ভাবনা-৪২
তুরষ্কের রাষ্ট্রপতি রিচেপ তয়্যিব এরদোয়ানের দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোটে বিজয়ী হবার উপর নির্ভর করছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক কিছু। প্রথমে আমাদের মতো দূরদেশীয়রা ভেবেছিলেন, এরদোয়ান সহজে বিজয়ী হবেন। সহজ বিজয় না পেলেও প্রথম দফার ভোটে তাঁকে প্রায় বিজয়ী বলা যায়। আমাদের বাংলাদেশ হলে তো শপথ নেবার আগেই আস্বাদিত হতো ক্ষমতার রস। তুরষ্কের নৈর্বাচনিক নিয়মানুযায়ী এরদোয়ান এ যাত্রায় রাষ্ট্রের কুরসীতে বসতে পারছেন না সত্য, তবে দ্বিতীয় পর্বের ভোটাভুটিতে অগ্রগামী প্রার্থী হিসাবে লড়বেন। এটাও প্রচলিত গণতন্ত্রের এক রূপ। এরদোয়ান ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের চিত্র বুঝিয়ে দেয় গণতন্ত্রের নামে বিশ্বে কতো রকমের হেরফের আছে। মার্কিন গণতন্ত্র আবার আরেক ধরনের, সে বলাবাহুল্য। এরদোয়ানের বিজয় হবে কি হবে না, সেটা নির্ভর করছে জটিল এক হিসাবের মারপ্যাঁচে। এখানে জনগণের রায় বড়ো কথা নয়, প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের যোগবিয়োগের খেলাই বড়ো কথা। এ খেলা নিখাদ এক জুয়াখেলা। মূলত কথিত গণতন্ত্রই জুয়ার এক নয়নাভিরাম ও প্রতারণামূলক আধুনিক সংস্করণ। এ খেলায় এরদোয়ান জয়ী হয়েও দূরনিয়ন্ত্রকদের কারসাজিতে ভোগ করতে পারেন বেদনাবিধুর পরাজয়। আবার মাত্র সামান্যসংখ্যক ভোট পেয়েও পেছনের সারির প্রার্থী বা নিকটতম প্রার্থী পেয়ে যেতে পারেন কুরসীর স্বাদ। লাগবে কেবল স্বার্থ আর গদি দখলের নির্ভেজাল উম্মাদনা।এরদোয়ানের সম্ভাব্য বিজয় জড়িয়ে আছে কেবল তুরষ্কের জাতীয় উত্থানের সাথে—এমন ধারণা বিভ্রমাত্মক। নির্বাচনস্থল তুরষ্ক হলেও প্রভাবের জায়গাটা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বব্যাপী। এখানেই এরদোয়ানের গুরুত্ব বোঝা সহজ। এর প্রমাণ, আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমাদের সর্বগ্রাসী এরদোয়ানবিরোধী প্রচারণা ও চেষ্টা-তদবির। কেন পশ্চিমারা এরদোয়ানের অপসারণ চায়? সবিস্তারে এখানে বলা কঠিন স্থান-স্বল্পতার কারণে ও পাঠকদের ধৈর্য্যচ্যুতির আশঙ্কায়। তবে এটুকু জেনে রাখা দরকার, এরদোয়ান আগের শাসকদের মতো পশ্চিমাদের মনোরঞ্জন করে নিজেকে কাগুজে মানচিত্রে বন্দী করে রাখেননি। আপন ইতিহাসের মর্যাদা পুনর্বিন্যাসে এরদোয়ান প্রতিরক্ষাকে করেছেন উচ্চমার্গীয়; সমরশিল্পকে করেছেন বহির্মুখী; সীমান্তকে নিষ্কলঙ্ক রাখতে বিচ্ছিন্নতাবাদের লাগাম টেনে তৈরি করেছেন নিরাপদ মধ্যাঞ্চল; সিরিয়ার যুদ্ধে অনুপ্রবেশ করে মধ্যপ্রাচ্যকে রাশিয়া ও ইরানের খপ্পর থেকে টেনেছেন ভারসাম্যের দিকে; আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজারবাইজানকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে একদিকে যেমন তুরষ্কের জাতিশাখাকে রক্ষা করেছেন অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার সাহায্যকে বাধাগ্রস্থ করে আজারবাইজানকে বিজয়ী করেছেন। শুধু তাই নয়, এরদোয়ান তার কূটনীতি দিয়ে আমেরিকার মতো পরাশক্তিকে একটি বৃত্তে আটকে রাখতে সমর্থ হয়েছেন যার দৃষ্টান্ত নেই বললে চলে। যে মধ্যপ্রাচ্যে ছিলো মার্কিনের একচ্ছত্র আধিপত্য সেখানে ইরান, কাতার ও রাশিয়ার সাথে মিলে এরদোয়ান মার্কিন প্রভাবকে সীমিত করে ইসরাঈলকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিতে সক্ষম হন। এখন আমেরিকা চাইলেই মধ্যপ্রাচ্যে ছড়ি ঘোরাতে পারবে না। ন্যাটোসদস্য হয়েও রাশিয়ার সাথে কৌশলগত সখ্যতা সৃষ্টি করে মার্কিননির্ভরতাকে দুর্বল করতে পারা এরদোয়ানের বিশাল কৃতিত্ব বলা চলে। দক্ষিণ এশিয়াতেও তুরষ্ক হাত বাড়িয়েছে। এসব বিবেচনা করে পশ্চিমাবিশ্ব আগে থেকেই এরদোয়ানকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে। ২০১৬ সালে এরদোয়ানবিরোধী অভ্যুথান ব্যর্থ হবার পর প্রকাশ হয়ে পড়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের মুখোশ। তাই তাদের একটাই লক্ষ্য—এরদোয়ানের অপসারণ। এরদোয়ান ক্ষমতায় থেকে গেলে পশ্চিমাদের স্বপ্নে লালবাতি জ্বলবে—এ আশঙ্কা তাড়িয়ে ফিরছে তাদেরকে। কারণ, এ-রি মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে পশ্চিমাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার প্রধান কারণ এরদোয়ান।
কূটনৈতিক রাজনীতিতে এরদোয়ানের দক্ষতা অনুকরণীয়। সৌদি কলামিস্ট জামাল খোশোকজীর হত্যাকাণ্ড ও কাতারকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের সাথে তুরস্কের আহত সম্পর্ককে কৌশলে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করেছেন এরদোয়ান নিপূণভাবে। আমেরিকা চেয়েছিলো, তুরষ্কের সাথে সৌদির সম্পর্ক খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলুক। এফ-৩৫ জঙ্গীবিমানকে কেন্দ্র করে মার্কিন আচরণ বুঝতে এরদোয়ানের দেরি হয়নি। তাই যতো সম্ভব কমশত্রুর কৌশলকে কাজে লাগিয়ে এরদোয়ান সৌদি শাসক ও এমবিএস’র সাথে সম্পর্ক মেরামত করে ফেলেন। বিষয়টি মার্কিনীদের কাছে ভালো লাগেনি, লাগার কথাও নয়। ইরানের সাথে সৌদির সম্পর্ক সাপ-নেউলে। চীনের মাধ্যমে সে সম্পর্ক এখন মেঘ কাটিয়ে ওঠার দিকে। এখানেও কাজ করেছে এরদোয়ানের মস্তিষ্ক। আজ ইয়েমেনযুদ্ধ শেষের পথ খুঁজছে। বলাবাহুল্য, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রধান স্বার্থ: ইসরাঈলের নিরাপত্তা। সেখানে বিশেষত সিরিয়ার যুদ্ধে এরদোয়ান রাশিয়াকে সাথে নিয়ে ইরানকে অনেকটা বেকায়দায় রেখে যে চাল চেলেছেন আমেরিকা তাতে বড়োসড়ো মার খেয়েছে বলা যায়। আর আমেরিকা মার খাওয়া মানে ইসরাঈল মার খাওয়া। মার্কিন সমর্থিত কুর্দিদের যেভাবে এরদোয়ান কোণঠাসা করে ফেলেছেন, সেটা আমেরিকাকেও জখম করতে বাদ রাখেনি। বলা যায়, এরদোয়ান ছলে-বলে-কৌশলে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের যেভাবে নাকানি-চুবানি খাইয়েছেন সেটা পর্যবেক্ষকমাত্রই জানেন। এ জ্বালা-এ দহন ভুলতে পারছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও য়ুরোপিয়ান দেশগুলো। তাই তাদের সম্মিলিত লক্ষ্য—এরদোয়ান হটাও! তুরষ্কে যারা এরদোয়ানের বিরোধী শিবির বলে পরিচিত, তারা মূলত পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের বাহক হিসাবে কাজ করছে। সঙ্গতকারণে বলা যায়, কোন কারণে এরদোয়ান নির্বাচিত না হলে তুরষ্কের জাতীয় জীবনে হয়তো বড়ো প্রভাব পড়বে কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে। এরদোয়ানের অনুপস্থিতিতে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যে সঙ্কটের সৃষ্টি হবে সেটার মাশুল হবে ভয়াবহ। তখন রাশিয়া, চীন আর ইরানের মতো দেশগুলোকে সামলানো কঠিন হবে। শুরু হতে পারে নতুন মানবিক ও নিরাপত্তা সঙ্কট। যুদ্ধের লেলিহান শিখা মধ্যপ্রাচ্যে ভিন্নমাত্রায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে বরাবরের মতো ফায়দা লুটবে পশ্চিমা দেশগুলো।
মোদ্দাকথা হলো, এরদোয়ানের জয়-পরাজয় কেবল তুরষ্কের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিকতায়ও হবে এর তীব্র আবেদন ও প্রতিক্রিয়া। রিচেপ তয়্যিব এরদোয়ান তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে তিলতিল করে যে মহীরুহ সৃষ্টি করছেন, তা একটি মাত্র নির্বাচনে হাওয়ায় উড়ে যাবে—এমন ভাবা হবে আহাম্মকীয়। জয়ী না হলেও এরদোয়ানের কর্মই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দিয়ে বিশ্বকে ব্যস্ত রাখবে—তা হিসাব করে বলা যায়। তা’ছাড়া, শাসনে এরদোয়ান বহাল থাকা অবস্থাতে একশ’ বছরের লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে, এও পশ্চিমাদের দুশ্চিন্তার অন্যতম বড়ো কারণ। তাই পরাজয়ে এরদোয়ান হারিয়ে যাবেন না বরঞ্চ জয়ের আবেদন নিয়ে বিশ্ব-রাজনীতিকে প্রভাবিত করে যাবেন। এখানেই এরদোয়ান আমেরিকা ও পশ্চিমাদের কাছে ভয়ঙ্কর।
২০.০৫.২০২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন