ভাবনা-২৪
ভোট আসছে। এখনও কেউ জানে না ভোটের চেহারা-চরিত্র কেমন হবে। নির্বাচন দশটা হবে নাকি একটা হবে তাও জানা নেই। খবরে দেখলাম, ইসলামী দলগুলো নির্বাচন নিয়ে তাদের কৌশল ঠিক করছে। আমি রাজনীতির মানুষ নই। তবে রাজনীতির খবরাখবর রাখি। বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতিক দলগুলোতে বিভক্তি আছে। ক্যাডারভিত্তিক দল জামাতে ইসলামী, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এবং কওমীভিত্তিক দল। আমার আজকের আলোচনা কওমীভিত্তিক দলগুলোকে নিয়ে। কওমীভিত্তিক ইসলামী দল মূলত কওমী মাদরাসাকেন্দ্রিক। এর নেতা-কর্মীরা নিরঙ্কুশভাবে কওমী মাদরাসার সাথে জড়িত। দেশের অন্যান্য রাজনীতিক দলের যেমন নীতি-দর্শন আছে, কওমীভিত্তিক দলগুলোরও আছে। এদের দর্শন মূলত ইসলামভিত্তিক বলে পরিচিত। অন্যান্য দল যেমন ঘোষিতভাবে ক্ষমতামুখী রাজনীতি করে, এ ঘরানার দলগুলো তেমনটা বলে না। কিন্তু তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেন এবং তাদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেন। এক সময় বামপন্থী বাদে আমাদের রাজনীতিক দলগুলো ছিলো তৃণমূলীয়, এখনকার মতো রাজধানীকেন্দ্রিক নয়। রাজধানীতে সদরকাজ ছিলো কিন্তু পদচারণা ছিলো গ্রামীণ জনপদভিত্তিক। এর বড় উদাহরণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ থেকে পথচলা শুরুর পর মজলুম জননেতা মরহুম আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ গ্রামেগঞ্জে চষে বেড়িয়েছেন দলের ভিত শক্ত করতে। তাঁরা মনে করতেন, প্রান্তিক অঞ্চলের ভিত ছাড়া রাজনীতি অসম্ভব। স্বাধীনতার পর ক্ষমতায়ন হলে আওয়ামী লীগ তৃণমূলায়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেখা দেয় রাজনৈতিক সংঘাত ও অরাজকতা। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেই তৃণমূলীয় ধারাকে ফিরিয়ে আনতে। তিনি প্রায়ই বলতেন, I shall make politics difficult. অর্থাৎ, রাজধানীকেন্দ্রিক আয়েশী রাজনৈতিক ধারাকে গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে এলিটধর্মী রাজনৈতিক নেতাদের জন্য রাজনীতিকে কঠিন করে তুলবেন। এতে তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো, রাজনীতি হবে উন্নয়নভিত্তিক এবং তৃণমূলীয়। পুরো দেশটাকেই তিনি রাজনীতির মাঠ বানাতে চেয়েছিলেন যেন সবাই সমান অংশীদার হন। তাঁর শাহাদাতে সেটা আর হয়নি। বিএনপিও রাজধানীভিত্তিক এলিট-রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়। দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, আমাদের কওমীভিত্তিক ইসলামী দলগুলোও এলিট-রাজনীতির খপ্পরে পড়ে যায়। এরা মূলত রাজধানীভিত্তিক। গ্রামীণ জনপদে এদের পদচারণা শূণ্যের কাছাকাছি। অথচ এটা কওমী-দর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কওমী-দর্শন ভিত্তিগতভাবেই তৃণমূলীয়। তাঁদের মূলশক্তি গ্রামীণ জনপদে। দেওবন্দ মাদরাসার মৌলনীতি বা উসূলে হাশতগানা দেখলেই তা বোঝা যাবে। তা’ছাড়া, ‘সাওয়ানেহে কাসেমী’তে (হযরত কাসেম নানতুভী রহ.-র জীবনীগ্রন্থ: মাওলানা মানাযির হাসান গিলানী রহ.) বিষয়গুলো স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে। তাহলে কেন তাঁরা আজ রাজধানীনির্ভর? ক্যাডারভিত্তিক দল জামাতে ইসলামী বিশ্বাস করে: আগে ক্ষমতা পরে ইসলাম। তাই তারা ক্যাডারভিত্তিক ও ক্ষমতামুখী। কিন্তু কওমীরা এর বিপরীত। তাঁরা মনে করে তৃণমূলীয় সমাজ-সংস্কার আগে, ক্ষমতা পরে। ক্ষমতা মূল আরাধ্য নয়, ইসলামের দা’ওয়াত ও সংস্কার মূল আরাধ্য। আর প্রচলিত রাজনীতিতে ইসলামের আদর্শ অক্ষত রেখে কতোটুকু অংশগ্রহণ সম্ভব তা গবেষণার বিষয়। সন্দেহ নেই, সর্বব্যাপী সংস্কারের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। মনে পড়ে আমীরে শরীয়ত হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ.-র তাওবার রাজনীতির কথা। মূলত সেটাই ছিলো ইসলামের মূলধারার রাজনীতি বা আন্দোলন। হযরতের ইন্তিকালের পরে সে ধারা আর অব্যাহত থাকেনি। এর বিষময় ফল এখনও আমাদেরকে ভোগ করতে হচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কওমীভিত্তিক ইসলামী রাজনীতিক দলগুলোকে প্রথমেই ঠিক করতে হবে, তারা কোন পথে যাবেন। তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, অন্য কোন দলের সাথে জোট করতে পারেন কিন্তু মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে নয়। মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যদি রাজনীতিক দল টিকিয়ে রাখতে হয়, মনে হয় সেটা অন্য কিছু হবে, ইসলামী রাজনীতি হবে না। মা বেঁচে থাকতে ‘মা’ ডাকলে অর্থবহ হয়, মা মরে গেলে সে ডাক কে শুনবে? আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে মনে হয়, ইসলামী দলগুলোর তৃণমূলীয়করণ করা দরকার যা অনুপস্থিত। মনে রাখা দরকার, কওমী মাদরাসা আর কওমীভিত্তিক রাজনীতিক দল এককথা নয়। তাঁরা রাজনীতি করুন কিন্তু রাজনীতিজীবি না হোন। এটাই কাম্য।
০৪.০৩.২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন