ভাবনা-৩৪
গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিশ্বে এখন বহুল পরিচিত ও প্রচলিত একটি পরিভাষা বা মতবাদ। মুসলিমদের সচেতন অংশ বিলক্ষণ জানেন, কুরআনের আয়াতের অর্থ, উদ্দেশ্য ও ভাব বুঝতে প্রেক্ষাপট জানা জরুরী যা ‘শানে নুযূল’ হিসাবে পরিচিত। বিনা শানে নুযূলে অর্থ ও উদ্দেশ্য জানা সম্ভব নয়। তেমনি প্রচলিত পরিভাষা বা মতবাদের উদ্দেশ্য বুঝতে সেগুলোরও শানে নুযূল জানা অপরিহার্য। এতে করে মূল সমস্যা, সমস্যার সমাধানকল্পে প্রদর্শিত প্রতিক্রিয়া এবং প্রভাব জানা সহজ হয়। আমাদের এখানে কথায়-কথায় গণতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা যারা বলেন, সম্ভবত তারা জানেন না অথবা পড়ে দেখেননি গণতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার সৃষ্টিকারণ—যাকে বলছি, শানে নুযূল। এর ওপর একেকজনের একেক সংজ্ঞা। কেউ বলেছেন, অমুক এটা বলেছেন, তমুক ওটা বলেছেন ইত্যাদি। ইতিহাসূত্রে জানা যায়, মধ্যযুগে পাশ্চাত্যে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় খ্রীষ্টান চার্চের কর্তৃত্বপরায়নতার সাথে রাজার দ্বন্দ্ব এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সরূপ গড়ে ওঠে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা। বিশেষত প্রাচীন গ্রীস এ ধারণার জন্মক্ষেত্র বলে পরিচিত। সে-সময় ইতালীর দার্শনিক নিকোলো মেকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) মধ্যযুগীয় খ্রীষ্টীয় প্রভাব থেকে জাগতিক জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে ধর্মের উর্ধ্বে স্থান দিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্রের ধারণা প্রদান করেন। বিগত একশো বছর ধরে রোমান ধর্মগুরু ও পোপদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তা থেকেই মূলত মার্টিন লুথারের (১৪৮৩-১৫৪৬) প্রোটেস্টান্ট ক্যাথলিক সংস্কার আন্দোলন গড়ে ওঠে। এগুলো ছিলো তৎকালীন খ্রীষ্টান-সমাজের নিজস্ব সমস্যা। এর মূলে ছিলো, চার্চের কর্তৃত্বপরায়নতা থেকে সাধারণ প্রশাসনকে রক্ষা এবং খ্রীষ্টধর্মকে সংস্কার করার আকাঙ্খা। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক নির্মল কুমার সেন বলছেন, “পোপ শাসিত রোমান ক্যাথলিক ধর্মপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ধর্ম সংস্কার অন্দোলনের সূচনা হয় জার্মানীতে মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে। সামন্ততন্ত্রের অবসানকল্পে এটাই ছিলো বুর্জোয়াদের প্রথম সংগ্রাম। লুথার ছিলেন জার্মানীর উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মশাস্ত্রের অধ্যাপক। আবাল্য খ্রীষ্টান ধর্মের প্রতি অনুরাগী লুথারের কাছে পোপের কার্যকলাপ শাস্ত্রবিরোধী বলে মনে হয়েছিল। পাপ মোছনের জন্য পোপের অনুচরদের ক্ষমাপত্র বিক্রয়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে পোপ এবং ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে লুথারের বিদ্রোহের সূচনা”(রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পৃ:৬০, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৮৬, পশ্চিবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলিকাতা)। এভাবেই রাষ্ট্র পরিচালনায় চার্চের কর্তৃত্ব নির্মূলে আন্দোলন চূড়ান্তরূপ পরিগ্রহ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রচিন্তার সূচনা হয়। এ পথ ধরে আসে প্রচলিত গণতন্ত্রের ধারণা। গণতন্ত্রের মূল প্রবক্তাদের মধ্যে যাকে প্রধান ভাবা হয়, তিনি—ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮)। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্ম যার-যার ব্যক্তিগত; শাসনে এর কোন অধিকার থাকতে পারে না। গণতন্ত্রের আরও দু’জন প্রবক্তা হলেন: মোন্টেসক্যু (Montesqiue) ও রুশো (Rousseau)। এ তিন দার্শনিকই ছিলেন ফরাসী। পাকিস্তান শরীয়া আদালতের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারক ও প্রখ্যাত ফকীহ মুফতী তাকী উসমানী ভেলতেয়ারের দর্শন নিয়ে লিখছেন,“ভলতেয়ারের মতাদর্শের আরেকটি কথা, যেটা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে, তা হচ্ছে এই যে, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত একটি বিষয় এবং এমন কোন অথরিটি নেই, যা কাউকে অপরের ধর্ম সম্পর্কে সঠিক বা ভুল সাব্যস্ত করার প্রবক্তা করে তুলতে পারে। বরং এটা মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। মানুষ ইচ্ছা করলে মূর্তিপুজা করতে পারে; ইচ্ছা করলে কোন ঐশী-ধর্ম গ্রহণ করতে পারে; ইচ্ছা করলে ইহুদী বা খ্রীষ্টান হতে পারে। এটা নিছক তার নিজের বিষয়। এখানে চার্চেরও হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই; সরকার তথা রাষ্ট্রেরও হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই। হকুমতের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই” (ইসলাম ও রাজনীতি পৃ: ১০১, ১ম প্রকাশ ২০১৫, মাকতাবাতুল হেরা ঢাকা)। অপর দার্শনিক রুশো সামাজিক সন্ধির (১৭৬২) ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, স্বাধীন এবং মুক্ত মানুষের পারস্পরিক চুক্তিই রাষ্ট্রনৈতিক সংগঠনের ভিত্তি। তাঁর এ মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই তত্ত্বকে সম্বল করে ১৮৬৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলবাণী বলে খ্যাত ‘জনগণের সরকার, জনগণের কর্তৃক এবং জনগণের জন্য’ প্রচার করেন। এভাবেই আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বে কথিত গণতন্ত্র বা ডেমোক্রেসি (এখানে Demos থেকে এসেছে জনগণ এবং Kratos থেকে এসেছে ক্ষমতা বা শাসন) প্রচলিত রয়েছে। সবকিছু পর্যালোচনা করে বলা যায়, সেক্যুলারিজম ও গণতন্ত্র এক অপরের পরিপূরকও রক্ষক। তাহলে বোঝা গেলো, যেসব সমস্যার কারণে পাশ্চাত্যে ধর্মনিরপেক্ষতা আর গণতন্ত্র এসেছে, সেসব একান্তই তাদের সমস্যা, অন্যদের নয়। কিন্তু আজ অষুধ খেতে হচ্ছে পৃথিবীর তাবৎ বাসিন্দার। আমরা যখন বলি, বিদেশী হস্তক্ষেপ কাম্য নয়, প্রশ্ন করি: ধর্মনিরপেক্ষতা আর কথিত গণতন্ত্র তো বাইরের সমস্যাজনিত ফল, আমরা কেন প্রয়োগ করছি? বিদেশী হস্তক্ষেপ তো এগুলোর মধ্য দিয়ে আসছে। যারা ওগুলোর জন্ম দিয়েছে, প্রচার চালাচ্ছে, তারা তো বাইবেলে হাত রেখে শপথ নেয়। তখন কি সাম্প্রদায়িকতা হয় না? সেখানেও তো সংখ্যালঘু আছে। তাহলে আমরা কেন কুরআন ছুঁয়ে বা সামনে রেখে বা আল্লাহর নামে শপথ নিতে পারি না? আসলে মানসিকভাবে আমরা আজও ওদের গোলাম। স্বাধীনভাবে কথা বলার বা কাজ করার অধিকার তো আমাদের শাসক ও রাজনৈতিকেরা আগেই বিলিয়ে বসে আছেন। য়ূরোপে এখন খ্রীষ্টধর্মীয় রাজনৈতিক দল শক্তিশালী হয়েছে। ওখানে মৌলবাদী বলা হয় না কেন? ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায়, ওদেরকে সাম্প্রদায়িক বলা হয় না কেন? দোষ কি শুধু আমাদের ইসলামী রাজনীতি নিয়ে? এখানে ইসলাম নিয়ে কথা বললে স্বাধীনতাবিরোধী হয়। তাহলে ভোটের আগে টুপি মাথায় দিয়ে মুমিন সাজার কসরত কেন? এগুলো কি ধাপ্পাবাজি নয়? আমাদের সমস্যা সমাধান করতে হবে আমাদের ধর্মীয় ও জাতীয় মূল্যবোধ দিয়ে। বিদেশী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে নয়।
২০.০৩.২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন