ভাবনা-২৫
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসার
সাথেসাথে দেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে অদৃশ্য টানাটানি
চলছে। নৈর্বাচনিক ফলাফলে ইসলামী দলগুলোর আসনসংখ্যা উল্লেখ করার মতো না হলেও ভোট-ব্যাংক
হিসাবে বা নির্বাচনে প্রভাব সৃষ্টিতে দেশের ইসলামী দলগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ২০১৩
সালের চার সিটি নির্বাচন রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোটপ্রার্থীদের
একচ্ছত্র জয়ের পেছনে কওমীদের ভূমিকা প্রচার-মাধ্যমে উঠে আসে। সে-সময় দৈনিক আমাদের সময়
প্রধান খবরের শিরোনাম করে, “জোট-মহাজোট নয়, খেলেছে হেফাজত”। ফলে, তাঁদের দুয়ারে ধর্ণা দেয়ার কাতারে শাসক-বিরোধী
সবাই সামিল। দলগুলো মূলত কওমীভিত্তিক। তাই, কওমীরা বিষয়টি নিয়ে কি ভাবছে, তা অবশ্যই
জিজ্ঞাস্য। অতীতে যেভাবে নিজেদের পথ ঠিক করা হয়েছিলো, সেভাবে এখন সম্ভব কি সম্ভব নয়—তা অবশ্যই ভাবার বিষয়। চরিত্রগতভাবে
কওমীরা প্রচলিত ডানপন্থীদের নিকটবর্তী বলে পরিচিত। এর কারণ, ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিত
আওয়ামী ঘরানা ও বামপন্থীদের সম্মিলনকে কওমীরা কখনও ভালো চোখে দেখেনি, এখনও দেখে না।
কারণ, তাঁদের কাছে বামপন্থা মানে নাস্তিকতাচর্চা ও ইসলামবিদ্বেষ। এমন ধারণার শক্তিশালী
কারণও আছে। সেদিক বিবেচনায় তাঁদের সাথে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের ভিটাবাড়ি অধিকতর কাছের।
আবার আদর্শিকভাবে কওমীরা জামাতপন্থী রাজনীতির ঘোর বিরোধী। পদ্ধতিগত কারণে চরমোনাই আন্দোলনের
সাথেও কওমীদের দূরত্ব চোখে পড়ার মতো। এসব বিবেচনায় নিয়ে কওমীদের ভাবতে হবে, আগামী কৌশল
কী হওয়া যুক্তিযুক্ত? এখানে কৌশলটা নির্ধারিত হওয়া দরকার আবেগ বা জোশের বশে নয়। দু’কারণে
এটা নির্ধারিত হতে পারে। এক: কওমী স্বার্থ, দুই: রাষ্ট্রীয় স্বার্থ। কওমী স্বার্থ কি
হবে, সেটা সবাই বসে ঠিক করতে পারেন বা অতীত অভিজ্ঞতা ও বর্তমান বাস্তবতার ভিত্তিতে
নির্ণয় করা যেতে পারে। আমার মনে হয়, শাপলার ঘটনা-পরবর্তী প্রবাহ থেকে শুরু করে মুদিবিরোধী
আন্দোলনের ফলাফলকে সামনে রেখে ইসলামী দলগুলোর কৌশল নির্ধারণ করা দরকার। কোথায় কি ভুল
হয়েছে বা করার দরকার ছিলো, করা হয়নি বা বোঝা দরকার ছিলো, বোঝা হয়নি ইত্যাদি বিচার-বিশ্লেষণ
করে কৌশল ঠিক করা দরকার। বুঝতে হবে, কওমীভিত্তিক ইসলামী দল কারও ইজারাপ্রাপ্ত সম্পদ
নয়। তাঁদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে যদি তাঁদের নীতিগত অবস্থান সঠিক
থাকে। সেদিক থেকে তাঁদের স্বার্থ যে কি, কেমন হবে তার চৌহদ্দী—এসব সম্মিলিতভাবে চিহ্নিত করা
অপরিহার্য। মনে হয়, বাস্তবতার ভিত্তিতে কোন দল বা জোটের আবেগাসৃত অনুসরণ না করে স্বার্থ
ও কৌশলভিত্তিক পন্থাগ্রহণ সুফল বয়ে আনবে। ক্ষমতায় কে আসবে, সে সম্ভাবনায় গা না ভাসিয়ে
যেই আসুক তার কাছ থেকে স্বার্থ আদায়ের কৌশল গ্রহণ করার পথ উম্মুক্ত রাখা অধিকতর ফলদায়ক
হতে পারে। অন্ধ দুই চোখ চায়। কওমীভিত্তিক ইসলামী দলগুলো চাইবে তাঁদের স্বার্থ, নিছক
ক্ষমতাভোগ নয়। অতীতে দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে যেসব পথ অনুসরণ করা গেছে, সেগুলো কতোটুকু
শুদ্ধ ও দূরদর্শী ছিলো—তা
এখনই পর্যালোচনা করা জরুরী। যদিও কওমীভিত্তিক ইসলামী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ কোন জোট নেই,
তা সত্ত্বেও দৃষ্টিভঙ্গীগত ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা গেলে জাতির লাভ হবে। সেখান থেকে অন্তত
স্বার্থ বিষয়ে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যাবে। বলা যায়, তাঁরা ভিন্নভিন্ন দল হওয়া সত্ত্বেও
একটি সম্মিলিত ইশতিহার উপস্থাপন করতে পারেন যা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীগত ঐক্যকে প্রচার
করবে। এটাও কম কিসের? শাপলার মহাসমাবেশের প্রাক্কালে হেফাজত ১৩ দফা দাবি দিয়ে একটিও
আদায় করতে সক্ষম হয়নি। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। খুঁজতে হবে কওমীভিত্তিক ইসলামী
দলগুলো আদৌ ইসলামের মূলধারার রাজনীতি করছেন কি না—সে
প্রশ্নের উত্তর। মনে রাখতে হবে, দাবিতেই ফল নয়। এখন তো সুদী ব্যাংকও সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ইসলামী দাবি করে। তাই বলে কি ওরা সুদমুক্ত?
সবচেয়ে বড়ো দুর্ভাগ্য হলো, ইসলামী দলগুলোর সম্মিলিত কোন পরিষদ নেই যেখান থেকে অন্তত
অধিকাংশ মতের ভিত্তিতে ফিকহী সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসবে। যার ফলে দেখা যায়, দলীয় ফোরাম
থেকেই সিদ্ধান্ত আসে, যা মতান্তরে দুর্বল হয়। খোদ কওমী মাদরাসাগুলোর মধ্যে এমন ব্যবস্থা
চালু নেই। স্বীকৃতির সময় এ দুর্বলতা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। কওমীভিত্তিক ইসলামী দলগুলোকে
সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা কওমী স্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সমন্বয় করে কোন পথ অবলম্বন
করবেন। সেটা যেন অবশ্যই বিশেষ কোন দল বা জোটের অনুগ্রহপ্রার্থী না হয়ে স্বকীয় হয়।
০৭.০৩.২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন