জামায়াতে ইসলামীর সাথে কওমীদের ঐক্য কি আদৌ সম্ভব?
বাংলাদেশে ইসলাপন্থীদের ঐক্য নিয়ে আলোচনার হায়াত অনেক দীর্ঘ। এক সময় ঐক্যের শেকল-সূরাত নিয়ে বিস্তর বাহাস হতো। কারণ, যাদের নিয়ে ঐক্যের ডাক দেয়া হয় তাদের মতান্তরের ক্ষেত্র ছিলো বিষমবাহু দ্বারা বেষ্টিত। ফলে আলোচনার মৃত্যু না হলেও সবল হতে পারেনি। ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফতে রাব্বানী, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (ইডিপি) ও ইমারত পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ সংক্ষেপে আইডিএল। এই ঐক্যবদ্ধ দলের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ ও ভাইস চেয়ারম্যান মাও. মুহাম্মদ আবদুর রহীম। আইডিএল ১৯৭৯ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ২০টি আসনে জয়লাভ করে যার মধ্যে জামায়াত পায় ৬টি আসন। এ সময় মাওলানা আব্দুর রহীমের নেতৃত্বে পার্লামেন্ট অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে আইডিএল। ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এ জোট স্থায়ী ছিলো। পরে জামায়াতের কৌশলগত রাজনীতিসৃষ্ট মতভিন্নতার কারণে জোট ভেঙ্গে যায়। বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের একটি বৃহৎ বলয় হলো কওমী-জগৎ। কওমী মাদরাসাভিত্তিক আলিম-উলামা নিয়ে কওমী-জগতের অস্তিত্ব। কওমীরা পরিচয়ের দিক থেকে ঐতিহ্যগত ইসলামের ধারক ও বাহক। কথিত ‘মডারেট ইসলামে’র ধারণাকে তাঁরা স্বীকার করেন না। তাঁদের কাছে সেটা আপোষকামীতা বা বিকৃতকরণের আধুনিক প্রকাশ। তাই তাঁদের সাথে অন্য দলের ঐক্যপ্রশ্নে সরলরেখা প্রলম্বিত হয় না। এখানে আরও একটি বিষয় ধর্তব্য। তা হলো, কওমী-জগতের কাছে বিশ্বাসগত বা ইসলামের মৌলিক শর্তসমূহের নিরাপত্তা অগ্রাধিকার বলে বিবেচিত। যেসব ঐক্য তাঁদের কাছে সন্দেহজনক বা ইসলামের মৌলিক শর্তসমূহকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয় না বলে সন্দিগ্ধ হয়, সেখানে কওমীদের উপস্থিতি থাকে না বা সাময়িককাল পরে সরে যায়। অনেকে তাঁদেরকে দুনিয়াবিচ্ছিন্ন একটি গোষ্ঠী বলে বিবেচনা করতো কিছুদিন আগেও। কওমীদের সম্পর্কে সাধারণের একটি বৃহদাংশের ধারণা ছিলো: তাঁরা মেধাহীন, দরিদ্র জনগোষ্ঠী থেকে উদ্গত। বিজ্ঞান ও রাজনীতি তাঁদের কাছে সদূর প্রবাসী। কিন্তু কালের উত্তরণে সে ধ্যানধারণা এখন কেবল ইতিহাস। এখনকার কওমী-প্রজন্ম সবকিছুকে জানতে চায়; বুঝতে চায়। উদারনৈতিক চিন্তার উম্মেষ ঘটেছে বলা যায়। এখানে এক সন্ধিক্ষণের ধ্বনি শোনা যায় যা কওমীদেরকে বাস্তবতার উপলব্ধি ও ঐতিহ্যের দ্বন্দ্বকে তুলামূলক ধারণার ভিত্তিতে পা ফেলার পথ দেখায়। তবুও তাঁরা কথিত মডারেট ইসলামকে মানতে অনিচ্ছুক। এর বড় কারণ তাঁদের সনাতনী সতর্কতা।
৮০’র দশক থেকে যখন এ দেশের কওমীরা রাজনীতি সচেতন হওয়া শুরু করলো, নির্বাচনে দাঁড়ানোর সাহস সঞ্চয় করলো—সেদিন থেকে কওমী আলিম-উলামা সম্পর্কে সাধারণের ধারণা বদলাতে শুরু করে। আমীরে শরীয়াত মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযুর রহ. কর্তৃক গঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের কথা নবপ্রজন্ম না জানলেও ইতিহাসে তা রক্ষিত আছে। আমার এখনও মনে আছে, হাফেজ্জী হুযুর যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়ান অনেকেই কটাক্ষের তীর ছুঁড়েছিলেন। ১৯৮১ ও ১৯৮৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাফেজ্জী হুযুরের যথাক্রমে তৃতীয় ও দ্বিতীয় স্থান লাভ কওমীদের মাঝে নতুন রাজনীতিক চেতনার উম্মেষ ঘটায়। সে সময় এমন ধারণা বহুল পরিচিতি পেয়েছিলো যে, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে প্রকৃতপক্ষে হাফেজ্জী হুযুর রহ. প্রথম হয়েছিলেন কিন্তু জেনারেল এরশাদ সেটাকে পরিবর্তন করে দেন। এ ধারাবাহিকতায় জাতি কওমীদের শক্তি, সামর্থ্য ও দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে বুঝতে পারে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ মুজিবহত্যা পরবর্তী প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করলে ইসলামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার কারণে কওমীদের কাছে ঐক্যের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাঁরা তাঁদের সহজ মিত্র বলে পরিচিত বিএনপি’র সাথে চার দলীয় জোট গঠন করে যেখানে জামায়াতও অন্যতম শরীক দল ছিলো। পরিস্থিতির কারণে সে-সময় কওমীরা জোট গঠন করলেও জামায়াতকে নিয়ে স্বস্তিতে ছিলো না। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতা গ্রহণ করলে ইসলামপন্থীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। বিশেষত, ২০১৩ সালে সংগঠিত শাপলার গণহত্যার পর আওয়ামী লীগ একদিকে মামলা-হামলা দিয়ে হেফাজতে ইসলামকে দমনে প্রবৃত্ত হয়। পাশাপাশি কওমীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে সরকারপন্থী দালালশ্রেণী তৈরিতে মনযোগী হয়। তাতে তারা কিছু-কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়। এতে আওয়ামী লীগের প্রতি চরম মাত্রায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে কওমী-জগৎ। অবশেষে ছাত্রদের কোটাবিরোধী ও সরকার পতনের আন্দোলনে স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করে কওমী আলিম ও ছাত্ররা। তাঁদের মধ্যে কমবেশি পঞ্চাশ জন শহীদও হন বলে জানা যায়।এমন পরিস্থিতিতে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নেই, প্রশ্ন উঠতে পারে: জামায়াতের সাথে কওমীদের ঐক্য সম্ভব কি না? উচিৎ কি না? কেন এখন জামায়াতের সাথে ঐক্য অনিবার্য হবে? কেমন ঐক্য হবে? এসব প্রশ্নের সুরাহা না করে সামনে পা ফেলা সহজ হবে না। এখানে বলে রাখি, প্রথমেই জানতে হবে কওমীদের অভ্যন্তরীণ বাহাসকে (Internal debate) যা সবসময় তাঁরা মৌলনীতি, দৃষ্টান্ত ও যুক্তির মাপকাঠিতে পরিমাপ করে। তা না জেনে নিজ থেকে জামায়াতের সম্মেলনে হাযির হয়ে ঐক্য-ঐক্য করলেও ঐক্য হবে না। অভ্যন্তরীণ বাহাসে কওমীরা কোন-কোন বিষয়ে বহুধা-বিভক্ত হয়ে পড়লেও এক সময় এমন জায়গায় এসে ঐক্যমত্য হয় যা তাঁদেরকে অনড় করে তোলে। যেমন, সুন্নাহ ও বিদআতপ্রশ্নে; ধর্মনিরপেক্ষতাপ্রশ্নে; বামপন্থী রাজনীতিপ্রশ্নে। তাই, কওমীদের পাঠাভ্যাসে ‘তাকরার’ বা সমষ্টিগত পাঠ-পর্যালোচনার গুরুত্ব যেমন অপরিসীম তেমনি তাঁদের সমষ্টিগত কোন সিদ্ধান্তে অভ্যন্তরীণ বাহাসের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। এদিকটি এড়িয়ে গেলে চলবে না।
কওমীদের সাথে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য ইসলামী দলের ঐক্য নিয়ে কথা কম হয়নি। বলেছি, স্বাধীনতার পর থেকে হয়ে আসছে। যদ্দূর মনে পড়ে ৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঐক্য নিয়ে হযরত হাফেজ্জী হুযুরের সাথে বসেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতৃবৃন্দ। তখন মাঠ পর্যায়ে আমীর ছিলেন আব্বাস আলী খান। বিষয় ছিলো, ঐক্য। কিন্তু হাফেজ্জী হুযুরের সাথে কয়েক দফা বৈঠক হলেও সফলতা আসেনি। তখন শুনেছিলাম, হযরত হাফেজ্জী হুযুরের শর্তানুসারে জামায়াত নেতৃবৃন্দ আরও বসার কথা দিয়েও আর আসেননি। পরে হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ. লিখলেন ‘সতর্কবাণী’ পুস্তিকা। যা হোক, সেই শেষবারের মতো জামায়াতের সাথে ঐক্যের দফারফা হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে কখনও ডানপন্থী কখনও ইসলামী দলগুলোর ঐক্য নিয়ে কথা উঠলেও তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৯৯ সালে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোটের সমন্বয়ে চার দলীয় জোট গঠিত হলেও সেটা ছিলো নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক জোট।
অতিসম্প্রতি স্বৈরাচারিনী খুনি শেখ হাসিনার পতনের পর জামায়াতকে নিয়ে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য নিয়ে আবারও কথা উঠেছে। তবে এবারের চিত্রটা একটু ভিন্ন। জামায়াতের বর্তমান আমীর আহুত একটি বৈঠক হয় তাদের ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ে। পত্রিকার ভাষ্যমতে, সেখানে কওমী ঘরানার ১৫ থেকে ২০ জন আলিম নেতৃবৃন্দ যোগ দেন। পত্রিকার শিরোনাম ছিলো:
‘জামায়াতের নেতৃত্বেই ইসলামী রাষ্ট্র গঠন সম্ভব: কওমি আলেমরা’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫শে আগস্ট ২০২৪)। সেখানে যুগ্মমহাসচিব পদবিধারী হেফাজতের একজন সদস্যও ছিলেন। তাঁদের কথায়: ‘আমিরে জামায়াত সব মারকাজের আলেমদেরকে একত্রিত করে সবাইকে ধন্য করেছেন। আমাদের এই ঐক্য বা হাজারো ঐক্য কোনও কাজে আসবে না, যদি আমরা ব্যালটের যুদ্ধে একত্রিত হতে না পারি। আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক দেশ। তাই আমাদেরকে গণতান্ত্রিক সিস্টেমে আগাতে হবে।’…….‘দল-মত-নির্বিশেষে আমাদের এক হতে হবে। আমাদের অতীতের সব ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে। ‘…….‘আমরা ঐক্য ঐক্য বলতেছি। কিন্তু আমরা তো ঐক্যবদ্ধ ছিলামই। মাঝে কিছুদিন আমরা দূরে সরে গেছিলাম। বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা সকলেই নির্যাতিত হলাম। এখন আমাদের সবাইকেই আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের সব থেকে বড় ইসলামী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। মুহতারাম আমিরে জামায়াতের সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী মানুষ। তাই আমার বিশ্বাস, তিনিই পারবেন আমাদের সবাইকে এক প্লাটফর্ম-এ দাঁড় করাতে, ইনশাআল্লাহ।’……‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ডাকে আমরা সবাই একত্রিত হতে পেরেছি, সে জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। আমার জানা মতে, জামায়াতে ইসলামীর আমির প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখেন। তিনি একজন মুখলিস ব্যক্তি। যদিও সরাসরি প্রশংসা করা ঠিক না, তবুও জানার জন্য বলছি। তাই আমার মন বলে যে, তার দ্বারাই একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ।’
এখানে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করতে হয়। প্রথমত, যাঁরা জামায়াত আহুত সম্মেলনে গেছেন তাঁরা কি স্বউদ্যোগে গেছেন না কি প্রতিষ্ঠানিকভাবে গেছেন? তাঁরা যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গিয়ে থাকেন তবে হেফাজত বা কওমী-মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়েই কি গেছেন? সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলে তা প্রকাশ করা হয়নি কেন? জামায়াত আহুত সম্মেলনে তাঁরা যে ঐক্যের কথা বলেছেন তা কি হেফাজত বা কওমী-মাদরাসা কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত? তাঁরা যদি ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে জামায়াতের নেতৃত্বে শরীক হবেন তবে কওমী-মহল কি জামায়াতের নেতৃত্ব মেনে নেবার কথা বলেছে? এসব প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন। আমরা অতীতে দেখেছি, কওমীরা জামায়াতের নেতৃত্ব দূরে থাক জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্টতাও মানতে নারাজ। যেমন, হেফাজতে ইসলামের বর্তমান আমীর এবং কওমী-জগতের মুরুব্বী মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর ২০২১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠে প্রকাশিত বক্তব্য—
‘জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে হেফাজতের আঁতাতের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের আদর্শিক কোনো সম্পর্ক নেই। বরং কওমি আলেমরা জামায়াতের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে সব সময়। দেওবন্দের অন্যতম অলি আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানি জামায়াতের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। আমরা তাঁর অনুসারী হিসেবে এখনো জামায়াতের বিরুদ্ধে কথা বলি। তাই জামায়াতের সঙ্গে কওমিদের কোনো ঐক্য হতে পারে না। আদর্শিক কারণেই কওমিদের সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। রাজনৈতিক স্বার্থে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করেছে। কিন্তু হেফাজতের সঙ্গে জামায়াতের এখনো কোনো জোট হয়নি। হেফাজতের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই বলে দাবি করেন তিনি।’
জামায়াতে ইসলামীর সাথে ঐক্যপ্রশ্নে প্রথমেই কতোগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রথমত, কওমীদের কাছে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান। দ্বিতীয়ত, জামায়াতপ্রশ্নে কওমীদের ঐতিহ্যগত বিরোধিতার পুনর্মূল্যায়ন এবং তৃতীয়ত, জামায়াতের সাথে ঐক্য কি শর্তযুক্ত হবে না কি শর্তমুক্ত হবে? জামায়াত ঐক্যের স্বার্থে কওমীদের কতোটুকু ছাড় দিতে প্রস্তুত হবে? কারণ, অতীতে যতোবার ঐক্যের প্রশ্ন উঠেছে ততোবার উক্ত সমস্যাগুলোই অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে। কওমীদের কাছে জামায়াতের রাজনীতিক ধারণা পরিস্কার নয়। এখানে আরও একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। তা হলো, জামায়াতের রাজনীতি সাধারণ রাজনীতি নয়। জামায়াতে ইসলামী তাদের বিশেষায়িত একটি মিশনারী রাজনীতিতে(Missionary Politics) বিশ্বাসী যা কওমীদের কাছে আপত্তিকর। তারা কেবল নির্বাচনমুখী রাজনীতি করে না, পাশাপাশি তারা তাদের রাজনীতিক আদর্শ ‘মওদূদী মতবাদ’ও প্রচার করে থাকে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, তাদের মন-মস্তিষ্কে মওদূদী মতবাদের প্রভাব বেশ পরিপুষ্ট। সে জন্য কওমীরা সাধারণত জামায়াতকে মূলধারার ইসলামী দল বলে স্বীকার করতে নারায। কওমীরা যেসব পঠন থেকে তাঁদের মূ্ল্যবোধ আহরণ করে থাকে জামায়াত সেগুলোকে সযত্নে এড়িয়ে যায়। তাঁরা নিজেদেরকে কথিত মডারেট ইসলামের অনুসারী হিসাবে দেখতে স্বস্তি বোধ করে। পক্ষান্তরে, কওমীরা জামায়াতের মওদূদী মতবাদভিত্তিক ধ্যানধারণাকে পরিহার এবং প্রতিরোধ করে। এখানেই জামায়াতের সাথে কওমী-জগতের ঐক্য বাধাগ্রস্থ হয়। হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ.-র প্রকাশিত ‘সতর্কবাণী’ ও হেফাজত আমীর হযরত মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর বর্ণিত বক্তব্য এর প্রধানতম দলীল।
এখন প্রশ্ন হলো, কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে বৃহত্তর স্বার্থে কওমীরা জামায়াতের সাথে ঐক্য গড়তে পারে কি না। এখানে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ আছে। প্রথমে কওমীদেরকে দু’টি বিষয়ে পরিস্কার অবস্থান নিতে হবে। এক, জামায়াতকে কি তারা একটি ধর্মীয় জোটসঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করবেন না কি নিছক রাজনীতিক সঙ্গী হিসাবে নেবেন? আমি আগেই বলেছি, কওমীদের অভ্যন্তরীণ বাহাসের কথা। সেখান থেকে এ সিদ্ধান্ত আসতে হবে। যদ্দূর মনে হয়, জামায়াতকে কওমীদের ধর্মীয় জোটসঙ্গী হিসাবে বেছে নেয়া দুষ্কর হবে। কারণ, এখানে কওমীরা অনড় অবস্থান গ্রহণ করবে। তবে, রাজনীতিক সঙ্গী হিসাবে বেছে নেয়া অধিকতর সহজ হবে যেখানে মিশনারী রাজনীতির সুযোগ থাকবে না। যেমন, ২০০২ সালে পাকিস্তানে গঠিত ‘মজলিসে মুত্তহিদা আমল(এএমএ)’র কথা এখানে উদাহরণ হিসাবে নেয়া যেতে পারে। এ জোটের শরীকরা ধর্মীয় হলেও উদ্দেশ্য ছিলো জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে নির্বাচনে প্রতিরোধ করা। এ জোটের শরীকরা ছিলো: জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, তাহরিকে জাফরিয়া পাকিস্তান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (ফজলুর রহমান), জমিয়তে আহলে হাদীস এবং জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান। তাঁরা সে বছর পাকিস্তান জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৪২ টি আসনের মধ্যে ৬৩টি আসনে এবং সিনেটে ১০০টি আসনের মধ্যে ৬টি আসনে জয়ী হয়ে ‘খাইবার পাখতুন খাহ্’ প্রদেশে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। ২০১৮-তে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী জোট থেকে বেরিয়ে যায়। এ ছাড়া আমাদের দেশে গঠিত ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ বা আইডিএল’র কথা তো আছেই। ১৯৫৪ সালের পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে গঠিত যুক্তফ্রন্টের কথাও উল্লেখ করা যায়। তখন আওয়ামী মুসলিম লীগ(মাও.ভাসানী), কৃষক-শ্রমিক পার্টি(শেরে বাংলা), নেজামে ইসলাম পার্টি(মাও.আতহার আলী), বামপন্থী গণতন্ত্রী পার্টি(হাজী মোহাম্মদ দানেশ) ও খিলাফতে রব্বানী পার্টিসহ মোট পাঁচটি দল জোটগতভাবে শাসক দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে। এতে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসনে জয়লাভ করে মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে।
জামায়াতের রাজনীতির আরেকটি বিশেষ দিক যা অন্যদের কাছে বিরক্তিকর বলে বিবেচিত। সেটা হলো, তাদের আধিপত্যবাদী মানসিকতা। কারও সাথে তাদের জোট হলে দল হিসাবে তারা অপেক্ষাকৃত কতো বড় বা ছোট সেটা বিবেচনায় না নিয়ে তাদের আধিপত্যকে অগ্রাধিকার দিতে সচেষ্ট থাকে। এদিকটাও তাদের জোটসঙ্গীকে বিব্রত করে। ২০১০ সালে চট্টগ্রামের পোলোগ্রাউন্ড মাঠে চারদলীয় জোটের এক সম্মেলন হয়। সেখানে সভাপতিত্ব করেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি’র তুলনায় তাদের আকার ছোট হলেও তারা মঞ্চের সামনের জায়গাটা সকাল দশটা থেকেই দখল করে বসে থাকে। এ নিয়ে বেশ বিশৃঙ্খলা হয়। এ ধরনের মানসিকতা জোটসঙ্গীদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহবাসের অন্তরায়। স্বাধীনতা পরবর্তী জোট আইডিএল’র দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হয়েছিলো জামায়াতে ইসলামীর ঐ মানসকিতার কারণে বলে আমাকে নিশ্চিত করেন চারদলীয় জোটের চট্টগ্রাম জেলার সাবেক সমন্বয়ক জনাব আব্দুর রহমান চৌধুরী এবং বিশিষ্ট লেখক ও সাবেক জমিয়ত সম্পাদক মাও. আব্দুর রহীম ইসলামাবাদী। তাঁরা দু’জনেই সে সময় তরুণ বয়সে আইডিএল’র পরিণতি দেখেছিলেন।
পরিশেষে বলতে হয়, কওমীদের সাথে জামায়াতের ঐক্য একদিনে একটি মাত্র সভা থেকে ডাক দিলেই হয়ে যাবে না। এগুলো আবেগধর্মী ও অদূরদর্শী শব্দগুচ্ছ ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে অনেক কিছুর যোগ-বিয়োগ বাকি রয়ে গেছে। সেগুলো সম্পন্ন না করে হৈ-হল্লার ঐক্য কেবল পেপারে উঠে বক্তাকে প্রশস্তি দেবে, অশ্ব ডিম্বই প্রসব করবে। আমার মনে হয় না, জামায়াতের সাথে কওমীদের কোন ফলদায়ক ঐক্য হবার সিদ্ধান্ত আসবে। কারণ, অনৈক্য ও বিরোধিতার শেকড় অনেক গভীরে, অনেক অতীতে। আরও একটি বিষয় আমাদের সামনে রাখতে হবে। তা হলো, জামায়াত প্রচলিত রাজনীতির মাঠে অনেক পারদর্শী যেখানে কওমীদের অবস্থান শূণ্যের কাছাকাছি। এই অসম অবস্থানও বিবেচনায় রাখতে হবে। চারদলীয় জোটের কথা মনে করুন, জোটে থেকে জামায়াত বিএনপি থেকে দর কষাকষি করে অনেক কিছু অর্জন করতে পেরেছে কিন্তু ইসলামী ঐক্যজোট পারেনি। অথচ চারদলীয় জোটের ভূমিধস জয়ে কওমীদের সিংহভাগ অবদান ছিলো। অভিযোগ ছিলো: জোট জয়ী হবার পর জামায়াত এদিকে যেমন নিজেদের অবস্থান সুসংহত করায় সচেষ্ট থেকেছে অন্যদিকে জোট সরকারে কওমীদের যেনো কোন প্রভাব সৃষ্টি না হয় সেদিকেও জামায়াতের তদবীর ছিলো। বিষয়গুলো কওমীদের অভ্যন্তরীণ বাহাসে উঠে আসবে না, তেমন ভাবা হাস্যকর। তাই, ঐক্য নির্বাচনমুখী হলেও মূলরস যে কওমীদের গলা সিক্ত করবে—সে গ্যারান্টি কোথায়? হতে পারে বেলা শেষে দেখা যাবে, পানিটুকু উবে গেছে খালি কলসিই কেবল কওমীর ভাগ্যকে অলংকৃত করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, জামায়াতের সাথে কওমীরা ঐক্যে না গিয়ে সম্ভব হলে কেবল সমভাবাপন্ন দল নিয়ে একটি ঐক্য গড়া উচিৎ সেটা নির্বাচনমুখী হবে কথা নেই, সমাজমুখী হোক। সম্পর্ক ক্ষমতার সাথে না হোক, মানুষের সাথে হোক।
01.09.2024 Mail: gr.islamabadi@gmail.com