ভাবনা-৪৮
ভেতরে ও বাইরে বাংলাদেশ নিয়ে এক সঙ্কট চলছে এখন। যেটুকু বোঝা যায়, সঙ্কটের এখন মধ্যাহ্ন চলছে। প্রতিনিয়ত আসা খবর থেকে আন্দাজ করা যায়, সঙ্কট আরও বৃহত্তর সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে। হতে পারে, সঙ্কটের পারদ উঠতে-উঠতে বিপদসীমার দিকে চলে যাবে। সঙ্কটের পুরোটা রাজনৈতিক হলেও প্রভাব কিন্তু রাজনীতিকে ছাপিয়ে যাবে বলে মনে হয়। ইয়েমেন, ইরাকের উদাহরণ ভুলে যাবার কারণ নেই। প্রথম দিকটা রাজনৈতিক হলেও পরবর্তীতে সুদাসল আদায় করেছে বেকসুর জনসাধারণ। আফগানিস্তানের বিষয়টি ভূ-রাজনৈতিক, তবুও ধকল গেছে সবার উপর দিয়ে। যে প্রকৃতিতে বাংলাদেশ সঙ্কটের দিকে আপাতত এগুচ্ছে, মনে হচ্ছে, সামনে বিপদ ভারী। আল্লাহ না করুন, তেমন কিছু হলে এমনিতেই জর্জরিত দেশের মানুষ নিরঙ্কুশ পতনের দিকে এগিয়ে যাবে। আমার মনে হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে এমন সঙ্কট এই প্রথম। দেশের ভেতরে নির্বাচনবিমুখ বিভক্ত, আতঙ্কিত মানুষ, রাজনীতিক দীনতা আর বাইরে ‘গণতান্ত্রিক’ পরিবেশ সৃষ্টিতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক চাপ। অর্থনীতিকভাবে মানুষ এমনিতেই উচ্ছৃংখল দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে বিপর্যস্ত, আয়ের চেয়ে চাহিদা ভয়ানক গতিতে বেশি এবং কর্মহীনতা যত্রতত্র—এমন পরিস্থিতিতে সঙ্কট ঘনীভূত হলে মানুষকে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর কাতারে দাঁড়াতে হবে। ক্ষমতাশীনরা মানতে নারাজ বিরোধীদের কথা আর বিরোধীদের এক কথা: আগে পদত্যাগ, তারপরে কথা।
দেশের সঙ্কটের সময় যখন কোন সমাধানে যাওয়া জটিল মনে হয়, তখনি কওমীদের এগিয়ে আসা উচিৎ যাঁরা ১. সরকারের সাথে সঙ্কট নিয়ে কথা বলবেন, ২. বিরোধীদলের সাথে কথা বলবেন, ৩. একটি মহাসমাবেশ ডেকে দেশের স্বার্থে সঙ্কট সমাধানে একটি সম্মিলিত বিবৃতি ও প্রস্তাবনা পেশ করবেন এবং ৪. দেশব্যাপী একটি দোয়ার ব্যবস্থা করবেন। এখানে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, কওমীরা কি সমাধান করতে পারবেন? পক্ষ-বিপক্ষ কি তাঁদের কথা শুনবে? দেখুন, সমাধান কিভাবে হবে বা আদৌ হবে কি না—এগুলো কেউ আগাম বলতে পারেন না। ভবিষ্যৎ তো কেবল আল্লাহর হাতে। তাই বলে কি চেষ্টাতে মানা আছে? মনে রাখতে হবে, কওমীরা এ দেশেরই নাগরিক, দেশ ও দশ নিয়ে তাঁদেরও দায়িত্ব আছে; দায়বদ্ধতা আছে। তাঁরা মৌলিকভাবে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করছেন, তাতে কারও আপত্তি নেই। সাথেসাথে যখন দেশ ও দশ সঙ্কটে পড়বে, কওমীরা কি নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকতে পারবে? দেশ ও দশকে সঙ্কট থেকে উদ্ধারের চেষ্টা কি ধর্মীয় দায়িত্বের সাথে সাংঘর্ষিক? ধরে নিলাম, কওমীদের কথা ওরা রাখলো না। তাতে কি? কওমীরা যে জাতীয় দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসলো, সে তো জাতীয় ইতিহাসে লেখা থাকবে। কেউ কওমীদেরকে নির্বাসনে থাকা অসচেতন প্রজাতি বলে কটাক্ষ করার সাহস পাবে না। প্রস্তাবগুলো দায়িত্বশীলগণ ভেবে দেখতে পারেন। বলা তো যায় না, আল্লাহ কাকে দিয়ে কি কাজ করান।
বলতে দ্বিধা নেই, জাতীয়ভাবে কওমীদের একঘরে থাকার অপবাদ দীর্ঘদিনের। এখান থেকে মুক্তি মেলেনি বলে জাতীয়ভাবে তাঁদের মূল্যায়নও হয় না। উর্ধতনমহল মনে করেন, এঁরা মোল্লা মানুষ, মসজিদ-মাদরাসা নিয়েই এঁদের জিন্দেগী। জাতির জন্য তাঁরা কিইবা করতে পারেন? সে সক্ষমতা কি তাদের আছে? আমরা কওমীদেরকে প্রমাণ করতে হবে: আমাদের সে সক্ষমতা আছে। এটা প্রমাণের মধ্যে লুকিয়ে আছে কওমীদের আত্মমর্যাদা ও বৃদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা। কেবল দান-সদকা খাওয়া প্রজন্মের কটাক্ষমূলক তকমা লাগিয়ে বাস করা কি মর্যাদার? এমনও দেখেছি, ধনাঢ্যদের কেউকেউ মাদরাসায় এ জন্য সন্তানদের পাঠান না যে, সেখানে গেলে অমর্যাদাকর রীতি গ্রহণ করতে হয়। কেন এমন বলা? বলতে দ্বিধা নেই, এখানে আমাদেরও ঘাটতি আছে। ইসলামে সাধাসিধা জীবনাচার আছে, তাই বলে কি অমর্যাদাকর জীবন যাপন করতে হবে? কওমীরা মূলত একটি দায়ীর জামায়াত। এঁরা ইসলামের দিকে জাতিকে ডাকবেন; নির্দেশনা দেবেন। সঙ্গতকারণে, আমাদের কোন আচরণে যদি মানুষ সাধারণে অস্বস্তি বোধ করে এবং দ্বীনের দিকে আসতে দ্বিাবোধ করে, তবে সে দায় আমাদের। যেমন আপনি এমন এক লোকালয়ে গেলেন যেখানে সবাই পরিস্কার ও পরিপাটি কাপড় পরাকে পছন্দ করে। কিন্তু আপনি গেলেন অপরিপাটি ও ঢিলেঢালা পোষাকে। এতে সেখানকার বাসিন্দারা মানসিকভাবে এতোটাই বিগড়ে যাবেন, দায়ী হিসাবে আপনার কথায় মনযোগ দিতে চাইবে না। ফল কি দাঁড়ালো? আপনার কারণে দ্বীনের মুখাপেক্ষী মানুষ দ্বীনের কথা শুনতে পারলো না। এর দায় একান্তই দায়ীর। মদীনার উদাহরণ দেখুন! প্রথম মুবাল্লিগ বা দায়ী হিসাবে মহানবী সা. মাদীনায় পাঠালেন হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের রজি:কে। কিন্তু কে এই মুসআব ইবনে উমায়ের? মুসআব ইবনে উমায়ের মক্কার সেই যুবক যে সবচেয়ে দামী আতরে ও পরিপাটি পোষাকে চলতেন। তিনি ছিলেন অন্যান্য যুবকদের মডেল। মদীনার অধিবাসীরাও ছিলো চাল-চলনে পরিপাটি, পরিচ্ছন্নতার প্রতীক। সঙ্গতকারণে, মুসআব ইবনে উমায়ের রজি:র স্বভাবগত চালচলনের কারণে মদীনার বিত্তশালী, নেতৃত্বাস্থানীয় শ্রেণীর কাছে দ্বীনের দা’ওয়াত পৌঁছাতে সহজ হয়। তাঁর দা’ওয়াতে পরের বছর দশ হাজার মুসলিম মক্কায় আসেন রসুলুল্লাহ সা.’র কাছে ইসলাম গ্রহণ করতে যাঁদের মধ্যে মুয়ায ইবনে জাবাল রজি.’র মতো নক্ষত্রতুল্য সাহাবীও ছিলেন। কওমীরাও যদি মাদরাসার পরিবেশ পরিপাটি-পরিচ্ছন্ন রাখেন তাতে কি সমস্যা হবে? স্বভাবতই ধনাঢ্যশ্রেণী চাইবে তাদের সন্তান কওমীতে পড়ুক কিন্তু মিসকীন-মিসকীন ভাব নিয়ে নয়। পোষাকে-আষাকে পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি হওয়া তো দোষের নয়। সেদিকটায় কওমীদের প্রচুর দুর্বলতা আছে। তবে ইদানীং কিছু পরিবর্তন যে হচ্ছে না, তা নয়।
যাক, বলছিলাম, দায়ী হিসাবে দাওয়াত গ্রহণকারীদের পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। সেদিক থেকে বলতে হয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের স্বার্থে কওমীদের বলায় ও আচরণে শিক্ষিত ও পরিপাটি হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেদিকটায় নযর দিতে পারলে জাতি কওমীদের পদক্ষেপকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করতে চাইবে। জাতি যখন কওমীদের আন্তরিকতাকে গ্রহণ করবে, জাতীয় পর্যায়ে কওমীদের অবদানের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হবে। আজ দেশের এমন সঙ্কটের মুখে কওমী আলিম-উলামার কোন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসিত হবে। কওমীদের মধ্য থেকে একটি প্রগতিশীল ও আধুনিক প্রজন্ম গড়ে উঠতে হবে যাঁরা সুন্নাহ’র মৌলিক অনুসরণকে সম্বল করে যুগের প্রয়োজনে আধুনিক ভাষা ও প্রযুক্তি রপ্ত করে জাতিকে এমন কিছু দেবে যা অন্যদের পক্ষে দেয়া সম্ভব হবে না।
মহাসমাবেশ যে কেবল সঙ্কটকালে করতে হবে, তা নয়। মাঝেমাঝেই সমাবেশ করে জাতিকে দ্বীনের পথে দা’ওয়াত দিতে হবে, নির্দেশনা দিতে হবে। দেশের আলিম-উলামার দায়িত্ব গতানুগতিক নেতানেত্রীর মতো নয়। তাঁদের দায়িত্ব ব্যাপক। তাই তাঁরা একদিকে যেমন দায়ী হিসাবে মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে ডাকবেন অন্যদিকে শাসক ও বিরোধীদলের দুর্বলতা ও ত্রুটি চিহ্নিত করে দেবেন। সমাবেশ সম্মিলিত ব্যনারে যেমন হতে পারে তেমনি হেফাজতে ইসলামের নামেও হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, সমাবেশের মেজাজ যেন রাজনৈতিক হয়ে না যায়; উচ্ছৃংখল-বক্তৃতা ও গোপন সওদাবাজি যেন উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করতে না পারে।
১৫.০৬.২০২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন