রবিবার, ১১ জুন, ২০২৩

কওমীদের বাংলাচর্চা

ভাবনা-৪৬

আমাদের কওমী মাদরাসার আলিম-ছাত্রদের বাংলা বলা-লিখার ব্যাপারটি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক কারণ, তাঁদের শিক্ষার প্রধান ও মূল মাধ্যম প্রথমত ও প্রধানত আরবী এবং পরে উর্দূ ও ফার্সীতে বাংলা যে তাঁরা একদম পড়েন না, তা নয় কওমী মাদরাসায় পঠিত সিলেবাসের লক্ষ্য অর্জন ও প্রয়োজনকে সামনে রেখে দেশীয় ভাষা বাংলা, ইংরেজি, অংক ইত্যাদি পাঠ্যভুক্ত আছে এক সময় সেটা প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নত করা হয়েছে একটা সময় ছিলো, কওমী মাদরাসায় বাংলা পড়া বা বাংলা বইপত্র রাখা খুব একটা ভালো চোখে দেখা হতো না প্রয়োজনকে সামনে রেখে এখন সে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তন হয়েছে মানসিকতারও তাই দেখা যায়, কওমীদের মধ্যে বাংলাচর্চা এখন আগের সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে বাংলা নিয়ে পশ্চাদপদতার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে এবং এর জন্য কওমীদেরকে একতর্ফা দোষও দেওয়া যায় না বিষয়টি বোঝা দরকার বলাবাহুল্য, বাংলার সাথে সংস্কৃতভাষার আত্মীয়তা গভীর বাংলায় অনেক শব্দ এসেছে সংস্কৃত থেকে সেগুলো তৎসম ও অর্ধতৎসম শব্দ নামে পরিচিত মোগল আমলে ভারতের সরকারী ভাষা ছিলো ফারসী পাশাপাশি আরবী ছিলো মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষাইংরেজ-আধিপত্যবাদের শুরুতে বিশেষত ১৮৫৭ ব্যর্থ স্বাধীনতা-সংগ্রামের পর বৃটিশরা যখন রাতারাতি সরকারী ভাষা ফারসী পরিবর্তন করে মুসলিম সম্প্রদায়কে অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলে, স্বভাবত ইংরেজদের সংস্কৃতি ভাষার প্রতি মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে একটা ঘৃণার আবহ তৈরি হয়স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইংরেজদের সহযোগিতা করাপথে এগিয়ে গেলে মুসলিম সম্প্রদায় আরও হতাশ হনসে সময় যে বাংলা-সাহিত্য চর্চা হয় তা ছিলো মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে এবং হিন্দু ধর্মপ্রভাবিতফলে ভিন্ন বিশ্বাসের কারণে মুসলমানদের মাঝে তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনাগ্রহ দেয়তাঁরা তাঁদের চর্চা হিসাবে ফারসী, আরবী উর্দূকে ব্যবহার করতে শুরু করেএখানে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রত্যয় ছিলো ন্যায়সঙ্গতঠিক আমরা যেমন উর্দূকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে বাংলাচর্চাকে প্রাধান্য দিয়েছি এবং বাঙ্গালিত্বের স্বতন্ত্রতাকে রক্ষার চেষ্টা করেছিএখানকার কওমী মাদরাসাতেও সে প্রভাব পড়ে যুক্তিসঙ্গতভাবেবাংলা-সাহিত্যে নজরুল-যুগের সূচনা না হলে আজও হয়তো বাংলা সাহিত্যের প্রতি বিরাগের ধারা অব্যাহত থাকতোকারণ, আপন বিশ্বাস সংস্কৃতি রক্ষার তাগিদের প্রেক্ষাপটে হিন্দু-বিশ্বাসপ্রভাবিত বাংলা-সাহিত্যকে মুসলিমরা কখনোই গ্রহণ করতে পারেনিএর উপর বঙ্কিমদের মতো উগ্রসাম্প্রদায়িক বাংলা-সাহিত্যচর্চা মুসলিম-সমাজে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করেএসব কারণেআদি বাল্যশিক্ষা পরিবর্তেমুসলিম বাল্যশিক্ষাশিশুপাঠের গোড়াপত্তন ঘটে

তে বাংলা-সাহিত্য মূলত দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েএর জন্য দায়ী হিন্দু সাহিত্যিকেরা যারা সচেতনভাবে মুসলিম উপাদানকে পরিহার করে গেছেন তাঁদের সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কারণেরবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রও এর ব্যতিক্রম ননমধ্যযুগে আরাকান রাজসভার সাহিত্যচর্চার ইতিহাস উম্মোচিত না হলে কেউ জানতো না: চট্টল-সন্তান মহাকবি আলাওল দৌলত কাজীরা মুসলিম-সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা-সাহিত্যও চর্চা করেছেনসঙ্গতকারণে, আমাদের বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাতেও আরবী, ফার্সী, উর্দূর পাশাপাশি বাংলাচর্চা প্রাথমিক অবস্থায় প্রয়োজনীয় গুরুত্ব পায়নিএর আরও একটি কারণ হলো, কওমী মাদরাসা মূলত একটি ধর্মীয় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আরবী, ফার্সী, উর্দূর মতো বাংলাতে যথেষ্ট পরিমাণ উপাদান না থাকা এরপর আসে গতানুগতিক বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গীর বিষয় এখানে সবাই কিন্তু দায়ী নয় ক্ষুদ্র হলেও কওমীদের একটি সচেতন অংশ কওমী অঙ্গনে বাংলা ভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাচর্চাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেনব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগউভয় দিক থেকে গতিতে মন্থর হলেও কওমীদের মধ্যে বাংলাচর্চা অব্যাহত থাকে বৃটিশ আমল থেকেপাকিস্তান আমলেও ছিলো এমন প্রচেষ্টা কেউ বাংলাতে কুরআন-হাদীসের অনুবাদগ্রন্থ করেছেন; কেউ তাফসীর, কেউ সীরাত, কেউ বা ইতিহাসগ্রন্থ করেছেনপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেও চলেছে উদ্যোগযেমন চট্টগ্রাম থেকে আঞ্জুমানে হেদায়তুল ইসলামএটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৬০ দশকে প্রখ্যাত শাইখুল হাদীস মাওলানা ইসহাক গাযী রহ.’ হাতেসেখান থেকে বেশ কিছু প্রকাশনাবের হয়১৯৭১ সালে যুদ্ধের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায় ছাড়া বিভিন্ন কওমী মাদরাসা থেকে স্মারক, পুস্তিকা মাসিক পত্রিকাও বের হতো যা আজও বর্ধিতাকারে অব্যাহত আছেএসবের মধ্যে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. কর্তৃক সম্পাদিত প্রকাশিত মাসিক মদীনার কথা না বললেই নয়বলতে দ্বিধা নেই, কওমী অঙ্গনে বাংলাচর্চার উন্নয়নের পেছনে মাসিক মদীনার প্রভাব ছিলো সর্বজনবিদিতএরপর আসে চট্টগ্রামের দারুল উলূম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী থেকে প্রকাশিত মাসিক মুঈনুল ইসলামের কথা১৯৩৪ সালে প্রখ্যাত বুযুর্গ আলিম দারুল উলূম হাটহাজারীর সাবেক পরিচালক মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেব রহ.’ তত্ত্বাবধানেইসলাম প্রচারনামে একটি সাময়িকী প্রকাশিত হয়১৯৫২ সাল থেকে সেটিমাসিক মুঈনুল ইসলামনামে আজও প্রকাশিত হয়ে আসছে১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মুখপত্র মাসিক আত তাওহীদ

কওমীদের বাংলাচর্চা নিয়ে সাধারণ শিক্ষিতমহলে নেতিবাচক মানসিকতা আছেতারা মনে করেন, কওমীরা মননে বলায় আধুনিক ননবাংলা বলায় তাঁরা দুর্বল; লেখায় প্রাইমারী পর্যায়ের এবং চিন্তায় অনগ্রসরযেহেতু কওমীমহল নির্দিষ্ট সীমানায় থাকে তাই তাঁরা হয়তো সমালোচনা সম্পর্কে যতোদূর জানা দরকার ততোদূর জানেন না বা অতোটা গায়ে মাখেন নাআসলেই কি কওমীদের সমালোচনা যথার্থ? আমার মনে হয়, সমালোচনার পুরোটা কওমীরা বহন করার কথা নয়তবে দায়টা নিদেনপক্ষে অর্ধেক তো নিতেই হবেকারণ, মাতৃভাষা হিসাবে বাংলার প্রতি কওমীদের দৃষ্টিভঙ্গী সিংহভাগ সুখকর নয়একটা অজানা অবহেলার দূরত্ব অস্বীকার করা যায় নাফলে ছাত্রেরাও সে প্রভাবে প্রভাবিত হয়ভালো আরবী, উর্দূ বা ফার্সী বললে বা লিখলে যে পরিমাণ বাহবা মিলে, বাংলার ভাগ্যে সে পরিমাণের সিকিভাগও জোটে নাএখানে প্রাতিষ্ঠানিক কিছু ব্যাপারও আছেযেহেতু শিক্ষার মূল মাধ্যম আরবী, উর্দূ তাই বাংলা যে স্বাভাবিকভাবে অপুষ্টিতে ভুগবেসে তো অবাঞ্ছনীয় নয়এরপরও অবহেলার যুক্তি টিকবে বলে মনে হয় নাকারণ, মাতৃভাষার প্রতি অগ্রহণযোগ্য অবহেলামনে রাখতে হবে, যে ভাষাতেই শিক্ষা গ্রহণ করুক না কেন, সবকিছু অন্তরে বিচরণ করে মাতৃভাষার আবরণেইআমরা ভুলে যাই, ভাল সাহিত্যচর্চার বুনিয়াদ কিন্তু মাতৃভাষার ওপর ভাল দখলের ভিত্তিতেআপনি ভালো আরবী সাহিত্যিক হবেন, তবে অবশ্যই আপনাকে মাতৃভাষাতে ভাল সাহিত্যজ্ঞান রাখতে হবেযে আপন মায়ের মমতা বুঝতে অক্ষম সে পুরো নারী জাতির মমতা কি করে বুঝবে? মাতৃভাষার প্রতি কওমীদের দূরত্বের মূল কারণ সংকীর্ণ মানসিকতাএখান থেকে মুক্ত হতে না পারলে সে ক্ষত পুষবে বলে মনে হয় নামানসিকতার মেরামত হলে চর্চার প্রসার হবে শুদ্ধপথে

এবার আসুন বলা নিয়েসমালোকেরা বলেন: ওনাদের উচ্চারণ মানের নয়; শব্দের আমদানী যথার্থ নয়ঠিক আছে ধরেই নিলাম, কওমীদের স্ক্রু টাইট নয়যাঁরা বলেন তাদের কি অবস্থা? তাঁরা কি শুদ্ধ বলেন? আমাদের নাগরিকদের সবচেয়ে শিক্ষিতশ্রেণী বলে যাঁদের জানি, সেই তাঁরা নিশ্চয় য়ুনিভার্সিটির শিক্ষক বা বিচারবিভাগের বিচারকবৃন্দবাংলা বলায় তাঁদের অবস্থা কি? প্রখ্যাত বিচারপতি জনাব শাহাবুদ্দীনের কথা মনে আছে? তিনি যখন ১৯৯সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন, তাঁর দেয়া প্রথম ভাষণের কথার মনে আছে? আমার এখনও মনে আছে, প্রচুর ভুল উচ্চারণে তিনি সেদিন বাংলাতে ভাষণ দিয়েছিলেনতখন খারাপ লাগেনি? টকশোতে বাংলাদেশের য়ুনির্ভাসিটির সেরাসব জ্ঞানীদের আলোচনা তো হরহামেশা শুনছিএকে তো ভুল বাংলা উচ্চারণ, তার পর সাধু-চলিত রীতির মিশ্রণ আঞ্চলিক উচ্চারণ-কি লঙ্কাকাণ্ড না দিল্লীকাণ্ড বোঝা মুশকিলএখন আরেক আপদ হলো, আমাদের শিক্ষিতেরা যা বলেন, সে কোন ভাষা প্রশ্ন করতে হয়যদি কথা বলেন দুই মিনিট, সেখানেবাট/সোমিলিয়ে ইংরেজি থাকে দেড় মিনিটআচ্ছা, তো বাংলা-ইংরেজি মেশানো বিলকুলবাংরেজি ভাষাতাই না! বিশিষ্ট প্রাগ্রসর রাজনীতিক বলে খ্যাত আন্দালিব রহমান পার্থ বা রেজা কিবরিয়ার কথা শুনেছেন? তাঁরা জ্ঞানী, স্বীকার করিকিন্তু তাঁদের কথাগুলো তো শ্রুতিমধুর নয়ই, এদেশের সাধারণ মানুষের বোধগম্যও নয়জনাব ওবায়দুল কাদের বা অন্য গতানুগতিক রাজনীতিকদের কথাগুলোকে বাংলানা বলে, ‘দাঙ্গা’ বললে সমস্যা থাকার কথা নয়ঢাকা য়ুনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রদের ইংরেজি লেখার কায়দাটা একবার দেখুন! তখন কি কওমীর সমালোচকদের জাতে লাগে না? আসলে কওমীদের প্রতি, মাদরাসায় পড়ুয়াদের প্রতি এক ধরনের অবৈধ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সমালোচনাগুলো হয়আমি বলছি না, কওমী-ঘাটতি তাই চলতে দেয়া দরকারনা, সে হবে কেন? অপরের ভুল কি আমার ভুলকে বৈধতা দেয়? বরঞ্চ অপরের ভুল থেকে সংশোধনের শিক্ষা নেয়া উচিৎ।

কওমীদের বাংলাচর্চার সংস্কৃতিটা সংস্কার করা প্রয়োজন। পাঠ্যক্রমে কেবল মাধ্যমিক পর্যায়ের সাধারণশিক্ষা রাখলেই বাংলাচর্চার দায়িত্ব আদায় হলোসে কথা ভুল। প্রত্যেক মাদরাসায় একটি করে বাংলা বিভাগ থাকা দরকার। সেখানে প্রতিভাবান ও অভিজ্ঞ শিক্ষক থাকতে হবে। তিনি মাদরাসার পাঠ্যসূচী ও সময়ের সাথে সমন্বয় করে একটি পরিকল্পনা করবেন যেনো সময়ের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে বিভিন্ন জামাতের ছাত্রদের বাংলাচর্চাকে বেগবান করা যায়। যেমন ধরুন, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়এ রকম ধাপে কোন-কোন বিষয়কে আনা যায়। মনে করি, প্রথম ধাপে ধ্বনির বিশ্লেষণ ও উচ্চারণস্থান বা মাখরাজ, দ্বিতীয় ধাপে বর্ণের উৎস ও বিশ্লেষণ এবং মাখরাজ, তৃতীয় ধাপে শব্দের গঠন ও শব্দচয়ন ইত্যাদি। এমন পরিকল্পনা-প্রশিক্ষণের সময় সবার ক্ষেত্রে অভিন্ন নাও হতে পারে, প্রয়োজনে মূলশিক্ষার অগ্রাধিকার বিবেচনায় সময় বেছে নেয়া যেতে পারে। রমজান মাসে যেমন বন্ধের সময় আরবী ব্যাকরণ বা কিরাতের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয় তেমনি অন্য বন্ধকেও কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠান যদি এসবে জড়িত না থাকে তবে তা সফল হবে বলে মনে হয় না। মাঝেমাঝে বাংলাচর্চা নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করলে ভালো ফল বেরুবে বলে আশা করা যায়। এর সবকিছু নির্ভর করবে প্রতিষ্ঠান-প্রশাসনের সদিচ্ছার উপর। কারণ, চাপ বিনে তাপ উৎপাদন হয় না।

১১.০৬.২০২৩

কোন মন্তব্য নেই:

Featured Post

জামায়াতে ইসলামীর সাথে কওমীদের ঐক্য কি আদৌ সম্ভব ? ভাবনা-৫০ বাংলাদেশে ইসলাপন্থীদের ঐক্য নিয়ে আলোচনার হায়াত অনেক দীর্ঘ । এক সময় ঐক্যের শে...