আমীরে শরীয়াত মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযুর রহ.-র সুপারিশ ও দোয়ায় শাইখুল ইসলাম হযরত তাকী উসমানী দা.বা. যেভাবে পাকিস্তানের শরীয়া আদালতের বিচারক হয়েছিলেন:
আমীরে শরীয়াত মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযুর রহ.-র অমূল্য উপদেশ:
আমরা যাঁদের হারালাম; তাঁদের মহান স্মৃতিকে সামনে রেখে আল্লাহ’র কাছে তাঁদের মাগফিরাত কামনা করছি। আমীন। শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা গাজী সাহেব হুযুর রহ. ও প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী রহ.-র মহান স্মৃতি।
মক্কা-মদিনায় সমাহিত ভারতবর্ষের মুসলিম মনীষীরা
জাওয়াদ তাহের
০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
মক্কা-মদিনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভূমি। প্রত্যেক মুমিন মক্কা-মদিনা জিয়ারতের স্বপ্ন দেখে। আল্লাহর কাছে পবিত্র মক্কা ও সোনার মদিনার রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। হাদিসে এই পুণ্যভূমির অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। সেখানে যারা অবস্থান করে, তাদেরও রয়েছে বিশেষ সম্মান। যে জমিনে রাসুল (সা.) হেঁটেছেন, সে জমিনে যারা বসবাস করে, সেখানে যারা মৃত্যুবরণ করে, তাদের ব্যাপারে বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এজন্য ওমর (রা.) রাসুল (সা.)-এর শহরে নিজের মৃত্যু আসার কামনা করতেন। জায়দ ইবনে আসলাম (রহ.) থেকে বর্ণিত, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলতেন, হে আল্লাহ! তোমার কাছে আমি প্রার্থনা করি, যেন তোমার রাহে শাহাদত করতে পারি। আর তোমার রাসুলের এই নগরে (মদিনা শরিফে) আমি মৃত্যু বরণ করি। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদিস : ৯৮৪)
আল্লাহ তাআলা তাঁর এই দোয়া কবুল করেছিলেন। শহীদও হয়েছেন, আর মদিনা শরিফেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় অনেক সৌভাগ্যবান ব্যক্তি পাওয়া যায়, যাঁরা মক্কা-মদিনায় মৃত্যুর আশায় রাসুল (সা.)-এর শহরে হিজরত করেছেন। ভারতবর্ষের এমন অনেক ব্যক্তি, কীর্তিমান মহান পুরুষ হিজরত করেছেন। নিম্নে আমরা তাঁদের কয়েকজনকে নিয়ে আলোচনা করব।
মাওলানা রহমতুল্লাহ কিরানভি (রহ.)
মাওলানা রহমতুল্লাহ কিরানভি। ভারতের উত্তর প্রদেশ অন্তর্গত কিরানায় ১৮১৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সময়ের সেরা তার্কিক ব্যক্তি ছিলেন তিনি। খ্রিস্ট ধর্মের পাদ্রিদের সঙ্গে তিনি একাধিকবার মুনাজারা করেন। প্রতিবারই বাতিলকে পরাস্ত করেন। ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ে তাঁর পড়াশোনা ছিল বিস্তৃত ও ঈর্ষণীয়। ভারতে তিনি ছিলেন খ্রিস্ট ধর্মের বিকৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। এ ব্যাপারে তিনি তিন খণ্ডের কিতাব লেখেন ‘ইজহারুল হক’ নামে। খ্রিস্টানরা মুনাজারায় (বিতর্ক অনুষ্ঠান) পরাস্ত হয়ে, এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। সেজন্য মাওলানা রহমতুল্লাহ কিরানভিকে হত্যা করার হুমকি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানা রহমতুল্লাহ কিরানভি মক্কায় হিজরত করেন। সেখানে গিয়ে তিনি ‘আস-সাওলাতিয়া’ নামের একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজ অবধি চলমান। ১৮৯১ সালে তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। ‘জান্নাতুল মুআল্লা’য় উম্মুল মুুমিনিন খাদিজা (রা.)-কে যেখানে দাফন করা হয়েছে, সেখানেই তিনি সমাধিস্থ হয়েছেন।
হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি (রহ.)
কঠিন সংকটময় এক মুহূর্তে ভারতবর্ষের মুসলমানদের আশার আলো হয়ে উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার অন্তর্গত ‘নানুতা’ নামক প্রত্যন্ত একটি গ্রামে ১৮১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি (রহ.)। তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ে উলামাদের আধ্যাত্মিক রাহবার। আলেম-উলামাদের অভিভাবক ও আধ্যাত্মিক রাহবার হওয়ার কারণে তাঁকে ‘সাইয়্যিদুত তা-ইফাহ’ তথা আলেমকুল শিরোমণি উপাধিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কীর্তিমান এই মনীষীর জীবনে জড়িয়ে আছে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য। তাঁর অসামান্য অবদানে ভারতবর্ষে ইসলামী আন্দোলনের জোয়ার ওঠে। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে ইলমে ওহির আঁতুড়ঘর দারুল উলুম দেওবন্দের উপদেষ্টা। ইংরেজদের বিতাড়িত করার অগ্র সেনানী ছিলেন তিনি। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তিনি সেই পরোয়ানা কাঁধে নিয়ে অনেক কষ্টে মক্কায় হিজরত করেন। বাকি জীবন তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। ১৮ অক্টোবর ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে রোজ বুধবার ফজরের সময় আপন রবের ডাকে সাড়া দেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর তিন মাস ২০ দিন। মক্কা মুকাররমার জান্নাতুল মুআল্লায় ‘মাদরাসায়ে সাওলাতিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা রহমতুল্লাহ কিরানভি (রহ.)-এর সমাধির পাশে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
খলিল আহমদ সাহরানপুরি (রহ.)
মাওলানা খলিল আহমদ সাহরানপুরি। এক শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। হাদিসের জগতে তাঁর অসামান্য অবদানে যুগ যুগ ধরে বেঁচে আছেন মানুষের মণিকোঠায়। ছোট বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও অনন্যতার বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছিল। সমকালীন আলেমদের থেকে ইলম অর্জন করার পর তিনি আধ্যাত্মিকতার সম্পর্ক গড়ে তোলেন যুগ শ্রেষ্ঠ ফকিহ, মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহির সঙ্গে। ইলমের গভীর জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন তিনি, বিশেষ করে হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রে। তাঁর কালজয়ী ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘বজলুল মাজহুদ’। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। ১৮৫২ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে সাহরানপুর জেলা নানুতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জীবনের শেষ সময়ে তিনি রাসুলের শহর মদিনায় হিজরত করেন। সেখানে প্রায় দেড় বছর অবস্থান করার পর ১৩ অক্টোবর ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান। মদিনা মুনাওয়ারায় ‘জান্নাতুল বাকি’তে তাঁকে দাফন করা হয়।
শাইখুল হাদিস জাকারিয়া কান্ধলভি (রহ.)
যেসব মানুষকে নিয়ে যুগ গর্ব করে, যাঁদের অস্তিত্ব পৃথিবীকে সুন্দর করে, জাকারিয়া কান্ধলভি (রহ.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম একজন। তাঁর পুরো জীবনটাই ছিল ঈর্ষণীয়। পুরো জীবনে তাঁর বিন্দুমাত্র সময় অহেতুক নষ্ট হয়নি। ইবাদত, শেখা-শেখানো, জিকির, শিক্ষকতা, আধ্যাত্মিকতা আর মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন নিজের পুরো জীবন। এলেম অর্জনের জন্য তাঁর মতো কষ্টসাধ্য খুব কম মানুষই করেছেন। এলেমের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, নিমগ্নতা আর একাগ্রতার কারণে আল্লাহ তাআলা তাঁকে এই স্তরে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি তাঁর জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করেছেন স্বহস্তে লিখিত ‘আপ বিতি’ কিতাবে। তিনি তাঁর পুরো জীবন বিনা পয়সায় একমাত্র আল্লাহর জন্য পাঠ দান করেছেন। তৎকালীন সময়ে উলামায়ে কেরামের মধ্যমণি ছিলেন তিনি। তিনি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি শাইখুল হাদিস উপাধিতে উপমহাদেশে খ্যাতি লাভ করেন। আরবি, উর্দু, ফারসি—তিন ভাষায় সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন। সব ভাষায়ই তাঁর আছে প্রশংসাযোগ্য রচনাবলি। ২ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮ সালে উত্তর প্রদেশের কান্ধেলা জেলায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শেষ বয়সে তিনিও মদিনায় হিজরত করে চলে যান। ২৮ মে ১৯৮২ সালে রাসুলের শহর মদিনা মনোয়ারায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর প্রিয় ওস্তাদ, মাওলানা খলিল আহমদ সাহরানপুরি (রহ.)-এর পাশে ‘জান্নাতুল বাকি’তে তাঁকে দাফন করা হয়।
আশেক এলাহি বুলন্দশহরি (রহ.)
মাওলানা আশেক ইলাহি বুলন্দশহরি (রহ.) মুহাজিরে মাদানি ছিলেন একজন ভারতীয় ইসলামী পণ্ডিত। ১৯২৫ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে বুলন্দশহর জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। শিক্ষাজীবন সমাপন করার পর কয়েক বছর নিজ দেশেই কর্মরত ছিলেন। পরে মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.)-এর অনুরোধে তিনি দারুল উলুম করাচিতে যান। সেখানে বেশ কয়েক বছর হাদিস ও তাফসির পড়ান। তিনি সেখানে ফতোয়া বিভাগের (দারুল ইফতা) দায়িত্বও গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত মুফতি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি মুহাম্মদ জাকারিয়া কান্ধলভি (রহ.)-এর শিষ্য ছিলেন এবং বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ ‘আনওয়ারুল বয়ান’ রচনা করেন। পরে তিনি মদিনায় চলে যান, সেখানে তিনি তাঁর জীবনের ২৫ বছর অতিবাহিত করেন। মদিনায় তিনি ২০০২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ‘জান্নাতুল বাকি’তে এই মনীষীকে দাফন করা হয়।
তথ্যঋণ : নুজহাতুল খাওয়াতির, মুকাদ্দিমায়ে বাজলুল মাজহুদ, ইজহারুল হক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন