ভাবনা-৩২
একশ্রেণীর কথিত
বুদ্ধিজীবি ক্রমাগত বলে আসছেন, বাংলাদেশ নাকি ধর্মনিরপেক্ষ। তাদের কথায় দেশ যদি ধর্মনিরপেক্ষ
হয়, মানুষগুলো কি হবে? এ প্রশ্নের উত্তর কি তারা দিতে পেরেছেন? ওনারা বলেন, সংবিধানে
লেখা আছে। ঠিক আছে, লেখায় যদি সব হয়, তবে কেন ওনারা কথায়-কথায় তুলনা দেন: গোয়ালার গরু
গোয়ালে নেই, খাতায় আছে? প্রশ্ন করতে পারি,
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি? এর চরিত্রই বা কি? তখন ওনারা বলে উঠেন: ধর্মনিরপেক্ষতার এই
মানে, সেই অর্থ ইত্যাদি। বাংলাদেশের এক স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক
সরকারে অন্যতম উপদেষ্টা প্রয়াত আকবর আলি খান লিখেছেন, “বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ইংলিশ-বাংলা
অভিধান অনুসারে ইংরেজি সেক্যুলারিজম শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘নৈতিকতা ও শিক্ষা
ধর্মকেন্দ্রিক হওয়া উচিৎ নয়, এই মতবাদ; ইহজাগতিকতা; ইহবাদ। ’গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের
সংবিধানের বারো অনুচ্ছেদে সেক্যুলারিজমের অনুবাদ করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। কোন অনুবাদ
সঠিক? দুটোই ঠিক। ইংরেজি সেক্যুলারিজম শব্দটির দুটো অভিধা রয়েছে। সেক্যুলারিজম শব্দটি
একটি জীবনদর্শন, আবার এটি একটি শাসনতান্ত্রিক মতবাদও বটে।”(অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে
রাজনীতি পৃ: ৮৯, দ্বিতীয় সংস্করণ: ২০১৭, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা।) তিনি আরও লিখছেন, “তবে শাসনতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতা
ইহবাদের চেয়েও পুরোনো মতবাদ। রোমান ক্যাথলিক গির্জার বিরুদ্ধে শাসকদের ক্ষমতার লড়াইয়ে
এই মতবাদ বিকশিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন এ জন্য যাতে এক ধর্ম অন্য
ধর্মের ওপর প্রধান্য লাভ না করে। কিন্তু ইউরোপে সবাই ছিলো খ্রিষ্টান। ঝগড়াটা এক ধর্মের
সঙ্গে অন্য ধর্মের ছিলো না; ঝগড়া ছিলো খ্রিষ্টানদের বিভিন্ন উপদল বা সিলসিলার মধ্যে।
ঝগড়া শুধু শাসনতান্ত্রিক ছিলো না; লড়াইটি ছিলো মূলত বৈষয়িক।ক্যাথলিক গির্জা ছিলো বিশাল
ভূসম্পত্তির মালিক। ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদ গড়ে ওঠে রাষ্ট্র কর্তৃক গির্জার সম্পত্তি
দখল নিয়ে।”(সূত্র: ঐ) এবার বলুন, মূল সমস্যা কোথায়? এক ঘরে ঝগড়া হলো, তাই সব ঘরে সালিস করতে হবে কোন
যুক্তিতে? ঝগড়া হলো খ্রিষ্টান রাজ্যে; বিষয় হলো সম্পত্তির দখল অথচ সে ঝগড়ার বাগড়া দেয়া
হচ্ছে অন্যঘরে—এ আবার
কোন হিসাব? ইতিহাসে দেখা যায়, চতুর্দশ শতাব্দীতে পোপ-শাসিত রোমান ক্যাথলিক ধর্ম-প্রতিষ্ঠানের
বিরুদ্ধে জার্মান উইটেনবাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মশাস্ত্রের অধ্যাপক মার্টিন লুথারের
(১৪৮৩-১৫৪৬) সংস্কার-আন্দোলন ছিলো মূলত গীর্জার আধিপত্যরোধের আন্দোলন। এখান থেকেই য়ুরোপে
রাষ্ট্র এবং গীর্জার পৃথকীকরণের ধারণা আসে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধর্মহীন করার দাবি ওঠে।
ফলে জন্ম নেয় নিখাদ ইহজাগতিক ধারণা—ধর্মনিরপেক্ষতা,
যা একান্তই য়ুরোপের। আকবর আলী খানের লেখা থেকে বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার
মূলরস কিন্তু ইহজাগতিকতা। এখানে বিচার হবে সামগ্রিক দৃষ্টিতে অর্থাৎ ইহলৌকিক ও পারলৌকিক
চিন্তায় নয়, আংশিক ইহজাগতিকতার ভিত্তিতে। জনাব খানের কথায় আরও স্পষ্ট যে, সেক্যুলারিজম
একটি জীবনদর্শন। অর্থাৎ, য়ুরোপের সমস্যাহেতু যে ধর্মনিরপেক্ষতা জীবনদর্শন হিসাবে বিবেচিত
হবে, সেটা অন্যস্থানেও; অন্যধর্মাঞ্চলেও প্রযুক্ত
হবে। এখানেই আমাদের মূল আপত্তি। য়ুরোপ ধর্মনিরপেক্ষতাকে জীবনদর্শন মেনে যদি রাষ্ট্রনীতি
গড়তে পারে তাহলে আমরা কেন ইসলামকে জীবনদর্শন মেনে রাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করতে পারবো না?
এখানে আপত্তি তাদের, যারা ইসলামকে পূর্নাঙ্গ জীবনবিধান হিসাবে মানতে নারাজ। এ-ছাড়া,
সেক্যুলারিজম মানে যদি এই হয়, কোন ধর্মকে অন্য ধর্মের উপর প্রাধান্য দিতে অস্বীকার
করা, তবে তাও কোন মুসলিম জনগোষ্ঠী বিশ্বাসগতভাবে মানতে পারে না। কারণ, পবিত্র কুরআনে
স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে:
(سورة
فتح)“هو
الذي أرسل رسوله بالهدى ودين الحق ليظهره على الدين كله وكفى بالله شهيدا”
(তিনিই তাঁর রসূলকে হেদায়েত ও সত্য ধর্মসহ
প্রেরণ করেছেন, যাতে একে অন্য সমস্ত ধর্মের উপর জয়যুক্ত
করেন। সত্য প্রতিষ্ঠাতারূপে আল্লাহ যথেষ্ট।)
সুতরাং একজন মুসলমান
একান্ত বিশ্বাসগতভাবে যেমন ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দর্শনকে জীবনদর্শন হিসাবে মানতে পারেন
না তেমনি অন্যান্য ধর্মের তুলনায় ইসলামকে শ্রেষ্ঠ ও সত্য বিশ্বাস করতে বাধ্য। এর অন্যথা
হলে, সে ইহজাগতিকতার যুক্তিতে হোক বা অন্য কোন অজুহাতে হোক তার ঈমান বহাল থাকবে না।
কারণ, কুরআনের স্পষ্ট সিদ্ধান্তের বাইরে যাবার কোন সুযোগ মুসলমানের জন্য রাখা হয়নি।
সেদিক থেকে রাষ্ট্রনীতি বা জীবনদর্শন হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণের সুযোগ নেই। তবে
হ্যা, অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা ও প্রদানে ইসলাম যে নির্দেশনা দিয়েছে তাও মুসলিম সমাজ
মানতে বাধ্য। সঙ্গতকারণে, বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ যেখানে ৯১ শতাংশ মুসলিম
বাস করে, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে আমরা সেক্যুলার হতে পারি না বা তাকে জীবনদর্শন ও রাষ্ট্রনীতি হিসাবে গ্রহণও করতে পারি না।
১৬.০৩.২৩