ভাবনা-৪১
স্মৃতিকে বিস্মৃত করার পুরনো অভ্যাসে আমরা হয়তো ভুলে গেছি: আজ ২০১৩ সালের নির্মম স্মৃতির ১০ বছর পূর্ণ হলো। সে দিবাগত রাতে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ঢাকা-অবরোধকে কেন্দ্র করে ঘটে যায় ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ঘটনা। অজানাসংখ্যক হেফাজত কর্মী-সমর্থকের আহত-নিহত হবার ঘটনা ঘটে সে রাতে। আজও সে ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি না হেফাজতের পক্ষ থেকে, না সরকারের কাছ থেকে। কি হলো, কেন হলো—ইত্যকার প্রশ্নে আজও মানুষের কৌতুহলের অভাব নেই। মূলপ্রশ্ন, পূর্বঘোষিত অবরোধ থেকে মধ্যবেলার পর আকস্মিক শাপলা-চত্বরে ঢোকার সিদ্ধান্ত এবং মাত্র আধ-ঘণ্টার ব্যবধানে সরকারের অনুমোদন পাবার রহস্যের আজও কূলকিনারা হয়নি। ঘটনার পর দায়িত্বশীল কারওকারও কাছে জানতে চেয়েছি বিষয়টি নিয়ে, কেউ মুখ খোলেননি। রাতেই শাপলা-চত্বর ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত হলেও শাপলা-চত্বরে তৎকালীন আমীর মরহুম আহমদ শফীকে আসতে না দিয়ে রাত যাপন করার রহস্যজনক সিদ্ধান্তের জট খোলা যায়নি এখনও। সেদিন রাতে যাঁরা হযরত জুনায়েদ বাবুনগরীর পাশে ছিলেন তাদের সাথে কথা বলেছি, তারা অকপটে জানিয়েছেন: হামলার আগে অর্থাৎ, আহমদ শফী সাহেব শাপলায় যাত্রা করার পূর্বে হযরত জুনায়েদ বাবুনগরী বারবার চেষ্টা করেছেন আমীরের সাথে কথা বলতে, রাতেই শাপলা-চত্বর ত্যাগ করে অনাকাঙ্খিক ঘটনা এড়িয়ে যেতে। কিন্তু তথ্যদানকারীদের মতে আমীরের পুত্র আনাসের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তাদের মতে আনাসের আড়ালে ছিলো: একটি শক্তিশালী চক্র, যারা যে কোনভাবেই শাপলাতে রাত যাপনের পক্ষে ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় অনেক আলোচনা হয়েছে; দায়িত্বশীলদের কেউ মুখ খোলেননি। প্রশ্ন উঠেছে, শহরের বাইরে অবরোধের পূর্বসিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ভেতরে ঢোকার সিদ্ধান্ত হলো কেমন করে? সন্দেহের তীর যাদের দিকে, তারা ব্যাখ্যা দিয়েছেন: বিষয়টি পরিস্থিতির নিরিখে আল্লামা আহমদ শফী রহ.-র নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অনুমোদিত হয়। কিন্তু কেউ-কেউ বৈঠকের বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। পরে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর ইন্তিকালের আনুমানিক বছরখানিক আগে গ্রামের বাড়িতে আসলে আমি গিয়ে সরাসরি তাঁর কাছে বিষয়টি জানতে চাই। প্রশ্নটি করার আগে আমি হযরতের খাদিমকেও সরিয়ে দেই। কারণ, হযরত বাবুনগরী ইতঃস্তত করছিলেন। তিনি আমাকে একান্তে বললেন, বিষয়টি যেন তৎক্ষণাৎ প্রকাশ করা না হয়। বুঝলাম, হযরত তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ না করতে বলছেন। তাঁর কথায়, আসলে কোন সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হয়নি। যারা কুশীলব বলে খ্যাত (হযরত নামও উল্লেখ করলেন যা এখানে প্রকাশ করছি না), তারা প্রথমেই পরিকল্পিতভাবে আমীর আহমদ শফী সাহেবের কাছ থেকে শাপলা-চত্বরে প্রবেশ করে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত লিখে স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। পরে অন্যদের তা দেখিয়ে দস্তখত আদায় করে। হযরতের বাকি কথাগুলো আর লিখলাম না।
আজ ১০টি বছর হারিয়ে গেলো শাপলা থেকে। এ দশ বছরে হেফাজত অনেকটা ভুলে যেতে বসেছে শাপলার স্মৃতি। পরের বছর ২০১৪ সালে কেউ পালন করেনি শাপলার মর্মান্তিক ঘটনার বর্ষপূর্তি। এমন ঘটনা বিরল। পঞ্চাশ বছর আগের ২৫শে মার্চের কালরাত্রির স্মরণ চলে ফীবছর কিন্তু শাপলার হয় না কখনও। এ আমাদের উদারতা(!) না কি বিশ্বাসঘাতকতা—জানবার উপায় নেই। সে-সময় যারা কলকাঠি নেড়েছে, সওদাবাজি করেছে, তারা তো দিব্যি মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অপরাধ কেবল তাঁদের, যারা প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন। কওমীদের পক্ষ থেকে নানা বই-পুস্তক লেখা হয় কিন্তু শাপলার ইতিহাসটা লেখা হয় না। সবার কথা বলছি না, কেউ আছেন আতঙ্কে। তবে আমি নিরাশ হতে পারি না। আমার আশা এ মজলুম ঘটনার ইতিহাস একদিন লেখা হবে, কুশীলব আর সওদাবাজিকরদের পরিচয় প্রকাশ পাবে। তা না হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পূ্বসূরীরা সমালোচিত হবেন, আল্লাহর কাছে তো দায়ি হবেন-ই। শাপলার ঘটনার পর আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন ছিলো; প্রয়োজন ছিলো নিজেদের দুর্বলতাগুলো সারিয়ে নেবার। কিন্তু তাতে কতোটুকু কি হয়েছে—সেটা ফলেই বৃক্ষের পরিচয়। ২০২০ সালের মুদি ও মূর্তীবিরোধী প্রতিবাদ থেকে সে ধারণা পাওয়া যাবে। ইসলামের ইতিহাস তো সওদাবাজিকরদের মুনাফেকির ইতিহাস। সে-কথা কে না জানে? তবুও আমরা ঘরের দরোজা মেলে ঘুমাই; চোর আসে, মালামাল নিয়ে যায়; আমরা কেবল তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখি। মামলাও করি না।
১৮৫৭’র আজাদী আন্দোলন থেকে আমরা যদি নিজেদের রক্ষার কোন শিক্ষা না নিতাম, ১৮৬৭ সালে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা হতো না। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পেছনে সওদাবাজিকর আর কুশীলবদের কি ভূমিকা ছিলো, তা কারও অজানা নয়। আজও মির্জাফরের বংশধরেরা লজ্জায় রাস্তায় বের হতে সাহস পায় না। জানি না, শাপলার মির্জাফরদের বংশধরের কী পরিণতি হবে। যাঁরা ভুক্তভোগী তাঁদের শোকাহত পরিবারের বেদনার্ত স্মৃতির মিনারে দাঁড়িয়ে একটু অনুভব করলে আমার প্রশ্ন আর আপত্তির জায়গাগুলো আশ্রয় পাবে মনে করি। আল্লাহ সকল শহীদ ও মজলুমদের রহম করুন।
০৫.০৪.২০২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন