ভাবনা-৪৩
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর বৌদ্ধদের এতো নির্যাতনের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি একটি অদ্ভুত কথা শুনতে পাই। রোহিঙ্গা-সংশ্লিষ্টজনদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে তারাও বলেন সে-কথা। কথাটি হলো, রোহিঙ্গাদের মাঝে কোন ঝগড়াঝাটি হলে, মতবিতর্ক হলে বা মারামারি হলে তারা সালিশ হিসাবে মীমাংসা করার জন্য নিয়ে আসতো বৌদ্ধদের কাউকে। সুদূর অতীত থেকে চলে আসছে এ প্রথা। এতে বৌদ্ধরা বুঝতে পারে, এদের ভেতরটা কতোটা ক্ষয়ে গেছে। যারা নিজেদের ঝগড়াঝাটি মীমাংসা করতে শত্রুপক্ষকে নিয়ে আসে, তাদের পরিণতির ভয়াবহতা হিসাব করতে হয় না। রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা বুঝতে পেরেই বৌদ্ধরা আজ যা ইচ্ছে তাই করার সাহস দেখাতে পারছে। এই যদি হয় একটি জাতির বৈশিষ্ট্য সে কি কখনও স্বাধীন হতে পারে? বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের রাজনীতিতে হাল আমলে চলছে সেই আত্মঘাতী তৎপরতা। দেখেশুনে মনে হয়, আমরা কোন স্বাধীন ভূখণ্ডের বাসিন্দা নই; কোন ঔপনিবেশিক মকামের মানুষজন। তাই নিজেদের সমস্যা নিজেদের মেটাবার মুরোদ নেই, বিদেশকর্তাদের মুহতাজ হতে হয়। এ রোগ হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে এসব রোগ-বালাই পিছু নিয়েছে। রোগের প্রাদুর্ভাব দেখে মনে হতে বাধ্য, কালেকালে জীবাণু এতো গভীরে ঢুকে গেছে, নিরাময় যেনো অসাধ্য কিছু।যে জাতি শোষণের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, স্বাধীন জনমতের স্বপক্ষে যুদ্ধ করে নিজেদের স্বাধীন করেছে বলে দাবি করে, তারা যখন বহিঃশক্তির কাছে নিজেদের সমস্যা মিটমাট করতে ধর্ণা দেয়, প্রশ্ন করতে হয়: এই কি তবে স্বাধীনতা? আমাদের রাজনীতিকেরা এ প্রশ্নে কখনও দায় নেন না। কেউকেউ স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দেন। বিদেশমুখিতা আর বিদেশনির্ভরতা কিন্তু এক নয়। একটি জাতিকে সুসংহত হতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের খাতিরে বিদেশমুখিতাকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতে হয়, অবশ্য পরিমিত হারে। এ পৃথিবীতে বাঁচতে হলে এক অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়। কিন্তু একটি জাতির জন্য বিদেশনির্ভরতা স্বাধীন চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। তাই, প্রত্যেক সার্বভৌম দেশ ঘোষণা করে: তাদের একটি স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি রয়েছে। এর ভিত্তিতেই একটি স্বাধীন দেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপন স্বকীয়তা বজায় রেখে অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পর থেকে আমরা পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার নামে বিদেশমুখিতাকে অতিক্রম করে বিদেশনির্ভর সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়েছি। ফলে, দেশের ভেতর থেকেই দেশের স্বার্থ বিলিয়ে দেবার অভিযোগ ওঠে। যারা অভিযোগ করেন, ক্ষমতায় গেলে সে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেও ওঠে। কিন্তু কেন? বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক। প্রথমেই একটি বাস্তবতা মেনে কথা শুরু করতে হবে। সেটা হলো, এখন দু’একটি বাদে প্রায় সব দেশে চলছে কথিত গণতেন্ত্রর ভিন্নভিন্ন রূপ। মোটামুটি বলা যায়, গণতান্ত্রিক শাসন। এখন গণতান্ত্রিক শাসন বা সরকারের চরিত্র নিয়েও মতভিন্নতা বর্তমান। ভারতের কাছে তাদের যে পদ্ধতি গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত, সে দৃষ্টিকোণে মার্কিন গণতন্ত্র শুদ্ধ নয়। তেমনি মার্কিন গণতন্ত্রের পদ্ধতিগত দৃষ্টিকোণে ভারতের গণতন্ত্রও বিশুদ্ধ নয়। আবার তুরস্কের গণতন্ত্র দেখুন। সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েও রাষ্ট্রপতি হতে পারেন না ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায়। এর উপর আছে প্রেসিডেন্ট ও সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের নিয়ম। এখন যে পদ্ধতিই হোক বাহ্যিকভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত সরকারকে প্রচলিত গণতান্ত্রিক সরকার বলে গণ্য করা করা হয়। বর্তমানে অবশ্য গণন্ত্রের প্রয়োগে অনেক শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। সব শর্ত পূরণ না হলেও অধিকাংশ শর্ত পূরণ হলে পাশ নম্বর দেয়া হয়।
বর্তমান বিশ্বে নিরপেক্ষ নির্বাচন, জনমত প্রকাশের অধিকার ও জনসম্পৃক্ততা সুশাসনের অন্যতম বড়ো সূচক হিসাবে চিহ্নিত। সেদিক থেকে আমাদের বাংলাদেশের নৈর্বাচনিক ও শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস বড়ো করুণ। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, জনসম্পৃক্ততা, স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার, বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার প্রদান ইত্যাদি প্রচলিত সুশাসনের সূচক হিসাবে স্বীকৃত। মূলত যে সরকার উক্ত বিষয়গুলোতে যতো শক্তিশালী, পররাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় সে সরকার ততো বেশি শক্তিশালী। পক্ষান্তরে, জনসম্পৃক্তহীন ও সুশাসনবিহীন সরকারের অবস্থান ততো দুর্বল। এই যে বিদেশনির্ভরতা বা বিদেশীদের হস্তক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে, সেটা আসে নিজেদের নৈতিক অবস্থানের গভীর-অগভীরতার নিরিখে। তাই, কোন সরকার যদি চায় পররাষ্ট্রের সাথে তার শক্তিশালী ও মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক থাকুক, তাহলে তাকে অবশ্যই জনসম্পৃক্ততা ও সুশাসনসম্পন্ন সরকার হতে হবে যেনো বাইরের শক্তি কোন দুর্বলতা খুঁজে না পায়। দুর্বলতা থাকলে কেউ না কেউ সুযোগ নিতে চাইবে। বনের বাঘ-সিংহ সব সময় দুর্বল শিকারীকেই খোঁজে। সুতরাং, যে দেশে বিদেশী হস্তক্ষেপ হয় বুঝতে হবে সে দেশের সরকারের সুশাসন ও জনসম্পৃক্ততার সূচকের দুর্বলতা অধিক। দেশে সুশাসন থাকলে বিদেশী হস্তক্ষেপের পরিস্থিতিতে জনগণ প্রতিবাদ করে সরকারের সাথে একাত্মতার জানান দেয়। এটাই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মূলশক্তি। তাবৎ বিশ্ব একে সমীহ করে। আর সুশাসনের অভাব হলে জাতি বিভক্ত হয়, বিদেশী হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচনপ্রশ্নে বিদেশী হস্তক্ষেপ বলে যে বলাবলি হচ্ছে, সেটি মূলত দেশে সামগ্রিকভাবে সুশাসনের অভাবহেতু। সঙ্গতকারণে, বিদেশীদের একতর্ফা দোষ দিয়ে আমরা খেয়া পার হবো—সে চেষ্টা বৃথা। রোহিঙ্গা মুসলিমদের টানা উদাহরণ থেকে যদি আমরা শিক্ষা গ্রহণ না করি, নিজেদের ঝগড়ার মীমাংসায় বাইরের সালিশ নিয়ে আসার প্রবণতাকে রোধ করতে না পারি, তবে স্বাধীনতা তো অবশ্যই হারাবো। আমাদের কেউ দাম দেবে না।
২৩.০৫.২০২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন