বৃহস্পতিবার, ৪ মে, ২০২৩

কওমীদের প্রতিভাবান প্রজন্ম কোথায়?

ভাবনা-৪০

প্রতিভা আর মেধার ফরখটা কি? শব্দগুলো আমরা যখন পাইকারিভাবে ব্যবহার করি, মনে কি হয় মানেটা কি? এমন অনেক শব্দ আমাদের লেখাপড়ায় আসে আর যায়, যাদের সঠিক পরিচয় জানা থাকে না। বাংলায় বলে নয়, আরবী, ফারসী, ইংরেজি ইত্যাদিতেও এমন ঘটনা ঘটে। যেমন ধরুন, ‘গণতন্ত্র’। উর্দূতে ‘জমহুরিয়াহ’ বলা হলেও আরবীতে কিন্তু ‘দীমোক্রাতিয়াহ’ (ديمقراطية )। অথচ ‘জমহূর’ আরবী শব্দ। তবে তো ‘দীমোক্রাতিয়াহ’ না বলে ‘জমহুরিয়াহ’ বললে দোষ কোথায়? এ প্রশ্ন আমার। আসলে ভাষার শব্দ-প্রচলনে লোকমুখে ও পরিবেশে ভাবের গভীরতার পরিমাপ প্রামান্য। ধরুন, পানি ও জল। আমাদের এখানে লোকমুখে ও পরিবেশে ‘পানি’র ভাব যতোটা আপন ও গভীর পশ্চিমবঙ্গে ততোটা নয়। আবার পশ্চিমবঙ্গে বিশেষত হিন্দু-সমাজে ‘জল’র ভাব যতোটা কাছের আমাদের এখানে ততোটা নয়। তাই দু’জায়গায় দু’রকমের প্রয়োগ আর বোঝাবুঝি। আবার ‘জল’ পশ্চিমবঙ্গে যতো কাছের হোক ওখানেও পানি আক্রমন করে প্রকাশ্যে। তাই, সেখানে ‘পান্তাভাত’ জলভাত হতে পারেনি; সরবত ‘পানসে’ লাগলেও ‘জলসে’ হবার সাহস দেখায়নি। এ হচ্ছে ভাষার শব্দ-ব্যবহার বা প্রচলনের মারপ্যাঁচ। এগুলো মাথায় না থাকলে আপনার লেখা বা বলা পানসে না হয়ে জলসে হয়ে বসে থাকবে। সূতরাং শব্দ-প্রচলনে ভাবের তারতম্য নখদর্পণে রাখতে না পারলে ব্যবহার ব্যর্থ হবে।

তাহলে ফিরে আসি মেধা আর প্রতিভার আলোচনায়। মেধার আভিধানিক অর্থ: বুদ্ধি, ধীশক্তি, বোধশক্তি, স্মৃতিশক্তি আর প্রতিভার আভিধানিক অর্থ হলো: ব্যক্তির সৃজনীশক্তি, ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিমত্তাবিশিষ্ট গুণাবলী বিশেষ। অর্থের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি, কোন্ শব্দের ভাব ও গভীরতা কেমন। মূলত মেধা কেন্দ্র আর প্রতিভা কেন্দ্রের বিস্তার-ক্ষমতা। বুঝিয়ে বলি। মেধা হলো মূলধন আর সে মূলধনকে ব্যবহার করে আপনি ব্যবসাকে কতোটা বিস্তৃত করতে পারেন বা নতুন-নতুন ব্যবসা উদ্ভাবন করতে পারেন, সে-ক্ষমতা হলো প্রতিভা বা সৃষ্টিশীলতা। ধরুন, আপনি কলম নিয়ে বসলেন দু’কলম লিখবেন বলে। আপনার প্রচণ্ড স্মৃতিশক্তি আছে; প্রচুর তথ্যসূত্র বা রেফারেন্স আপনি অনর্গল দিতে পারেন অথবা আহামরি না হলেও মোটামুটি স্মৃতিশক্তি আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো: আপনার স্মৃতিশক্তি কমবেশি যাই থাকুক, সেটাকে ব্যবহার করে নতুন কি কি সৃষ্টি করতে পারলেন? জাতিকে কী নির্দেশনা বা প্রস্তাবনা দিতে পারলেন যা আপনার পরিবেশের সাথে সংশ্লিষ্ট? আপনার উপসংহার কতোটা সমৃদ্ধ হলো? তথ্যভর্তি লেখা দিয়ে আপনি প্রশংসিত কিন্তু শেষফল কী বের হলো? পাঠক আপনার কাছ থেকে নতুন কী পেলো? এখানে ব্যর্থ হলে লেখক হিসাবে আপনি পরিচিতি পেতে পারেন, সফল হতে পারেন না। মনে রাখতে হবে, যে কলম সংস্কার বা নির্দেশনার পথ প্রদর্শন করে না, সেটা যতো দামিই হোক মোটাতাজা দুগ্ধবিহীন গাভীর তুল্য। বাংলা-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অনেক অবদান আছে কিন্তু নজরুল যেভাবে কষে লাঙ্গল চালিয়ে মাটি ওলটপালট করে জমিকে নতুন চাষের উপযোগী করে তুলেছিলেনসে কি রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন? এখানেই নজরুলের প্রতিভা আর সৃষ্টিশীলতার পারদর্শিতা যা আজও অম্লান। তাই নজরুল বলতে পেরেছিলেন, “আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে চোখ হাসে মোর বুক হাসে!” নজরুল তৃণমূল থেকে উঠে আসা পোড়খাওয়া এক মহান সাহিত্য-সৈনিক। নজরুল-সাহিত্যের বড়ো সম্পদ সৃজনশীলতা যা ফররুখদের মতো বিখ্যাত কবিদের প্রভাবিত করে গেছে। আশা করি এবার বুঝতে পেরেছেন মেধা আর প্রতিভার পরিচয়।

আজ আমি কওমীদের মধ্যে সে প্রতিভাবান-প্রজন্মকে খুঁজছি যাঁরা মেধার পুঁজি নিয়ে সৃষ্টিশীলতাকে বিশ্বের দরবারে পথ দেখাবে। আক্ষেপ করে বলতে হয়, আমাদের কওমী-জগতে নতুন-নতুন ডিগ্রীধারীদের সংখ্যা কম নয়। কেউ আজহারী, কেউ নদভী, কেউ মাদানী আবার কেউ দেওবন্দ থেকে আসা কাসেমী। তাঁদের প্রচুর মেধা আছে বলে জানি, সম্মান করি। কিন্তু ঐ একটা জায়গায় আমাদের হায়-হায় রব তুলতে হয়। সৃজনশীলতার মাপকাঠিতে কারও সনদ চোখে পড়ে না। উস্তাযুল আসাতিযা মাওলানা ইসহাক আল গাযী রহ. বলেছিলেন: এ দেশের মাটিটাই এমন যে, এখানে স্বর্ণ পড়লেও কয়লা হয়ে যায় আর বিদেশের মাটিতে কয়লা পড়লেও স্বর্ণ হয়ে যায়। এ নির্মম বাক্যের মধ্যে হযরতের তিক্ত অতীতের যে মর্মান্তনা ফুটে উঠেসে ব্যথা বুঝবে ক’জন? এও সত্য, প্রতিভার অধীকারী হয়েও আমাদের সন্তানদের কেউ কেউ পরিস্থিতির কারণে, সঠিক মূল্যায়নের অভাবে, কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা-অবহেলায়, অর্থনৈতিক শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে হয়তো কক্ষবাসী হয়ে পড়ে নতুবা আপনক্ষেত্র ত্যাগ করে ভিন্ন পেশায় আশ্রয় গ্রহণ করে হারিয়ে যায়। তাই বলে কি আমাদের জমিটা অনাবাদযোগ্য হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে? কেউ কি এগিয়ে আসবে না ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করে? ইতিহাস কি বলে? চরম ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশের লালচক্ষুকে এড়িয়ে তুরষ্কের রিচেপ তৈয়ব এরদোগান কি মঞ্চে উঠে আসেননি? আজ একজন এরদোগানই কি বিশ্বকে প্রভাবিত করছেন না? আমরা কি পারি না সে দৃষ্টান্তকে কওমী জামা পরিয়ে মঞ্চে তুলে ধরতে? বিশ বছরের সশস্ত্র জিহাদ শেষ করে তালিবান কি আজ তাঁর সৃষ্টিশীলতা দিয়ে আফগানিস্তানকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না? বিশ্বব্যাংক রিপোর্টে তালিবানের অর্থনৈতিক রিপোর্ট কি প্রশংসিত হয়নি? একজন মুফতী তাকী উসমানীর কথাই ধরুন। পাকিস্তানে কি বিজ্ঞ আলিম-উলামার অভাব আছে? কিন্তু একজন তাকী উসমানী দাঁড়িয়ে গেছেন; ইসলামী ফিকাহকে যুগের প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড় করিয়ে জন্ম দিলেনইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেম যা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস-পর্যালোচনা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, পৌরনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বিচারব্যবস্থাপনা: কোথায় নেই মাওলানা তাকী উসমানীর পথনির্দেশনা? পাকিস্তানের শরীয়া আদালতের আপিল বিভাগের চেয়ারে বসে বিচারকের দায়িত্ব পালন করে এ কওমী সন্তান অন্যান্য মেগাবিচারকদের শিখিয়েছেন কি করে আইন বুঝতে হয়; ফয়সালা করতে হয়।

তাহলে আমাদের আজহারী, নদভী, কাসেমী, মাদানী ভাইয়েরা কোথায়? তাঁরা কি পারেন না কওমী জগতকে সৃজনশীলতা দিয়ে সাজাতে; তাঁরা কি পারেন না তাঁদের গবেষণা দিয়ে বিশ্বকে পথ দেখাতে? তাঁরা কি পারেন না তাঁদের দেখা জামিয়া আজহার, দারুল উলূম দেওবন্দ, জামিয়া মদীনা, জামিয়া নাদওয়ার ব্যবস্থাপনাকে কাজে লাগিয়ে কওমী-জগতকে সমৃদ্ধ করতে? বাইরে থেকে বড়োবড়ো গাভী এনে যদি দুগ্ধদোহন সম্ভব না হয় তবে কি সব মাঠে মারা গেলো না? আমাদের এতোএতো মেধাবী সন্তান আছে বলে দাবি করি, তবে কেন হেফাজত আন্দোলন তাঁদের কাছ থেকে কোন পথনির্দেশনা পায়নি? পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রয়োজন ছিলো তাঁদের উপস্থিতি। তাঁদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, গবেষণা হেফাজতের পদযাত্রায় কেন কাজে লাগানো যায়নি? এ দায় কি তাঁদের একার? আমি তো মনে করি, রাজনৈতিক হোমরা-চোমরাদের গদিতে না বসিয়ে ওঁসব প্রতিভাবানদের সামনে আনা গেলে হেফাজতের আজকে এ দশা হতো না। গবেষণা ও সৃষ্টিশীলতায় কওমীদের অবস্থান কতোটা হতাশাব্যঞ্জক তা বুঝতেও আমরা অক্ষম। দুর্ভাগ্য, আমাদের এখানে কারীর চেয়ে ক্যাসেটের দাম বেশি। এটাই হযরত গাযী সাহেব রহ-র মন্তব্যের এক সার। আসলে আমাদের এখানে দক্ষ ব্যক্তির মূল্যায়ন নেই; আছে জ্বী হুযুরমার্কা অদক্ষ মানুষের মূল্যায়ন। তাই, আমাদের বাগানের নাম গুলশান কিন্তু কাজেকর্মে সুনশান। বিখ্যাত দার্শনিক ও আলিম হাকীমুল ইসলাম কারী তয়্যিব সাহেব রহ. লিখে গেছেন:

صرف درس نظامی کے کتابے پڑھنے اور پڑھانے کانام دیوبندیت نہیں ہے

আজ আমরা প্রচণ্ডভাবে অনুভব করছি, একটি প্রবল জোয়ারের যার নিখিল প্রবাহে ভেসে যাবে সব প্রথাগত খড়খুটো; পড়বে নতুন পলিমাটি; শুরু হবে ‍পুরনো জমিতে সৃজনশীলতার নতুন চাষ; ফলবে এ যুগের মুজাদ্দিদদের সরব জন্মোৎসব; মিল্লাত পাবে পথপ্রদর্শক, দেশ পাবে ফসল ফলানো অভিভাবক; সমাজ পাবে সংস্কারের কারিগর আর মানুষ পাবে “নয়া জামানার ডাক”। আমরা কোনভাবেই পারবো না আমাদের নতুন প্রতিভাবান প্রজন্মকে হারিয়ে ফেলতে। যদি পরিবেশ-প্রতিষ্ঠানের প্রতিকূলতায় সে সম্ভব না হয়, তবে ভদ্রতার সাথে; বিনয়ের সাথে প্রতিভাবান প্রজন্মের হাত ধরে ব্যতিক্রমধর্মী কোন প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলে জাতি তাকে অভ্যর্থনা জানাবে। আল্লাহ হা-ফিয।

০৪.০৪.২০২৩ 

 

কোন মন্তব্য নেই:

Featured Post

জামায়াতে ইসলামীর সাথে কওমীদের ঐক্য কি আদৌ সম্ভব ? ভাবনা-৫০ বাংলাদেশে ইসলাপন্থীদের ঐক্য নিয়ে আলোচনার হায়াত অনেক দীর্ঘ । এক সময় ঐক্যের শে...