মঙ্গলবার, ২ মে, ২০২৩

আগামী জাতীয় নির্বাচনে কওমীদের ভূমিকা

ভাবনা-৩৮

ঘনিয়ে আসছে জাতীয় নির্বাচন ২০২৪। এ অবশ্য বিধিবদ্ধ কথা। বাস্তবে আদৌ নির্বাচন হবে কি না, হলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না কি চলমান সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচন হবেইত্যকার বিষয় হিসাবে রাখা অনিবার্য। এখন রাজনীতিক দোলাচল যে চরিত্র বহন করছে তাতে আগাম কিছু বলা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, পর্দা নামের যে বাস্তবতা রাজনীতিতে সারাক্ষণ রাজত্ব করে সেটার এপাশে-ওপাশে কি চলছে, তা সাধারণের কাছে বোধগম্য নয়। এপাশের নাটক না হয় আমরা দেখলাম, ওপাশের দৃশ্য তো দেখা অসম্ভব। উপরে তো সবাই শেখ ফরিদ ভেতরে যদি ‘বোগল মে ইট’ থাকে, তা কি আমরা দেখি? তাই প্রচলিত রাজনীতি মানেই ছলনা, আলো নয় আলেয়া। সঙ্গতকারণে, এ জগতের জ্ঞান না থাকলে; ধূর্ত প্রাণীগুলোর গতিবিধি সম্পর্কে সচেতনতা না থাকলে স্বর্ণ খুঁজতে গিয়ে ছাই হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে প্রবল। মিথ্যার জঞ্জাল, প্রতারণার সমূদ্র আর প্রতিশোধের কুমতলবকে ডিঙ্গিয়ে তীরে পৌঁছানো দুষ্কর। তাই, আজ রাজনীতিতে সৎ, সাহসী ও নীতিবান মানুষের বড়ো অভাব। এখন নেই মাওলানা ভাসানী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমূখদের অনুসারী। এখন দেশ বড়ো নয়, দল বড়ো। দেশের স্বার্থে দলকে গৌণ করার নযীর বিরল। দেশের মানুষ কি ভাবলো আর কি ভাবলো নাতা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। এ চিত্র অস্বীকার করা যায় না।

বলছিলাম, নির্বাচনে কওমীদের ভূমিকা ‍নিয়ে। বিধিবদ্ধভাবে পাঁচ বছরের রাজনীতির নির্যাস নির্বাচন, যদি তাতে মানুষের স্বাধীন মতামত রক্ষার গ্যারন্টি থাকে। আজ দেড় যুগ হয়ে গেলো দেশের মানুষের সাথে সঙ্গী হয়ে আছে সাম্প্রতিক ইতিহাসের নিকৃষ্টতম প্রতারণা। তাই, মানুষ এখন আর ভোট দিতে চায় না। এ হলো বিগত দেড়যুগের রাজনীতির নির্যাস। এমন পরিস্থিতিতে কী হতে পারে কওমীদের ভূমিকা? তাঁরা কি নির্বাচনে ভোট দিতে যাবেন? আমার মনে হয়, এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা জরুরী। ভয় হলো, কওমীদের তো আবার আবেগ নামের এক ভয়ানক অস্ত্র আছে, একতরফা সিদ্ধান্ত নেবার শক্তিশালী স্বভাব আছে। তাই আমার বলা যে কার গায়ে কতোটা লাগবে, জানি না। প্রশ্ন তুলতে পারেন: কওমীদের কি ঐক্যবদ্ধ কোন রাজনীতিক ছাউনি আছে? যৌক্তিক প্রশ্ন। নেই, তবে বিক্ষিপ্ত হলেও একটি বিশাল শক্তি আছে যা কালের সন্ধিক্ষণে মিলিত হলে জাতীয় গতিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। এর অন্যতম নযীর ১৯৯১ সালে ৫ম ও ২০০২ সালে ৮ম জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে চার দলীয় জোটের ধসনামানো বিজয়। অতএব, কওমীদের শক্তি আছে কিন্তু সর্বক্ষণ নিয়ন্ত্রিত নয়। বিক্ষিপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে যায়, তবে আদর্শবিরোধী শিবিরে যোগ দেয় না কখনও। এমন অবস্থায় আগামী নির্বাচন কওমীদের জন্য আদর্শিক ও কৌশলতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা রাজনীতিতে ডানপন্থী বলে পরিচিত, তারা কওমীদের কাছে রাখতে চায় নিঃস্বার্থে নয়, নিজস্বার্থে। এটা কওমীদের বুঝতে সময় লাগে যতক্ষণ না ধোঁকা খায়। প্রচলিত রাজনীতিক দলগুলোর কওমী-শক্তির রস চিবিয়ে পান করার বাসনা গোপন নয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিতর্কিত স্বীকৃতি ও আশ্বাস কওমীরা যখন প্রথমবারের মতো বিবেচনার চিন্তা করে, সে প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যায় ২০২০ সালের মুদীবিরোধী প্রতিবাদে সরকারের অবিবেচকসূলভ সিদ্ধান্তে। অবশ্য এতে কওমীদের অভ্যন্তরীণ আত্মঘাতী সিদ্ধান্তও দায়িত্ব এড়াতে পারে না। সবকিছুর পরে বলা যায়, কওমীরা এখন ভীষণভাবে সরকারবিরোধী।

এখন প্রশ্ন হলো, আগামী জাতীয় নির্বাচনে কওমীরা কি করতে পারে? কওমীরা যা করতে পারে তা হলো:

১. দেশের সকল কওমী আলিমদের একটি সম্মেলন আহ্বান করে মতামত নেয়া ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ। সেটা অবশ্য দু’ভাবে হতে পারে: প্রথমত, বিভাগীয় সম্মেলন ও দ্বিতীয়ত, হাটহাজারীতে জাতীয় সম্মেলন।

২. নির্বাচন যদি বর্তমান সরকারের অধীনে হয় তবে ভোটদান থেকে বিরত থাকা উচিৎ কি না, ভেবে দেখা।

৩. নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কোন দলের লেজুড়বৃত্তি না করে স্বতন্ত্র কোন অবস্থান নেয়া যায় কি না, ভেবে দেখা।

৪. স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে ব্যর্থ হলে বিকল্প অবস্থান ঠিক করা।

৫. একটি ইশতেহার প্রকাশ করে নিজেদের অবস্থান ও কারণ সম্পর্কে জাতিকে অবহিত করা।

পরিশেষে বলতে হয়, দেশের কওমী আলিম ও ছাত্রসমাজ মূলত কওমী মাদরাসাভিত্তিক । এরাই দেশের একমাত্র সামাজিক শক্তি যাঁদের শেকড় মাটি ও মানুষের গভীরে বিস্তৃত। এরা যতোই বিক্ষিপ্ত থাকুক, দুই কোটির কাছাকাছি ভোটব্যাংক জাতীয় নির্বাচনে কওমী-জগতের প্রধানশক্তি। বিক্ষিপ্ত  থেকেও আদর্শিক বন্ধনের জোরে এ শক্তি কাজে আসে অলৌকিকভাবে কালের প্রয়োজনে। এটা নিষ্ঠুর এক বাস্তব। তাই ভোটের আগে সবাই কওমীদের কাছে টানতে চায়। ইসলামবিরেরাধী পরিচিতি নিয়েও ইসলামপ্রীতি দেখাতে হজ্ব করতে  যায়। জানি না বিষয়গুলো আমাদের কওমীরা কতোটুকু অনুধাবন করেন। আমার মনে হয়, হাতি যেমন দুই কানের কারণে তার শরীর দেখতে অক্ষম তেমনি কওমীরাও অসতেনতার পর্দার কারণে আপন শক্তি অনুধাবনে অক্ষম। কিন্তু প্রতিপক্ষরা কওমীদের শক্তি সম্পর্কে সজাগ। সজাগ বলেই লোভ-লালসা দেখিয়ে এ শক্তিকে বাগে আনতে চায়, বিভক্ত করে দুর্বল করতে চায়। এমতাবস্তায় কওমীরা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয় তাতে জাতির কাছে লজ্জিত হতে হবে। আল্লাহ মাফ করুন।

০২.০৪.২০২৩

কোন মন্তব্য নেই:

Featured Post

জামায়াতে ইসলামীর সাথে কওমীদের ঐক্য কি আদৌ সম্ভব ? ভাবনা-৫০ বাংলাদেশে ইসলাপন্থীদের ঐক্য নিয়ে আলোচনার হায়াত অনেক দীর্ঘ । এক সময় ঐক্যের শে...