রবিবার, ১২ মার্চ, ২০২৩

সৌদি-ইরান-চীন সম্পর্ক: চিন্তিত মার্কিন-ইসরাঈল

ভাবনা-২৯

 

বিশ্বরাজনীতির জটিল খেলা আরও জটিলতর হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। মার্কিন-ইসরাঈল অক্ষশক্তির আপ্রাণচেষ্টা সত্ত্বেও স্রোতের বিপরীতে আচমকা ঘটনা ঘটলো একটি। ঘটনায় ভূমিকম্প না হলেও রাজনীতিকম্প হয়েছে বেশ শক্তিশালী। ইতোমধ্যে অনেকে জেনে গেছেন, আন্তর্জাতিক প্রচার-মাধ্যমে চীনের মধ্যস্থতায় চিরবৈরী সৌদি আরব ও ইরান পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে আপাত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। বিশ্বমিডিয়ায় খবরটি বেশ সাড়া ও নাড়া ফেলেছে বলা যায়। ট্রাম্পের জামানায় আরব আমিরাত, সুদান ও ওমানের মতো দেশগুলোকে ইসরাঈলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ফাঁদে ফেলায় আমেরিকা কিছুটা এগিয়ে গেলেও বাইডেনের জামানায় সে প্রচেষ্টাকে একেবারে নাকানি-চুবানি খাওয়ানো হয়েছে। ট্রাম্প কিন্তু তার আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে আরব আমিরাতের সাথে ইসরাঈলের চুক্তিও করিয়ে নিয়েছিলেন। কাতার বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোন আরব দেশে ইহুদীরা দলেদলে এসে ফুটবলীয় উল্লাসে মেতে ওঠে। এগুলো সব আমেরিকার চেষ্টায় আরবদের সাথে ইহুদীদের গা লাগানোর কুশিশ। মার্কিন চেষ্টা শতভাগ সফল হয়েছে বলবো না, কিন্তু ময়লায় ফেলতে না পারলেও গায়ে ময়লা লাগাতে পেরেছে বলা যায়। মনে হচ্ছিলো, সে ঝাপটা এমবিএস’র উসিলায় সৌদিয়াকেও কিছুটা কাত করে ফেলবে। প্রসঙ্গত বলা যায়, ২০২০ সালে কুনওয়ার খুলদূনে শহীদ নামে একজন পাকিস্তানী সাংবাদিক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের একটি সাক্ষাৎকারের সূত্রে রিপোর্ট করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলিম দেশও পাকিস্তানকে ইসরাঈলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকে চাপ দিয়েছে। প্রতিবেদকের বর্ণনায়, সে দেশটি সৌদি আরব। ২০১৭ সালে একজন ইসরাঈলী কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে সংবাদ-মাধ্যম জানায়, এমবিএস’র যুবরাজ হিসাবে শপথ নেয়ার দিন নিরাপত্তার জন্য কয়েকটি ইসরাঈলী জঙ্গীবিমান সৌদি আকাশে টহল দেয়। অবশ্য রিপোর্টটি নিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ কোন উচ্চবাচ্য করেনি। বর্তমানে ইহুদী রাষ্ট্রটির বিমান চলাচলের জন্য সৌদি আকাশ উম্মুক্ত করে দেয়া আছে। এখানে আরেকটি কথা: ট্রাম্প থেকে বাইডেনে উত্তরণের প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরবের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক মানবাধিকারপ্রশ্নে অমসৃণ হয়ে যায়। কারণ, ট্রাম্প যেভাবে এমবিএসকে খালি চেক দিচ্ছিলেন, বাইডেন-প্রশাসন সেভাবে দিতে নারাজ। বিশেষত জামাল খাশোগ্জী হত্যাকাণ্ডে এমবিএসের জড়িত থাকা নিয়ে যে খবর প্রচার হয়, সেটাতে সৌদি আরব বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে নাখোশ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ইয়েমেনের যুদ্ধ নিয়েও বাইডেন-প্রশাসনের ভূমিকায় সৌদি আরব খুশি ছিলো না। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মিত্র ইসরাঈলও ইরানপ্রশ্নে সৌদি আরবের সাথে দহরম-মহরম সম্পর্ক গড়তে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। ভূ-রাজনীতি দিয়েও মধ্যপ্রাচ্য বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, লেবানন প্রভৃতি অঞ্চলে ইরানের উপস্থিতি মার্কিন-ইসরাঈলের জন্য সুখকর নয়। এর মধ্যে রাশিয়ার য়ুক্রেন আক্রমণে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি আন্তর্জাতিক মনযোগ বিভক্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিকে অত্যন্ত চতুরতার সাথে কাজে লাগায় চীন। চীন সৌদি আরবকে বোঝাতে সক্ষম হয়, মার্কিননির্ভরতা থেকে বেরিয়ে ইরানের সাথে সম্পর্ক সহজ করার মধ্যে সৌদি আরবের শক্তির ভারসাম্যতা অক্ষুণ্ন থাকবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রনির্ভর পররাষ্ট্র নীতিতে সৌদি আরব স্বস্তি বোধ করতে পারে না। সৌদি আরব চীনের যুক্তি বুঝতে পারে। তাই চীনের মধ্যস্থতায় ইরানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মধ্যে সৌদি আরব নিজেদের স্বার্থকে বুঝতে দেরি করেনি। সৌদি আরব আশা করছে, এর মধ্য দিয়ে ইয়েমেনেও সে ঝামেলামুক্ত হতে পারবে এবং চীন সেখানেও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকার চেষ্টা করবে। এখানে চীনের স্বার্থ বিলকুল স্পষ্ট। প্রথমত, বহুদিন থেকে চীন বিশ্বপরাশক্তি হিসাবে জানান দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে আছে। দরকারটা কেবল সুযোগের। চীনের সমঝোতায় সৌদি-ইরান সম্পর্ক যদি স্বাভাবিকের দিকে যেতে শুরু করে সে হবে এক বিরাট অর্জন। তখন চীনের বৈশ্বিক ও বাণিজ্যিক দুয়ার বিস্তৃত হবে, সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়ত, চীনের নজর পড়বে ইয়েমেনযুদ্ধ ও য়ুক্রেনযুদ্ধের দিকে। কপাল ভালো থাকলে, দু’টোই পেলে তো পোয়াবারো, নচেৎ একটিতেও চীনের সোনায় সোহাগা হবে। তখন চীনের পরাশক্তি হিসাবে দাঁড়াতে কারও সুপারিশ লাগবে না। সিরিয়ার দিকে চীন তাকাবে কি না, বলা যায় না। কারণ, বিশ্বরাজনীতি নিয়ে তার উচ্চাবিলাষে কোন সন্দেহ নেই। আমার মনে হয়, যে চীন দীর্ঘদিন ধরে নিজের খেয়ে নিজের ভাবনায় মত্ত থাকার নীতিতে অবিচল ছিলো, এখন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ও সুযোগে মধ্যপ্রাচ্যেও ঢুকে যেতে পারে। কারণ, সিরিয়ার অন্যতম খেলোয়ার রাশিয়া ও ইরান চীনের মিত্র। তাই যদি হয়, বুঝতে হবে আগামীর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি যা এখনও মার্কিন ও ইসরাঈলনির্ভর, নতুন রঙে উপস্থিত হতে পারে যেখানে ইসরাঈল তার স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে। প্রভাব কমতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও য়ুরোপীয় দেশগুলোর। চীন অবশ্যই চাইবে, ‍যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেরকে দুর্বল করে মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে। সেখানে সাথে পাবে ইরান, রাশিয়া ও তুরষ্ককে। এতে সৌদি আরবের মতো কিছু আরব দেশ চীনকে সমর্থন করতে পারে। এখানেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশ এবং ইসরাঈলের ভয়। চীনের মধ্যস্থতা নিয়ে কূটনৈতিক স্বাগত জানালেও ভেতরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাঈল যে মোটেও স্বস্তিতে নেই, তা বলাই বাহুল্য।

১২.০৩.২৩           

কোন মন্তব্য নেই:

Featured Post

জামায়াতে ইসলামীর সাথে কওমীদের ঐক্য কি আদৌ সম্ভব ? ভাবনা-৫০ বাংলাদেশে ইসলাপন্থীদের ঐক্য নিয়ে আলোচনার হায়াত অনেক দীর্ঘ । এক সময় ঐক্যের শে...