ভাবনা-২০
আমাদের দেশের রাজনীতিতে কিছু নীতি-স্লোগান প্রচলিত আছে। ওসবের মধ্যে একটি হলো: দলের চেয়ে দেশ বড়। শুনতে ভালোই লাগে; লাগারই কথা। অনীতিতে যতোই আমরা সিদ্ধহস্ত হই, নীতিকথাতে সাঁই না দেবার দহলিজে এখনও পা রাখিনি। একে বলতে পারি, শেষরক্ষার অবশিষ্ট। রাজনীতি নিয়ে আমাদের কটাক্ষ কম নয়। তবুও এতীমের মতো গুটিকয়েক সৎ ও নিষ্ঠাবান রাজনীতিক আমরা কালভদ্রে দেখি। ওনারা গুটিকয়েক বলে দলবাজদের কোলাহলে নিতান্ত সংখ্যালঘু। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলবাজদের ধাক্কায় গুটিকয়েক রাজনীতিক সাধারণের কাছে বরাবরই অপরিচিত থেকেছেন। বদনামের তকমা তাঁদের গায়েও আছড়ে পড়েছে অবলীলায়। সমাজ বাছ-বিচার করে না; কাউকে রেহাই দেয় না। যখন কোন এক অজানা রিকশাওয়ালা বা দিনমজুর খুঁজে পাওয়া লোভনীয় টাকা মালিককে ফেরৎ দেন, আমরা তাঁকে বলি: বিরল সততায় ধন্য। প্রচার-মাধ্যমে ভরে যায় তাঁর মহত্বের ছবি-সংবাদ। কিন্তু আমরা কখনও দেখি না, আমাদের পঁচা রাজনীতির মাঝে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা সেই গুটিকয়েক মানুষের কথা, যাঁরা নিজের খেয়ে পড়ে, বাপের জমি বেচে সংসার চালান আর মানুষের জন্য রাজনীতি করেন। অনেকেই হয় তো জানেন না, প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদের আমলে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন মরহুম মুফতী ওয়াক্কাস। খবরের কাগজে বেরিয়েছিলো, তিনি কখনও সরকারী আবাসন সুবিধা নেননি; নিজের ভাড়া বাসায় থাকতেন। এমপি থাকাকালে পতাকাবাহী গাড়িও ব্যবহার করেননি। রিকশা-টেক্সিতে চলাচল করতেন। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের সে-কথা। ইতিহাসে পড়েছি, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা মরহুম এ কে ফজলুল হক যখন কোথাও বেরুতেন, তাঁর একটি গাড়ি ছিলো। একবার বেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলে গাড়ি চালানো যাচ্ছিলো না। কারণ, গাড়ির সামনের বাতি দু’টো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় টাকার অভাবে ঠিক করা হয়নি। এখন কি করা? গাড়ির চালক শেষ পর্যন্ত একটি হারিকেন জোগাড় এনে শেরে বাংলার নির্দেশে গাড়ির সামনে ঝুলিয়ে দিল। হারিকেনের আলোতে আস্তেআস্তে গাড়ি সামনে চললো। এই হলো, দুই সৎ-রাজনীতিকের মহৎ উদাহরণ। মজলূম জননেতা মরহুম মাওলানা ভাসানীর কথা তো বলাই বাহুল্য। এঁরা তাঁরা, যাঁরা দেশের জন্য, দশের জন্য ত্যাগের মহিমা রেখে গেছেন—সেখানে দল ছিলো গৌণ, ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কোন প্রশ্ন ছিলো না। কিন্তু আজ? রাজনীতির কথা উঠলেই মানুষ গাল দিয়ে বরণ করে। ঘৃণায় লাল হয়ে ওঠে বিবেক। দেশ আজ গৌণ, দল বড়ো; প্রাপ্তির ভাগ আমাদের সামনে আয়না ধরিয়ে দেয়। দলের স্বার্থে, ক্ষমতার স্বার্থে দেশ আর দশ অসহায় হয়ে যায়। বিদেশের বেগমপাড়া হয়ে ওঠে রমরমা। আমাদের টাকার বোঝা টানতে হাঁপিয়ে ওঠে সুইস ব্যাংক। আমেরিকার মাটিতে পরিবার রেখে দেশের মাটিতে রাজনীতি করার মজাই আলাদা। নিজেদের আখের গোছাতে বলি দিতে হয় জনগণকে; গোটা দেশকে। এ যে সোনার বাংলা!
২৮.০২.২৩