ভাবনা-৪৫
সম্প্রতি চলে গেলেন দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর পরিচালক মাওলানা ইয়াহইয়া সাহেব রহ.। ২০২১ সালে এ সুপ্রাচীন মাদরাসার দায়িত্ব নিয়ে এ বছর তিনি চলে গেলেন। এক সময় কওমী মাদরাসাগুলো বুজুর্গব্যক্তিত্বের পদভারে মুখরিত ছিলো। এ যেনো বাগানভরা ফুলের এক সমাহার। নানা ফুলের নানা খুশবুতে মোহনীয় হয়ে থাকতো কওমী অঙ্গন। দারুল উলূম হাটহাজারী ছিলো এসব ফুলের কেন্দ্রবিন্দু। দুই দশক আগেও কওমী অঙ্গনে দেখা মিলতো অসামান্যসব ব্যক্তিত্বের: যাঁদের সান্নিধ্যে বেহেশতী ছোঁয়া তন্দ্রায়িত করে দিতো। হঠাৎ করে কি এক প্রলয় ঘটে গেলো, একেএকে সবাই চলে গেলেন। পেছনে শূণ্য পড়ে রইল শুষ্ক, রুক্ষ অসহায় গুলশান। আগের সে দৃশ্য যারা দেখেছেন, তাঁদের ব্যথাই সবচেয়ে বেশি জাগে। বর্তমান প্রজন্ম সে ব্যথা বুঝবে না। আজও মনে পড়ে, যখন সে-সব মহানেরা বিচরণ করতেন, বুকে অজানা সাহস অনুভব করতাম। সেখানটায় আজ বেদনা-বিচ্ছেদের বিষাদ-সিন্ধু। ৮০’র দশকে যখন হাফেজ্জী হুজুরের খেলাফত আন্দোলনের জোয়ারে চারদিক থৈথৈ করছিলো, দেখতাম দলেদলে বুজুর্গ আলিমের মজলিস, ওয়াজ মাহফিল, খেলাফতের সমাবেশ। ১৯৮৭/৮৮/৮৯’র দিকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ মাঠে বসতো আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন। শাইখুল আরব ওয়াল আজম হাজী ইউনুস সাহেব রহ., সুলতান আহমদ নানুপুরী রহ., আলী আহমদ বোয়ালভী রহ., উস্তাযুল আসাতিযা হযরত ইসহাক আল গাযী রহ., খতীব মাওলানা ওবায়দুল হক সাহেব রহ., মাওলানা তফাজ্জল হক সিলেটী রহ., মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ., মাওলানা আহমদুল্লাহ আশরাফ রহ., খতীবে ইসলাম মাওলানা মোজাহিরুল ইসলাম রহ. প্রমূখ বুজুর্গ আলিমে দ্বীন সভামঞ্চকে আলোকিত করে রাখতেন। বিদেশ থেকে আমন্ত্রিত হতেন আল্লামা তাকী উসমানী দা.বা., মাওলানা রফী উসমানী রহ., মাওলানা সালেম কাসেমী রহ., খতীবে ইসলাম মাওলানা আব্দুল মজীদ নদীম রহ., ফিদায়ে মিল্লাত মাওলানা আসআদ মাদানী রহ., মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকী শহীদ রহ. প্রমূখ আলিমে দ্বীন। মাও. তাকী উসমানী ছাড়া এঁরা এখন আর কেউ বেঁচে নেই; সবাই চলে গেছেন ওপারে। তাঁদের শূন্যতা আর পূরণ হয়নি, হবারও নয়।তিক্ত হলেও সত্য, বর্তমানের কওমী অঙ্গনের চিত্র আগে কখনও কল্পনাতে আসেনি। এ মরুকরণ মন মানতে চায় না। জানি, এ পৃথিবীতে কেউ থাকেনি, পরের জনেরাও থাকবার নয়। কিন্তু যাঁদের চরণস্পর্শে কওমী মাদরাসাগুলো প্রাণচাঞ্চল্যে চঞ্চল হয়ে থাকতো, তাঁদের অবর্তমান যেনো এক বিভীষিকা। মরুর মাঝে পিপাসার্ত মুসাফির যেমন করে খুঁজেফিরে একবিন্দু জল, তেমন করে সত্যান্বেষীরাও খুঁজে ফিরছে হারিয়ে যাওয়া অভিভাবকদেরকে কওমীর পৃথিবীতে, যদি কোথাও দেখা মেলে। আমার মাঝেমাঝে দীর্ঘশ্বাসে মনে হয়, এভাবে শূণ্য হয়ে পড়লে কেমন করে চলবে কওমী অঙ্গন? একদিন কিয়ামত হবে, পৃথিবী অস্তিত্ব হারাবে—সবই সত্যি। “মাওতুল আলিম কামাওতুল আলম”—এ সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। ধ্বংসোম্মুখ পৃথিবী তো এটাকেই চায়। তাই বলে, ক্ষান্ত দেয়া! না, তাতো হতে পারে না। মানুষ আসবে মানুষ যাবে; তাই বলে কি জীবন থেমে রবে? একবার ভাবুন তো, সিদ্দীকে আকবর রজি.’র ইন্তিকালে খিলাফত কি থেমেছিলো? ফারুকে আযম রজি.’র শাহাদাতে ইসলামের অগ্রযাত্রা কি থমকে গিয়েছিলো? তাহলে আমাদের মুহসিন উত্তরসুরীদের ব্যথিত বিদায়ে কওমী জগৎ কেন অসহায় হয়ে থাকবে। জানি, গাড়ি পথ ঠিকই চলবে, কিন্তু অগ্রজদের মতো করে সম্ভব নয়; তবুও একবুক আশায় এগুতেই হবে এ কওমী কাননকে বাঁচিয়ে রাখতে।
আমাদের গুলশানে হরেক ফুল হরেক সুগন্ধ দিয়ে মাতোয়ারা করে রেখেছে মুসলিম উম্মাহকে। কেউ তাফসীর; কেউ হাদীসের গবেষণা; কেউ ফিকাহ; কেউ রাজনীতি; কেউ ইতিহাস—এমনি আরও অনেকে বিভিন্ন শাখা-উপশাখায় আপন-আপন অবদান দিয়ে বিশ্বকে বিমোহিত করেছেন। শাইখুল হিন্দ মাহমূদ হাসান দেওবন্দী রহ.’র পরে তাঁর দরস থেকে উঠে এসেছেন একঝাঁক বে-নযীর সৈনিক: খাতিমুল মুহাদ্দিসীন আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী, হাকীমুল উম্মাহ আশরাফ আলী থানভী, মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী, মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী, মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী, মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী, মুফতী কিফায়তুল্লাহ দেহলভী প্রমূখ। এঁরা একেকজন একেক পথের দিশারী হয়ে আজও অমর হয়ে আছেন। দারুল উলূম হাটহাজারীর সদ্য মরহুম পরিচালক মাওলানা ইয়াহয়া রহ.’র ইন্তিকালের খবর শোনার পর থেকে বড়ো ব্যথিতহৃদয়ে কথাগুলো ভাবছিলাম। হযরতের সাথে আমার যে কোন ঘনিষ্ঠতা ছিলো—তা নয়। এ এক হৃদয়ের আত্মীয়তা। শুনেছি, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় মরহুমের অসাধারণ দক্ষতা ছিলো। এমন মানুষই তো কওমীদের বড়ো দরকার। ঠান্ডামাথার ব্যক্তি হিসাবে, জাগতিক সমস্যাকে সহজপন্থায় মুকাবিলা করার গুণান্বিত পুরুষ হিসাবে তাঁর দক্ষতা ছিলো বলে শুনেছি। দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা তাঁকে হারালাম বড়ো প্রয়োজনের সময়। আবেগ আর অদূরদর্শীতার ঝড়ো বাতাসে যখন কওমী জগৎ কম্পমান—সে সময় মাওলানা ইয়াহয়া সাহেবের মতো একজন মানুষের দারুল উলূম হাটহাজারীর পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ অনেক বড়ো পাওয়া। সে পাওয়ার আবেদন না ফুরাতেই বিদায়ের ঘণ্টা আরও একবার কওমী জগতকে ধাক্কা দিয়ে গেলো।
এখানেই আমাদের তরুণ আলিম-প্রজন্মের পথচলার আহ্বান; গুরুভার কাঁধে নিয়ে সম্মুখে এগুবার প্রত্যয়; কওমী-জগতকে নতুনত্ব দিয়ে সাজিয়ে বিশ্বায়িতকরণের উদাত্ত আবেদন। কেবল পূঁথিগত শিক্ষার নিগড়ে আবদ্ধ না থেকে গভীর লক্ষ্য থেকে মনিমুক্তা তুলে এনে কওমী জগতের গলায় জেওর পরাবার প্রত্যয়ে সজ্জিত হোক আমাদের নতুন ও তরুণ-প্রজন্মের আলিমদের জিন্দেগী। তাফসীর থেকে ফলিত তাফসীর (Applied Tafseer), ফিকাহ থেকে ফলিত ফিকাহ (Applied Fiqh ), তাফাসীরে হাদীসের বিশ্বায়ন (Globalization of Hadith and it’s explanation ), ইসলামী ইতিহাসের ভূরাজনীতিক বৈশিষ্ট্য (Geo-political characteristics of Islamic history), হিজরাতপূর্ব ইসলামী দর্শন (Islamic perspective before hijrah), হিজরাতোত্তর ইসলামী দর্শন (Islamic perspective after hijrah ), তূলনামূলক ধর্মতত্ত্ব (Comparative Theology )—সবকিছুতে তাঁরা অর্জন করবেন পারদর্শিতা ও অভিজ্ঞতা। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে তাঁরা বুনিয়াদ ঢালবেন মৌলিক ও আধুনিক প্রতিষ্ঠানের। এই তো আমাদের আরাধ্য; চাওয়া। গতানুগতিক সংস্কৃতিকে আকায়েদের আবরণে আবৃত না করে মৌলিকত্বকে বিস্তৃত করার মানসে প্রযুক্তিবিধৌত কদম হোক তরুণ-প্রজন্মের আলিমদের সম্বল। সুন্নাহ’র অনুসরণকে ক্ষতবিক্ষত না করে আধুনিক জগতের কাছে ইসলামকে উপস্থাপনার প্রত্যয় হোক প্রতিজ্ঞার মূলধন। কিন্তু কারা হবেন সে সৈনিক? কারা সাহসে দণ্ডায়মান হয়ে হাতে তুলে নেবেন নয়া জামানার নিশান? নিরাশার মেঘ দূর করে সে সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখবে আমাদের কওমী সন্তান—এ স্বপ্নকে অনাত্মীয় ভাবতে পারবো না কখনও। কেন ওরা পারবে না? পারতেই হবে। ওরা যে ইবনে খালদুনের উত্তরসুরী! ওরা যে ইমাম রাযীর রুহানী সন্তান; ওরা যে ইমাম গাযালীর পাহারাদার! ওরা যে জালালুদ্দীন রুমীর ফরযন্দ। আমরা আজ জড়ো হয়েছি খর্জুরবৃক্ষের নিচে দু’ফোটা রস আস্বাদনের নিমিত্ত। নিশ্চয়ই আমাদের কওমী সন্তানেরা আমাদেরকে নিরাশ করবে না। বিশ্বমণ্ডলে জ্ঞান আর বিজ্ঞানকে ইসলামের পোষাকে সজ্জিত করে পরিবেশন করার দায়িত্ব তো তাঁদেরই। তাঁরা তো কওমী কাননের পাহারাদার—আগামীর সিপাহসালার।
০৬.০৬.২০২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন