ঘ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে যেসব নীতি ও কর্মসূচী তৈরি হয়সেসবই  UN Charter বা জাতিসঙ্ঘ সনদ বলে পরিচিত। এখান থেকে তৈরি হয় জাতিসঙ্ঘ কার্যপরিকল্পনা বা UN Work Plan যা দিয়ে পৃথিবীকে সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। তেমনি একটি কার্যপরিকল্পনা হলো ‘লিঙ্গ বা লৈঙ্গিক সমতা’ অর্জন। প্রশ্ন হতে পারে, এখানে আমাদের সমস্যা আছে কি? থাকলে সেটা কোথায়? আমি বলবো, সমস্যা মৌলিক ও ন্যায্য। আমরা লিঙ্গ-সমতার কথা বলতে পারি না, আর এটা যুক্তিসঙ্গতও নয়। যুক্তিসঙ্গত হলো, লিঙ্গ-অধিকার। যাকে আমরা Gender Right বলবো। এর ভিত্তি হলো, জন্মগতভাবে মানুষ (পুরুষ ও মহিলা) যে স্বতন্ত্র প্রকৃতির অধিকারী, তার সামর্থ্য, প্রয়োজন ও আচরণ। আপনি চাইলেই একজন নারী ও পুরুষ সর্বক্ষেত্রে সমান সামর্থ্য, আচরণ ও প্রয়োজন প্রদর্শন করতে পারেন না। এটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ, হতে পারে না। কারণ, যদি আস্তিক হোন তবে আপনাকে মানতে হবে আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তা যে ভিন্নতা দিয়ে নারী-পুরুষের দেহাবয়ব, প্রকৃতি ও আচরণ সৃষ্টি করেছেন সেটা বদলানো যায় না। এটা সম্ভবও নয়। তাই আমাদের বক্তব্য হলো, লিঙ্গ-সমতা নয়. লিঙ্গ-অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ইসলাম এটাই বলে।  যেমন বিবাহক্ষেত্রে ‘মাহর’ (মোহর) নারীর অধিকার ও প্রাপ্য, পুরুষের নয়। এখন কি আপনি বলবেন, পুরুষেরও মাহর চাই যা নারীকে পরিশোধ করতে হবে? কই, জাতিসঙ্ঘ-সনদে তো মহিলাদের মাহর আদায়ের কথা বলা হয় না। কেন? ওরা বলছে, সম্পদে সমান সুযোগ দিতে হবে। ঠিক আছে, আমাদের মুসলিম আইনে একজন বিবাহিত নারী বাবার কাছ থেকে যেমন সম্পদ পায়, তেমনি স্বামীর কাছ থেকেও পায়। কই, পুরুষ কি নারীর পৈতৃক সম্পত্তির কোন অংশ পায়? জাতিসঙ্ঘ সনদ কেন বলে না, পরুষও নারীর সম্পত্তি থেকে অংশ পাবে? লিঙ্গ-সমতাই যদি চাওয়া হয় সে-কথা বলে না কেন? আসলে সমস্যা, সর্বক্ষেত্রে অসমতা নয়, ন্যায্য অধিকারহীনতা বা অধিকার বঞ্চনা। জাতিসঙ্ঘ সনদের কথা মানতে গেলে আঘাত আসবে আমাদের চিরাচরিত পারিবারিক ব্যবস্থা ও বন্ধনের ওপর। এ সনদ বাস্তবায়ন করতে গেলে শুরু হবে সীমাহীন অরাজকতা, নিশ্চিতভাবে বিপদে পড়বে কন্যাসন্তানেরা। সম্পত্তির কারণে এরা পুরুষ অংশীদারের নিরবিচ্ছিন্ন সহিংসতার শিকারে পরিণত হবে। তখন কি সরকার সামাল দিতে পারবে? এমনিতেই তো সরকার অনেক কিছুই সামাল দিতে পারছে না। মনে রাখতে হবে, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজ আলিম-উলামা প্রভাবিত। বাইরে থেকে আসা কোন সনদ বাস্তবায়নের আগে অন্যান্যদের সাথে বিজ্ঞ ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের সাথে মতবিনিময় করলে জাতি অনাকাঙ্খিত অনেক কিছু থেকে রক্ষা পাবে। আমরা সকল প্রকার বৈষম্যের বিরোধিতা করি এবং সর্বক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকারকে সমর্থন করি। কুরআন-সুন্নাহর বাইরে গিয়ে এসবের বাস্তবায়ন সীমাহীন অরাজকতা সৃষ্টি করবে।

০৯.০৩.২৩

 

ভাবনা-২৬

ইলেকশন এলেই ‘যোগ্য’ বা ‘কোয়ালিফাইড’ প্রার্থী নির্বাচনের একটা বাজারি কথার প্রচলন ঘটে যত্রতত্র। অমুক মিয়ার চরিত্র ফুলের মত পবিত্র; যোগ্য প্রার্থী অমুক ভাই, মা-বোনদের বলে যাই ইত্যাদি শুনতে-শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। কোথাও যে গিয়ে দু’দণ্ড কানকে বিশ্রাম দেবোসে সাধ্য কি আর আছে? মাইক নিয়ে বেটারা যেনো আমাকেই খুঁজছে। ঘরে-বাজারে কোথাও ঠাঁই নেই। মাঝেমাঝে মনে হয় খোদাওন্দ যেনো আমাদের মতো অযোগ্যদেরকে এসব যোগ্যপ্রার্থীর প্রহার থেকে রক্ষা করেন। পাড়ার মানুষ বলছে, এখন দেখি সকাল আটটা বাজতেই প্রার্থী দুয়ারে হাজির আর ভোটের আগে বিকাল দেড়টার সময়ও চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দেখা পাইনি। যাক, তবুও যোগ্যপ্রার্থী নিয়ে দু’কথা বলতে হচ্ছে। সরকার বাহাদুর থেকে শুরু করে নিচতলার সবাই বলছেন, যোগ্যপ্রার্থীকে ভোট দিতে। কিন্তু কে যোগ্য? যোগ্যতার মাপকাঠিই বা কি? যোগ্য কি কোন বিশেষ জায়গায় বসবাস করে? গেলোবারে ক’জন প্রার্থীকে দেখে মনে হয়েছিলো, এরা কি আগে চিড়িয়াখানায় ছিলো? সবাই সরকারীদলের। একজন দীর্ঘদিনের গরুবেপারী; টাকার অভাব নেই। সে ভেবেছে, টাকা ছিটালেই কিল্লা ফতেহ! কথাটা যে একদম বেঠিক, তা বলছি না। যেখানে এক কাপ চায়ে ভোট কেনা যায়, সেখানে টাকার কারিশমা তো অস্বীকারের জো নেই। তবে সব সময় টাকায় সবকিছু হয় না। সেই গরুবেপারী এবারও যোগ্য(!) প্রার্থী। গত পরাজয়ের পর এবার শুনছি, ৩ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে নেমেছেন তিনি। স্বপ্ন, উনি মেয়র হবেন। লেখাপড়া যতোটুকু জানি, আন্ডার লেবেল। কথাবার্তায় মনে হয়, আগের দশ বারের নির্বাচিত মেয়র। বড়ো কথা হলো, যোগ্যপ্রার্থী কিন্তু উপজেলা শাসকদলের বর্ষিয়ান সদস্য। ফলে, তাকে যে আসল কীর্তিতে কিছু বলবো, সে সাধ্য কার? কারণ, সরকারীদল। অবশ্য দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। তিনি স্বতন্ত্র। যিনি শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিততিনি মনোনয়ন পেয়েছেন সত্য, কিন্তু এতো টাকা নেই যে বিলাতে পারবেন। তাঁকে বলেছি, দয়া করে প্রতীক নিয়ে আসবেন না, এলাকার একজন মানুষ হিসাবে আসুন। আর ভার সইতে পারছি না। এখন দেখি সেই গরুবেপারীর সাথেও বেশ মানুষ; ছাত্র লীগের ছেলেরাও আছে। ঘটনা কি! টাকা..আর টাকা। মানুষকে আমি দোষ দেই না, কারণ, এই দুর্মূল্যের বাজারে প্রার্থী শিক্ষিত আর ভদ্র হলে কি মানুষের পেট ভরবে? তার চেয়ে অশিক্ষিত গরুবেপারী শ-দু’শ টাকা গুঁজে দেয়, ও দিয়ে আলু-ডাল তো জোটে। এই হলো খেটে খাওয়া মানুষের অখণ্ডণীয় যুক্তি। একবারে নিরস কি? এখানে অবশ্য শিক্ষিত ও মার্জিত প্রার্থী নিয়ে বিরক্তিও আছে। গেলোবার যিনি মেয়র হয়েছিলেন তাঁর প্রতীক ছিলো, ধানের শীষ। নির্বাচন জিতে দু’এক দিনের মধ্যে ঢুকে গেলেন সরকারী দলে। সেই থেকে মানুষ তাঁর গায়ে তকমা দিলোবিশ্বাসঘাতক, মির্যাফর আরও কতো কি। এখন বলে, শিক্ষিত দিয়ে কি লাভ হলো, অশিক্ষিতই ভালো। ক্ষতিটা কিন্তু কেবল ধানের শীষের হয়নি, নৌকারও হয়েছে। এই হলো আমাদের সমাজের পচনের একদিক। সুতরাং, যোগ্য বলে যখন নির্দিষ্ট কোন রূপরেখা বাকি নেই, সেখানে অযোগ্যরাই যোগ্য। সরকার ও প্রশাসন ওদের সমীহ করে। কারণ, টাকা আর চ্যানেল। রাজনৈতিক দলগুলো যদি শিক্ষিত, সৎ ও মার্জিত প্রার্থী দিতে আপোষহীন হতো তবে আমাদের অনেক উপকার হতো। এখন তো মাস্তানীও এক যোগ্যতা। আল্লাহর রসূল সা. বলে গেছেন: যখন দেখবে অযোগ্যরা পদে আসীন, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করো। এখন হয়েছে এমন হাল। কোথাও রক্ষা নেই, আইন-আদালত থেকে গ্রাম্য পরিষদ পর্যন্ত সব রোগে রোগাক্রান্ত। চোর-বাটপারদের সালাম করতে হয়। নচেৎ, উচিৎশিক্ষা অনিবার্য।

০৮.০৩.২৩

ভাবনা-২৫

২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসার সাথেসাথে দেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে অদৃশ্য টানাটানি চলছে। নৈর্বাচনিক ফলাফলে ইসলামী দলগুলোর আসনসংখ্যা উল্লেখ করার মতো না হলেও ভোট-ব্যাংক হিসাবে বা নির্বাচনে প্রভাব সৃষ্টিতে দেশের ইসলামী দলগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ২০১৩ সালের চার সিটি নির্বাচন রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোটপ্রার্থীদের একচ্ছত্র জয়ের পেছনে কওমীদের ভূমিকা প্রচার-মাধ্যমে উঠে আসে। সে-সময় দৈনিক আমাদের সময় প্রধান খবরের শিরোনাম করে, “জোট-মহাজোট নয়, খেলেছে হেফাজত”।  ফলে, তাঁদের দুয়ারে ধর্ণা দেয়ার কাতারে শাসক-বিরোধী সবাই সামিল। দলগুলো মূলত কওমীভিত্তিক। তাই, কওমীরা বিষয়টি নিয়ে কি ভাবছে, তা অবশ্যই জিজ্ঞাস্য। অতীতে যেভাবে নিজেদের পথ ঠিক করা হয়েছিলো, সেভাবে এখন সম্ভব কি সম্ভব নয়তা অবশ্যই ভাবার বিষয়। চরিত্রগতভাবে কওমীরা প্রচলিত ডানপন্থীদের নিকটবর্তী বলে পরিচিত। এর কারণ, ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিত আওয়ামী ঘরানা ও বামপন্থীদের সম্মিলনকে কওমীরা কখনও ভালো চোখে দেখেনি, এখনও দেখে না। কারণ, তাঁদের কাছে বামপন্থা মানে নাস্তিকতাচর্চা ও ইসলামবিদ্বেষ। এমন ধারণার শক্তিশালী কারণও আছে। সেদিক বিবেচনায় তাঁদের সাথে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের ভিটাবাড়ি অধিকতর কাছের। আবার আদর্শিকভাবে কওমীরা জামাতপন্থী রাজনীতির ঘোর বিরোধী। পদ্ধতিগত কারণে চরমোনাই আন্দোলনের সাথেও কওমীদের দূরত্ব চোখে পড়ার মতো। এসব বিবেচনায় নিয়ে কওমীদের ভাবতে হবে, আগামী কৌশল কী হওয়া যুক্তিযুক্ত? এখানে কৌশলটা নির্ধারিত হওয়া দরকার আবেগ বা জোশের বশে নয়। দু’কারণে এটা নির্ধারিত হতে পারে। এক: কওমী স্বার্থ, দুই: রাষ্ট্রীয় স্বার্থ। কওমী স্বার্থ কি হবে, সেটা সবাই বসে ঠিক করতে পারেন বা অতীত অভিজ্ঞতা ও বর্তমান বাস্তবতার ভিত্তিতে নির্ণয় করা যেতে পারে। আমার মনে হয়, শাপলার ঘটনা-পরবর্তী প্রবাহ থেকে শুরু করে মুদিবিরোধী আন্দোলনের ফলাফলকে সামনে রেখে ইসলামী দলগুলোর কৌশল নির্ধারণ করা দরকার। কোথায় কি ভুল হয়েছে বা করার দরকার ছিলো, করা হয়নি বা বোঝা দরকার ছিলো, বোঝা হয়নি ইত্যাদি বিচার-বিশ্লেষণ করে কৌশল ঠিক করা দরকার। বুঝতে হবে, কওমীভিত্তিক ইসলামী দল কারও ইজারাপ্রাপ্ত সম্পদ নয়। তাঁদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে যদি তাঁদের নীতিগত অবস্থান সঠিক থাকে। সেদিক থেকে তাঁদের স্বার্থ যে কি, কেমন হবে তার চৌহদ্দীএসব সম্মিলিতভাবে চিহ্নিত করা অপরিহার্য। মনে হয়, বাস্তবতার ভিত্তিতে কোন দল বা জোটের আবেগাসৃত অনুসরণ না করে স্বার্থ ও কৌশলভিত্তিক পন্থাগ্রহণ সুফল বয়ে আনবে। ক্ষমতায় কে আসবে, সে সম্ভাবনায় গা না ভাসিয়ে যেই আসুক তার কাছ থেকে স্বার্থ আদায়ের কৌশল গ্রহণ করার পথ উম্মুক্ত রাখা অধিকতর ফলদায়ক হতে পারে। অন্ধ দুই চোখ চায়। কওমীভিত্তিক ইসলামী দলগুলো চাইবে তাঁদের স্বার্থ, নিছক ক্ষমতাভোগ নয়। অতীতে দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে যেসব পথ অনুসরণ করা গেছে, সেগুলো কতোটুকু শুদ্ধ ও দূরদর্শী ছিলোতা এখনই পর্যালোচনা করা জরুরী। যদিও কওমীভিত্তিক ইসলামী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ কোন জোট নেই, তা সত্ত্বেও দৃষ্টিভঙ্গীগত ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা গেলে জাতির লাভ হবে। সেখান থেকে অন্তত স্বার্থ বিষয়ে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যাবে। বলা যায়, তাঁরা ভিন্নভিন্ন দল হওয়া সত্ত্বেও একটি সম্মিলিত ইশতিহার উপস্থাপন করতে পারেন যা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীগত ঐক্যকে প্রচার করবে। এটাও কম কিসের? শাপলার মহাসমাবেশের প্রাক্কালে হেফাজত ১৩ দফা দাবি দিয়ে একটিও আদায় করতে সক্ষম হয়নি। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। খুঁজতে হবে কওমীভিত্তিক ইসলামী দলগুলো আদৌ ইসলামের মূলধারার রাজনীতি করছেন কি নাসে প্রশ্নের উত্তর। মনে রাখতে হবে, দাবিতেই ফল নয়। এখন তো সুদী ব্যাংকও সাইনবোর্ড  ঝুলিয়ে ইসলামী দাবি করে। তাই বলে কি ওরা সুদমুক্ত? সবচেয়ে বড়ো দুর্ভাগ্য হলো, ইসলামী দলগুলোর সম্মিলিত কোন পরিষদ নেই যেখান থেকে অন্তত অধিকাংশ মতের ভিত্তিতে ফিকহী সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসবে। যার ফলে দেখা যায়, দলীয় ফোরাম থেকেই সিদ্ধান্ত আসে, যা মতান্তরে দুর্বল হয়। খোদ কওমী মাদরাসাগুলোর মধ্যে এমন ব্যবস্থা চালু নেই। স্বীকৃতির সময় এ দুর্বলতা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। কওমীভিত্তিক ইসলামী দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা কওমী স্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সমন্বয় করে কোন পথ অবলম্বন করবেন। সেটা যেন অবশ্যই বিশেষ কোন দল বা জোটের অনুগ্রহপ্রার্থী না হয়ে স্বকীয় হয়।

০৭.০৩.২৩




ভাবনা-২৪

ভোট আসছে। এখনও কেউ জানে না ভোটের চেহারা-চরিত্র কেমন হবে। নির্বাচন দশটা হবে নাকি একটা হবে তাও জানা নেই। খবরে দেখলাম, ইসলামী দলগুলো নির্বাচন নিয়ে তাদের কৌশল ঠিক করছে। আমি রাজনীতির মানুষ নই। তবে রাজনীতির খবরাখবর রাখি। বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতিক দলগুলোতে বিভক্তি আছে। ক্যাডারভিত্তিক দল জামাতে ইসলামী, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এবং কওমীভিত্তিক দল। আমার আজকের আলোচনা কওমীভিত্তিক দলগুলোকে নিয়ে। কওমীভিত্তিক ইসলামী দল মূলত কওমী মাদরাসাকেন্দ্রিক। এর নেতা-কর্মীরা নিরঙ্কুশভাবে কওমী মাদরাসার সাথে জড়িত। দেশের অন্যান্য রাজনীতিক দলের যেমন নীতি-দর্শন আছে, কওমীভিত্তিক দলগুলোরও আছে। এদের দর্শন মূলত ইসলামভিত্তিক বলে পরিচিত। অন্যান্য দল যেমন ঘোষিতভাবে ক্ষমতামুখী রাজনীতি করে, এ ঘরানার দলগুলো তেমনটা বলে না। কিন্তু তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেন এবং তাদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেন। এক সময় বামপন্থী বাদে আমাদের রাজনীতিক দলগুলো ছিলো তৃণমূলীয়, এখনকার মতো রাজধানীকেন্দ্রিক নয়। রাজধানীতে সদরকাজ ছিলো কিন্তু পদচারণা ছিলো গ্রামীণ জনপদভিত্তিক। এর বড় উদাহরণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ থেকে পথচলা শুরুর পর মজলুম জননেতা মরহুম আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ গ্রামেগঞ্জে চষে বেড়িয়েছেন দলের ভিত শক্ত করতে। তাঁরা মনে করতেন, প্রান্তিক অঞ্চলের ভিত ছাড়া রাজনীতি অসম্ভব। স্বাধীনতার পর ক্ষমতায়ন হলে আওয়ামী লীগ তৃণমূলায়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেখা দেয় রাজনৈতিক সংঘাত ও অরাজকতা। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেই তৃণমূলীয় ধারাকে ফিরিয়ে আনতে। তিনি প্রায়ই বলতেন, I shall make politics difficult. অর্থাৎ, রাজধানীকেন্দ্রিক আয়েশী রাজনৈতিক ধারাকে গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে এলিটধর্মী রাজনৈতিক নেতাদের জন্য রাজনীতিকে কঠিন করে তুলবেন। এতে তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো, রাজনীতি হবে উন্নয়নভিত্তিক এবং তৃণমূলীয়। পুরো দেশটাকেই তিনি রাজনীতির মাঠ বানাতে চেয়েছিলেন যেন সবাই সমান অংশীদার হন। তাঁর শাহাদাতে সেটা আর হয়নি। বিএনপিও রাজধানীভিত্তিক এলিট-রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়। দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, আমাদের কওমীভিত্তিক ইসলামী দলগুলোও এলিট-রাজনীতির খপ্পরে পড়ে যায়। এরা মূলত রাজধানীভিত্তিক। গ্রামীণ জনপদে এদের পদচারণা শূণ্যের কাছাকাছি। অথচ এটা কওমী-দর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কওমী-দর্শন ভিত্তিগতভাবেই তৃণমূলীয়। তাঁদের মূলশক্তি গ্রামীণ জনপদে। দেওবন্দ মাদরাসার মৌলনীতি বা উসূলে হাশতগানা দেখলেই তা বোঝা যাবে। তা’ছাড়া, ‘সাওয়ানেহে কাসেমী’তে (হযরত কাসেম নানতুভী রহ.-র জীবনীগ্রন্থ: মাওলানা মানাযির হাসান গিলানী রহ.) বিষয়গুলো স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে। তাহলে কেন তাঁরা আজ রাজধানীনির্ভর? ক্যাডারভিত্তিক দল জামাতে ইসলামী বিশ্বাস করে: আগে ক্ষমতা পরে ইসলাম। তাই তারা ক্যাডারভিত্তিক ও ক্ষমতামুখী। কিন্তু কওমীরা এর বিপরীত। তাঁরা মনে করে তৃণমূলীয় সমাজ-সংস্কার আগে, ক্ষমতা পরে। ক্ষমতা মূল আরাধ্য নয়, ইসলামের দা’ওয়াত ও সংস্কার মূল আরাধ্য। আর প্রচলিত রাজনীতিতে ইসলামের আদর্শ অক্ষত রেখে কতোটুকু অংশগ্রহণ সম্ভব তা গবেষণার বিষয়। সন্দেহ নেই, সর্বব্যাপী সংস্কারের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। মনে পড়ে আমীরে শরীয়ত হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ.-র তাওবার রাজনীতির কথা। মূলত সেটাই ছিলো ইসলামের মূলধারার রাজনীতি বা আন্দোলন। হযরতের ইন্তিকালের পরে সে ধারা আর অব্যাহত থাকেনি। এর বিষময় ফল এখনও আমাদেরকে ভোগ করতে হচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কওমীভিত্তিক ইসলামী রাজনীতিক দলগুলোকে প্রথমেই ঠিক করতে হবে, তারা কোন পথে যাবেন। তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, অন্য কোন দলের সাথে জোট করতে পারেন কিন্তু মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে নয়। মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যদি রাজনীতিক দল টিকিয়ে রাখতে হয়, মনে হয় সেটা অন্য কিছু হবে, ইসলামী রাজনীতি হবে না। মা বেঁচে থাকতে ‘মা’ ডাকলে অর্থবহ হয়, মা মরে গেলে সে ডাক কে শুনবে? আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে মনে হয়, ইসলামী দলগুলোর তৃণমূলীয়করণ করা দরকার যা অনুপস্থিত। মনে রাখা দরকার, কওমী মাদরাসা আর কওমীভিত্তিক রাজনীতিক দল এককথা নয়। তাঁরা রাজনীতি করুন কিন্তু রাজনীতিজীবি না হোন। এটাই কাম্য।  
০৪.০৩.২৩


ভাবনা-২৩

 খবরে দেখলাম, প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব হাবিবুল আউয়াল বললেন: নির্বাচন নিয়ে কমিশন সংকটে আছেন। কারণ, তাঁর মতে আস্থার জায়গাটা সন্তোষজনক নয়। তিনি তাঁর ব্ক্তব্যে জাতীয় পার্টির প্রধান জি এম কাদেরের প্রকাশিত এক মন্তব্যের সূত্র ধরে বলেন, নির্বাচনে মানুষের আস্থার জায়গাটা শূণ্যের কোটায় নেমে এসেছেকথাটি ঠিক নয়, তবে আংশিক সত্য। জনাব জি এম কাদেরের কথাটি সত্য কি মিথ্যা, পরিমাপ করে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু তৃণমূলে অর্থাৎ, গ্রামগঞ্জে মানুষের ভাবনা তালাশ করে যা পাওয়া যায়, কোন অবস্থাতেই সেটা স্বস্তির বলা যায় না। প্রতিদিন আমি খেটে খাওয়া মানুষদের সাথে দু’একজন করে কথা বলছি। তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারছি তাঁদের মনের কথা। তাঁদের কথা হলো, প্রথমত: বিএনপি নেই, দ্বিতীয়ত: ভোটকেন্দ্রে যাওয়া না যাওয়া সমান। কারণ, তাঁদের দেয়া ভোট গন্তব্যে পৌঁছুবে না। তৃতীয়ত: ইভিএম বা মেশিনের কারসাজি হবে, সে বিষয়ে তাঁরা শঙ্কিত। চতুর্থত: সরকারীভাবে যাকে সিগন্যাল দেয়া হয়েছে, তিনিই হবেন; ভোট যাকেই দেয়া হোক না কেন। এ কথাগুলো এখন ঘুরে ফিরছে মুখেমুখে। আজকে এক সরকারী দলের কর্মী এলাকা থেকে ফিরে এসে আমাকে হতাশার কথাই জানালো। তার কথায়: মানুষ ভোটকেন্দ্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় যাবে কি না সন্দেহ। তাঁর হিসাবে চল্লিশ শতাংশের মতো যেতে পারে; কমও হতে পারে। কিন্তু দলনিরপেক্ষ সাধারণের কথা শুনলে মনে হয় পরিসংখ্যান আরও নিচে চলে যাবে। বিশেষত ২০১৪ ও ২০১৮-র নির্বাচনের কথা মানুষ ভুলতে পারছে না। আমাদের চট্টগ্রামে একটি প্রবাদ আছে: চুন খেয়ে যে গাল খসিয়েছে, সে দই দেখলেও ডরায়। এখন মানুষের অবস্থাও হয়েছে সে রকম। আমার মনে হয়, ভোটকেন্দ্রের প্রতি ভোটারদের আস্থা ফেরানো, নির্বাচন-ব্যবস্থাকে মানুষের বিশ্বাসে আনতে পারাটাও বড় চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনের জন্য।  তা’ছাড়া, মানুষ কোন দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিশ্বাসই করতে নারাজ। এখানে যদি মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তন না হয়, নির্বাচন কমিশন যাই বলুক, ঘোড়া ডিমই পেড়ে যাবে। এমনিতে তৃণমূলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা নজরে পড়ছে। দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎবিল বৃদ্ধিসবকিছুতে বেসামাল দেশ। সরকারীদলের নেতাকর্মীরাও প্রকাশ্যে সাধারণের ক্ষোভের কারণে কিছু বলতে পারছে না। এখন যদি গণভোট নেয়া হয়, মনে হয়, নব্বই ভাগ ভোট পড়বে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের পক্ষে। সরকার বিষয়টি যে বুঝতে পারছে না, তা নয়। মনে হয় যতো দেরি হবে, জটলা ও ঝুঁকি ততোই বাড়বে। ধাক্কা দেয়ার আগেই যদি দু’চাকার মাঝখানে শুয়ে পড়া যায়, তাতে জান আর মান দু’টোই কি রক্ষা পাবে না? 

০৩.০৩.২৩


ভাবনা-২২

ফটিকছড়ি উপজেলার নাজিরহাট পৌরসভা মূলত একটি মফস্বল এলাকা। স্বাক্ষরতা সরকারী হিসাবে ৬১.৫ শতাংশ। ৫.২৬ বর্গমাইল আয়তনের নাজিরহাট পৌর এলাকায় ৫০,০০০ মানুষের বসবাস বলে সরকারী খাতায় দেখানো হয়েছে। এখানে চলছে পৌর নির্বাচনের প্রচারণা। শুনতে পাচ্ছি, এখানে ইভিএম-এ ভোট হবে। জানি না, ইভিএম পদ্ধতি কতোটা পরিশুদ্ধ। পাশের ফটিকছড়ির পৌরসভা নির্বাচনে ইভিএম-র ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ঢের। শুনেছি, সেখানে অনেক বিতর্ক উঠেছে। যাদেরকে দেয়া হয়েছে তারা ভোট পাননি। সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা ভোট হয়তো দেবেন কিন্তু জানেন না মেশিনে কেমন করে ভোট দিতে হয়। বিশেষ করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যাদের সংখ্যা বেশি, জানেন না ইভিএম কি বা কেমন তার ব্যবহার। এখানেই সমস্যা; প্রতারিত হবার ঝুঁকি বেশ। নির্বাচন কমিশনের কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি। ধরে নিলাম ইভিএম পদ্ধতি সঠিক। কিন্তু গ্রামের মানুষেরা যে প্রশিক্ষিত হয়নি বা পারদর্শী হয়নিসেকথা বুঝেছে কেউ? অজ্ঞকে তো ধোঁকা দেয়া সহজ। আর আমাদের মতো দেশে যেখানে রাতেও ভোট হয়, আগে থেকে বাক্স ব্যালটভর্তি করে রাখার নজির আছে, সেখানে ইভিএমের কারসাজি (যদি হয়ে থাকে) রুখবে কে? বলাবাহুল্য, এখন তো স্থানীয় নির্বাচনও হচ্ছে দলীয় প্রতীকে। সে হিসাবে দলীয় তোড়জোড় তো আছেই। তবে বিএনপি না থাকায় সবাই সরকারী দলের, তাই কথা আছে, জৌলুশ নেই। আগে যখন দলহীন নির্বাচন হতো, মানুষে-মানুষে কৌতুহল, আলোচনা, উৎসাহসব হতো। বলা চলে, এখন খালি মাঠে গোল করার মেলা। প্রার্থীরা সবাই এলাকার। নানা মতে বিভক্ত মানুষ কেউ যাবে ভোট দিতে, কেউ হয়তো যাবে না। কারণ, আগের অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে ’১৪ আর ’১৮-র নির্বাচনের কথা মানুষ ভোলেনি। চোখ বন্ধ করে বলা যায়, মানুষ আজ পর্যন্ত দ্বিধায়। ভাবতে পারেন, ন্যূনতম হলেও কিছু মানুষের ভোটে কেউ জনপ্রতিনিধি হবেন; কাজ চালাবেন আগামী পাঁচ বছর। নতুন প্রার্থী-পুরনো প্রার্থী: সবাই মানুষের দ্বারে; অন্তত তাদেরকে যেন একবার সুযোগ দেয়া হয়। আমাদের কথা: বিরোধীরা যখন নেই, প্রতীক নিয়ে আমাদের কাছে আসবেন না; এমনি আসুন, আমরা বিবেচনা করবো। উন্নয়নের কথা বলে, সাহায্যের কথা বলে তারা দোয়া চায়, ভোট চায়। মানুষ যখন জানবে-বুঝবে: তাদের ভোট বিপথে যাবে না, সকালে গিয়ে শুনবে না: ভোট হয়ে গেছে, তখন-ই কেবল নির্বাচন স্বার্থক হবে-সফল হবে। 

০২.০৩.২৩      

 

ভাবনা-২১

ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিন অর্থাৎ, ২৮ তারিখ, পত্রিকার পাতায় খবর বেরুলো সাবেক নির্বাচন কমিশনার মরহুম মাহবুব তালুকদার তাঁর ‘নির্বাচননামা: নির্বাচন কমিশনে আমার দিনগুলো’ বইয়ে লিখেছেন: বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির স্থপতি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিসাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। আমি তাকে অরাজনৈতিক ব্যক্তি বললেও মূলত তিনি পর্দার অন্তরাল থেকে দলীয় রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে দাবার চাল দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির আসনে থেকে তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যে ঘটনাটি ঘটান, তার নাম সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়। এই রায়ের ফলে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়। তিনি আরও লিখেছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বিচার বিভাগ। গণতান্ত্রিক দেশে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে অনেক যৌক্তিকতা প্রদর্শন করা যেতে পারে। কিন্তু এই ব্যবস্থার স্থলাভিষিক্ত করার জন্য যে নতুন আইনি কাঠামোর প্রয়োজন ছিল, বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ে তা অনুপস্থিত। তিনি অবশ্য বলেছেন যে, এ রায়ের পর আরও দুই টার্ম জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। কিন্তু এর কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। ফলে নতুন ব্যবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রেসক্রিপশন দিয়ে পক্ষান্তরে তিনি রাজনৈতিক বিপর্যয় টেনে আনেন। বিষয়টিতে একটি সাংবিধানিক কমিটির সদস্য হিসাবে জনাব মাহবুব তালুকদার যেভাবে মন্তব্য করেছেন, সেভাবে অন্য কেউ বলেছেন কিনা জানি না। তাঁর লেখাতে বিচারবিভাগ ও একজন প্রধান বিচারপতির নৈতিক অবক্ষয়জনিত অবস্থানের যেমন চিত্র ধরা পড়েছে, তেমনি ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণও উদ্ধৃত হয়েছে। কিয়ামাতের কঠিন দিনে সাত শ্রেণীর মানুষকে আল্লাহর আরশের নিচে ছায়াদানের কথা পবিত্র হাদীস শরীফে বলা হয়েছে। এঁদের মধ্যে প্রথমজন হলেন, হাদীসের ভাষায়, ‘আল ইমামুল আদিল’ অর্থাৎ, ন্যায়পরায়ন বাদশা, নেতা, বিচারক প্রমুখ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন ইমামুল আদিলকে এক নম্বরে উল্লেখ করা হলো? ভাষ্যকারেরা বলছেন: একজন ন্যায়পরায়ন বাদশা বা বিচারক কেবল ব্যক্তিত্ব বলেই নয়, সমাজের নীতি-নৈতিকতা, স্বস্তি-শান্তি রক্ষার প্রধান নির্বাহী। তাঁদের কথা এবং কাজ সমাজকে যেমন রক্ষা করবে, তেমনি ধ্বংসও করবে। ছায়া লাভকারী বাকি ছয় শ্রেণীর মানুষ আপন-আপন গুণাবলীতে ভাস্বর থেকে যোগ্য বিবেচিত হবেন বটে কিন্তু ইমামুল আদিলের মতো সমাজে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না। এর কারণ, ক্ষমতা ও প্রভাব। মরহুম মাহবুব তালুকদারের কথায় হাদীসের কথাটি মনে পড়ে গেলো। নিঃসন্দেহে সাবেক বিচারপতি খায়রুল হক সে দৃষ্টিকোণে আল্লাহর কাছে তো বটেই, জাতি ও সমাজের কাছেও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে পুরো জাতি ও দেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, রায় ঘোষণা করে রাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ অনুদান হিসাবে গ্রহণ করে বিশ্বের কাছে আমাদেরকে শরমিন্দাও করে রেখেছেন।

০১.০৩.২৩ 

ভাবনা-২০

আমাদের দেশের রাজনীতিতে কিছু নীতি-স্লোগান প্রচলিত আছে। ওসবের মধ্যে একটি হলো: দলের চেয়ে দেশ বড়। শুনতে ভালোই লাগে; লাগারই কথা। অনীতিতে যতোই আমরা সিদ্ধহস্ত হই, নীতিকথাতে সাঁই না দেবার দহলিজে এখনও পা রাখিনি। একে বলতে পারি, শেষরক্ষার অবশিষ্ট। রাজনীতি নিয়ে আমাদের কটাক্ষ কম নয়। তবুও এতীমের মতো গুটিকয়েক সৎ ও নিষ্ঠাবান রাজনীতিক আমরা কালভদ্রে দেখি। ওনারা গুটিকয়েক বলে দলবাজদের কোলাহলে নিতান্ত সংখ্যালঘু। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলবাজদের ধাক্কায় গুটিকয়েক রাজনীতিক সাধারণের কাছে বরাবরই অপরিচিত থেকেছেন। বদনামের তকমা তাঁদের গায়েও আছড়ে পড়েছে অবলীলায়।  সমাজ বাছ-বিচার করে না; কাউকে রেহাই দেয় না। যখন কোন এক অজানা রিকশাওয়ালা বা দিনমজুর খুঁজে পাওয়া লোভনীয় টাকা মালিককে ফেরৎ দেন, আমরা তাঁকে বলি: বিরল সততায় ধন্য। প্রচার-মাধ্যমে ভরে যায় তাঁর মহত্বের ছবি-সংবাদ।  কিন্তু আমরা কখনও দেখি না, আমাদের পঁচা রাজনীতির মাঝে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা সেই গুটিকয়েক মানুষের কথা, যাঁরা নিজের খেয়ে পড়ে, বাপের জমি বেচে সংসার চালান আর মানুষের জন্য রাজনীতি করেন। অনেকেই হয় তো জানেন না, প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদের আমলে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন মরহুম মুফতী ওয়াক্কাস।  খবরের কাগজে বেরিয়েছিলো, তিনি কখনও সরকারী আবাসন সুবিধা নেননি; নিজের ভাড়া বাসায় থাকতেন। এমপি থাকাকালে পতাকাবাহী গাড়িও ব্যবহার করেননি।  রিকশা-টেক্সিতে চলাচল করতেন। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের সে-কথা। ইতিহাসে পড়েছি, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা মরহুম এ কে ফজলুল হক যখন কোথাও বেরুতেন, তাঁর একটি গাড়ি ছিলো। একবার বেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলে গাড়ি চালানো যাচ্ছিলো না। কারণ, গাড়ির সামনের বাতি দু’টো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় টাকার অভাবে ঠিক করা হয়নি। এখন কি করা? গাড়ির চালক শেষ পর্যন্ত একটি হারিকেন জোগাড় এনে শেরে বাংলার নির্দেশে গাড়ির সামনে ঝুলিয়ে দিল। হারিকেনের আলোতে আস্তেআস্তে গাড়ি সামনে চললো। এই হলো, দুই সৎ-রাজনীতিকের মহৎ উদাহরণ। মজলূম জননেতা মরহুম মাওলানা ভাসানীর কথা তো বলাই বাহুল্য। এঁরা তাঁরা, যাঁরা দেশের জন্য, দশের জন্য ত্যাগের মহিমা রেখে গেছেনসেখানে দল ছিলো গৌণ, ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কোন প্রশ্ন ছিলো না। কিন্তু আজ? রাজনীতির কথা উঠলেই মানুষ গাল দিয়ে বরণ করে। ঘৃণায় লাল হয়ে ওঠে বিবেক। দেশ আজ গৌণ, দল বড়ো; প্রাপ্তির ভাগ আমাদের সামনে আয়না ধরিয়ে দেয়। দলের স্বার্থে, ক্ষমতার স্বার্থে দেশ আর দশ অসহায় হয়ে যায়। বিদেশের বেগমপাড়া হয়ে ওঠে রমরমা। আমাদের টাকার বোঝা টানতে হাঁপিয়ে ওঠে সুইস ব্যাংক। আমেরিকার মাটিতে পরিবার রেখে দেশের মাটিতে রাজনীতি করার মজাই আলাদা। নিজেদের আখের গোছাতে বলি দিতে হয় জনগণকে; গোটা দেশকে। এ যে সোনার বাংলা! 

২৮.০২.২৩    

ভাবনা-১৯

আওয়ামী লীগের ছাত্র-সংগঠন ছাত্রলীগের বিশেষ করে ঢাকায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ড জাতীয়ভাবে প্রশ্ন ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। শুধু ছাত্রলীগ নয়, ছাত্রীলীগও এখন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনায়। এসব নিয়ে সীমিত পরিসরে হলেও পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ঘৃণার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে মনে হয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদের সময় সরকারীদলের ছাত্র-সংগঠন ছিলো, ‘নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ’। ঢাকায় তাদের দৌরাত্ম্য আমি দেখেছি। যতোদূর মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র সরকারী ছাত্র-সংগঠনের হাতে নির্যাতিত হয়ে তার শিক্ষার যে করুণ পরিণতি হয়সেটা তিনি এক সাক্ষাতে সরাসরি পেসিডেন্টকে অবহিত করতে সক্ষম হন। মরহুম এরশাদ সাহেব বিন্দুমাত্র দেরি না করে তাঁর গড়া নতুন বাংলা ছাত্র সমাজকে নিষিদ্ধ করে দেন। ছাত্র-সমাজের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ তা নিয়ে অনেক লম্ফঝম্ফ করেন কিন্তু মরহুম প্রেসিডেন্ট তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়াননি। পুরো জাতি সেদিন এমন পদক্ষেপের জন্য প্রেসিডেন্ট এরশাদকে অভিনন্দিত করে। দোষে-গুণে মানুষ। যার যা ভালো বলতে হবে। এটা অন্য কেউ পারেন নি। রাজনীতির সুযোগে ছাত্রেরা এসব কেন করে? এর বড়ো কারণ অপরিণত বয়সে ক্ষমতার স্বাদ ও অপব্যবহার। ছাত্রদের মূলকাজ লেখাপড়া, জ্ঞানার্জন ও দেশসেবা। তা না করে এখন তারা যা করছেসেসব যে নিখুঁত চোর-ডাকাত আর অপরাধীদের কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য সবাই যে এমন, তা কিন্তু নয়। কিছু ভালো ও মেধাবী ছাত্রও আছে। কিন্তু সংখ্যায় তারা কম। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ছাত্রলীগ কিন্তু প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রিত কোন সংগঠন ছিলো না। ছাত্রলীগের সাবেক ছাত্রনেতারাও কিন্তু তেমনটা বলেন। সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ফজলুর রহমান বিভিন্ন টকশোতে বারবার সে-কথা বলেছেন। তাঁদের কথা হলো, মূল রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকেই অধঃপতনটা শুরু হয়। কারণ, এখানে ক্ষমতার স্বাদটা বেশ কাছের। আর ক্ষমতা কে না ভোগ করতে চায়? বলা দরকার, ১৯৩৮ সালে কোলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করা হয়। সে-সময় মুসলিম ছাত্রলীগ মূলত তিনটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের সংগঠিত করে: (১) সকল ক্ষেত্রে মুসলমানদের দাবি তুলে ধরা (২) মুসলমান ছাত্রদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা (৩) শিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশ সাধন করা। (বংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাস, কে. এম. শামসুল আলম, প্রকাশ: ১৯৯৩, পৃ:৩) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নাম পরিবর্তন করে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ হিসাবে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ প্রচারিত এক বিজ্ঞপ্তিমূলক দলীলে তারা জানায়, “..সরকারের জনকল্যাণকর কর্মপদ্ধতির প্রতি আমাদের সক্রিয় সাহায্য ও সহানুভূতি থাকবে, কিন্তু সরকারের জন ও ছাত্র স্বার্থবিরোধী কর্মপন্থার বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াবো। পক্ষান্তরে, বাধ্যতামূলক ফ্রি প্রাইমারী চিকিৎসার ব্যাপক ব্যবস্থা, বিনা খেসারতে জমিদার ও বর্গাদার প্রথার উচ্ছেদ, নানাবিধ কারিগরী সুবন্দোবস্ত, পূর্বপাকিস্তানে সামরিক শিক্ষার সুবন্দোবস্তের জন্য সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন, ডাক্তারী ও ধাত্রীবিদ্যা প্রসারের জন্য উন্নত ধরনের নতুন কারিকুলামের দাবি, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মুনাফাকারী ও চোরাকারবারীর সমূলে বিনাশ এবং ইসলামী ভাবধারায় শিক্ষা প্রসারের জন্য আমাদের প্রস্তাবিত নবপ্রতিষ্ঠানটি কাজ করে যাবে।” (সৌজন্যে: ঐ, পৃ:১৮) এতোএতো মহৎ কর্মসূচী ঘোষণা করে যে দলটি ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেসে দল কেমন করে আজকের এ অধঃপতিত অবস্থায় পতিত হলো, সে কি কালের প্রশ্ন নয়? আমার বারবার মনে হয়, ছাত্রলীগের মতো ঐতিহাসিক সংগঠনটির দুরাবস্থার জন্য দায়ী মূলত ক্ষমতাসীনদের অপব্যবহার। বড়োরা যদি তাদেরকে টিকে থাকার ঢাল হিসাবে ব্যবহার না করতেন, তবে কি ছাত্রলীগ এভাবে বিতর্কের বস্তুতে পরিণত হতো? তাদেরকে সঠিক ব্যবহারে অনেক দেশসেবী মেধাবী মানুষের জন্ম হতো, তা তো অস্বীকার করা যায় না। বিরানী পঁচলে দুর্গন্ধে দুনিয়া ভরে যায়। এদেরও অবস্থা হয়েছে সে-রকম। এদের ঠিকানা ছিলো পড়ালেখায়, কিন্তু আজ ঠাঁই হলো নর্দমায়। কেন?সে প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই খুঁজে দেখতে পারে। সবাইকে ভাবতে হবে, বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্রদেরকে ক্ষমতাসীনদের লাঠিয়াল হিসাবে ব্যবহারের প্রবণতা রোধ করা যায় কি না।

২৪.০২.২৩               

ভাবনা-১৮

কোথায় যাবো বলুন, দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে কিন্তু দলীয়ভাবে। আগে হতো স্বতন্ত্র বা দলনিরপেক্ষ। এ সরকার এসে করে দিলো: সব স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা যাবে। আগে ছিলো বাঘ বনে, এখন এলো লোকালয়ে। দলনিরপেক্ষ স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী যাচাই করার অবাধ সুযোগ ছিলো মানুষের হাতে, এখন দলীয় ছায়ায় সে সুযোগও গেলো হাতছাড়া হয়ে। দলীয় রাজনীতির কলুষতায় কিছুটা হলেও আগে যে সুষম পরিবেশ ছিলো, এখন তা নেই। মারমার-কাটকাট জাতীয় অবস্থা স্থানীয় নির্বাচনগুলোকে করে রাখলো পিষ্ট। এখন আমরা কী করবো? মানুষটা হয়তো ভালো, হলে কি হবে, তার প্রতীক তো তাকে আমার কাছে থেকে আলাদা করে রেখেছে যদি আমি ঐ দলীয় রাজনীতির সমর্থক না হই। এখানে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বা বিবেচনার সুযোগ কম। বলতে পারেন, দলীয় প্রভাবে ক্ষতি কোথায়? শুনবেন সে কথা? দুনিয়ার অন্য কোথাও কেমন জানি না, এখানে দলীয় মানে জিঘাংসা, হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, খুনোখুনি আারও কতো কি! এক-ই সমাজে বসবাস করি, থাকি, খাই কিন্তু প্রতীক কাঁধে একে অপরকে ধরাশায়ী করতে নিত্য তৎপর। আগে তো স্কুলে রাজনীতি ছিলো না। এখন ছাত্রলীগের কমিটি হচ্ছে, ছোটছোট ছেলেরা যারা উত্তর-দক্ষিণ চেনে না; এখনও মানসকে কলুষ করতে শিখেনি, অভদ্র আচরণে অভ্যস্ত হতে পারেনিতারা দলীয় রাজনীতির স্বাদ পেয়ে বাবার সামনেও মাস্তানী করার সাহস পাচ্ছে, দলের উপরের মহল আশকারা দিচ্ছে। এসবের উদাহরণ কম নয়। পত্র-পত্রিকায় বেরুনো খবর কি কম? এসবে দল মনে করছে, এতে তৃণমূলে দলের প্রভাব বাড়বে; দখল বাড়বে। বিনিময়ে সমাজ যে ভেতর থেকে, একেবারে তলা থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছেসে খবর কি আছে? মনে রাখতে হবে, যে যা করায় সেটার মুখোমুখী একসময় নিজেকেও হতে হয়। কেউ রক্ষা পাবে না। আজ যে দল ক্ষমতায় থেকে এসব করাচ্ছে, তারা কি সবসময় ক্ষমতায় থাকবে? তখত বদল হলে কাল যখন অন্যদলের ছেলেরা এসে উল্টাপাল্টা করবে, ভালো লাগবে? ইট মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। বলছিলাম, স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে। কালভদ্রে কিছু অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ও ভদ্র মানুষ ভোট চাইতে আসে। আমার দুঃখ হয়। সমর্থন করতে ইচ্ছে করে ব্যক্তিত্বের দিকে চেয়ে। কিন্তু ঐ যে বললাম, দলীয় পরিচিতিতে মন যায় না। আগে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, আবার এসেছেনতারাও বলছে কাজ করবেন। কিন্তু বিশ্বাসের জায়গাটা কোথায়? গত নির্বাচনে শুনেছি, প্রার্থী দম্ভরেভভরেভভরে বলছেন, ভোট আপনারা যেখানেই দেন সেটা অমুক বাক্সে চলে আসবে। তাহলে আমরা ভোটকেন্দ্রে যাবো কেন?  ’১৪ আর ’১৮-তে তো দেখেছি। যদি বলি স্বতন্ত্রে যান, তারও কি উপায় আছে? এ ওর টাকাতে দাঁড়িয়েছে; ও তো ভোট কাটতে এসেছে ইত্যাদি। বলা হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের না দিলে এলাকায় উন্নয়ন হবে না। তবে আর ভোট দেয়া কেন? ঘরে বসে নিজের অবস্থার উন্নয়নে কাজ করলেই ভালো। চেয়ে-চেয়ে দেখলাম তুমি হয়ে গেলে, আমার করার কিছু ছিলো না।

২৩.০২.২৩   


ভাবনা-১৭

বাজারের থলে নিয়ে কি আগে বাজারে যাবো না কি হাসপাতালে? মজা করে বলছি না। সত্যি-সত্যি বলছি! আমরা থাকি মফস্বলে। শহুরে কথা বলতে পারবো না। বাজারের বর্তমান হালাবস্থা এখন আর বোঝাতে হয় না। শীতের পানি যে কতো ঠাণ্ডা নামলেই বোঝা যায়; যন্ত্র লাগে না। তেমনি বাজারের যে কি অবস্থা থলে নিয়ে গেলে বোঝা যায়; খবরের কাগজ দেখতে হয় না। বলছিলাম, হাসপাতালে আগে যাবো কি না। কারণ জানতে চান? বলছি। অপারেশনে গিয়েছেন কখনও? না গেলেও অন্যজনের অপারেশনের খোঁজ-খবর তো রেখেছেন নিশ্চয়। ডাক্তার যখন ঠিক করেন অপারেশন করতে হবে, রোগীও যখন মনস্থির করেন: ব্যবচ্ছেদে যাবেন, তার আগে ডাক্তার রোগীর রক্তচাপ, ডায়াবেটিস আছে কিনা, থাকলে কি পরিমাণ ইত্যাদি-ইত্যাদি দেখে থাকেন। এর কারণ হলো, অপারেশন টেবিলে যেন কোন সমস্যা না হয়। ব্যাপারটি কেবল এখানে নয়। আপনি দেশের বাইরে যাবেন তো আপনার কাগজপত্র সব ঠিক আছে কিনা বিমানবন্দরে যাচাই করে দেখা হয় যেন পরে অসুবিধা না হয়। এই দুর্মূল্যে বাজারে ঢুকছি, ভাবছি, যাবো কোথায়? মাছের বাজারে, গোস্তের দোকানে, মুরগীর ওখানে, নাকি তরকারী হাটে? যাবার আগে ভয়ে কাঁপে পা, বুক, শরীর যেন ডিবি অফিসে বা র‌্যাপ-পুলিশ অফিসে ঢুকছি। এমনিতে কসাইদের নামেই চেনা যায়। তার ওপর দাম! তরকারীর নুন দেখতে আমাদের রমণীদের একটা অভ্যাস আছে। সেই ঢং-এ গোস্তের দাম জিজ্ঞেস করি। জবাব যদি আসে ৮০০/৯০০ টাকা? গত হাটে যা দেখেছি এখন দেখছি ৫০ টাকা বেড়ে হয় ৭০০ না হয় ৭৫০ টাকা। পকেট ধাক্কা দিয়ে বললো: কেটে পড়, পারলে হিমালয়ে যা! মাছের বাজারে জিন্দা মাছের দাম আকাশছোঁয়া! মূর্দার দামও কম নয়, ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত খোঁজে। সাগরের হলে তো কথাই নেই, তার উপর রঙবেরঙের মেকআপ। দেশি মাছ ৯০০/১০০০ টাকা চায়। কমদরা মাছের মধ্যে ৮০/১০০ টাকার তেলাপিয়া এখন ১৮০/২০০ টাকায়। তার উপর সাইজ বা আকার নিয়ে আছে ওঠানামা। গরীবের খাদ্য বলে পরিচিত ব্রয়লার আর ডিমের প্রমোশন হয়েছে ঢের। ১২০ টাকার ব্রয়লার এখন দু’শ পেরিয়েছে, ঘেন্নায় আামাদের দিকে তাকায়ও না। ডিম ডজন প্রতি ১৪০/৪৫ টাকা। তরকারির বাজারে তো ১০ টাকার কাঁচা মরিচও দিতে চায় না তরকারিওয়ালা। তবুও মোটামুটি শব্জিটাকে কাছের আত্মীয় মনে হয় যদিও সর্বনিম্ন ৪০/৫০ টাকা। সিলিন্ডার গ্যাসের দাম আগে যেখানে ছিলো ১০৫০ টাকা তো এখন বেড়ে ১৪৫০ থেকে ১৫০০ টাকা। চালের দোকানে গেলে মন চায় খুদের দাম জিজ্ঞেস করি। মুদির দোকানে গিয়ে শুনি কালকের দাম আর বেঁচে নেই। নতুন আর মুশকিল দামে বিকাচ্ছে পণ্য। রমযান মাস আর ক’দিন পরেই। এখনই ছোলার দাম এক নিঃশ্বাসে শ’ টাকা। খেসারী ৮৫-৯০। ঘরে এসে দেখি নতুন মূল্যে বিদ্যুৎবিল দুয়ারে দাঁড়িয়ে সুসংবাদ দিচ্ছে। কি করবো বলুন! আমরা তো আর রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে বাজারের টাকা উসুল করতে পারি না! মানুষ এ নিয়ে হরহামেশা মা-বোন তুলে সরকারের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে। কিন্তু সরকারদলীয়রা চুপ। কিরে বাপ, তোরা কি বাজার করিস না! তোদের কি পেট নেই? না কি তোদের আলাদা করে রেশন দিচ্ছে সরকার? চুপ থাকিস কেন? এই কি তোদের জনস্বার্থ? নিশ্চিত করে বলতে পারবো, বাজারে ঢোকার আগে আমার রক্তচাপ আর বেরুনোর পরে রক্তচাপে অনেক তফাৎ। সেটা হাঁটার কারণে নয়, দামের কারণে। তাই ভাবছি, রাজারে যাবার আগে হাসপাতালে যাবো; রক্তচাপ, ডায়াবেটিসএসব চেক করে দেখতে হবে। নচেৎ মাথা ঘুরে পড়লে ঘর তো খবর-ই পাবে না। তাই চলুন, আগে ডাক্তারের কাছে যাই, পরে বাজারে। এর চেয়ে নিরাপদ উপায় আর কি?

২২.০২.২৩ 


ভাবনা-১৬

আজ ৮ই ফাল্গুন, ২১শে ফেব্রুয়ারী। বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে মহান ভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এদিনে তৎকালীন পাকিস্তানী রাষ্ট্রশক্তি কর্তৃক উর্দূকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে পাশাপাশি বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও দাপ্তরিকভাষা করার দাবিতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর আন্দোলন রফিক-সালাম-বরকতেরা রক্তের বিনিময়ে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার বীজ রোপণ করেনযা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্তরূপ পরিগ্রহ করে। ৫২’র আন্দোলন ছিলো মূলত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, মাতৃভাষা আন্দোলন নয়। সে-সময় মাতৃভাষা নিয়ে কোন জটিলতা সৃষ্টি হয়নি।ওরা, মানে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আমাদেরকে বলেনি যে, আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলতে পারবো না। ইতিহাসের বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজে দেখা যায়, কোথাও মাতৃভাষা আন্দোলনের নাম নেই, আছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্ল্যাকার্ড আর ধ্বনি। পরে সম্ভবত বাংলাদেশ আমলে এসে একটি শ্রেণী ৫২’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে মাতৃভাষা আন্দোলন বলে প্রচার করতে থাকে।এটাকে প্রচার না বলে অপপ্রচার বললে ভালো হয়।উইকিপিডিয়াতে দেখলাম লেখা হয়েছে: বাংলাভাষা আন্দোলন। হ্যা, সমস্যা নেই; রাষ্ট্রভাষা অন্দোলনকে বাংলাভাষা আন্দোলন বলা যেতে পারে একার্থে। কিন্তু সবচেয়ে পূর্ণ ও বাস্তব অবয়ব হলোরাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। যাঁরা আন্দোলন করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, কারাবরণ করেছেন: তাঁদের সবাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে সরগরম ছিলেন, মাতৃভাষা আন্দোলন নিয়ে নয়। যারা প্রচার করেছেন: ওরা আমার মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো, তারা কি সঠিক বলেছেন? আমার মনে হয় না এর কোন ভিত্তি আছে। ভাষা অন্দোলনের উপর রচিত দু’টো বই ভাষা সৈনিক অলি আহাদের লেখা ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫’ ও বামপন্থী লেখক বদরুদ্দীন উমরের লেখা ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’তে প্রদর্শিত অনেক দুর্লভ তথ্য ও ছবিতে কোথাও দেখা যায়নি ৫২-তে মাতৃভাষা আন্দোলন হয়েছে। বরঞ্চ এমন প্ল্যাকার্ডও আন্দোলনকারীদের হাতে দেখা গেছে, যেখানে লেখা ছিলো: উর্দূ-বাঙলা ভাই ভাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। তাহলে মাতৃভাষা আন্দোলন কি করে হলো? অবশ্যই বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, সে ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সংগ্রাম হয়েছিলো, মাতৃভাষা করা বা ঘোষণার দাবিতে নয়। ১৯৫২ সালের ২৯শে জুন সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের স্বাক্ষর অভিযানে অথবা সর্বদলীয় ভাষা আন্দোলন কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারীর ধর্মঘট সম্পর্কিত ইশতেহারে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির কথা বলা হয়েছে, মাতৃভাষা করার দাবি নয়। তাহলে কেন আমরা এখন বলছি, আজ মাতৃভাষা আন্দোলন বা ওরা আমাদের মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো? কথাগুলো কতোটুকু সত্য? স্বীকার করি, ৫২’র অন্দোলন অবশ্যই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা বা প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিলো, কখনোই বাংলাকে মাতৃভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার লড়াই নয়। কারণ ইতিহাস বলে না: ওরা আমাদেরকে বাংলায় কথা বলতে মানা করেছিলো। কিন্তু আমরা আজ রাষ্ট্রভাষা দিবসের পরিবর্তে মাতৃভাষা দিবস পালন করছি। অধ্যাপক ড.সলিমুল্লাহ খানও সম্প্রতি বলেছেন: ৫২-তে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিলো, মাতৃভাষা আন্দোলন নয়। এখন প্রশ্ন হলো, মাতৃভাষা আন্দোলনে সমস্যা কোথায়? সমস্যা: ঐতিহাসিক অর্থাৎ ইতিহাসে অনুপস্থিত বিষয়ের অবাস্তব উচ্চারণ এবং ইতিহাসের প্রকৃত চরিত্র ও গতিধারাকে স্থানচ্যুতকরণযা পরবর্তী প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করবে। আমাদের কিছু অত্যুৎসাহী অংশের চেষ্টায় জাতিসঙ্ঘ ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক বিশ্বে যে বার্তাটি যাচ্ছে, সে কি শুদ্ধ না কি অশুদ্ধ? আমরা সংগ্রাম করেছি, আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে, মাতৃভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে নয়। বাংলা তো মাতৃভাষা আগে থেকেই ছিলো, এখনও আছে। বরঞ্চ বলবো, মাতৃভাষা আন্দোলন বলতে গিয়ে আমরা ব্যাপকতা কমিয়েছি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বললে ব্যাপকতা আরও বাড়তো। বাইরের বিশ্বে যারা মাতৃভাষা দিবসের গোড়া খুঁজতে চাইবে, তারা যখন দেখবে এ তো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তখন আমাদের ইতিহাস বিকৃতির চিত্র কি ফুটে উঠবে না? আমাদের পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও বাংলা মাতৃভাষা হিসাবে প্রচলিত। অথচ ওরা বাংলার জন্য কোন ত্যাগ স্বীকার করেনি। ৫২’র আন্দোলনে ওদের কোন অংশীদারিত্বও ছিলো না।তাই, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বললে আমাদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ভেজালে বিমর্ষ হতো না। তা’ছাড়া আরও একটি কথা, আমরা যে বাংলা ভাষা দিবসকে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ বলছি, সবিনয়ে প্রশ্ন করতে পারি কি: ‘ফেব্রুয়ারী’ কোন শ্রেণীর বাংলা শব্দ?  মি. জিন্নাহর উর্দূকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করাকে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক মানসিকতা বলে সমালোচনা করেছি। ঠিক আছে। কিন্তু ৮ই ফাল্গুনের পরিবর্তে একুশে ফেব্রুয়ারী মার্কা জগাখিচুড়ি পরিভাষা ব্যবহার কোন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ? এ প্রশ্নের কি কোন জবাব আছে? জানি না এসব অনাহুত বিতর্ক থেকে কবে আমাদের ইতিহাস মুক্তি পাবে। 

২১.০২.২৩     


ভাবনা-১৫

অনলাইনে খবর দেখতে গিয়ে পত্রিকার পাতায় একটি কৌতুহলোদ্দীপক খবর পেলাম। গতকাল শনিবার ঢাকার মগবাজার কনভেনশন হলে অনলাইন বিজনেস ফার্ম ‘কওমী উদ্যোক্তা’ গ্রুপের তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো।এটাকে কওমী আলিমদের সর্ববৃহৎ ব্যবসা-উৎসাহ দানকারী একটি অনলাইন কেন্দ্র হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২০ সালে সংশ্লিষ্ট কওমী-আলিমদের সমন্বয়ে গড়া গ্রুপটির যাত্রা শুরু। বলা হয়েছে, বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ২ লক্ষ ৫০ হাজার। দেয় তথ্যানুসারে, সহস্রাধিক আলিমকে ব্যবসায় দিকনির্দেশনা দিয়েছে উক্ত গ্রুপ। হাজারো আলিম এ গ্রুপের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন বলে বলা হয়েছে। প্রথম দেখাতে খবরটি ভালো না লাগার কোন কারণ নেই। আমাদের এ সমাজে আলিম মানে হতদরিদ্র ও প্রায় নিঃস্ব, পরের কাছে প্রার্থী একটি শ্রেণীকে মনে করা হয় যারা কেবল মসজিদ-মাদরাসা নিয়ে পড়ে থাকে। জাগতিক জ্ঞানে এঁরা পশ্চাদপদ। তাই ভালো কোন চাকরি পায় না; ছেলেপুলেদের ভালো বন্দোবস্তও করতে পারে না; পরের ঘর থেকে আনা মেয়েটার দু’আনা খরচও মেটাতে পারে না। এ ধরনের ধারণার একটি কারণও আছে বৈ কি। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে গড়ে উঠা আমাদের সমাজে ১৮৫৭’র মহাবিপর্যয়ের পর সুপুষ্ট মুসলিম জমিদার ও ধনাঢ্য শ্রেণী ইংরেজদের চক্রান্তে ও হিন্দু বাবুশ্রেণীর সহযোগিতায় পথে বসতে বাধ্য হলে প্রশ্ন দেখা দেয়: পতনোম্মুখ মুসলিম সমাজকে কোন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে? স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে একটি শ্রেণী রায় দেয়, ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা ও তাদের শিক্ষা গ্রহণ করে; ইংরেজ সরকারের চাকরিতে অংশ নিয়ে আত্মরক্ষার উপায় বের করতে হবে। অন্যদিকে তৎকালীন আলিম-সমাজ যাঁরা কখনোই হতদরিদ্র ছিলেন না, অসচ্ছল ছিলেন না কিন্তু বিপর্যন্ত পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বকীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষার আন্দোলন নিয়ে গড়ে তুললেন সম্পূর্ণ সরকারী সাহায্যমুক্ত এবং জনসম্পৃক্ত মাদরাসার বলয় যা দেওবন্দ আন্দোলন নামে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ।তাঁদের দর্শন ছিলো, একটি জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা ও সংস্কিৃতি আর সেটাকে প্রথমেই রক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে সমাজকে আত্মপ্রত্যয়ী করে গড়ে তুলতে হবে। তাই তাঁরা বৃহত্তর স্বার্থের প্রয়োজনে ইংরেজ-চাকুরির লোভকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের স্বর্বস্ব ত্যাগ করে মুসলিম-সমাজকে ইসলামী শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন।তাতে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তাঁরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেন বটে, মুসলিম-সমাজকে অবক্ষয়ের মুখ থেকে রক্ষা করলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফলতার দিকে নিয়ে গেলেন। তাঁদের এ চেষ্টায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন, সন্দেহ নেই। সেই থেকে মাদরাসায় কুরআন-হাদীসের জ্ঞানদান নিয়ে পড়ে থাকা আলিম-সমাজ স্বল্প আয় সম্বল করে আজও পথ চলছেন সমাজের প্রয়োজনে, বিনিময়ে এ সমাজ থেকে পেলেন অসহায়, জাগতিকভাবে অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র শ্রেণীর ঘৃণাত্মক ও অবহেলাসূচক তকমা। বিশেষ করে অন্যান্য স্থানের তুলনায় আমাদের বাংলাদেশের অধিকতর দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিস্থিতিহেতু আলিম-সমাজের অবস্থা হয় শোচনীয়। এ থেকে পরিত্রাণের চেষ্টায় ধীরেধীরে সময়ের পরিবর্তনে কওমী আলিম-সমাজ আত্মসচেতনতায় নিজেদের পথকে নতুনভাবে পরিবর্তনের তাগিদ বোধ করলেন। মাদরাসাশিক্ষা শেষ করে কেউ গেলেন বিদেশে; কেউ স্বল্পিপুঁজি নিয়ে দেশজ বিনিয়োগে গড়ে তুললেন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। এভাবেই পথচলা শুরু। আজ যখন উপরের খবরটি নজরে পড়লো, সতর্কভাবে খুশি হয়েছি বেশ। সতর্ক এ জন্য যে, দেখেছি, কেউকেউ ওদকে নজর দিতে গিয়ে হয় আত্মকেন্দ্রিক হয়েছেন, না হয় কওমী মৌলিকত্ব হারিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। আমি কওমী আলিমদের ব্যবসা-জগতে বিচরণকে এ জন্য সমর্থন করি যে, তাঁরা ব্যবসার রন্ধ্রেরন্ধ্রে হালাল-হারামকে প্রাধান্য দিয়ে দা’ওয়াত পেশ করবেন এবং নিজেদেরকে সচ্ছল করে গড়ে তুলে দেশ ও দশের সেবা করতে সক্ষম হবেন।।তাতে ভেতর থেকে সমাজ পরিবর্তন হবার পথ খুঁজে পাবে। অন্যথায় হারিয়ে যাবার আশঙ্কা থাকলে দুষ্ট গরুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল ঢের ভালো হবে।

১৯.০২.২৩       


ভাবনা-১৪

আজ এক সুইপারের গল্প বলি। গল্পটি লিখে গেছেন মাওলানা রুমী রহ. তাঁর মসনবীতে। চমৎকার সে কাহিনী। সুইপারকে আমাদের চট্টগ্রামে আঞ্চলিক ভাষায় বলে ‘মেথর’। ওদের অবাসস্থলকে বলে মেথরপট্টি। পট্টি মানে বোঝেন-ই: পল্লী বা বস্তি। তো তেমনই এক মেথরপট্টিতে থাকতো এক সুইপার। সারা দিন আবর্জনা সাফ করতে পার হতো তার দিনকাল। একদিন সে কি এক দরকারে বাজারে গেলো। বাজারে ছিলো এক আতরের দোকান। খুশবুতে বোঁ-বোঁ করতো দোকানের সামনের অংশ। পথচারীদের নাকেমুখে লাগতো আতরের মোহনীয় খুশবু। ঘটনাক্রমে ঐ সুইপার আতরের দোকানটির সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। যেতে যেই না তার নাকে আতরের খুশবু এসে লাগলো, ব্যাস, ধপাস করে পড়ে গেলো রাস্তায়।পড়েই বেহুঁশ। কি হলো, কি হলো করতে করতে লোকজন দৌড়ে এলো। দেখলো, নাকেমুখে খিঁচুনি; হাত দু’টো শক্ত হয়ে আছে। কি করা, কেউ তাকে বাতাস দিচ্ছে; কেউ দিচ্ছে পানির ছিটা। নাহ, হুঁশ ফেরার লক্ষণ নেই। একজন গিয়ে নিয়ে এলো আগরবাতি; জ্বালিয়ে ধোঁয়া দেয়ার চেষ্টা করলো। অন্তত হুঁশ তো ফিরুক! সবাই দেখলো, অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। যতোই আগরবাতির ধোঁয়া দেয়া হচ্ছে, বাতাস দেয়া হচ্ছেততোই অবস্থা কাহিলতর হচ্ছে। খিঁচুনি তো থামছেই না, ক্ষণেক্ষণে বাড়ছে। শেষতক কেউ একজন দৌড়ে গিয়ে তার ভাইকে খবর দিলো: যা-যা, তোর ভাই তো মরতে চলেছে! ভাই দৌড়ে গিয়ে দেখে মেথরের অবস্থা সুবিধার নয়। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আতরের দোকান। বুঝে ফেললো রোগের কারণ। সবাইকে আগরবাতির ধোঁয়া, বাতাস, পানিএসব দিতে কঠিনভাবে মানা করলো। লোকজনকে একটু সবুর করতে বলে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এলো রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কিছু কুকুরের শুকনো মল। সেটা নাকের উপর দিতেই মেথর চোখ খুললো, হাত নাড়লো একসময় উঠে বসলো। লোকজন তো দেখে হতবাক! ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলো রহস্য কি? তখন মেথরের ভাইটি বললো: আমার ভাই জীবনভর করে এসেছে মিথরগিরি। এসব করতে-করতে দুর্গন্ধই তার কাছে স্বাভাবিক। আজকে যেই না সে আতরের দোকানের সামনে এলো, নাকে খুশবু লাগতেই তার কাছে বিশ্রী আর উৎকট মনে হলোতাতেই বেহুঁশ। আপনার সেটা বুঝতে না পেরে যতোই আগরবাতির ধোঁয়া, পানি ইত্যাদি দিচ্ছিলেন, তার অবস্থা ততোই খারাপ হচ্ছিলো। আমি এসেই আতরের দোকান দেখে রোগ বুঝে ফেলি। তাই দৌড়ে গিয়ে ময়লা এনে ধরতেই সে তার স্বাভাবিকতা ফিরে পেলো; হুঁশ এলো। মাওলানা রুমী রহ. ঘটনাটির বয়ান দিয়ে মন্তব্য করলেন: মানুষ তার নিত্যদিনের পরিবেশ আর আচরণে বাধ্য হয়ে যায়। তখন প্রকৃত সুগন্ধ আর দুর্গন্ধের বাছবিচার থাকে না। পরিবেশ ও আচরণের প্রভাবে সুগন্ধ যেমন দুর্গন্ধ হয়ে যায় তেমনি দুর্গন্ধ হয়ে যায় সুগন্ধ। সে দুর্গন্ধের পথকেই মনে করে তার মুক্তির পথআসল ঠিকানা। তাই কেউ সুগন্ধের সন্ধান দিলেও প্রত্যাখ্যান করে, অসুস্থ বোধ করে। আমি কিন্তু সেই সুইপারের মধ্যে এ সমাজকে পরখ করি। আজ আমরা যে সমাজে বাস করছি সে কেমন সমাজ? আমরা কি জানি? আসলেই কি আমরা দুর্গন্ধে অভ্যস্ত না সুগন্ধেসে কি বুঝি? নিজেদের মনগড়া আর পশ্চিমাধারায় চলতে চলতে কখন যে দু্র্গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। এখন সেই সুইপারের মতো সুগন্ধও দুর্গন্ধ ঠেকে আমাদের নষ্ট-নাকে; আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। আল্লাহ আমাদেরকে সুরা ফাতিহায় বলেছেন, ইহুদী আর খৃস্টানদের অনুসরণ না করতে। কেন? কারণ, আল্লাহপ্রদত্ত অহী কুরআনের অনুসরণই সুগন্ধ, পরিপন্থী সব দুর্গন্ধ। আমাদেরকে তাই সুগন্ধে থাকতে বলেছেন। কিন্তু আমরা দুর্গন্ধে থাকতে-থাকতে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি; সুগন্ধে বেহুঁশ হয়ে যাই, অস্বস্তি বোধ করি। এ থেকে বের হতে না পারলে দুর্গন্ধেই থেকে যাবো, দুর্গন্ধে থাকতে-থাকতে দুর্গন্ধ নিয়ে কবরে যাবো। আল্লাহ পানাহ। 

১৮.০২.২৩   


ভাবনা-১৩

ইদানিং আমাদের কিছু প্রচারমাধ্যমের কিছু উপস্থাপনা নজর কাড়ছে। ছাপানো মাধ্যম বলুন আর ইলেকট্রনিক মাধ্যম বলুন--বিষয়টি দৃষ্টিএড়ানো বা শ্রুতিএড়ানো নয়। দেখছি, আগে লেখা হতো: ১লা মার্চ, ২রা জুলাই, ৪ঠা এপ্রিল, ৮ই মে, ২০শে জুন ইত্যাদি। এখন দেখি, লেখা হচ্ছে: ১ মার্চ, ২ জুলাই, ৪ এপ্রিল, ৮ মে, ২০ জুন ইত্যাদি। ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে পড়াও হচ্ছে তেমন। আচ্ছা, পরের গুলো কি শুদ্ধ হচ্ছে? আগের গুলো কি গলৎ? আসুন তবে দেখি। একটি প্রশ্ন করি: স্কুলে সাধারণত ক্লাসে যে লেখা থাকে বা ছাত্রেরা বলে: ক্লাস ফাইভ, ক্লাস নাইন, ক্লাস টেন ইত্যাদি--সে কি শুদ্ধ? আসলে শুদ্ধ নয়। বাংলায় বললে হবে: ৫ম শ্রেণী, নবম শ্রেণী, দশম শ্রেণী ইত্যাদি আর ইংরেজিতে বলতে হবে: Fifth Class, Ninth Class, Tenth Class ইত্যাদি। এখানে নির্দিষ্ট শ্রেণীকে বোঝানো হচ্ছে, কয়েক শ্রেণীকে এক সাথে নয়। যখন আপনি বলবেন: Class Five তখন মূলত বোঝানো হবে, একসাথে ৫টি শ্রেণী। কিন্তু কেউ তো একসাথে ৫টি শ্রেণীতে পড়ে না। তাহলে সে কী বলবে? বলবে: আমি ৫ম শ্রেণীতে পড়ি বা Fifth Class-এ পড়ি। তাহলে লেখাটা শুদ্ধ হলো--বলাটা শুদ্ধ হলো। এবার আসুন আমাদের মিডিয়া-পাড়ার কথায়। খবর লেখায় বা পড়ায় আগে বলা হতো, যেমন বলে এসেছি: ১লা মার্চ, ২রা জুলাই ইত্যাদি। আর এখন লেখা হচ্ছে, ১ মার্চ, ২ জুলাই ইত্যাদি। গলৎটা কোথায়? ঐ যে শ্রেণীর যুক্তিতে দেখুন, আপনি ১লা এপ্রিল, ৪ঠা এপ্রিল বললে বোঝাবে এপ্রিলের প্রথম দিন বা চতুর্থ দিন পক্ষান্তরে, ১ এপ্রিল বা  ৪ এপ্রিল বললে বোঝাবে, হয় একটি এপ্রিল বা এক সাথে এপ্রিলের ৪ দিন বা ৪টি এপ্রিল মাস, যেমন আমরা বলি: একটি আম--যার মানে কখনোই এক টুকরো আম বা একটি আমের এক টুকরো নয়। বাংলায় বলতে গেলে বলতে হবে: ১ম এপ্রিল বা ৪র্থ এপ্রিল। তাহলে আপনি একটি নির্দিষ্ট দিনকে পাবেন। আশা করি পাঠক বুঝতে পেরেছেন। ঘটনা যখন কোন নির্দিষ্ট দিনে বা কোন নির্দিষ্ট দিন থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী কোন নির্দিষ্ট দিনে শেষ হয়, প্রকাশে আপনাকে সেভাবেই বলতে হবে খিচুড়ি করে নয়। কিন্তু আমরা বলি বা বলছি! হ্যা,বলছি, সেটা কিন্তু শুদ্ধ নয়, অশুদ্ধ। ভুলের উপর বলা আর কি। আসুন এবার মিডিয়া-পাড়ার দিকে। আমাদের মিডিয়ার বাক্যগঠন বা শব্দচয়ন বা সংবাদ পরিবেশনা যে কতোটা দুর্বল, সেটা বোঝানো মুশকিল। আগে সংবাদ লিখন বা পরিবেশন ছিলো মূলত সংবাদনির্ভর, ফ্যাশননির্ভর নয়। বেশি ন্যাকামো করতে গিয়ে শব্দের উচ্চারণকে কতো বিকৃত করা হচ্ছে তা শুনে বিস্মিত হতে হয়। অথচ এদের ডিগ্রীর বহর দেখলে অবাক হতে হয়। সংবাদ পরিবেশনার নামে এখন যা হচ্ছে সেখানে সাংবাদিকতা প্রাধান্য পায় না, প্রাধান্য পায় ফ্যাশন, অসামাঞ্জস্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গী। ৮০’র দশকে আমি বিবিসি ও ভয়েজ অব আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠান শুনতাম উচ্চারণ আর সংবাদ পরিবেশনার ধরন দেখতে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এসে দেখলাম লম্বালম্বা ডিগ্রী নিয়ে বিবিসি’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে কতো ভুল উচ্চারণে সংবাদ পড়তে। এখন মিডিয়াতে যা হচ্ছে, নিরঙ্কুশ অমেরুদণ্ডীয় আচরণ। এই যে উপরে বলে এলাম, তারিখের কথা; বললেই বলবে ১লা, ২রা, ৪ঠা তো বাংলা রীতি নয়, উর্দূ-ফার্সী রীতি। আমরা তো আবার ভাষার জন্য লড়েছি, তাই না! তবে ভুল কেন, বাংলাতে ১ম মার্চ, ৪র্থ এপ্রিল--এভাবে বলুন! আচ্ছা একটি প্রশ্নের উত্তর দিন। ভাষার যে দিনকে মনে রাখতে আপনারা উর্দূ-ফার্সী রীতি বর্জন করে বলছেন: ১ মার্চ, ৪ এপ্রিল, আপনারা আবার ভাষার দিনকে ‘২১শে ফেব্রুয়ারী’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, ‘অমর একুশে’ এসব লিখছেন কেন, বলছেন কেন? তখন কেন বলেন না: ২১ ফেব্রুয়ারী বা একুশ ফেব্রুয়ারী? আচ্ছা ‘ফেব্রুয়ারী’ কি বংলা? বাংলা মাস কোথাও কি নির্বাসনে গেছে? আসলে এসবের পেছনে আছে উদ্ভ্রান্ত সেক্যুলারগোষ্ঠী এবং তাদের মানসপুত্রেরা, যারা স্বকীয় সাংবাদিকতাকে বাদ দিয়ে কলকাতাইয়া সাংঘাতিকতাকে (সাংবাদিকতা) এখানে বসত গড়াতে চায়। কেবল ১লা, ২রা, ৪ঠা এগুলোতেই কি উর্দূ-ফার্সী? বাংলায় কি আর উর্দু-ফার্সী নেই? এভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ-প্রজন্মকে উদ্ভ্রান্ত করে রাখতে চায় যেন তারা ভুল বলে, ভুল শিখে কিন্তু বুঝবে না তারা যে মূলরাস্তা ফেলে ভিনরাস্তায় চলছে। এ ধরনের অপচেষ্টা এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, আসামে চলছে; বাংলা থেকে আরবী-ফারসী বাদ দিতে হবে। এটা বিজেপি-থিওরী। এর পেছনে আছে উগ্র-সাম্প্রদায়িকতা। যেখানে-সেখানে পাকিস্তানী গন্ধ খুঁজে বেড়ানো এদের কাজ। তাদের কাছে জানতে ইচ্ছে হয়, পাকিস্তানী নামেই যখন এতো অসহ্য তখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদেরকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে বারবার আহ্বান জানায়, তারা নীরব থাকেন কেন? কেন মিডিয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে?
১৬.০২.২৩


ভাবনা-১২

বৃটেনভিত্তিক সংবাদ-সংস্থা বিবিসি সম্প্রতি তাদের টেলিভিশনে “BBC: The Modi question" নামে একটি তথ্যচিত্র প্রচার করেছে দুই কিস্তিতে। এর প্রথম কিস্তিতে দেখানো হয় মুদি আমলে ২০০২ সালে সংঘটিত গুজরাটের মুসলিম গণহত্যার ভয়ালচিত্র এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে দেখানো হয় ‍মুদির প্রধানমন্ত্রিত্ব থাকাকালে ভারতের মুসলিমদের হাল-হাকীকত। অনলাইন থেকে উভয় কিস্তি আমি দেখেছি। ভারতীয় গণমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সবাই বলেছেন, বিবিসির ঐ তথ্যচিত্রে যা কিছু দেখানো হয়েছে তাতে এমন কিছু ছিলো না, যা আগে প্রদর্শিত হয়নি। তাহলে বিতর্ক কেন? মুদি সরকারের ঐ তথ্যচিত্রের বিরুদ্ধে এতো লাঠিসোটা কেন? প্রদর্শনে এতো সরকারি বাধা কেন? বিতর্কে কারণ: ১. মুদির ইমেজ-সঙ্কট ২. তথ্যচিত্র প্রচারের কাল ৩. গুজরাট গণহত্যাকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার এবং ৪. গুজরাটের ঘটনার কারণে মুদির প্রধানমন্ত্রিত্ব অর্জন। মুদিপন্থীরা ওসব বিষয়কে আমলে নিয়ে তথ্যচিত্রটি প্রদর্শনে জানপ্রাণ দিয়ে বাধা দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে বলে মনে হয়। তথ্যচিত্রটি যারা দেখেছেন, বিলক্ষণ বুঝবেন বিবিসি তাদের তথ্যচিত্রে একটি অজানা বিষয়কে সামনে এনেছে আর তা হলো, তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী জ্যাক স্ট্র গুজরাট-ঘটনা নিয়ে গোপন তদন্ত পরিচালনা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন: এক, প্রচার-মাধ্যমে যা কিছু এসেছে বাস্তবচিত্র তার চেয়েও ঢের বেশি ভয়াবহ ছিলো এবং দুই, পুরো ঘটনার পেছনে মুখ্যমন্ত্রী মুদি সরাসরি দায়ী। এ ছিলো বিবিসি’র মূল উপসংহার। এখানে ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে হয়। সেদিনকার বাস্তবচিত্রকে যদি সামনে আনা হয়, বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে, সে ছিলো মূলত একটি মুসলিম গণহত্যা। অথচ ভারতীয় গণমাধ্যম বরাবরই বলেে এসেছে-‘দাঙ্গা’। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, বাইরের বিশ্বকে এ মর্মে বিভ্রান্ত করা যে, এখানে একতর্ফা মারা হয়নি, উভয়ের মারামারি হয়েছে।  বিবিসি’র তথ্যচিত্র থেকে যে বিভৎস বিষয় উঠে এসেছে তা হলো, গুজরাটে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মুদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট দেয়ার কারণ গণহত্যা এবং সেটাকেই পুঁজি করে মুদি পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন। তাহলে ব্যাখ্যাটা কী দাঁড়ালো? ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এ কারণে মুদিকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে টিকিয়ে রেখেছিলেন যে, তিনি মুসলিমদের উচিৎ শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচন করা হয়েছে সে সক্ষমতার কারণে। তাহলে বিজেপি কেন ভারতে বেশি ভোট পায়--সে প্রশ্ন কি একান্তই জিজ্ঞাস্য? বিবিসি আসলে ভারতের সাম্প্রতিক রাষ্ট্র-চরিত্র্র ও গণচরিত্রের একটি অপ্রকাশিত দিককে উম্মোচিত করেছে--যা আন্তর্জাতিক বিশ্বকে ভাবতে বাধ্য করবে। 
১৫.০২.২৩


ভাবনা-১১

সম্প্রতি প্রায় সবার অলক্ষে একটি ঘটনা ঘটে গেলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ঘটনার প্রধান চরিত্র মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধি ইলহান ওমর। ইনি ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচনে মিনেসোটা’র একটি আসন থেকে কংগ্রেস-সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম দু’জন মুসলিম মহিলা কংগ্রেস সদস্য হন। ইলহান ওমর তাঁদের একজন। ইলহান ওমরের পরিবার সোমালিয়া থেকে উদ্বাস্তু হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। তাঁর জন্ম ১৯৮২ সালের ৪ঠা অক্টোবর। উল্লেখ্য, কংগ্রেস-সদস্য হিসাবে শুরু থেকেই ইলহান ওমরকে ঘিরে শুরু হয় বিতর্ক। কারণ, তিনি বিশ্বাসগতভাবে মুসলিম, গায়ের রঙে কালো এবং পোষাকে হিজাব পরিহিতা। ইসরাঈল এবং ইসরাঈলপন্থী লবি তাঁকে তাঁকে নিয়ে ছিলো সদা উদ্বিগ্ন। ওদের নিয়ে মন্তব্য করার কারণে তাঁকে এন্টি সেমিটিক বা ইহুদীবিরোধী বলে আক্রমণ করতো ডানপন্থী সমালোচকেরা। পরে অবশ্য ইলহান তাঁর মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। একজন মুসলিম কংগ্রেস সদস্য হিসাবে তিনি ইতোমধ্যে নানা ধরনের হুমকির মুখেও পড়েছেন। টুইন টাওয়ার ধ্বংস নিয়ে ইলহান তাঁর এক বক্তব্যে বলেছিলেন: Some people did something অর্থাৎ, কিছু লোক কিছু একটা করেছে। ২০১৯ সালের ২৩শে মার্চ ইলহান কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স’র সভায় মন্তব্যটি করেন। ২০ মিনিটের ঐ ভাষণে তিনি ইসলামোফোবিয়া থেকে শুরু করে নিউজিল্যান্ডের মসজিদে সন্ত্রাসবাদী হামলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বলেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, টুইন টাওয়ার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হয়। তাঁর কথায়, “এই হচ্ছে প্রকৃত সত্য। বহুদিন ধরে আমাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে একটা অস্বস্তি নিয়ে বসবাস করতে হয়েছে এবং সত্যি বলতে কি, আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এই দেশের প্রতিটি মুসলিমেরও তাই হওয়া উচিৎ। ইলহান ওমরের এই ব্ক্তব্য ‘১৯ সালের ৯ই এপ্রিল থেকে বিভিন্নমহলের মনোযোগ কাড়তে শুরু করে। টেক্সাসের এক রিপালিকান কংগ্রেস সদস্য ড্যান ক্রেনশ তার বক্তৃতাকে 'অবিশ্বাস্যবলে বর্ণনা করেন। এরপর বিষয়টি লুফে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের ফক্স নিউজসহ অন্যান্য রক্ষণশীল মিডিয়াতারা এটা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারম্যান ইলহান ওমরকে 'অ্যান্টি আমেরিকানবলেও বর্ণনা করেন। ইলহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ: তিনি টুইন টাওয়ার হামলাকে খাটো করে দেখছেন। এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে নিউ ইয়র্ক পোস্ট। তারা পত্রিকার প্রথম পাতায় নাইন ইলেভেনের হামলার একটি ছবি প্রকাশ করে ওপরে হেডলাইন দেয়: 'হিয়ার ইজ ইয়োর সামথিং।নিউ ইয়র্ক পোস্টের এই শিরোণাম বিতর্কটিকে আরও তিক্ত করে তোলে। এভাবে সূক্ষ্ম সামপ্রদায়িক কারণে এবং ইহুদী লবির প্রভাবে ইলহান ওমরকে নাজেহাল করা শুরু হয়। এর চূড়ান্ত পরিণতি আসে সম্প্রতি মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের নবনির্বাচিত রিপাবলিকান সদস্যদের প্রভাবে ইলহান ওমরকে পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি থেকে বাদ দেয়ার মাধ্যমে। এতে ইলহান ২১৮-২১১ ভোটে হেরে যান। এ ক্ষেত্রে ২০১৯ সালে তাঁর মন্তব্যের উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, ইলহান মিনেসোটা থেকে টানা তিনবারের জয়ী ডেমোক্র্যাট সদস্য। বাদ দেওয়ার আগে এক আবেগঘন বক্তব্যে ইলহান ওমর বলেন: কমিটিতে না থাকলেও আমার কণ্ঠ, আমার নেতৃত্বকে চাপা দিয়ে রাখা যাবে না। বলাবাহুল্য, আমেরিকায় ইহুদী লবীর দৌরাত্ম্য অত্যন্ত শক্তিশালী। উপরি হিসাবে আছে, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। এ রোগ মার্কিন রাজনীতির সুউচ্চ মার্গে দণ্ডায়মান দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। বর্তমান ডেমোক্র্যাট প্রশাসন বলছে, তারা এটা নিয়ে কাজ করছে। তবু শত বাঁধা সত্ত্বেও মুসলিম মূল্যবোধ মাথায় নিয়ে ইলহান ওমররা যা করে যাচ্ছেন, তা কখনও ইতিহাস ভুলবে না। মনে করি, বিশ্বের তাবৎ মুসলিম ইলহান ওমরদের বীরত্বগাঁথাকে অনুসরণীয় করে রাখবে। 

১৪.০২.২৩         

ভাবনা-১০

অবশেষে সরকার নতুন পাঠ্যক্রমে সংযুক্ত বিতর্কিত ও সমালোচিত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দু’টি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া ঘোষণাটি অবশ্যই সময়োপযোগী ও বাহ্যত ধন্যবাদযোগ্য। একটি জাতির অন্যতম প্রাণ হলো তার শিক্ষার উপাদান ও চরিত্র। এটা নির্ভর করে ঐ জাতির বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অবয়বের উপর। জাতি ভিন্নভিন্ন গোষ্ঠীর সমন্বয়ে হতে পারে; এক-গোষ্ঠী কেন্দ্রিক হতে পারে আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সাথে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সহাবস্থানেও হতে পারে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ একটি ভূখণ্ড যেখানে ৯১.৪ শতাংশ মুসলিম ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বসবাস করে। সঙ্গতকারণে, শিক্ষার চিত্র তৈরি হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও সংস্কৃতির আনুপাতিক উপস্থিতির উপর। এখন কেউ যদি তা না করে গরিষ্ঠ-লঘিষ্ঠ সবার উপর সমান হারে বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা চাপিয়ে দিতে চায়--সে কি গ্রহণযোগ্য হবে? এতে তৈরি হবে অস্থিরতা, অসন্তোষ ও অভ্যন্তরীণ অবিশ্বাস যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হবার পথকে রুদ্ধ করবে। বিতর্কিত বই দু’টি সেদিক থেকে সম্পূর্ণ অন্যায্য। বইয়ের মলাট, ভেতরের উপাদান, উপস্থাপনার ঢং--সবকিছুতে জাতিকে বিভ্রান্ত করার কৌশল নজরে পড়ে। তাই জাতির সচেতন অংশ প্রতিবাদ করে। আমরা এখনও সন্দিহান যে, সরকার কি আসলে তার অভ্যন্তরীণ নীতিকে পরিমার্জিত করার পথ নিচ্ছে না কি আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে জনসমর্থন হারানোকে এড়িয়ে যেতে উক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলেই বৃক্ষের পরিচয় হবে। ভেতরের কথা আমরা জানি না কিন্তু আকাশের মেঘ ও হাওয়া বুঝে অনুমান করা যায়: বই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পেছনে সরকার-প্রধানের হস্তক্ষেপ থাকতে পারে। ব্যাপার যাই হোক, আপাতত এটাকে সরকারের জনগণের অনুভূতি বুঝতে পারার প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা যায়। সন্দেহ নেই, সরকারের ভেতর একটি ক্ষুদ্র ও শক্তিশালী অংশ বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষকরণ বা সেক্যুলারাইজেশন করতে দীর্ঘদিন থেকে সচেষ্ট রয়েছে। এর ফলে বর্তমান সরকারকে জনসাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিশ্বাস ও সংস্কৃতিপ্রশ্নে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখে। মানুষ এ ধরণের চেষ্টাকে ধর্মহীনকরণের চেষ্টা বলে সন্দেহের চোখেও দেখে। বিষয়টি যদি সরকার ভালোয়-ভালোয় বুঝতে পারে তাতেই মঙ্গল। আমরা আশা করবো, সরকার তার ভেতরকার অপশক্তিকে বিদূরিত করে নিজেদের সততার প্রমাণ দেবে। আরেকটা কথা এখানে বল হয়। মানুষের অনুভূতি বিবেচনায় সরকার যে সচেতন পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটা যদি অতীতে প্রদর্শিত হতো তবে ইতিহাসটাও ভিন্ন হতো। ২০১২ সালে কুখ্যাত ব্লগার রাজিব গং যখন চরম ইসরামবিদ্বেষী হয়ে লেখাজোখা শুরু করে সরকার কিন্তু সে সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোভাব বুঝতে পারেনি। ফলে, রাজিবকে সরকারের পক্ষ থেকে “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ” বলে সম্মানিত করা ও তার বাসায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সান্ত্বনা দেয়ার ঘটনায় মুসলিম সমাজ নিজেকে আহত ও অসম্মানিত মনে করে। সেদিন যদি আজকের বই প্রত্যাহারের মতো সচেতনভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভূতিকে অপমান করার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো, তবে শাপলার মতো মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা হতো না।  আশা করি ভবিষ্যতে সরকার সচেতন হবে।

১২.০২.২৩                         

ভাবনা-৯

বাল্যকালে দেখেছি, ফজরের নামাযের পর বাড়ির প্রায় ঘর থেকে পুরুষের উচ্চকণ্ঠে কুরআন পড়ার ধ্বনি শোনা যেতো; মেয়েরা গুনগুনিয়ে পড়তো। ছোটরা চলে যেতো মক্তবে। সে এখন কেবলই স্মৃতি। তখন এতো সচ্ছলতা ছিলো না গ্রামে কিন্তু শান্তি ছিলো। বিশেষ করে পারিবারিক শান্তি; পারস্পারিক সৌহার্দ্য, বোঝাপড়ার মানসিকতা--এসব ছিলো। অশান্তি যে লেশমাত্র ছিলো না তা নয় কিন্তু সে নগণ্য। এখন খুঁজেও কুরআনের আওয়ায শুনতে পাওয়া যায়--এমন দু’একটি ঘর পাওয়া মুশকিল। শহরের অবস্থা তো বলাই বাহুল্য। এমন দেদার বাসাবাড়ি পাওয়া যাবে যেখানকার মুসলিম ছেলেমেয়েরা কুরআন পড়তে জানে না। আর এটাকে খুব দরকারি বলেও মনে করা হয় না। যে মূল্যে জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজনে বাসায় শিক্ষক রাখা হয়, তার সামান্য অংশও কুরআন পড়ানোর হুযুরকে দেয়া হয় না। এর বড়ো কারণ হলো অভিভাবকের অসচেতনতা। ইসলামে মা-বাবার উপর সন্তানের সর্বপ্রথম অধিকার হলো, তার বাবা যেনো একজন সতী-সাধ্বী, ধর্মপরায়ন ও সচেতন মহিলাকে বিয়ে করেন। কারণ, মায়ের কোল থেকেই সন্তান শিক্ষা-গ্রহণ শুরু করে। তাহলে দেখুন, সন্তান জন্মাবার আগেই তার বাবার উপর অধিকার বর্তাচ্ছে। এ অধিকারের কারণেই প্রত্যেক মা-বাবাকে কিয়ামাতের কঠিন দিনে আপন সন্তানের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। পবিত্র হাদীসে এসেছে, অভিযুক্ত সন্তানেরা তাদের পথভ্রষ্টতার জন্য মা-বাবার বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করবে। তাই বলা হয়, সমাজ সংশোধনের পূর্বশর্ত পরিবার সংশোধন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেককে এবং তার পরিবারের সদস্যদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। কথাগুলো হয় আমরা শোনার সুযোগ পাইনি অথবা ভুলেই গেছি। এর ফলে আমরা আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ ও শান্তি হারিয়ে ফেলছি। ক’দিন আগে খবরে দেখলাম দেশে বিশেষ করে ঢাকায় বিবাহবিচ্ছেদের হার অনেক বেড়ে গেছে। কারণ বলা হয়েছে, মূলত পারিবারিক অশান্তি। কেন? আপনি দেখবেন, পারিবারিকভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চার অভাব হলে শান্তি থাকে না। আমি বলছি না যে, শতভাগ শান্তি থাকবে; কিছু তো অস্থিরতা থাকবে সময়ে-সময়ে কিন্তু তা সমাধানের পথও মিলবে। স্থায়ী অশান্তি হবে না আল্লাহর রহমতে। এই যে ধরুন সন্তানকে যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে উৎসাহিত করা হয়, শাসন করা হয়; ফজরের নামাযের পর কুরআন পড়তে উৎসাহিত করা হয়, পড়তে না জানলে শিখানোর ব্যবস্থা করা হয়--তাতে পরিবারে প্রশান্তি আসবে, বোঝাপড়া হবে। পুরুষেরা একটু উচ্চ আওয়াজে আর মেয়েরা নিচুস্বরে তিলাওয়াত করবে। অন্তত কুরআন দিয়ে দিনটা শুরু হোক। দেখবেন আপনার অশান্তি স্থায়ী হবে না ইনশা আল্লাহ। কোন পরিবারে এমন ব্যবস্থা নেয়া হলে দেখা যাবে তাদের গুনাহ’র পরিমান কমে যাচ্ছে, গুনাহনির্ভর কাজের দিকে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এতে গুনাহ হ্রাস পেলে অশান্তিও হ্রাস পাবে। কারণ অশান্তি গুনাহ বা পাপেরই পরিণতি। আসুন আমরা ঘরকে আবাদ করি, কুরআনের ধ্বনি ও নামায দিয়ে ধৌত করি।

১০.০২.২৩  

ভাবনা-৮

আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মানুষ মাঝেমাঝে কওমী মাদরাসাগুলোর সমালোচনা করে বলেন: সেখানে বিজ্ঞান,সমসাময়িক ইতিহাস, প্রচলিত জাগতিক শিক্ষা দেয়া হয় না। তারা আরও বলেন: কওমী মাদরাসার শিক্ষার মাধ্যম মূলত আরবী, ফার্সী ও উর্দূনির্ভর। বাংলা-ইংরেজি সেখানে নেই বললেই চলে। এসব জাগতিক শিক্ষা না থাকার কারণে কওমী মাদরাসার পড়ুয়ারা প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি-বাকরি পান না; এরা বরাবরই সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন এবং তারা বেকারের সংখ্যাই বৃদ্ধি করছে।সমালোচনাকারীরা মাঝেমাঝে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে সাক্ষাৎকার দিয়ে মানুষকে এসব জানান দেয়ার চেষ্টা করেন। এতে কারওকারও মনে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। জানামতে এদের কারোর-ই কওমী মাদরাসা নিয়ে সঠিক পর্যবেক্ষণ নেই। জানা দরকার, ১৮৫৭’র মহান স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যর্থ হবার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় বিধ্বস্ত মুসলিম সমাজের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্ত্বাকে রক্ষা করতে এবং একটি সংগঠিত ও আদর্শনির্ভর প্রজন্ম গড়ে তুলতে ১৮৬৬ সালে ভারতের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসা বা ইসলামী শিক্ষালয়ের যাত্রা শুরু হয় যা বর্তমানে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী য়ুনিভার্সিটি হিসাবে কাজ করছে।বলাবাহুল্য, দেওবন্দের অনুসরণে তখন নিখিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমান পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে দেওবন্দের আদর্শানুসারে প্রচুর মাদরাসা বা ইসলামী শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তেমন ধারায় ১৯০১ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে বিখ্যাত মুঈনুল ইসলাম মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। জানা দরকার, মাদরাসা হিসাবে যাত্রা শুরু হলেও তারাঁ কেবল পুঁথিগত শিক্ষাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকেননি। শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক সংস্কার, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক সচেতনতা ইত্যাদি জায়গায় তাঁরা কাজ করেছেন অবিরত। সেদিনকার সামাজিক বাস্তবতায় অঞ্চলের অধিকাংশ হতদরিদ্র মানুষকে শিক্ষার আহ্বান জানিয়ে তাঁরা নিজনিজ সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি আনুগত্যের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সমাজের দুঃস্থ মানবসন্তানকে বিনে পয়সায় পড়িয়ে, খোরাকী দিয়ে যেভাবে তাঁরা সমাজকে আপন করে নিয়ে ছিলেন তার বিনিময়ে তাঁদের শেকড় পৌঁছে যায় অনেক গভীরে যা তাঁদেরকে এনে দিয়েছে একমাত্র সামাজিক শক্তির উপাধি। এটা কেবল মুখের কথা নয়, সমাজের সাথে যাদের জানাশোনা আছে, তাঁরা বিলক্ষণ বিষয়টি স্বীকার করবেন। প্রশ্ন হলো হলো: সামাজিক বন্ধনে যাঁরা শতশত বছর ধরে আবদ্ধ তাঁরা হঠাৎ করে সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হন কি করে? আমার মনে হয়, যারা এসব বলেন, দেশের সমাজদেহ নিয়ে তাদের জ্ঞান একবারেই সীমিত। কোন প্রকার সরকারী সাহায্য ব্যতিরেকে সমাজের প্রত্যন্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা এসব প্রতিষ্ঠান কি কেবল হাওয়া খেয়েই চলে? তাঁদের প্রাত্যহিক খরচগুলো কোত্থেকে আসে? আসে সমাজ থেকে। সমাজের সদস্যরা এ অর্থ জোগান দেন সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে। প্রশ্ন করতে হয়, যারা রাজধানীতে বসে কওমী আলিম-ছাত্রদের মূলস্রোতবিচ্ছিন্ন বলে অপবাদ দেন তারা কোন সমাজের অংশ? বিজ্ঞান-গণিত ইত্যাদি পড়ানো হয় নাএ অপবাদ অবান্তর। পড়ানো হয় তবে সেসবের উচ্চশিক্ষা নয়, প্রয়োজনমাফিক। কারণ, কওমী মাদরাসা মূলত ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একচ্ছত্র জাগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। যে যুক্তিতে সমালোচকেরা বলেন: কওমী মাদরাসা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হলে জাগতিক উচ্চশিক্ষা দেয়া হয় না কেন, সেখান থেকে ডাক্তার-ইনজিনিয়ার বের হয় না কেনতাঁদের কাছে প্রশ্ন রাখতে হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবার এক-ই যুক্তিতে বলতে হয় মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল কলেজগুলোতে কুরআন-হাদীস-ফিকাহ ইত্যাদি শেখানো হয় না কেন? ওখান থেকে আলিম-ওলামা বের হতে পারে না কেন? আসলে কওমী মাদরাসা একটি বিশেষায়িত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান।এখানকার মূল আদর্শ ইসলাম। দেশের জনগণের টাকা খরচ করে সরকার নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজগুলো তাদের উৎপাদন কতোটুকু সফলভাবে করতে পারছে, তা কারও অজানা নয়। প্রতিকূলে কওমী মাদরাসা সমাজের অর্থ নিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে সম্বল করে সমাজকে যা দিয়ে যাচ্ছে তাও অজানা নয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় ও নৈতিক জগতকে বাঁচিয়ে রেখেছে এসব মাদরাসাওয়ালাই।এরা বেকার তৈরি করে না বরঞ্চ বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে অগণিত মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছেন। এঁরা তো জাতীয় সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

৯.২.২৩  

ভাবনা-৭

একটি জাতি কখন শক্তিশালী হয়? কখন স্বমেরুদণ্ডে দণ্ডায়মান হতে পারে? কখন নিজ শক্তিবলে পররাষ্ট্রের সাথে দর কষাকষি করে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করতে পারে? এর উত্তর একদম সোজা: যে জাতি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন এবং ঐক্যবদ্ধ থাকে। জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলে তার প্রভাবে রাষ্ট্রও শক্তিশালী হয়। মতপথ বাদ দিয়ে য়ুরোপের দেশগুলো বা আমেরিকার কথাই ধরা যাক। কাগজে-কলমে, মাঠে-ময়দানে ওরা বিশ্বদরবারে শক্তিশালী বলে পরিচিত। বিশেষ করে অর্থনীতির অনস্বীকার্য  সাম্রাজ্যে ওদের শক্তিমত্তা ও নিরাপত্তা অনেক নিরাপদ। কারণ, জাতি হিসাবে তারা ঐক্যবদ্ধ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাপ্র্রশ্নে বিভক্তহীন। ওদের স্বার্থ নিয়ে কোন আপোষ করতে চায় না। হাল-আমলের য়ুক্রেন যুদ্ধ তার প্রমাণ। অতীতের ইরাক ও আফগানিস্তান আগ্রাসন পশ্চিমাদের ঐক্যবদ্ধ স্বার্থসচেতনাকে নির্দেশ করে। তারা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বলে কোন চুক্তিতে বা সমঝোতায় নিজেদের অবস্থানকে অধিক নিরাপদ করার দর কষাকষিতে জয়ী হয়। দেখুন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রকৃতির প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল রাষ্ট্রকে অর্থ প্রদানে নানা শর্ত আরোপ করে মাথা ঝুঁকাতে বাধ্য করে। এদের পেছনে আছে শক্তিশালী রাষ্ট্রের হাত। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোও ওদের শর্ত মানতে বাধ্য হয়। শুধু এখানেই নয়, প্রতিরক্ষাতেও ওরা শক্তিশালী। কারণ, স্বার্থপ্রশ্নে ওদের প্রশাসন-জনগণ একাট্টা। ওরা যখন কোন রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসাতে চায়, দলের আদর্শ ও সক্ষমতার দিকটি বিশেষ বিবেচনায় রাখে। ওদের আরেকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। তা হলো, সরকার তাদের কাছে জবাবদিহিতায় আক্ষরিকার্থে দায়বদ্ধ। এর অন্যথা হলে মাঝপথেই গদি হারাতে হয়। ঠিক এক-ই যুক্তিতে আসুন, আমরা জাতি হিসাবে কতোটুকু শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ এবং নিরাপত্তায় সচেতন--তা বিবেচনা করি।  উত্তরপত্র কতোটুকু ইতিবাচক হবে তা আশা করি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। প্রথমত, আমরা জাতি হিসাবে আজ বিভক্ত। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিয়ে জনসাধারণের কতোটুকু সচেতনতা আছে তা বলাবাহুল্য। আমরা যখন কোন দলকে ভোট দেই, দেখি না তার আদর্শ ও সক্ষমতা। মাত্র ক’টি টাকার বিনিময়ে যে জাতি চোখ বন্ধ করে ব্যালটে সীল মারতে পারে তাদের কাছে দলের জবাবদিহিতার প্রশ্ন কতোটুকু ওজন রাখে--তা না বোঝার কারণ নেই। দল আর সরকারও চায় না জনসাধারণ তাদের বিষয়ে সচেতন হোক। কারণ, এতে চোর নির্বিঘ্নে পালানোর পথ খুঁজে পেতে সক্ষম হবে এবং বারবার চুরির মোক্ষম সুযোগে মাল হস্তগত করতে পারবে। জাতির মধ্যে বিভক্তি সবচেয়ে ক্ষতিকর। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোন জাতির বিভক্তিতে বিদেশীশক্তির হাত থাকে। এতে বাইরের নীরব ও সরব উভয় প্রকারের হস্তক্ষেপের জায়গা থাকে।  আর বিভক্তি নিয়ে কোন জাতি স্বমেরুদণ্ডে শক্তবদনে দাঁড়াতে পারে না। আমরা এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে রীতিমতো বিভক্ত-বিধ্বস্ত। এতে বিদেশীশক্তির কতো ধরনের হস্তক্ষেপের শিকারে পরিণত হচ্ছি --সেটা দিবালোকের মতো পরিস্কার। সর্বক্ষণ অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিপক্ষের লালচক্ষুকে গণনায় রাখতে হয় আমাদেরকে। সরকারও চায় না জনগণ মননে-আওয়াজে শক্তিশালী ও সচেতন হোক। কারণ, ছাত্র বেশি মেধাবী ও প্রতিভাবান হলে অনেক শিক্ষক বিরক্ত বোধ করেন। কেননা, সে বেশি জানতে চায়, প্রশ্ন করে, কৈফিয়ত খোঁজে। তাই, সুযোগসন্ধানী সরকার বা দল চায় অসুস্থ জনগণ যেনো সরকারের জন্য বিরক্তিকর হয়ে না দাঁড়ায়। এতে রাজত্ব দীর্ঘকাল হবে। পরিণতিতে জাতি ও রাষ্ট্র স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হারায় এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে যায়।  
০৮.০২.২৩   

ভাবনা-৬

সাম্প্রতিক অতীতে সরকার-প্রধানের সাথে হেফাজতে ইসলামের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের একটি সাক্ষাৎ হয়। খবরে জানা যায়, তাঁরা বন্দী নেতাকর্মীদের মুক্তি চেয়ে এবং কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলেছেন। বিষয়টি নিয়ে একটি পক্ষ মিডিয়াতে প্রশ্ন তুলেছেন: সরকার আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে হেফাজতকে বাগে আনতে চাইছে। আপত্তিকর প্রশ্ন হলো: তাঁদের বক্তব্যানুসারে, হেফাজতে ইসলামের কর্তাব্যক্তিরা সরকারের কাছে মুচলেখা দিয়ে এসেছেন যে, তাঁরা আর কোন রাজনীতি করবেন না বা রাজনৈতিক কোন কর্মসূচী দেবেন না। দলীল হিসাবে প্রশ্নতোলা ব্যক্তিবর্গ বলেছেন, সাক্ষাতের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন, কারাবন্দী নেতাকর্মীদের কেউকেউ মুক্তি পাচ্ছেন। যতোদূর জানি, হেফাজতের পক্ষ থেকে কোন প্রকার মুচলেখা দেয়ার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কেন হেফাজত রাজনীতিতে জড়িত না হবার বিতর্কে বারবার আহত হচ্ছে? হেফাজত তো বরাবরই স্বঘোষিত অরাজনৈতিক সংগঠন। এর কারণ হলো, হেফজতে ইসলাম লিখিতভাবে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন সত্য কিন্তু তাঁদের আলোচিত কিছুকিছু কর্মসূচী রাজনীতি-ঘনিষ্ট বলে বাহ্যত মনে হয়। সাথেসাথে এও বলতে হয়, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ইসলামী ব্যক্তিবর্গ হেফাজতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থেকেছেন। ফলে, হেফাজতে একটি রাজনীতি-অরাজনীতির মিশ্রন ঘটে গেছে। এ মিশ্রনের গতি-প্রকৃতি পরবর্তীতে বিভিন্ন রঙ যেমন পরিগ্রহ করে তেমনি আলোচনা-সমালোচনারও জন্ম দেয়। বলাবাহুল্য, হেফাজতে ইসলামের কর্মকর্তা, কর্মী সবাই কওমী মাদরাসাকেন্দ্রিক। তবে সমাজে শতশত বছর ধরে চলে আসা কওমী আলিম-ছাত্রদের যে সুগভীর শেকড় আর প্রভাব রয়েছে তা চরম বিরোধীরাও অস্বীকার করতে পারবে না। বলা দরকার, হেফাজতে ইসলামে আগে থেকেই রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের পদায়ন করা হয় এই  ‍যুক্তিতে যে, তাঁরা সবাই তো কওমী মাদরাসাকেন্দ্রিক এবং সংগঠনকে এগিয়ে নিতে তাঁদের ভূমিকার বিকল্প নেই। বিষয়টি এখানেই যদি থেমে থাকতো আপত্তি ছিলো না। আপত্তি হলো, হেফাজতে ইসলামের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনেকেই তাদের রাজনৈতিক সত্ত্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ফলে, গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়; বিশেষত সরকার পক্ষ শংকিত হয়ে ওঠে। সরকার মনে করতে থাকে, দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিশেষত বিএনপি ও জামাতে ইসলামী হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচী থেকে ফায়দা লুটতে পারে, এমন কি হেফাজতের রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে সংযোগ স্থাপন করে সরকারের ভাষায় ‘গোলযোগ বা অস্থিরতা’ তেরি করতে পারে। শাপলার ঘটনা থেকে শুরু করে একবারে মুদিবিরোধী বিক্ষোভ পর্যন্ত কর্মসূচীগুলোকে পর্যবেক্ষণে নিলে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচীকে ঘিরে সন্দেহ একবারে অমূলক মনে হবে না। কারণ, যারা প্রথম থেকে হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণ করার সমূহ চেষ্টা করেছেন তাদেরকে দেখা গেছে কখনও সরকার পতনের ঘোষণা দিতে, কখনও বঙ্গভবনে আপ্যায়িত হতে। সুতরাং হেফাজতে ইসলাম নিয়ে বিতর্ক কখনও মৃতরূপ ধারণ করেনি। বলতে হয়, হেফাজতে ইসলামের মৌলিক দুর্বলতা হলো, আজ পর্যন্ত তাঁরা কোন গঠনতন্ত্র তৈরি করতে পারেনি যা দিয়ে সংগঠনকে আপাদমস্তক নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এরপর সংগঠনে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সংশ্লিষ্টতা নয় পদায়ন করা ছিলো মস্তবড় ঝুঁকিপূর্ণ যা বারবার বিপদের কারণ হয়েছে। বলাবাহুল্য, হেফাজতের একটি কাউন্সিলও নিয়মতান্ত্রিক ও সংবিধানভিত্তিক হতে পারেনি। এর জন্য পূর্বাপর দায়িত্বশীলরা দায় এড়াতে পারেন না। আজ যা হচ্ছে বা হয়েছে, সেসবের ফলে যে সমূহক্ষতি আমাদের কওমী আলিম-ছাত্রদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তা কখনও মুছে যাবার নয়। যদি হেফাজত তার স্বঘোষিত নীতিকে কর্মে দেখাতে পারতো তবে আজ মুচলেখা দেবার প্রচারিত অপবাদে জর্জরিত হতে হতো না।
০৭.০২.২৩  


ভাবনা-৫

অধুনা বাংলাদেশের নতুন পাঠ্যক্রমে সংযোজিত বিতর্কিত বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা উঠেছে ঢের। সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে কথা উঠছে প্রচুর। সমাজের একেবারে নিম্নস্তরের চায়ের দোকানের টকশো থেকে প্রচারমাধ্যমের টকশো পর্যন্ত কোথাও বাদ নেই। ইতিহাসের নিরিখে, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে সংযোজিত বিষয় নিয়ে বিতর্ক আর সরকারের সমালোচনা আসমান ছুঁবে মনে হয়। আপাতত ইতিহাসের পাঠ সরিয়ে রেখে বিতর্কিত ‘বিবর্তনবাদ’ নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। প্রথমত দেখা যাচ্ছে, লেখা বা সম্পাদনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের ভূমিকা এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া রহস্যজনক। মনে হচ্ছে, কোথাও আড়ালে কোন খেলা হচ্ছে। সরকারের শিক্ষামন্ত্রী বললেন: যাদেরকে বই তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তারা সরকারের সুপারিশকে পাত্তা দেননি; সঙ্গতকারণে এমন পরিবেশনা। সম্পাদকেরা ক্ষমা না চেয়ে গাবাঁচানো দুঃখ জানিয়ে কাজ সেরেছেন। এখনও সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে সঙ্গীন বিবেচনা করে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বিবর্তনবাদ ডারউইনের অত্যন্ত বিতর্কিত ও অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক একটি উদ্ভাবন। বিজ্ঞানের সাথে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। এ তত্ত্বের মূলকথা হলো, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ বানরেরই পরবর্তী প্রজন্ম; বর্তমানের মানুষ আদিযুগের কোন মানব বা মানবগোষ্ঠীর পরপ্রজন্ম নয়। এ নিয়ে অনেক গোলমাল হয়েছে অতীতে। যাক, সেদিকে না গিয়ে প্রশ্ন করা যায়, হঠাৎ করে আমাদের সন্তানদের পাঠ্যবইয়ে এ বিবর্তনবাদ ঢোকানো হলো কেন?  এর কারণ, গোটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেই একটি বিবর্তনবাদের মধ্য দিয়ে একটি বিতর্কিত গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। বলাবাহল্য, বাংলাদশের মানুষের নব্বই শতাংশ বিশ্বাসগতভাবে মুসলমান। সঙ্গতকারণে তাঁরা বিশ্বাস করে: মানুষ পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম আ.-র পর্যায়ক্রমিক সন্তান। পবিত্র কুরআন এ বিষয়ে বিশদ বিবরণ দিয়েছে। শুধু মুসলিম বলে নয়, দুনিয়ার হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদী কেউ বলে না: মানুষ বানর বা অন্য কোন পশুর পরপ্রজন্ম। যা বলছিলাম, পাঠ্যবইয়ে বিবর্তনবাদ ঢুকিয়ে বাংলাদেশের উপর একটি রাষ্ট্রীয় বিবর্তনের ধারা প্রয়োগের চেষ্টা হচ্ছে। চেষ্টাটা নতুন নয়, স্বাধীনতার পর থেকে যখন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে তথাকথিত সেক্যুলার বা ধর্মহীন করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয় তখন থেকে। যেখানে নব্বই শতাংশ মানুষ একটি বিশেষ বিশ্বাসনির্ভর দর্শনকে বহন করে সেখানে সে জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রভাব অধিকতর দৃশ্যমান হবে--সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু একটি নেতিবাচকমহল যারা নিজেদেরকে সেক্যুলার বলে দাবি করে, নিরলস চেষ্টায় ব্যাপৃত যেন সেই সংখ্যাগরিষ্ঠের আবহকে ধীরে চলমান একটি বিবর্তনবাদের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন করে শিশু-তরুণ-যুবক প্রজন্মকে এমন এক স্তরে নিয়ে আসা যায়, যেখানে ওদের বিশ্বাস হবে সংশয়পূর্ণ ও বিতর্কিত। তখন তারা নিজেদের মানব-সন্তানের পরিচয় হারিয়ে পশু-সন্তানের পরিচয়ে বড় হবে এবং ধীরেধীরে বিশ্বাসহীন একটি গোষ্ঠীতে পরিবর্তিত হয়ে পশুর মতো আচরণে অভ্যস্ত হতে চাইবে। এটা সেই গন্তব্য যাকে সেক্যুলারাইজেশন বা ধর্মরিপেক্ষকরণ নামে এখন প্রচার চালানো হচ্ছে। একটি গোষ্ঠী দীর্ঘদিন থেকে এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, তদবির করছে। ভূলবশত বা অসাবধানতাবশত পাঠ্যসূচীতে বিবর্তনবাদ ঢুকে গেছে--এমন সরলীকরণের কোন সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, ছিদ্র ছোট থাকতে বন্ধ করতে না পারলে সেখান দিয়ে এসসময় হাতি প্রবেশ করবে। শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড বলে স্বীকৃত। এখন সে শিক্ষাকে যদি একটি বিশেষমহলের লালসা পূরণের হাতিয়ার করে দেয়া হয় তা হবে জাতি ও মুসলমানদের জন্য বড় বিপদের কারণ।

০৬.০২.২৩    


ভাবনা-৪

‘উগ্রপন্থা’ বলে একটি কথা আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। এর উল্টোশব্দ বা বিপরীত শব্দ বলে বুঝি--উদারপন্থা। হতে পারে। কিন্তু উদারপন্থা উগ্রপন্থার উল্টোশব্দ হতে পারে, প্রতিষেধক নয়। প্রতিষেধক হলো: মধ্যপন্থা। কথাটি বলছিলাম, আমাদের সমস্যা বোঝাতে। তবে উগ্রপন্থা আর চরমপন্থার মধ্যে আমার কাছে ভিন্নতা আছে মনে হয়। উগ্রপন্থার মাঝে যেমন সবসময় উগ্রতা থাকে তেমনি চরমপন্থার মধ্যে চরম বা চূড়ান্ত হবার পরিণতি বিদ্যমান থাকে। সেদিক থেকে উগ্রপন্থার মধ্যে উগ্রতা বা বাড়াবাড়ি থাকা স্বাভাবিক যা কোনভাবেই গ্রাহ্য নয়। চরমপন্থা তেমন নয়। মানুষ যখন তার কাম্য কোন গন্তব্য অর্জনের জন্য একের পর এক প্রতিকূল পরিস্থিতি মুকাবিলা করতে থাকে শেষচেষ্টা হিসাবে চরমপন্থাকে গ্রহণ করে থাকে। তাই ব্যাখ্যানির্বিশেষে কারও কাছে চরমপন্থা ইতিবাচক, কারও কাছে নেতিবাচক। রোগ থেকে বাঁচার চেষ্টায় একের পর এক অষুধে কাজ না হলে যেতে হয় অপারেশান বা অস্ত্রোপচারে। এটা অবশ্যই চরমপন্থা কিন্তু উগ্রপন্থা নয়। এখানে বাড়াবাড়ি নেই। তেমনি একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উগ্রপন্থা নয়, চরমপন্থা। তাই মুক্তিযুদ্ধকে একটি চরমপন্থী আন্দোলন বললে ভুল হবার কথা নয়। অবশ্য বৃটিশ-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তৎকালীন বাংলায় অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তরের মতো যেসব ‘চরমপন্থী’ দলের কথা উল্লেখ আছে সেগুলোর চরিত্র সর্বাংশে চরম ছিলো না; সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্বনির্ভর ও উগ্রবাদীও ছিলো। আজকে যেমন ভারতের আরএসএস, বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইত্যাদি উগ্রপন্থাকে অনুসরণ করে। ইংরেজিতে কিন্তু চরমপন্থা আর উগ্রপন্থা--উভয়কে Extremism বলে ডাকা হয়। এটা কোনভাবেই সমীচীন নয়। উগ্রপন্থা আর বাড়াবাড়ি অভিন্ন, চরমপন্থার চরিত্র ব্যাখ্যনির্ভর। আমাদের মাঝেও ক্ষেত্রবিশেষে উগ্রপন্থা দেখা দেয় যা আমাদের সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য কখনও হিতকর প্রমাণিত হয়নি। বরঞ্চ ক্ষতি করেছে অপূরণীয়। এর মূল কারণ হলো: আমাদের চিন্তার ক্ষুদ্রতা এবং উগ্রতা, চরমপন্থা ও কালের ভিত্তিতে কর্তব্যের আহ্বানকে উপলব্ধি করার ব্যর্থতা। পরিবেশকে সঙ্গী না করে আমরা যে ব্যাখ্যা দাঁড় করাই সেটাকে মুশাওয়ারা বা উদার পরামর্শের ভিত্তিতে সজ্জিত না করে একদর্শী পথ চললে উগ্রপন্থার খপ্পরে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।  আগেই বলেছি, উগ্রপন্থার প্রতিষেধক মধ্যপন্থা যাকে কুরআনের ভাষায় বলা হয়--“সিরাতুল মুস্তাকীম” অর্থাৎ, অকঠিন, অজটিল ও সহজ-সরল পথ। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এই সহজ-সরল পথকেই চিনতে আমাদের জটিলতা অত্যধিক যা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক। সঙ্গতকারণে, আমাদের বিপদ সবসময় সীমার উপরে দৃশ্যমান হয়। আমাদের রাষ্ট্রচরিত্র, রাজনীতি, ধর্মচর্চা সর্বক্ষেত্র আজ উগ্রপন্থার ভয়াল থাবার মুখোমুখী। এর একমাত্র প্রতিষেধক অবশ্যই মধ্যপন্থা এবং মধ্যপন্থা।

০৫.০২.২০২৩


ভাবনা-৩

দেশে কোথাও কোথাও স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে। আমাদের এলাকাতেও নিকট-ভবিষ্যতে হতে যাচ্ছে পৌরসভা নির্বাচন। ইতোমধ্যে প্রার্থীদের জনসংযোগের কসরত শুরু হয়ে গেছে। গেলোবারের নির্বাচিত প্রার্থীরাও নিখোঁজ অবস্থা থেকে বেরিয়ে শুরু করছেন লাইসেন্স নবায়নের কাজ। নতুনরাও নেমেছেন মাঠে। কিন্তু প্রশ্ন: নির্বাচন কি আদৌ হবে, না কি নির্বাচনের নামে উপরের নির্দেশে বাছাই হবে, না কি ১৪, ১৮’র মডেলের নাটক প্রদর্শিত হবে? তৃণমূলে-জনমানুষ কী ভাবছে? আমরা কি জানি? আগের নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে মানুষের ভাবনার ছবি ইতিবাচক নয়। হাটে-মাঠে-ঘাটে মানুষের ভাবনা থেকে উঠে আসে ন্যায্য হতাশার করুণ ছবি। দৈনন্দিন মুখোমুখি হওয়া সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া জানলে আসন্ন নির্বাচনের সম্ভাব্য চিত্র নিয়ে আশার কিছু আছে বলে মনে হয় না। কর্তাব্যক্তিরা যতোই আশ্বাস দিক, মানুষ সেটা বিশ্বাস করে না। কারণ, অতীতে মানুষ মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস করে কি নিদারুণভাবে প্রতারিত হয়েছে--সে স্মৃতি ভুলে যাবার নয়। তবুও মানুষ নির্বাচন এলে কৌতুহলী হয়, মনের এককোণে পড়ে থাকা সংশয়কে সঙ্গী করে আশাবাদী হতে চায়। চায়ের দোকানে, বাজারে-সাজারে কিছু কথা পেড়ে. তর্কবিতর্ক করে মনের ঝাল মেটাতে চায় নির্বাচনোৎসাহী জনতা। তাঁদের এ তৎপরতায় যে সরলতার দাগ লেগে থাকে সেসব কি কখনও মূল্য পায় প্রশাসনের কাছে? তৃণমূলের মানুষের এখন একটাই হতাশা: ইলেকশন তো আগেই হয়ে যাবে, ভোট দিয়ে কী লাভ? এর দায় সরকারের-প্রশাসনের। ব্যক্তিগতভাবে আমিও ভাবছি ভোট দেবো কি না। আগে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির সুযোগ ছিলো কম। এখন তো সেখানেও রাজনীতির ভয়াল থাবা বিরাজমান। জাতীয় নির্বাচনের ভালোমন্দকে পেছেনে ফেলে মানুষ স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে মেতে উঠতো। বলতে গেলে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় নির্বাচনের সাথে সাধারণ মানুষের আত্মীয়তা ছিলো ঢের বেশি। কারণ, জাতীয় জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকে মানুষ কাছে পেতো। এখন রাজনীতি ঢোকার পর থেকে সে সুরতও উধাও। দেখা গেলো, মানুষ ক্রমেই তার নির্বাচনের স্বাধীনতা হারাচ্ছে। এখান থেকেই আজ মানুষ নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সরকারদলীয়রা যখন প্রকাশ্যে বলেন, ভোট যাকেই দিবেন আওয়ামী লীগই পাবে তখন কি মানুষ ক্ষুধা নিয়েও খেতে চাইবে? কথায় নয়, কাজে প্রমাণ দিতে হবে: মানুষের ভোটাধিকার ধর্ষিত হবে না। কিন্তু মানুষকে সে বিশ্বাস যোগাবে কে, যে তাঁর ভোটাধিকার আত্মসাৎ করা হবে না? নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও মানুষের দ্বারে যাবার তাগিদ অনুভব করেন না। কারণ, সিলেকশন।


ভাবনা-২

প্রচলিত ‘রাজনীতি’ আসলে কি? এক সময় রাজনীতি ছিলো দেশ আর মানুষ-সেবার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। দেশের স্বার্থ রক্ষায়, নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা তৃণমূল পর্যায়ে পৌছে দেয়ার সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিবর্গই রাজনীতি করতেন। তাঁরা রাজনীতি করতেন আত্মসাতের প্রত্যয়ে নয়, সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মহৎ নিয়তে। তাই তাঁরা ছিলেন বরাবরই সম্মানীত, বরণীয়; আজও আছেন। সেদিক থেকে বাংলার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ মজলুম জননেতা মরহুম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। নিজের খাদ্য পাকাতে মাটির চুলোয় আগুন জ্বালাতে দেখা গেছে--এমন কেউ কি আছেন ভাসানী বিনে? খদ্দরের পান্জাবী, তালপাতার টুপি আর লুঙ্গী পরে অতিসাধারণ বেশভুষায় রাজনীতি আর আন্দোলনের মাঠে তিনি ছিলেন মহানায়ক। কেউ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। আজ ভাসানী যেমন নেই, ভাসানীর রাজনীতিও নেই। এখন রাজনীতি মানে ব্যবসা, প্রতারণা আর নিজের পকেটে মিলিয়ন-বিলিয়ন টাকার বন্দোবস্ত করা। এক সময় দেখতাম, সমাজের সৎ আর নির্ভীক মানুষগুলো পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্ন দেখতেন সমাজসেবার মানসে। এখন দু’নম্বরী ব্যবসায়ীরা পত্রিকার মালিক। নিজেদের অপরাধ ঢাকতে আর বিশেষগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় প্রকাশিত হয় পত্রিকাগুলো। অতীত সময়ে রাজনীতিক আর পত্রিকার প্রকাশক-সম্পাদকেরা সমাজে যে সম্মান পেতেন, এখন তা স্বপ্নের দেশে। আজ যত্রতত্র দেখা যায়, শোনা যায় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হবার বীভৎস চিত্র, বিদেশে বিশাল অর্থ পাচারের কুৎসিৎ সংবাদ। এ সম্পদ আর টাকার মালিক কে বা কারা? সবাই তা জানে। আসল মালিক যাঁরা, মানে জনগণ কখনও সে সম্পদ ভোগ করতে পারে না। জনমানুষ রাষ্ট্রশক্তির সহায়তা পায় না। তাই তাঁরা বঞ্চিত, নিপীড়িত। জনগণের ক’জন সন্তান দেশে লেখাপড়া করে জানেন? সবাই বিদেশের নামিদামি শিক্ষালয়ে। এরাই দেশে এসে নেতৃত্ব দেয়, বিশাল সম্পদের মালিক হয়। তাহলে সর্বসাধারণের জন্য জায়গা থাকলো আর কি? কেবল কেরানিগিরীর চেয়ার? মোট কথা, রাজনীতি এখন উর্বর ব্যবসা যার কোন জবাবদিহিতা নেই। কারণ, জবাবদিহিতা তো এখন অগ্রহণীয়। সরকারের মন্ত্রী যখন কর্মচারীদের বলতে পারেন: ঘুষ খান তো সহনীয় করে খান; তখন কি কিছু বোঝার বাকি থাকে?

ভাবনা-১

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম। 

ভাবতে পারাটাই একটা ভীষণ রকমের যোগ্যতা মনে হয় আমার কাছে। ব্যক্তিবিশেষে অবশ্য ভাবার চিত্র আর চরিত্র একরকম হয় না। তাই আমি ভাবছি আমার মতো করে। আমার চার পাশে--যা পরিবেশ নামে পরিচিত, তার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারার মধ্যে একটি আনন্দ আর সফলতা আছে বৈ কি। ইসলামী আইন বিশারদগণ যাঁদের পারিভাষিক পরিচয়: ফকীহ, বলেন, আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে যারা অজ্ঞ তারা মূর্খ। তাই পরিবেশ সম্পর্কে দূরে থাকার ভয় তো আছেই। আবার অতি পরিবেশময় হয়ে যাওয়ার বিপদও কম নয়। যেমন, ভাসার জন্য নৌকার পানির প্রয়োজন অনস্বীকার্য তেমনি ভেতরে পানির প্রবেশও আত্মঘাতী। বলছিলাম, ভাবার কথা। হ্যা, ভাবতে গেলে ভাবের সাথে ভাব করতে হয়। সীমান্তে যেমন দ্রব্য পারাপারের জন্য ওপাশের কারও সাথে সখ্যতা গড়তে হয়, তেমন আর কি। দৃষ্টি, শ্রবণ, স্পর্শ আমাদের ভাবের প্রথম দ্বার। ওখান দিয়ে যে বার্তা এসে অন্তরকে আলিঙ্গন করে সেটা মগজের ছোঁয়ায় ভাবের জন্ম দেয়। মানুষ চিন্তার খোরাক পেয়ে চিন্তায় মগ্ন হয়। এখান থেকে পথ চলে যায় সড়ক-মহাসড়কের দিকে; তারপর সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে অসীমের খোঁজে। কুরআন যখন বলে: তুমি কি মরুর উট দেখোনি? কেমন করে তার অসাধারণ দেহাকৃতি এলো, তা কি তুমি ভেবো দেখোনি? সুবিস্তৃত আকাশ কি তোমাকে ভাবায় না? উর্ধ্বশিরের প্রশস্ত পর্বতশৃঙ্গ কি তোমার অন্তরে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে না? তখন কেন তুমি সড়ক-মহাসড়ক ধরে, সাগর-মাহাসাগর পেরিয়ে অসীমের পথে ধাবিত হও না? কেন তোমার চিত্ত মগজের অলিগলিতে হেঁটে বেড়াতে চায় না?  যে ভাবে না, তার আশপাশের যা কিছু নিয়ে--সে প্রাণী হতে পারে, মগজসমৃদ্ধ মানুষ হতে পারে না।

০১.০২.২০২৩





কোন মন্তব্য নেই:

Featured Post

জামায়াতে ইসলামীর সাথে কওমীদের ঐক্য কি আদৌ সম্ভব ? ভাবনা-৫০ বাংলাদেশে ইসলাপন্থীদের ঐক্য নিয়ে আলোচনার হায়াত অনেক দীর্ঘ । এক সময় ঐক্যের শে...