ভাবনা-৩৫
প্রচলিত ইসলামী রাজনীতি এবং মূলধারার ইসলামী রাজনীতি নিয়ে পার্থক্যের দর্শন আমি অনুভব করি বেশ আগে থেকেই। এর মূল কারণ, ৮০’র দশকের প্রারম্ভে আমীরে শরীয়াত হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-র নেতৃত্বে গঠিত ‘বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন’-এর সাথে আমার সম্পৃক্ততা। হযরতের জীবদ্দশায় বিষয়টি নিয়ে ভাবার সুযোগ হয়নি। কারণ, দু’টো ভিন্নভিন্ন বিষয়ের অস্তিত্ব প্রকাশের আগে পার্থক্যের ধারণা করা অসম্ভব। যেমন, রাত বা দিন অস্তিত্ব লাভ করার পূর্বে রাত-দিনের ভিন্নতা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এক-ই যুক্তিতে হযরত হাফেজ্জী হযুরের রাজনীতি বা অন্দোলনপরবর্তী ইসলামী রাজনীতির আকৃতি ও চরিত্র দর্শিত না হলে প্রচলিত ইসলামী রাজনীতি ও মূলধারার ইসলামী রাজনীতির পার্থক্য নির্ণয়ের ধারণার উম্মেষ হতো না। যাঁরা সে-সময়ে খেলাফত আন্দোলনের চরিত্র ও আচরণ প্রত্যক্ষ করেননি, তাঁদের পক্ষে উক্ত তর্কের মর্ম উপলব্ধি করা দুষ্কর হবে। ১৯৮১ সালের ১১ই নভেম্বর বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত হাফেজ্জী হুযুরের রাজনীতিক প্রক্রিয়াগুলোকে পর্যবেক্ষণ করলে একজন সচেতন মানুষের যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হবে, তা ইসলামী রাজনীতির মূলধারা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে। হাফেজ্জী হুযুরের রাজনীতিক গতি-প্রকৃতিকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায়: এক. আন্দোলন, দুই. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।
হুযুরের ‘খেলাফত আন্দোলন’ নামেই ছিলো ঐতিহাসিক এক সম্বন্ধ ও তাৎপর্য। সচেতন পাঠকমাত্রেই জানেন, ইসলামের খেলাফত-ব্যবস্থা মুসলিম শাসন-ইতিহাসের সর্বোৎকৃষ্ঠ স্বর্ণযুগ। সেই আবেগবাহিত এক আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯১৯ সালে ভারতে, তুরষ্কে উসমানীয় খেলাফত বহাল রাখার দাবিতে। এ আন্দোলন চলে ১৯২৪ পর্যন্ত। এরপর এক-ই নামে নতুন এক আন্দোলন গড়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশে হাফেজ্জী হুযুরের নেতৃত্বে। স্বভাবতই, হাফেজ্জী হুযুরের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও উপমহাদেশবিখ্যাত ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে এমন আন্দোলনে দেশব্যাপী কৌতুহল ও আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এ আন্দোলন যে দ্বিমতে আক্রান্ত হয়নি তা নয়। সবকিছুকে অতিক্রম করে খেলাফত আন্দোলন বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসাবে তার নাম লেখাতে পেরেছে—সেটা যেমন সমসাময়িক কালে পরিচ্ছন্ন রাজনীতির উদাহরণ হিসাবে মানুষকে আকর্ষণ করে, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মধ্যপন্থায় অবস্থান করে আত্মশুদ্ধিনির্ভর ও গঠনমূলক সংস্কারের পথ দেখায়। বলাবাহুল্য, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে আলিম-সমাজের রাজনীতিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে বহুদলীয় রাজনীতি অনুমোদিত হলে ইসলামী রাজনীতির দ্বার উম্মোচিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় মঞ্চে আসে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। তবে প্রকৃত বিচারে হাফেজ্জী হুযুরের জীবদ্দশায় খেলাফত আন্দোলন কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এগুলোই মূলত বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির এক ব্যতিক্রমধর্মী অধ্যায়। ১৯৮১-তে আনুষ্ঠানিক রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও মূলত হাফেজ্জী হুযুর রাষ্ট্রসংস্কারের চিন্তা করেন আরও আগে থেকে। এর প্রমাণ মেলে ১৯৭৮ সালে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে। বৈঠকে তিনি সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ যুক্ত করাসহ বিভিন্ন সংস্কারের জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের কিছু কর্তব্যের কথা তুলে ধরেন। ঐ বছরের ২৯শে মে তাঁর মৌখিক বক্তব্যগুলো তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বরাবরে একটি একটি খোলা চিঠি হস্তান্তর করেন। বাংলাদেশের কোন ইসলামী নেতার জন্য এ ছিলো ইতিহাসের প্রথম নযীর। তা’ছাড়া, মন্ত্রী, প্রশাসনের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের কাছে হাফেজ্জী হুযুরের দা’ওয়াতী চিঠি দিয়ে খেলাফত আন্দোলনের কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন চাওয়া হতো। হযরতের জীবনের শেষ পর্যন্ত এ ধরনের পদক্ষেপ অব্যাহত ছিলো। সরকারী-বেসরকারী উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছেও পৌঁছানো হতো লিখিত দা’ওয়াত। দেশব্যাপী দলের কর্মসূচীতে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন জেলা, থানা ও মাদরাসা সফর করে আন্দোলন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা ছিলো বিরামহীন। ফলে, পুরো দেশে খেলাফত আন্দোলন নিয়ে অভূতপূর্ব উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। তৃণমূল থেকে উপরতলা অবধি সর্বক্ষেত্রে খেলাফত আন্দোলন ছিলো আলোচনার বিষয়।
হাফেজ্জী হুযুরের আন্দোলনের বিস্ময়কর এক দিক ছিলো—তাওবার রাজনীতি। উপমহাদেশের রাজনীতিতে: সে ধর্মীয় হোক বা ধর্মনিরপেক্ষ, এ ছিলো ব্যতিক্রম এবং অভিনব। আমার আজও মনে পড়ছে, তাওবার রাজনীতি প্রশাসন, পুলিশ এমন কি সমাজের সর্বস্তরে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঢাকা স্টেডিয়ামের লাগোয়া বাইতুল মুকাররমের দক্ষিণ ফটকে দ্বিতীয় তাওবা দিবসের (আনু:১৯৮৩) ইতিহাজ্জ্বোল মহাসমাবেশের কথা বিস্মৃত হবার নয়। তখন এরশাদের আমল। সেদিন মঞ্চের সামনাসামনি ছিলাম আমি। হাফেজ্জী হুযুর যখন তাওবার মুনাজাতে হাত তুললেন, দুনিয়া যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো। সে এক হৃদয়বিদারী দৃশ্য! আলিম-উলামা, ছাত্র-জনতা, পুলিশের গগণবিদারী রোনাজারিতে ভেঙ্গে গেলো সব শৃঙ্খল। মনে হচ্ছিলো, আসমানের ফরিশতারাও বুঝি নেমে এলো জমিনে। সিলেটের প্রখ্যাত আলিম মাওলানা আব্দুল গাফফার সাহেব রহ. মতভিন্নতার কারণে ক্ষমা চেয়ে হযরতের দু’পা জড়িয়ে যে ক্রন্দনবিজড়িত দৃশ্যের অবতারণা করেছিলেন, তা কখনও বিস্মৃত হবার নয়। সর্বত্র হযরতের আহ্বান ছিলো: আমরা গুনাহগার; সকল অরাজকতা আমাদের গুনাহ’র কারণ। তাই, আসুন সকলে তাওবা করি। হযরতের স্লোগান ছিলো: এক হও নেক হও; দুনিয়ার মুমিন এক হও নেক হও। আত্মশুদ্ধির সাথেসাথে আল্লাহর জমীনে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নের যে রাজনীতি বা আন্দোলনের দৃষ্টান্ত হযরত হাফেজ্জী হুযুর সৃষ্টি করেন, তা এককথায় অভূতপূর্ব। যতোদূর মনে পড়ে, তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং এরশাদের সাথে সাক্ষাতে বলেছিলেন, আপনারা ক্ষমতায় থাকুন। আমি ক্ষমতা কেড়ে নিতে আসিনি। কিন্তু আল্লাহর জমীনে আল্লাহর হুকুম কায়েম করুন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হযরতের হাফেজ্জী হুযুরের অংশগ্রহণ ছিলো আরেক ইতিহাস। বাংলাদেশের কোন ইসলামী নেতার এমন পদক্ষেপ আর দেখা যায়নি। প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদাতের পর ১৯৮১ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁর প্রতীক ছিলো, বট গাছ। এ নির্বাচনে তিনি তৃতীয় স্থান লাভ করেন বটে কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অর্জিত ভোটের সংখ্যাধিক্যে হযরত হাফেজ্জী হুযুর আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন। তিনি উক্ত নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেন। এরপর আসে ১৯৮৬ সাল। এবারও তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারী হিসাবমতে ১৫ লক্ষ ১০ হাজার ৪ শ ৫৬ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। শতকরা হিসাবে তাঁর ভোটের হার ছিলো ৫.৬৯ শতাংশ। তবে জনশ্রুতি ছিলো, আসলে হাফেজ্জী হুযুর সর্বাধিক ভোট অর্জন করেন কিন্তু কারচুপি করে তাঁকে দ্বিতীয় স্থান দেখানো হয়। দু’-দু’টো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় কেউকেউ এবং কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হুযুরকে দিয়ে দেশ চালানোর সক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলেন। এখানে বিষয়টি পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন। হযরতের রাজনীতির আগাগোড়া পর্যবেক্ষণে কখনও মনে হয়নি তিনি নিছক ক্ষমতামুখী রাজনীতি করেছেন। তার রাজনীতি ছিলো মূলত ইসলামের নির্দেশিত পথে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রসংস্কার। দল গঠন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণে তিনি যা চেয়েছিলেন, তা হলো: ১. আলিম-সমাজকে কেবল মাদরাসাকেন্দ্রিক না রেখে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে জাতীয় উন্নয়নে শরীক করা, ২. জাতীয়ভাবে আলিম-উলামার প্রভাব সৃষ্টি এবং দেশের নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখা এবং ৩. দেশে নির্ভেজাল ইসলামী রাজনীতি ও নেতৃত্ব সৃষ্টি। যেহেতু দেশে তৎকালীন সময়ে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচনব্যবস্থা চালু ছিলো, তাই কোন প্রকার অরাজকতা সৃষ্টি না করে উক্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে যতোদূর সম্ভব সংস্কার-আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং জনসাধারণকে ইসলামের নির্দেশ “আমর বিল মা’রূফ ও নাহী আনিল মুনকার”(সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ)-র সাথে পরিচিত করে তোলা ছিলো হাফেজ্জী হুযুরের রাজনীতিক কৌশল। এ বিষয়গুলোকে উপলব্ধি করতে না পারলে হাফেজ্জী হযুরের রাজনীতির মূল্যায়ন সমূহকঠিন হবে। রাজনৈতিক দল গঠন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে তিনি ঘরমুখো আলিম-সমাজকে যেভাবে সচেতন ও উজ্জীবিত করে গেছেন, তার প্রভাব আজও বহমান।এভাবেই দেশে কিছু সময়ের জন্য হলেও মূলধারার ইসলামী রাজনীতি দৃশ্যপটে হাজির হয় হযরত হাফেজ্জী হুযুরের নেতৃত্বে। মূলত হুযুরের রাজনীতিক পদ্ধতিই মূলধারার ইসলামী রাজনীতি। এটা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। প্রশ্ন করতে পারেন, মূলধারার রাজনীতির মাপকাঠি কি? আমাদের জন্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূলধারার রাজনীতির মাপকাঠি হলো, পঞ্চদশ শতকে শেখ আহমদ সিরহিন্দী মুজাদ্দিদ আলফে সানী রহ. বাদশাহ আকবরের দ্বীনে ইলাহীর মুকাবিলায় যে রাজনীতিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন। ইতিহাসের অকাট্য গ্রন্থগুলো দেখুন, দেখবেন মুজাদ্দিদ আলফে সানীর গৃহীত পদ্ধতিই অনুসরণ করেছিলেন হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ.। মুজাদ্দিদ সাহেব যেভাবে সরাসরি বাদশাহকে দা’ওয়াত দেন, তাঁর আমীর ওমারাকে চিঠি দিয়ে ইসলামের মূলধারায় ফিরে আসার আহ্বান জানান, হযরত হাফেজ্জী হুযুরও সেভাবে দা’ওয়াত পৌছে দেন। মুজাদ্দিদ সাহেব মূলত রাসূলুল্লাহ সা.-র অনুসৃত পথেই তাঁর কর্মসূচী এগিয়ে নেন। আমার মনে হয়, আজও মার-মার, কাট-কাটধর্মী নেতিবাচক রাজনীতির পরিবর্তে হাফেজ্জী হুযুরের অনুসৃত মূলধারার রাজনীতি আমাদেরকে পথ দেখাবে। আন্দোলনের পাশাপাশি আমাদেরকে এও বুঝতে হবে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বাইরের শত্রুকে নিমন্ত্রণ করে এবং আমাদের শক্তিকে নেতিবাচক পথে ক্ষয় করে দুর্বল করে দেয়। সঙ্গতকারণে, বলতে হয়, হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ. যে মূলধারার ইসলামী রাজনীতির উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন, সেটাকে সঠিক মূল্যয়ন করা প্রয়োজন। অন্যথায়, বিপদ আমাদের পদেপদে সঙ্গী হবে।
২২.০৩.২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন