ভাবনা-৪৯
কওমী মাদরাসার বিশাল বলয় নিয়ে কওমী-জগৎ। মূলত কওমী মাদরাসার আলিম-উলামা ও ছাত্ররা এ জগতের মূল-বাসিন্দা। স্বীকৃতমতে, বাংলাদেশে কওমী মাদরাসার যাত্রা ১৯০১ সালে হাটহাজারী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেই থেকে এ দেশের মাটিতে সুগভীর শেকড় গেড়েছে কওমী জগৎ। দারুল উলূম হাটহাজারীর স্বপ্নদ্রষ্টা ও মূল পরিকল্পনাকারী শাইখুল কুল মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ রহ. এবং তিন সহযোগী সুফী আজীজুর রহমান রহ., মাওলানা আব্দুল হামীদ মাদারশাহী রহ. ও মাওলানা হাবীবুল্লাহ কুরাইশী রহ.’র আন্তরিক প্রচেষ্টায় নববী-নকশার যে ইসলামী শিক্ষার গোড়াপত্তন ঘটে, তাই আজ কালজয়ী কওমী মাদরাসা-শিক্ষাব্যবস্থা হিসাবে স্বীকৃত ও পরিচিত। কালে-কালে এসব কওমী মাদরাসা থেকে এমনসব ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব জন্ম নিয়েছেন, যাঁরা কেবল ধর্মীয় বলয়ে নয়, জাতীয় পর্যায়েও ঈর্ষণীয় অবদান রেখে গেছেন। এঁদের মধ্যে মাওলানা আতাহার আলী সিলেটী রহ., মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ., মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযুর রহ., মাওলানা সিদ্দীক আহমদ রহ., মাওলানা হাজী ইউনুস সাহেব রহ., মাওলানা আহমদ শফী রহ., মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী রহ., মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ. প্রমুখ আলিম নেতৃত্ব। তাঁদের গড়ে ওঠার কাহিনী হয়তো আমাদের সামনে নেই, আছে বিশাল অবদানের সামান্য কিছু স্মৃতি। বলতে দুঃখ হয়, আমাদের এখানে ইতিহাস থাকে অজানা, স্মৃতি থাকে অচেনা আর মূল্যায়ন হয় অদেখা। কতো বড়বড় মানুষ এ মাটিতে জন্মেছেন, কেউ তাঁদের খবর রাখেনি। পরপ্রজন্ম চেনে না আপন পূর্বসূরীদের। ফলে, যে বুক সাহসে আকাশে ওড়ার কথা ছিলো, হীমন্যতায় সে বুক আছড়ে পড়ে মাটিতে। আজ আমরা নিথর-নিরব-নির্বল।
কেন কওমীদের মধ্যে নেতৃত্ব গড়ে ওঠার হার প্রায় শূণ্যের কাছাকাছি? অবহেলায় কি এ ফল? না কি নেতৃত্ব গড়ার দুর্বলতার বিষফল? বলতে দ্বিধা নেই, ইদানীং আমাদের যাঁরা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে বড় হতে পেরেছেন; পরিচয়ে পরিচিত হতে পেরেছেন—তাঁরা জানি না কি এক অজানা কারণে আত্মকেন্দ্রিকতায় ডুবে গেছেন অলক্ষে। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত তাঁরা। নিজে বড় হবার চেয়ে অপরকে বড় করে তোলার মধ্যে সৃষ্টিসুখের উল্লাস যে কতো মধুর—সে কথা আমরা বুঝি না। আমাদের কেউকেউ আছেন, কওমীর ডালভাত খেয়ে; কওমীর পাটিতে শুয়ে বড় হয়ে আজ কওমীকেই ভুলে গেছেন। ‘ক্যারিয়ার’ গড়তে তারা এখন য়ুরোপ-আমেরিকায় সুখের নীড় গড়েছেন। তাদের যদি সবিনয়ে প্রশ্ন করা হয়: কওমী মাদরাসায় যাঁদের সাহায্যের টাকায় খেয়েপড়ে আজ কওমকে পেছনে ফেলে বিদেশের মাটিতে সুখের নীড় গড়ে তুলেছেন, তাঁদের জন্য এই কি প্রতিদান? আপনার বস্তার চাল খেয়ে কেউ যদি অপরের মাটি কাটতে যায়, তাকে কি বলবেন? ইংরেজরা যখন আমাদের শাসন-শোষণ করে, আমাদের সম্পদ লুট করে বৃটিশ-নগরী গড়ে তোলে,তাদের আমরা বলি—লুটেরা । আর যারা আমাদের ডালভাত খেয়ে আমাদের মেধা চুরি করে বাইরে ক্যারিয়ার গড়ে তোলে, তাদের কি বলবো? জবাব পাঠকদের কাছে। সান্ত্বনা পেতাম যদি দেখতাম, তাঁরা বাইরে গিয়ে এখানকার সন্তানদেরও ক্যারিয়ার গড়ায় সহযোগিতা করছেন। কিন্তু হচ্ছে কি এসব? এ আত্মকেন্দ্রিকতার কি কোন কৈফিয়ত আছে? আমাদের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একটি প্রবাদ আছে: ছাগলে বিয়ায় শিয়ালে খায়। কওমীরাও বলতে পারেন: কওমীরা বিয়ায় বিদেশে খায়। আমি বলছি না, আপনি সুযোগ পেলেও দেশে পচে মরুন। তা হবে কেন? দেশের সন্তানদের জন্যও কিছু করুন। নিজে খান অন্যকেও খাওয়ান। সেটাকে তো আত্মকেন্দ্রিকতা বলছি না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আপনি যান, সেখানে থাকুন কিন্তু আপনার মাতৃভূমিকে, আপনার কওমী প্রতিষ্ঠানটিকে ভুলে যাবেন না। পারলে কিছু মেধাবীকে নিয়ে গিয়ে গড়ে তুলুন। সেখানে যা কিছু ভালো আছে, যেমন: পরিচালনাজ্ঞান, ব্যবস্থাপনাজ্ঞান, তাফসীর, হাদীস-গবেষণা, ফিকাহ-গবেষণা ইত্যাদি অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশে পাঠান। কওমীদের অনেক উপকার হবে। দেশে আপনার বিরাট পরিচয়, ভালো। আর দশ জনকেও পরিচিত করিয়ে দিন, তাতে আপনি কিন্তু আরও বড় হবেন, ছোট হবেন না। চেরাগের আলো ধার দিলে কি আলো কমে? আত্মকেন্দ্রিকতা কিন্তু এক ধরনের সংকীর্ণতা, উদারতার ঘোরতর শত্রু।
নেতৃত্ব গড়ে তুলতে বড়দের বড় ভূমিকা রাখতে হয়। তা না হলে, নিচ থেকে নেতৃত্ব গড়ার পথ সংকীর্ণ হয়ে যায়। দারুল উলূম দেওবন্দের ৫৮ বছরের পরিচালক হাকীমুল ইসলাম কারী তয়্যিব সাহেব রহ.’র কথা কারও অজানা থাকার কথা নয়। আজও দারুল উলূমের দেয়ালে-দেয়ালে তাঁর অবদান প্রস্ফুটিত হয়ে আছে। তাঁর বিভিন্ন ওয়াযের সংকলন—‘খুতবাতে হাকীমুল ইসলাম’ সাত খণ্ডে সমাপ্ত, বাজারে পাওয়া যায়। সেখানে এক বক্তব্যে তিনি বলেছেন, বড়দের বদান্যতায় কেমন করে তিনি গড়ে উঠলেন। তাঁর কথায়: তিনি ছিলেন আজাদীর বীর সিপাহসালার শাইখুল হিন্দ মাহমূদ হাসান দেওবন্দী রহ.’র ছাত্র। কারী সাহেব যখন দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করলেন, নিজেকে আলিম ভাবার ধৃষ্টতা দেখাতে পারেননি। খুব লজ্জাশীল ছিলেন। কিন্তু হযরত শাইখুল হিন্দ মানিক চিনতে ভুল করেননি। কারী সাহেব রহ. বলছেন: হযরত শাইখুল হিন্দ যখন কোন প্রোগ্রামে যেতেন, অবশ্যই তাকে ডেকে নিতেন এবং মঞ্চে পাশে বসিয়ে রাখতেন। হযরত শাইখুল হিন্দ বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে দশ মিনিট সময় রেখে দিয়ে বলতেন, এখন আযীয কারী তয়্যিব সাহেব বয়ান করবেন। একদিন হলো কি, ঝড়ে কারী সাহেবের কাপড় এমন ভিজে গেলো, গায়ে রাখাটাই দুষ্কর হয়ে পড়লো। প্রোগামে গিয়ে কারী তয়্যিব সাহেব কাপড় বদলে একটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে শাইখুল হিন্দের পাশে বসে রইলেন। যথারীতি হযরত শাইখুল হিন্দ দশ মিনিট আগে বয়ান শেষ করে বলে দিলেন, আমার পাশে এক নওজোয়ান দরবেশকে আজ নিয়ে এসেছি। বাকি দশ মিনিট তিনিই বয়ান করবেন। হাকীমুল ইসলাম কারী তয়্যিব সাহেব রহ. বলেছেন: হযরত শাইখুল হিন্দ এভাবে গড়ে না তুললে তিনি মঞ্চে কখনোই সাবলীল হতে পারতেন না। এভাবেই আমাদের বড়রা তাঁদের অনুজদের গড়ে তুলেছেন। এখানে আত্মকেন্দ্রিকতার লেশমাত্র ছিলো না; ছিলো না বলেই দারুল উলূম নামের জ্ঞানের কারখানা থেকে জ্ঞানীরা, সংস্কারকরা, খতীবরা, মুজাহিদরা গড়ে উঠেছেন একে-একে।
নেতৃত্ব বলতে আসলে কি বোঝায়? সোজা কথায় আমি যদি বলি, নেতৃত্ব মানে এমন এক দায়িত্ব যা একটি জাতি বা গোষ্ঠীর মন-মেজাজ বুঝে তাঁদের কল্যাণ সাধনে নির্ধারিত পথ ও পদ্ধতিতে অগ্রসর হওয়া এবং জাতি বা গোষ্ঠীকে আদর্শিকভাবে সংগঠিত করা ও রাখা। আধুনিক দৃষ্টিতে ইসলামের পরিকাঠামোয় নেতৃত্ব বলতে বলা হচ্ছে:
“قیادت کا بنیادی مقصد انسانوں کی درست رہنمائی اور ان کے مسائل کا آسان حل فراہم کرنا ہوتا ہے-باشعور، باصلاحیت اور دیانت دار قیادت نہ صرف انسانی مسائل کے حل میں ہمیشہ مستعد و سرگرم رہتی ہے بلکہ معاشرے کی خوشحالی، امن اور ترقی میں بھی کلیدی کردار ادا کرتی ہے-قیادت متعین مقاصد کے حصول کے لئے عوام کو بلاجبر و اکراہ ایک طے شدہ سمت پر گامزن کرنے کانام ہے-تاثیر و کردار کے مجموعہ کوقیادت کہتے ہیں-کسی بھی اسلامی ریاست کیلئے ایک صالح قومی قیادت و لیڈر شپ لازمی و ابدی امر ہے جو اپنے دائرہ اختیار اور ریاست کی حدود میں حدود اللہ اور حدود العباد کاپوری طرح سے نفاذ ممکن بناتی ہے - اگر دنیا میں صالح قیادت کے قیام کااصول اور فرد کے باہمی تعلق کی حدود و قیود واضح کردی جائیں تو انسان کے لئے یہ ممکن ہے کہ وہ معاشرتی، معاشی، مذہبی ظلم و جبر سے نجات پالے”
(প্রফেসর ড. গোলাম রসূল, পাকিস্তান)
(নেতৃত্বের মৌলিক উদ্দেশ্য হলো, অধীনস্থদেরকে সঠিকভাবে পরিচালিত করা এবং তাদের সমস্যার সহজ সমাধান প্রদান করা। সচেতন, মেধাবী এবং সৎ নেতৃত্ব শুধুমাত্র মানুষের সমস্যা সমাধানে সর্বদা পরিশ্রমী ও সক্রিয়ই নয়, বরঞ্চ সমাজের সমৃদ্ধি, শান্তি ও উন্নয়নেও মূল ভূমিকা পালন করে। নেতৃত্ব নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানুষকে একটি নির্ধারিত পথে অগ্রসর হতে উৎসাহিত করার ক্ষমতার নাম। প্রভাব ও ভূমিকার সম্মিলনেই নেতৃত্ব । যে কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য একটি সৎ জাতীয় নেতৃত্ব অপরিহার্য ও চিরন্তন বিষয়, যা আপন ক্ষমতার সীমার মধ্যে থেকে আল্লাহর আদেশ এবং বান্দার অধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব করে। যদি পৃথিবীতে ন্যায়পরায়ন নেতৃত্বের মূলনীতি এবং নাগরিকের পরস্পরিক সম্পর্কের সীমা বুঝিয়ে দেয়া যায়, তবে মানুষের পক্ষে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।)
অন্যভাবে বলা হচ্ছে:
In Islam, the concept of leadership must act only to implement Allah’s laws on earth as the essence and primary responsibility of leaders. Leadership in Islam, as a trust (Amanah), and a sacred position that can solve the problems of humanity and guide them to the eternal betterment of here and hereafter. Although developments of several leadership models are just to solve the problem. On the other hand, leadership in Islam must think about humanity and the satisfaction of Allah the Almighty. The results of the field study indicate that there is a significant relationship between the spiritual values of leadership with Rabbani’s leadership practices. The results suggest that organizational direction requires divine or spiritual-based leadership. (www.intechopen.com) (ইসলামে নেতৃত্বের ধারণাটি অবশ্যই প্রাথমিক দায়িত্ব হিসাবে পৃথিবীতে আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবে। ইসলামে নেতৃত্ব একটি বিশ্বাস (আমানাহ) এবং একটি পবিত্র অবস্থান যা মানবতার সমস্যার সমাধান করতে পারে এবং তাদের ইহকাল ও পরকালের অনন্ত উন্নতির দিকে পরিচালিত করবে। যদিও বর্তমানে নেতৃত্বের বিভিন্ন প্রকারের সংস্করণ আছে, শুধুমাত্র সমস্যা সমাধানের জন্য। অন্যদিকে, ইসলামে নেতৃত্বকে অবশ্যই মানবতা এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা ভাবতে হবে। মাঠ পর্যায়ের ফলাফল নির্দেশ করে যে, আল্লাহওয়ালাদের নেতৃত্বের অনুশীলনের সাথে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। ফলাফলগুলো নির্দেশ করে, প্রাতিষ্ঠানিক দিকনির্দেশনার জন্য আসমানী বা আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব প্রয়োজন।)
এখন এ নেতৃত্বের গুণাবলী শিষ্যদের মাঝে প্রবিষ্ট করা কাদের কাজ? স্বীকার করি, যে কেউ এসব গুণের অধিকারী হতে পারেন না যতোক্ষণ না তার মধ্যে নিজ থেকে জ্বলে ওঠার বাসনা জাগ্রত হয়। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দরসে এমন ছাত্র পাওয়া যাবে যারা পরশ পেলে জ্বলে উঠবে। প্রয়োজন শুধু এদেরকে চিনতে পারা এবং লালন করা। এ কাজ অবশ্যই বয়ঃজ্যেষ্ঠদের, শিক্ষকেদের। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এ দিকে দৃষ্টি দেয়া হয় না সহজে। আমরা কেবল গতানুগতিক দরসের কিতাবী পড়াকে মুখ্য করে থাকি। এতে আমাদের অবিকশিত প্রতিভাগুলি আর বিকাশের সুযোগ না পেয়ে ভিনপথে চলে যায়। দুর্ভাগ্যের এ ইতিহাস কিন্তু আমাদের খুব বেশি অতীতের নয়। তাই যদি হতো, আমাদের পর্বসূরী নক্ষত্রগুলোকে আমরা দেখতে পেতাম না। যেমন ধরুন, আমীরে শরীয়ত হাফেজ্জী হুযুর রহ.’র কথা। হাকীমুল উম্মাহ হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ.’র পরশ না পেলে আমরা কি পেতাম আমীরে শরীয়তকে? ধরুন, চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার হাজী ইউনুস সাহেব রহ.’র কথা। মাওলানা হাবীবুল্লাহ কুরাইশী রহ. এবং মুফতী আজীজুল হক রহ.’র পরশ না পেলে আমরা কোথায় পেতাম শাইখুল আরব ওয়াল আযমকে? মুফতী আজীজুল হক রহ.’র পরশ না পেলে কোথায় পেতাম আমরা হযরত আলী আহমদ বোয়ালভী রহ. ও হযরত ইসহাক আল গাযী রহ.কে? মাওলানা জমীরুদ্দীন সাহেব রহ.’র পরশ না পেলে কোথায় পেতাম আমরা মুফতী আজীজুল হক রহ. ও মাওলানা হারুন বাবুনগরী রহ.কে? মুফতী আজীজুল হক রহ.’র সাহচর্য বিনে কোথায় পাওয়া যেতো সুলতান আহমদ নানুপুরী রহ.কে? এমন করে আরও অনেক নাম নেয়া যায়। এরপর কেমন করে যেন সব এলামেলোর দিকে চলে গেলো। আমাদের নক্ষত্রগুলো আর আকাশে দেখা গেলো না। নতুন নক্ষত্রও মিলিয়ে যেতে লাগলো। পাঠক, যাঁদের কথা বলে এলাম, তাঁরা যে কেবল ধর্মীয় নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, তা নয়। তাঁরা বিভিন্ন ক্রান্তিকালে জাতিকেও দিশা দিয়েছেন তাঁদের অমূল্য বক্তব্য ও পরামর্শ দিয়ে ; নেতৃত্ব দিয়েছেন উদারভাবে। ইতিহাসে সেসব আজও জ্বলজ্বল করে।
কওমী জগৎ আজ নেতৃত্ব-সঙ্কটে জর্জরিত। এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। পাঠক, এখানে এসেই নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যেতে চায়। বারবার প্রশ্ন জাগে: কেন এ সঙ্কট? স্বীকার করতে হয়, আমাদের মূল জায়গাটা কিন্তু দারস বা শ্রেণী। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা যদি ওখানে সচেতন হন, কারা কোন পথে যাবার যোগ্যতা রাখে, কিসে তার সহজাত প্রতিভা আছে—সে বিবেচনায় লালন করেন, তবে একটি প্রজন্ম জন্ম নেবে। আমাদের যা মেধা আছে, সে তুলনায় প্রতিভা অনেক কম। ফলে, মেধা আর প্রতিভার সমন্বয়ে নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পথ সংকুচিত হয়ে গেছে। দারস যদি যুগের প্রয়োজনকে সামনে রেখে দিনদিন সংস্কার হয়, সৈনিকরা ততো উন্নত হয়। যুদ্ধের মাঠে যেমন অস্ত্রের ব্যবহার হয় তেমনি বৃদ্ধিবৃত্তিক এ মাঠে বক্তব্য, যুক্তি-তর্ক, উপাস্থাপনার কৌশল, সমাসাময়িক ভূ-রাজনীতিক ও সংলাপ-কৌশল ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। বর্তমান যুগে পরিভাষার যুদ্ধ একটি বড় যুদ্ধ। প্রতিপক্ষের ছুঁড়ে দেয়া নতুন পরিভাষার বিরুদ্ধে ব্যাখ্যামূলক পাল্টাযুক্তি দিয়ে নিজেদের সৃষ্ট পরিভাষা দিয়ে অপরপক্ষকে ঘায়েল করার সক্ষমতা থাকতে হবে সৈনিকদের। তবেই তারা বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে টিকে থাকবে। এ যুদ্ধ কি জিহাদের এক প্রকার নয়? এসব অর্জনের ভিত্তি হবে দারস। এ জন্য দারসের দু’টি শর্ত অবশ্যই প্রযোজ্য: ১. মুদাররিস বা শিক্ষকের সমসাময়িক তথ্য ও তত্ত্বমিশ্রিত দারস ও ২. দারসের প্রতি ছাত্রদের দায়বদ্ধতা ও আন্তরিকতা। এখানে বড় ভূমিকা কিন্তু মুদাররিসের। যেমন আরোগ্যের ক্ষেত্রে ডাক্তারের। আর মুদাররিসের দেখানো পথে নিজেকে তৈরি করার দায়িত্ব ছাত্রের যেমন পথ্য খাওয়ার জিম্মাদারী রোগীর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেরুলে ছাত্রের দায়িত্ব বড় হয়ে দাঁড়ায়। দারসের ভিত্তিকে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে নিজের মধ্যে যোগ্যতা সৃষ্টির দায়িত্ব একান্তই ছাত্রের। অন্যথা হলে, সেটাই হবে ছাত্রের বড় খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা। এখানে যদি যথার্থ অর্থে কাজ করা যায়, তবে আমাদের আফসোস করতে হবে না।
সবাই যে নেতৃত্বের যোগ্য হবেন তেমন নয়। আল্লাহ তায়ালা একেকজনের মধ্যে একেক যোগ্য দিয়ে থাকেন। কারও কম, কারও বেশি। তবে বান্দার চেষ্টায় আল্লাহ’র ইচ্ছা হলে অসম্ভব কিছু নয়, নিরাশ হওয়ারও কারণ নেই। কেবল আল্লাহ’র জন্য নিবেদিত হয়ে মাখলুকের সেবার নিয়ত থাকলে নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা ও তামান্না অবৈধ নয়। হযরত সুলায়মান আ. যদি আল্লাহ’র নিয়ামাতের শোকরিয়া আদায়ের জন্য বাদশাহী চাইতে পারেন, আমরা কেন স্রষ্টার আনুগত্য ও মানবতার সেবার জন্য নেতৃত্বের যোগ্যতা চাইতে পারবো না? মনে রাখতে হবে, নেতৃত্ব যেহেতু এক গুরুভার যার জন্য কিয়ামাতের দিন আল্লাহ’র দরবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে, তার জন্য যোগ্যতাও তেমন উচ্চদরজার হতে হবে। এর অনিবার্য ও মূলশর্ত: খোদাভীতি। পার্থিব যোগ্যতার দিকে তাকালে যে কয়টি বিষয় প্রধানত বাঞ্ছনীয়, তা হলো: ১. বুনিয়াদী ও শরীফ বংশের সন্তান হওয়া, ২. সাহেবে নিসবাত বা ইসলাহী সিলসিলার অন্তর্ভুক্ত হওয়া, ৩. শিক্ষাগত ও তথ্যগত উচ্চযোগ্যতা থাকা, ৪. উদার মানসিকতার অধিকারী হওয়া, ৫. সচ্চরিত্রবান হওয়া, ৬. মানুষের সাথে মিশার মানসিকতা থাকা এবং ৭. মাখলুকের প্রতি ভালবাসা জাগ্রত থাকা। এসব যোগ্যতার অভাব হলে ব্যক্তি নেতৃত্বের অযোগ্য বলে বিবেচিত হন। হযরত উমর রজি.’র সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে: তুমি বাজারে যাওয়ার আগে বাজারের মাসআলা শিখে নাও, নচেৎ তুমি কাউকে ধোঁকা দেবে বা ধোঁকা খাবে। নেতৃত্বের বেলায়ও তেমন যুক্তি। একে শরীয়তের ভাষায় বলে: ইলমুল হা-ল্। আমাদের দেশে বলে: মন্ত্র না জেনে সাপের গর্তে হাত দিও না। এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলে লেখার ইতি টানছি। একবার এক ব্যক্তি হযরত থানভী রহ.’র দরবারে এসে বললো: হযরত আমি সিয়াসাত (রাজনীতি) করতে চাই। অনুমতি দিন। হযরত বললেন: না, তোমার জন্য রাজনীতি জায়েয হবে না। লোকটি বললো, হযরত কী আশ্চর্য! আপনি কি দেখছেন না, হযরত মাদানী সিয়াসাত করছেন, নেতৃত্বও দিচ্ছেন! অথচ আমাকে বললেন: আমার জন্য রাজনীতি বৈধ হবে না। তখন হাকীমুল উম্মাহ রহ. লোকটিকে যে অমূল্য কথাটি বললেন, তা কালান্তরে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। হযরত বললেন:
پہلے تو مدنی بن جا پھر سیاست کر!
২০.০৬.২০২৩