মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

দল বনাম দেশ

 ভাবনা-২০

আমাদের দেশের রাজনীতিতে কিছু নীতি-স্লোগান প্রচলিত আছে। ওসবের মধ্যে একটি হলো: দলের চেয়ে দেশ বড়। শুনতে ভালোই লাগে; লাগারই কথা। অনীতিতে যতোই আমরা সিদ্ধহস্ত হই, নীতিকথাতে সাঁই না দেবার দহলিজে এখনও পা রাখিনি। একে বলতে পারি, শেষরক্ষার অবশিষ্ট। রাজনীতি নিয়ে আমাদের কটাক্ষ কম নয়। তবুও এতীমের মতো গুটিকয়েক সৎ ও নিষ্ঠাবান রাজনীতিক আমরা কালভদ্রে দেখি। ওনারা গুটিকয়েক বলে দলবাজদের কোলাহলে নিতান্ত সংখ্যালঘু। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলবাজদের ধাক্কায় গুটিকয়েক রাজনীতিক সাধারণের কাছে বরাবরই অপরিচিত থেকেছেন। বদনামের তকমা তাঁদের গায়েও আছড়ে পড়েছে অবলীলায়।  সমাজ বাছ-বিচার করে না; কাউকে রেহাই দেয় না। যখন কোন এক অজানা রিকশাওয়ালা বা দিনমজুর খুঁজে পাওয়া লোভনীয় টাকা মালিককে ফেরৎ দেন, আমরা তাঁকে বলি: বিরল সততায় ধন্য। প্রচার-মাধ্যমে ভরে যায় তাঁর মহত্বের ছবি-সংবাদ।  কিন্তু আমরা কখনও দেখি না, আমাদের পঁচা রাজনীতির মাঝে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা সেই গুটিকয়েক মানুষের কথা, যাঁরা নিজের খেয়ে পড়ে, বাপের জমি বেচে সংসার চালান আর মানুষের জন্য রাজনীতি করেন। অনেকেই হয় তো জানেন না, প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদের আমলে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন মরহুম মুফতী ওয়াক্কাস।  খবরের কাগজে বেরিয়েছিলো, তিনি কখনও সরকারী আবাসন সুবিধা নেননি; নিজের ভাড়া বাসায় থাকতেন। এমপি থাকাকালে পতাকাবাহী গাড়িও ব্যবহার করেননি।  রিকশা-টেক্সিতে চলাচল করতেন। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের সে-কথা। ইতিহাসে পড়েছি, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা মরহুম এ কে ফজলুল হক যখন কোথাও বেরুতেন, তাঁর একটি গাড়ি ছিলো। একবার বেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলে গাড়ি চালানো যাচ্ছিলো না। কারণ, গাড়ির সামনের বাতি দু’টো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় টাকার অভাবে ঠিক করা হয়নি। এখন কি করা? গাড়ির চালক শেষ পর্যন্ত একটি হারিকেন জোগাড় এনে শেরে বাংলার নির্দেশে গাড়ির সামনে ঝুলিয়ে দিল। হারিকেনের আলোতে আস্তেআস্তে গাড়ি সামনে চললো। এই হলো, দুই সৎ-রাজনীতিকের মহৎ উদাহরণ। মজলূম জননেতা মরহুম মাওলানা ভাসানীর কথা তো বলাই বাহুল্য। এঁরা তাঁরা, যাঁরা দেশের জন্য, দশের জন্য ত্যাগের মহিমা রেখে গেছেনসেখানে দল ছিলো গৌণ, ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কোন প্রশ্ন ছিলো না। কিন্তু আজ? রাজনীতির কথা উঠলেই মানুষ গাল দিয়ে বরণ করে। ঘৃণায় লাল হয়ে ওঠে বিবেক। দেশ আজ গৌণ, দল বড়ো; প্রাপ্তির ভাগ আমাদের সামনে আয়না ধরিয়ে দেয়। দলের স্বার্থে, ক্ষমতার স্বার্থে দেশ আর দশ অসহায় হয়ে যায়। বিদেশের বেগমপাড়া হয়ে ওঠে রমরমা। আমাদের টাকার বোঝা টানতে হাঁপিয়ে ওঠে সুইস ব্যাংক। আমেরিকার মাটিতে পরিবার রেখে দেশের মাটিতে রাজনীতি করার মজাই আলাদা। নিজেদের আখের গোছাতে বলি দিতে হয় জনগণকে; গোটা দেশকে। এ যে সোনার বাংলা! 

২৮.০২.২৩    

বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির স্থপতি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি



বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির স্থপতি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি: বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির স্থপতি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি- সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। আমি তাকে অরাজনৈতিক ব্যক্তি বললেও মূলত তিনি পর্দার অন্তরাল থেকে দলীয় রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে দাবার চাল দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির আসনে থেকে তিনি রাজ�...

শুক্রবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

ছাত্রলীগ সমাচার

ভাবনা-১৯

আওয়ামী লীগের ছাত্র-সংগঠন ছাত্রলীগের বিশেষ করে ঢাকায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ড জাতীয়ভাবে প্রশ্ন ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। শুধু ছাত্রলীগ নয়, ছাত্রীলীগও এখন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনায়। এসব নিয়ে সীমিত পরিসরে হলেও পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ঘৃণার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে মনে হয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদের সময় সরকারীদলের ছাত্র-সংগঠন ছিলো, ‘নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ’। ঢাকায় তাদের দৌরাত্ম্য আমি দেখেছি। যতোদূর মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র সরকারী ছাত্র-সংগঠনের হাতে নির্যাতিত হয়ে তার শিক্ষার যে করুণ পরিণতি হয়সেটা তিনি এক সাক্ষাতে সরাসরি পেসিডেন্টকে অবহিত করতে সক্ষম হন। মরহুম এরশাদ সাহেব বিন্দুমাত্র দেরি না করে তাঁর গড়া নতুন বাংলা ছাত্র সমাজকে নিষিদ্ধ করে দেন। ছাত্র-সমাজের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ তা নিয়ে অনেক লম্ফঝম্ফ করেন কিন্তু মরহুম প্রেসিডেন্ট তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়াননি। পুরো জাতি সেদিন এমন পদক্ষেপের জন্য প্রেসিডেন্ট এরশাদকে অভিনন্দিত করে। দোষে-গুণে মানুষ। যার যা ভালো বলতে হবে। এটা অন্য কেউ পারেন নি। রাজনীতির সুযোগে ছাত্রেরা এসব কেন করে? এর বড়ো কারণ অপরিণত বয়সে ক্ষমতার স্বাদ ও অপব্যবহার। ছাত্রদের মূলকাজ লেখাপড়া, জ্ঞানার্জন ও দেশসেবা। তা না করে এখন তারা যা করছেসেসব যে নিখুঁত চোর-ডাকাত আর অপরাধীদের কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য সবাই যে এমন, তা কিন্তু নয়। কিছু ভালো ও মেধাবী ছাত্রও আছে। কিন্তু সংখ্যায় তারা কম। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ছাত্রলীগ কিন্তু প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রিত কোন সংগঠন ছিলো না। ছাত্রলীগের সাবেক ছাত্রনেতারাও কিন্তু তেমনটা বলেন। সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ফজলুর রহমান বিভিন্ন টকশোতে বারবার সে-কথা বলেছেন। তাঁদের কথা হলো, মূল রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকেই অধঃপতনটা শুরু হয়। কারণ, এখানে ক্ষমতার স্বাদটা বেশ কাছের। আর ক্ষমতা কে না ভোগ করতে চায়? বলা দরকার, ১৯৩৮ সালে কোলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করা হয়। সে-সময় মুসলিম ছাত্রলীগ মূলত তিনটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের সংগঠিত করে: (১) সকল ক্ষেত্রে মুসলমানদের দাবি তুলে ধরা (২) মুসলমান ছাত্রদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা (৩) শিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশ সাধন করা। (বংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাস, কে. এম. শামসুল আলম, প্রকাশ: ১৯৯৩, পৃ:৩) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নাম পরিবর্তন করে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ হিসাবে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ প্রচারিত এক বিজ্ঞপ্তিমূলক দলীলে তারা জানায়, “..সরকারের জনকল্যাণকর কর্মপদ্ধতির প্রতি আমাদের সক্রিয় সাহায্য ও সহানুভূতি থাকবে, কিন্তু সরকারের জন ও ছাত্র স্বার্থবিরোধী কর্মপন্থার বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াবো। পক্ষান্তরে, বাধ্যতামূলক ফ্রি প্রাইমারী চিকিৎসার ব্যাপক ব্যবস্থা, বিনা খেসারতে জমিদার ও বর্গাদার প্রথার উচ্ছেদ, নানাবিধ কারিগরী সুবন্দোবস্ত, পূর্বপাকিস্তানে সামরিক শিক্ষার সুবন্দোবস্তের জন্য সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন, ডাক্তারী ও ধাত্রীবিদ্যা প্রসারের জন্য উন্নত ধরনের নতুন কারিকুলামের দাবি, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মুনাফাকারী ও চোরাকারবারীর সমূলে বিনাশ এবং ইসলামী ভাবধারায় শিক্ষা প্রসারের জন্য আমাদের প্রস্তাবিত নবপ্রতিষ্ঠানটি কাজ করে যাবে।” (সৌজন্যে: ঐ, পৃ:১৮) এতোএতো মহৎ কর্মসূচী ঘোষণা করে যে দলটি ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেসে দল কেমন করে আজকের এ অধঃপতিত অবস্থায় পতিত হলো, সে কি কালের প্রশ্ন নয়? আমার বারবার মনে হয়, ছাত্রলীগের মতো ঐতিহাসিক সংগঠনটির দুরাবস্থার জন্য দায়ী মূলত ক্ষমতাসীনদের অপব্যবহার। বড়োরা যদি তাদেরকে টিকে থাকার ঢাল হিসাবে ব্যবহার না করতেন, তবে কি ছাত্রলীগ এভাবে বিতর্কের বস্তুতে পরিণত হতো? তাদেরকে সঠিক ব্যবহারে অনেক দেশসেবী মেধাবী মানুষের জন্ম হতো, তা তো অস্বীকার করা যায় না। বিরানী পঁচলে দুর্গন্ধে দুনিয়া ভরে যায়। এদেরও অবস্থা হয়েছে সে-রকম। এদের ঠিকানা ছিলো পড়ালেখায়, কিন্তু আজ ঠাঁই হলো নর্দমায়। কেন?সে প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই খুঁজে দেখতে পারে। সবাইকে ভাবতে হবে, বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্রদেরকে ক্ষমতাসীনদের লাঠিয়াল হিসাবে ব্যবহারের প্রবণতা রোধ করা যায় কি না।

২৪.০২.২৩               

বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

স্থানীয় নির্বাচনের জমা-খরচ

ভাবনা-১৮

কোথায় যাবো বলুন, দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে কিন্তু দলীয়ভাবে। আগে হতো স্বতন্ত্র বা দলনিরপেক্ষ। এ সরকার এসে করে দিলো: সব স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা যাবে। আগে ছিলো বাঘ বনে, এখন এলো লোকালয়ে। দলনিরপেক্ষ স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী যাচাই করার অবাধ সুযোগ ছিলো মানুষের হাতে, এখন দলীয় ছায়ায় সে সুযোগও গেলো হাতছাড়া হয়ে। দলীয় রাজনীতির কলুষতায় কিছুটা হলেও আগে যে সুষম পরিবেশ ছিলো, এখন তা নেই। মারমার-কাটকাট জাতীয় অবস্থা স্থানীয় নির্বাচনগুলোকে করে রাখলো পিষ্ট। এখন আমরা কী করবো? মানুষটা হয়তো ভালো, হলে কি হবে, তার প্রতীক তো তাকে আমার কাছে থেকে আলাদা করে রেখেছে যদি আমি ঐ দলীয় রাজনীতির সমর্থক না হই। এখানে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বা বিবেচনার সুযোগ কম। বলতে পারেন, দলীয় প্রভাবে ক্ষতি কোথায়? শুনবেন সে কথা? দুনিয়ার অন্য কোথাও কেমন জানি না, এখানে দলীয় মানে জিঘাংসা, হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, খুনোখুনি আারও কতো কি! এক-ই সমাজে বসবাস করি, থাকি, খাই কিন্তু প্রতীক কাঁধে একে অপরকে ধরাশায়ী করতে নিত্য তৎপর। আগে তো স্কুলে রাজনীতি ছিলো না। এখন ছাত্রলীগের কমিটি হচ্ছে, ছোটছোট ছেলেরা যারা উত্তর-দক্ষিণ চেনে না; এখনও মানসকে কলুষ করতে শিখেনি, অভদ্র আচরণে অভ্যস্ত হতে পারেনিতারা দলীয় রাজনীতির স্বাদ পেয়ে বাবার সামনেও মাস্তানী করার সাহস পাচ্ছে, দলের উপরের মহল আশকারা দিচ্ছে। এসবের উদাহরণ কম নয়। পত্র-পত্রিকায় বেরুনো খবর কি কম? এসবে দল মনে করছে, এতে তৃণমূলে দলের প্রভাব বাড়বে; দখল বাড়বে। বিনিময়ে সমাজ যে ভেতর থেকে, একেবারে তলা থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছেসে খবর কি আছে? মনে রাখতে হবে, যে যা করায় সেটার মুখোমুখী একসময় নিজেকেও হতে হয়। কেউ রক্ষা পাবে না। আজ যে দল ক্ষমতায় থেকে এসব করাচ্ছে, তারা কি সবসময় ক্ষমতায় থাকবে? তখত বদল হলে কাল যখন অন্যদলের ছেলেরা এসে উল্টাপাল্টা করবে, ভালো লাগবে? ইট মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। বলছিলাম, স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে। কালভদ্রে কিছু অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ও ভদ্র মানুষ ভোট চাইতে আসে। আমার দুঃখ হয়। সমর্থন করতে ইচ্ছে করে ব্যক্তিত্বের দিকে চেয়ে। কিন্তু ঐ যে বললাম, দলীয় পরিচিতিতে মন যায় না। আগে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, আবার এসেছেনতারাও বলছে কাজ করবেন। কিন্তু বিশ্বাসের জায়গাটা কোথায়? গত নির্বাচনে শুনেছি, প্রার্থী দম্ভরেভভরেভভরে বলছেন, ভোট আপনারা যেখানেই দেন সেটা অমুক বাক্সে চলে আসবে। তাহলে আমরা ভোটকেন্দ্রে যাবো কেন?  ’১৪ আর ’১৮-তে তো দেখেছি। যদি বলি স্বতন্ত্রে যান, তারও কি উপায় আছে? এ ওর টাকাতে দাঁড়িয়েছে; ও তো ভোট কাটতে এসেছে ইত্যাদি। বলা হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের না দিলে এলাকায় উন্নয়ন হবে না। তবে আর ভোট দেয়া কেন? ঘরে বসে নিজের অবস্থার উন্নয়নে কাজ করলেই ভালো। চেয়ে-চেয়ে দেখলাম তুমি হয়ে গেলে, আমার করার কিছু ছিলো না।

২৩.০২.২৩   

বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

বাজার-দর্শন

ভাবনা-১৭

বাজারের থলে নিয়ে কি আগে বাজারে যাবো না কি হাসপাতালে? মজা করে বলছি না। সত্যি-সত্যি বলছি! আমরা থাকি মফস্বলে। শহুরে কথা বলতে পারবো না। বাজারের বর্তমান হালাবস্থা এখন আর বোঝাতে হয় না। শীতের পানি যে কতো ঠাণ্ডা নামলেই বোঝা যায়; যন্ত্র লাগে না। তেমনি বাজারের যে কি অবস্থা থলে নিয়ে গেলে বোঝা যায়; খবরের কাগজ দেখতে হয় না। বলছিলাম, হাসপাতালে আগে যাবো কি না। কারণ জানতে চান? বলছি। অপারেশনে গিয়েছেন কখনও? না গেলেও অন্যজনের অপারেশনের খোঁজ-খবর তো রেখেছেন নিশ্চয়। ডাক্তার যখন ঠিক করেন অপারেশন করতে হবে, রোগীও যখন মনস্থির করেন: ব্যবচ্ছেদে যাবেন, তার আগে ডাক্তার রোগীর রক্তচাপ, ডায়াবেটিস আছে কিনা, থাকলে কি পরিমাণ ইত্যাদি-ইত্যাদি দেখে থাকেন। এর কারণ হলো, অপারেশন টেবিলে যেন কোন সমস্যা না হয়। ব্যাপারটি কেবল এখানে নয়। আপনি দেশের বাইরে যাবেন তো আপনার কাগজপত্র সব ঠিক আছে কিনা বিমানবন্দরে যাচাই করে দেখা হয় যেন পরে অসুবিধা না হয়। এই দুর্মূল্যে বাজারে ঢুকছি, ভাবছি, যাবো কোথায়? মাছের বাজারে, গোস্তের দোকানে, মুরগীর ওখানে, নাকি তরকারী হাটে? যাবার আগে ভয়ে কাঁপে পা, বুক, শরীর যেন ডিবি অফিসে বা র‌্যাপ-পুলিশ অফিসে ঢুকছি। এমনিতে কসাইদের নামেই চেনা যায়। তার ওপর দাম! তরকারীর নুন দেখতে আমাদের রমণীদের একটা অভ্যাস আছে। সেই ঢং-এ গোস্তের দাম জিজ্ঞেস করি। জবাব যদি আসে ৮০০/৯০০ টাকা? গত হাটে যা দেখেছি এখন দেখছি ৫০ টাকা বেড়ে হয় ৭০০ না হয় ৭৫০ টাকা। পকেট ধাক্কা দিয়ে বললো: কেটে পড়, পারলে হিমালয়ে যা! মাছের বাজারে জিন্দা মাছের দাম আকাশছোঁয়া! মূর্দার দামও কম নয়, ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত খোঁজে। সাগরের হলে তো কথাই নেই, তার উপর রঙবেরঙের মেকআপ। দেশি মাছ ৯০০/১০০০ টাকা চায়। কমদরা মাছের মধ্যে ৮০/১০০ টাকার তেলাপিয়া এখন ১৮০/২০০ টাকায়। তার উপর সাইজ বা আকার নিয়ে আছে ওঠানামা। গরীবের খাদ্য বলে পরিচিত ব্রয়লার আর ডিমের প্রমোশন হয়েছে ঢের। ১২০ টাকার ব্রয়লার এখন দু’শ পেরিয়েছে, ঘেন্নায় আামাদের দিকে তাকায়ও না। ডিম ডজন প্রতি ১৪০/৪৫ টাকা। তরকারির বাজারে তো ১০ টাকার কাঁচা মরিচও দিতে চায় না তরকারিওয়ালা। তবুও মোটামুটি শব্জিটাকে কাছের আত্মীয় মনে হয় যদিও সর্বনিম্ন ৪০/৫০ টাকা। সিলিন্ডার গ্যাসের দাম আগে যেখানে ছিলো ১০৫০ টাকা তো এখন বেড়ে ১৪৫০ থেকে ১৫০০ টাকা। চালের দোকানে গেলে মন চায় খুদের দাম জিজ্ঞেস করি। মুদির দোকানে গিয়ে শুনি কালকের দাম আর বেঁচে নেই। নতুন আর মুশকিল দামে বিকাচ্ছে পণ্য। রমযান মাস আর ক’দিন পরেই। এখনই ছোলার দাম এক নিঃশ্বাসে শ’ টাকা। খেসারী ৮৫-৯০। ঘরে এসে দেখি নতুন মূল্যে বিদ্যুৎবিল দুয়ারে দাঁড়িয়ে সুসংবাদ দিচ্ছে। কি করবো বলুন! আমরা তো আর রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে বাজারের টাকা উসুল করতে পারি না! মানুষ এ নিয়ে হরহামেশা মা-বোন তুলে সরকারের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে। কিন্তু সরকারদলীয়রা চুপ। কিরে বাপ, তোরা কি বাজার করিস না! তোদের কি পেট নেই? না কি তোদের আলাদা করে রেশন দিচ্ছে সরকার? চুপ থাকিস কেন? এই কি তোদের জনস্বার্থ? নিশ্চিত করে বলতে পারবো, বাজারে ঢোকার আগে আমার রক্তচাপ আর বেরুনোর পরে রক্তচাপে অনেক তফাৎ। সেটা হাঁটার কারণে নয়, দামের কারণে। তাই ভাবছি, রাজারে যাবার আগে হাসপাতালে যাবো; রক্তচাপ, ডায়াবেটিসএসব চেক করে দেখতে হবে। নচেৎ মাথা ঘুরে পড়লে ঘর তো খবর-ই পাবে না। তাই চলুন, আগে ডাক্তারের কাছে যাই, পরে বাজারে। এর চেয়ে নিরাপদ উপায় আর কি?

২২.০২.২৩  

মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

রাষ্ট্রভাষা বনাম মাতৃভাষা আন্দোলন

 

ভাবনা-১৬

আজ ৮ই ফাল্গুন, ২১শে ফেব্রুয়ারী। বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে মহান ভাষা-দিবস। ১৯৫২ সালের এদিনে তৎকালীন পাকিস্তানী রাষ্ট্রশক্তি কর্তৃক উর্দূকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে পাশাপাশি বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও দাপ্তরিকভাষা করার দাবিতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর আন্দোলন রফিক-সালাম-বরকতের রক্তের বিনিময়ে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার বীজ রোপণ করেযা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্তরূপ পরিগ্রহ করে। ৫২’র আন্দোলন ছিলো মূলত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, মাতৃভাষা আন্দোলন নয়। সে-সময় মাতৃভাষা নিয়ে কোন জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। ওরা, মানে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আমাদেরকে বলেনি যে, আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলতে পারবো না। ইতিহাসের বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজে দেখা যায়, কোথাও মাতৃভাষা আন্দোলনের নাম নেই, আছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্ল্যাকার্ড আর ধ্বনি। পরে সম্ভবত বাংলাদেশ আমলে এসে একটি শ্রেণী ৫২’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে মাতৃভাষা আন্দোলন বলে প্রচার করতে থাকে। এটাকে প্রচার না বলে অপপ্রচার বললে ভালো হয়। উইকিপিডিয়াতে দেখলাম লেখা হয়েছে: বাংলাভাষা আন্দোলন। হ্যা, সমস্যা নেই; রাষ্ট্রভাষা অন্দোলনকে বাংলাভাষা আন্দোলন বলা যেতে পারে একার্থে। কিন্তু সবচেয়ে পূর্ণ ও বাস্তব অবয়ব হলোরাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। যাঁরা আন্দোলন করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, কারাবরণ করেছেন: তাঁদের সবাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে সরগরম ছিলেন, মাতৃভাষা আন্দোলন নিয়ে নয়। যারা প্রচার করেছেন: ওরা আমার মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো, তারা কি সঠিক বলেছেন? আমার মনে হয় না, এর কোন ভিত্তি আছে। ভাষা অন্দোলনের উপর রচিত দু’টো বই ভাষা সৈনিক অলি আহাদের লেখা ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫’ ও বামপন্থী লেখক বদরুদ্দীন উমরের লেখা ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’তে প্রদর্শিত অনেক দুর্লভ তথ্য ও ছবিতে কোথাও দেখা যায়নি ৫২-তে মাতৃভাষা আন্দোলন হয়েছে। বরঞ্চ এমন প্ল্যাকার্ডও আন্দোলনকারীদের হাতে দেখা গেছে, যেখানে লেখা ছিলো: উর্দূ-বাঙলা ভাই ভাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। তাহলে মাতৃভাষা আন্দোলন কি করে হলো? অবশ্যই বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, সে ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সংগ্রাম হয়েছিলো, মাতৃভাষা করা বা ঘোষণার দাবিতে নয়। ১৯৫২ সালের ২৯শে জুন সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের স্বাক্ষর অভিযানে অথবা সর্বদলীয় ভাষা আন্দোলন কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারীর ধর্মঘট সম্পর্কিত ইশতেহারে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির কথা বলা হয়েছে, মাতৃভাষা করার দাবি নয়। তাহলে কেন আমরা এখন বলছি, আজ মাতৃভাষা আন্দোলন বা ওরা আমাদের মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো? কথাগুলো কতোটুকু সত্য? স্বীকার করি, ৫২’র অন্দোলন অবশ্যই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা বা প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিলো, কখনোই বাংলাকে মাতৃভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার লড়াই নয়। কারণ ইতিহাস বলে না: ওরা আমাদেরকে বাংলায় কথা বলতে মানা করেছিলো। কিন্তু আমরা আজ রাষ্ট্রভাষা দিবসের পরিবর্তে মাতৃভাষা দিবস পালন করছি। অধ্যাপক ড.সলিমুল্লাহ খানও সম্প্রতি বলেছেন: ৫২-তে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিলো, মাতৃভাষা আন্দোলন নয়। এখন প্রশ্ন হলো, মাতৃভাষা আন্দোলনে সমস্যা কোথায়? সমস্যা: ঐতিহাসিক অর্থাৎ ইতিহাসে অনুপস্থিত বিষয়ের অবাস্তব উচ্চারণ এবং ইতিহাসের প্রকৃত চরিত্র ও গতিধারাকে স্থানচ্যুতকরণযা পরবর্তী প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করবে। আমাদের কিছু অত্যুৎসাহী অংশের চেষ্টায় জাতিসঙ্ঘ ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক বিশ্বে যে বার্তাটি যাচ্ছে, সে কি শুদ্ধ না কি অশুদ্ধ? আমরা সংগ্রাম করেছি, আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে, মাতৃভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে নয়। বাংলা তো মাতৃভাষা আগে থেকেই ছিলো, এখনও আছে। বরঞ্চ বলবো, মাতৃভাষা আন্দোলন বলতে গিয়ে আমরা ব্যাপকতা কমিয়েছি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বললে ব্যাপকতা আরও বাড়তো। বাইরের বিশ্বে যারা মাতৃভাষা দিবসের গোড়া খুঁজতে চাইবে, তারা যখন দেখবে এ তো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তখন আমাদের ইতিহাস বিকৃতির চিত্র কি ফুটে উঠবে না? আমাদের পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও বাংলা মাতৃভাষা হিসাবে প্রচলিত। অথচ ওরা বাংলার জন্য কোন ত্যাগ স্বীকার করেনি। ৫২’র আন্দোলনে ওদের কোন অংশীদারিত্বও ছিলো না।তাই, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বললে আমাদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ভেজালে বিমর্ষ হতো না। তা’ছাড়া আরও একটি কথা, আমরা যে বাংলা ভাষা দিবসকে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ বলছি, সবিনয়ে প্রশ্ন করতে পারি কি: ‘ফেব্রুয়ারী’ কোন শ্রেণীর বাংলা শব্দ?  মি. জিন্নাহর উর্দূকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করাকে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক মানসিকতা বলে সমালোচনা করেছি। ঠিক আছে। কিন্তু ৮ই ফাল্গুনের পরিবর্তে একুশে ফেব্রুয়ারী মার্কা জগাখিচুড়ি পরিভাষা ব্যবহার কোন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ? এ প্রশ্নের কি কোন জবাব আছে? জানি না এসব অনাহুত বিতর্ক থেকে কবে আমাদের ইতিহাস মুক্তি পাবে। 

২১.০২.২৩     

রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

কওমী উদ্যোক্তা সংবাদ

ভাবনা-১৫

অনলাইনে খবর দেখতে গিয়ে পত্রিকার পাতায় একটি কৌতুহলোদ্দীপক খবর পেলাম। গতকাল শনিবার ঢাকার মগবাজার কনভেনশন হলে অনলাইন বিজনেস ফার্ম ‘কওমী উদ্যোক্তা’ গ্রুপের তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। এটাকে কওমী আলিমদের সর্ববৃহৎ ব্যবসা-উৎসাহ দানকারী একটি অনলাইন কেন্দ্র হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২০ সালে সংশ্লিষ্ট কওমী-আলিমদের সমন্বয়ে গড়া গ্রুপটির যাত্রা শুরু। বলা হয়েছে, বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ২ লক্ষ ৫০ হাজার। দেয় তথ্যানুসারে, সহস্রাধিক আলিমকে ব্যবসায় দিকনির্দেশনা দিয়েছে উক্ত গ্রুপ। হাজারো আলিম এ গ্রুপের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন বলে বলা হয়েছে। প্রথম দেখাতে খবরটি ভালো না লাগার কোন কারণ নেই। আমাদের এ সমাজে আলিম মানে হতদরিদ্র ও প্রায় নিঃস্ব, পরের কাছে প্রার্থী একটি শ্রেণীকে মনে করা হয় যারা কেবল মসজিদ-মাদরাসা নিয়ে পড়ে থাকে। জাগতিক জ্ঞানে এঁরা পশ্চাদপদ। তাই ভালো কোন চাকরি পায় না; ছেলেপুলেদের ভালো বন্দোবস্তও করতে পারে না; পরের ঘর থেকে আনা মেয়েটার দু’আনা খরচও মেটাতে পারে না। এ ধরনের ধারণার একটি কারণও আছে বৈ কি। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে গড়ে উঠা আমাদের সমাজে ১৮৫৭’র মহাবিপর্যয়ের পর সুপুষ্ট মুসলিম জমিদার ও ধনাঢ্য শ্রেণী ইংরেজদের চক্রান্তে ও হিন্দু বাবুশ্রেণীর সহযোগিতায় পথে বসতে বাধ্য হলে প্রশ্ন দেখা দেয়: পতনোম্মুখ মুসলিম সমাজকে কোন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে? স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে একটি শ্রেণী রায় দেয়, ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা ও তাদের শিক্ষা গ্রহণ করে; ইংরেজ সরকারের চাকরিতে অংশ নিয়ে আত্মরক্ষার উপায় বের করতে হবে। অন্যদিকে তৎকালীন আলিম-সমাজ যাঁরা কখনোই হতদরিদ্র ছিলেন না, অসচ্ছল ছিলেন না কিন্তু বিপর্যন্ত পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বকীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষার আন্দোলন নিয়ে গড়ে তুললেন সম্পূর্ণ সরকারী সাহায্যমুক্ত এবং জনসম্পৃক্ত মাদরাসার বলয় যা দেওবন্দ আন্দোলন নামে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ।তাঁদের দর্শন ছিলো, একটি জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা ও সংস্কিৃতি আর সেটাকে প্রথমেই রক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে সমাজকে আত্মপ্রত্যয়ী করে গড়ে তুলতে হবে। তাই তাঁরা বৃহত্তর স্বার্থের প্রয়োজনে ইংরেজ-চাকুরির লোভকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের স্বর্বস্ব ত্যাগ করে মুসলিম-সমাজকে ইসলামী শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। তাতে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তাঁরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেন বটে, মুসলিম-সমাজকে অবক্ষয়ের মুখ থেকে রক্ষা করলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফলতার দিকে নিয়ে গেলেন। তাঁদের এ চেষ্টায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন, সন্দেহ নেই। সেই থেকে মাদরাসায় কুরআন-হাদীসের জ্ঞানদান নিয়ে পড়ে থাকা আলিম-সমাজ স্বল্প আয় সম্বল করে আজও পথ চলছেন সমাজের প্রয়োজনে, বিনিময়ে এ সমাজ থেকে পেলেন অসহায়, জাগতিকভাবে অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র শ্রেণীর ঘৃণাত্মক ও অবহেলাসূচক তকমা। বিশেষ করে অন্যান্য স্থানের তুলনায় আমাদের বাংলাদেশের অধিকতর দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিস্থিতিহেতু আলিম-সমাজের অবস্থা হয় শোচনীয়। এ থেকে পরিত্রাণের চেষ্টায় ধীরেধীরে সময়ের পরিবর্তনে কওমী আলিম-সমাজ আত্মসচেতনতায় নিজেদের পথকে নতুনভাবে পরিবর্তনের তাগিদ বোধ করলেন। মাদরাসাশিক্ষা শেষ করে কেউ গেলেন বিদেশে; কেউ স্বল্পিপুঁজি নিয়ে দেশজ বিনিয়োগে গড়ে তুললেন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। এভাবেই পথচলা শুরু। আজ যখন উপরের খবরটি নজরে পড়লো, সতর্কভাবে খুশি হয়েছি বেশ। সতর্ক এ জন্য যে, দেখেছি, কেউকেউ ওদিকে নজর দিতে গিয়ে হয় আত্মকেন্দ্রিক হয়েছেন, না হয় কওমী মৌলিকত্ব হারিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। আমি কওমী আলিমদের ব্যবসা-জগতে বিচরণকে এ জন্য সমর্থন করি যে, তাঁরা ব্যবসার রন্ধ্রেরন্ধ্রে হালাল-হারামকে প্রাধান্য দিয়ে দা’ওয়াত পেশ করবেন এবং নিজেদেরকে সচ্ছল করে গড়ে তুলে দেশ ও দশের সেবা করতে সক্ষম হবেন।। তাতে ভেতর থেকে সমাজ পরিবর্তন হবার পথ খুঁজে পাবে। অন্যথায় হারিয়ে যাবার আশঙ্কা থাকলে দুষ্ট গরুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল ঢের ভালো হবে।

১৯.০২.২৩       

শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

সুইপারে সমাজ দেখি

ভাবনা-১৪

আজ এক সুইপারের গল্প বলি। গল্পটি লিখে গেছেন মাওলানা রুমী রহ. তাঁর মসনবীতে। চমৎকার সে কাহিনী। সুইপারকে আমাদের চট্টগ্রামে আঞ্চলিক ভাষায় বলে ‘মেথর’। ওদের অবাসস্থলকে বলে মেথরপট্টি। পট্টি মানে বোঝেন-ই: পল্লী বা বস্তি। তো তেমনই এক মেথরপট্টিতে থাকতো এক সুইপার। সারা দিন আবর্জনা সাফ করতে পার হতো তার দিনকাল। একদিন সে কি এক দরকারে বাজারে গেলো। বাজারে ছিলো এক আতরের দোকান। খুশবুতে মাতোয়ারা দোকানের সামনের অংশ। পথচারীদের নাকেমুখে লাগতো আতরের মোহনীয় খুশবু। ঘটনাক্রমে ঐ সুইপার আতরের দোকানটির সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। যেতে যেই না তার নাকে আতরের খুশবু এসে লাগলো, ব্যাস, ধপাস করে পড়ে গেলো রাস্তায়। পড়েই বেহুঁশ। কি হলো, কি হলো করতে করতে লোকজন দৌড়ে এলো। দেখলো, নাকেমুখে খিঁচুনি; হাত দু’টো শক্ত হয়ে আছে। কি করা, কেউ তাকে বাতাস দিচ্ছে; কেউ দিচ্ছে পানির ছিটা। নাহ, হুঁশ ফেরার লক্ষণ নেই। একজন গিয়ে নিয়ে এলো আগরবাতি; জ্বালিয়ে ধোঁয়া দেয়ার চেষ্টা করলো। অন্তত হুঁশ তো ফিরুক! সবাই দেখলো, অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। যতোই আগরবাতির ধোঁয়া দেয়া হচ্ছে, বাতাস দেয়া হচ্ছেততোই অবস্থা কাহিলতর হচ্ছে। খিঁচুনি তো থামছেই না, ক্ষণেক্ষণে বাড়ছে। শেষতক কেউ একজন দৌড়ে গিয়ে তার ভাইকে খবর দিলো: যা-যা, তোর ভাই তো মরতে চলেছে! ভাই দৌড়ে গিয়ে দেখে মেথরের অবস্থা সুবিধার নয়। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আতরের দোকান। বুঝে ফেললো রোগের কারণ। সবাইকে আগরবাতির ধোঁয়া, বাতাস, পানিএসব দিতে কঠিনভাবে মানা করলো। লোকজনকে একটু সবুর করতে বলে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এলো রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কিছু কুকুরের শুকনো মল। সেটা নাকের উপর দিতেই মেথর চোখ খুললো, হাত নাড়লো একসময় উঠে বসলো। লোকজন তো দেখে হতবাক! ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলো রহস্য কি? তখন মেথরের ভাইটি বললো: আমার ভাই জীবনভর করে এসেছে মেথরগিরি। এসব করতে-করতে দুর্গন্ধই তার কাছে স্বাভাবিক। আজকে যেই না সে আতরের দোকানের সামনে এলো, নাকে খুশবু লাগতেই তার কাছে বিশ্রী আর উৎকট মনে হলোতাতেই বেহুঁশ। আপনারা সেটা বুঝতে না পেরে যতোই আগরবাতির ধোঁয়া, পানি ইত্যাদি দিচ্ছিলেন, তার অবস্থা ততোই খারাপ হচ্ছিলো। আমি এসেই আতরের দোকান দেখে রোগ বুঝে ফেলি। তাই দৌড়ে গিয়ে ময়লা এনে ধরতেই সে তার স্বাভাবিকতা ফিরে পেলো; হুঁশ এলো। মাওলানা রুমী রহ. ঘটনাটির বয়ান দিয়ে মন্তব্য করলেন: মানুষ তার নিত্যদিনের পরিবেশ আর আচরণে বাধ্য হয়ে যায়। তখন প্রকৃত সুগন্ধ আর দুর্গন্ধের বাছবিচার থাকে না। পরিবেশ ও আচরণের প্রভাবে সুগন্ধ যেমন দুর্গন্ধ হয়ে যায় তেমনি দুর্গন্ধ হয়ে যায় সুগন্ধ। সে দুর্গন্ধের পথকেই মনে করে তার মুক্তির পথআসল ঠিকানা। তাই কেউ সুগন্ধের সন্ধান দিলেও প্রত্যাখ্যান করে, অসুস্থ বোধ করে। আমি কিন্তু সেই সুইপারের মধ্যে এ সমাজকে পরখ করি। আজ আমরা যে সমাজে বাস করছি সে কেমন সমাজ? আমরা কি জানি? আসলেই কি আমরা দুর্গন্ধে অভ্যস্ত না সুগন্ধেসে কি বুঝি? নিজেদের মনগড়া আর পশ্চিমাধারায় চলতে চলতে কখন যে দু্র্গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। এখন সেই সুইপারের মতো সুগন্ধও দুর্গন্ধ ঠেকে আমাদের নষ্ট-নাকে; আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। আল্লাহ আমাদেরকে সুরা ফাতিহায় বলেছেন, ইহুদী আর খৃস্টানদের অনুসরণ না করতে। কেন? কারণ, আল্লাহপ্রদত্ত অহী কুরআনের অনুসরণই সুগন্ধ, পরিপন্থী সব দুর্গন্ধ। আমাদেরকে তাই সুগন্ধে থাকতে বলেছেন। কিন্তু আমরা দুর্গন্ধে থাকতে-থাকতে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি; সুগন্ধে বেহুঁশ হয়ে যাই, অস্বস্তি বোধ করি। এ থেকে বের হতে না পারলে দুর্গন্ধেই থেকে যাবো, দুর্গন্ধে থাকতে-থাকতে দুর্গন্ধ নিয়ে কবরে যাবো। আল্লাহ পানাহ। 

১৮.০২.২৩   

বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

লেখার গলৎ পড়ার গলৎ

ভাবনা-১৩

ইদানিং আমাদের কিছু প্রচারমাধ্যমের কিছু উপস্থাপনা নজর কাড়ছে। ছাপানো মাধ্যম বলুন আর ইলেকট্রনিক মাধ্যম বলুন--বিষয়টি দৃষ্টিএড়ানো বা শ্রুতিএড়ানো নয়। দেখছি, আগে লেখা হতো: ১লা মার্চ, ২রা জুলাই, ৪ঠা এপ্রিল, ৮ই মে, ২০শে জুন ইত্যাদি। এখন দেখি, লেখা হচ্ছে: ১ মার্চ, ২ জুলাই, ৪ এপ্রিল, ৮ মে, ২০ জুন ইত্যাদি। ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে পড়াও হচ্ছে তেমন। আচ্ছা, পরের গুলো কি শুদ্ধ হচ্ছে? আগের গুলো কি গলৎ? আসুন তবে দেখি। একটি প্রশ্ন করি: স্কুলে সাধারণত ক্লাসে যে লেখা থাকে বা ছাত্রেরা বলে: ক্লাস ফাইভ, ক্লাস নাইন, ক্লাস টেন ইত্যাদি--সে কি শুদ্ধ? আসলে শুদ্ধ নয়। বাংলায় বললে হবে: ৫ম শ্রেণী, নবম শ্রেণী, দশম শ্রেণী ইত্যাদি আর ইংরেজিতে বলতে হবে: Fifth Class, Ninth Class, Tenth Class ইত্যাদি। এখানে নির্দিষ্ট শ্রেণীকে বোঝানো হচ্ছে, কয়েক শ্রেণীকে এক সাথে নয়। যখন আপনি বলবেন: Class Five তখন মূলত বোঝানো হবে, একসাথে ৫টি শ্রেণী। কিন্তু কেউ তো একসাথে ৫টি শ্রেণীতে পড়ে না। তাহলে সে কী বলবে? বলবে: আমি ৫ম শ্রেণীতে পড়ি বা Fifth Class-এ পড়ি। তাহলে লেখাটা শুদ্ধ হলো--বলাটা শুদ্ধ হলো। এবার আসুন আমাদের মিডিয়া-পাড়ার কথায়। খবর লেখায় বা পড়ায় আগে বলা হতো, যেমন বলে এসেছি: ১লা মার্চ, ২রা জুলাই ইত্যাদি। আর এখন লেখা হচ্ছে, ১ মার্চ, ২ জুলাই ইত্যাদি। গলৎটা কোথায়? ঐ যে শ্রেণীর যুক্তিতে দেখুন, আপনি ১লা এপ্রিল, ৪ঠা এপ্রিল বললে বোঝাবে এপ্রিলের প্রথম দিন বা চতুর্থ দিন পক্ষান্তরে, ১ এপ্রিল বা  ৪ এপ্রিল বললে বোঝাবে, হয় একটি এপ্রিল বা এক সাথে এপ্রিলের ৪ দিন বা ৪টি এপ্রিল মাস, যেমন আমরা বলি: একটি আম--যার মানে কখনোই এক টুকরো আম বা একটি আমের এক টুকরো নয়। বাংলায় বলতে গেলে বলতে হবে: ১ম এপ্রিল বা ৪র্থ এপ্রিল। তাহলে আপনি একটি নির্দিষ্ট দিনকে পাবেন। আশা করি পাঠক বুঝতে পেরেছেন। ঘটনা যখন কোন নির্দিষ্ট দিনে বা কোন নির্দিষ্ট দিন থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী কোন নির্দিষ্ট দিনে শেষ হয়, প্রকাশে আপনাকে সেভাবেই বলতে হবে খিচুড়ি করে নয়। কিন্তু আমরা বলি বা বলছি! হ্যা,বলছি, সেটা কিন্তু শুদ্ধ নয়, অশুদ্ধ। ভুলের উপর বলা আর কি। আসুন এবার মিডিয়া-পাড়ার দিকে। আমাদের মিডিয়ার বাক্যগঠন বা শব্দচয়ন বা সংবাদ পরিবেশনা যে কতোটা দুর্বল, সেটা বোঝানো মুশকিল। আগে সংবাদ লিখন বা পরিবেশন ছিলো মূলত সংবাদনির্ভর, ফ্যাশননির্ভর নয়। বেশি ন্যাকামো করতে গিয়ে শব্দের উচ্চারণকে কতো বিকৃত করা হচ্ছে তা শুনে বিস্মিত হতে হয়। অথচ এদের ডিগ্রীর বহর দেখলে অবাক হতে হয়। সংবাদ পরিবেশনার নামে এখন যা হচ্ছে সেখানে সাংবাদিকতা প্রাধান্য পায় না, প্রাধান্য পায় ফ্যাশন, অসামাঞ্জস্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গী। ৮০’র দশকে আমি বিবিসি ও ভয়েজ অব আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠান শুনতাম উচ্চারণ আর সংবাদ পরিবেশনার ধরন দেখতে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এসে দেখলাম লম্বালম্বা ডিগ্রী নিয়ে বিবিসি’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে কতো ভুল উচ্চারণে সংবাদ পড়তে। এখন মিডিয়াতে যা হচ্ছে, নিরঙ্কুশ অমেরুদণ্ডীয় আচরণ। এই যে উপরে বলে এলাম, তারিখের কথা; বললেই বলবে ১লা, ২রা, ৪ঠা তো বাংলা রীতি নয়, উর্দূ-ফার্সী রীতি। আমরা তো আবার ভাষার জন্য লড়েছি, তাই না! তবে ভুল কেন, বাংলাতে ১ম মার্চ, ৪র্থ এপ্রিল--এভাবে বলুন! আচ্ছা একটি প্রশ্নের উত্তর দিন। ভাষার যে দিনকে মনে রাখতে আপনারা উর্দূ-ফার্সী রীতি বর্জন করে বলছেন: ১ মার্চ, ৪ এপ্রিল, আপনারা আবার ভাষার দিনকে ‘২১শে ফেব্রুয়ারী’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, ‘অমর একুশে’ এসব লিখছেন কেন, বলছেন কেন? তখন কেন বলেন না: ২১ ফেব্রুয়ারী বা একুশ ফেব্রুয়ারী? আচ্ছা ‘ফেব্রুয়ারী’ কি বংলা? বাংলা মাস কোথাও কি নির্বাসনে গেছে? আসলে এসবের পেছনে আছে উদ্ভ্রান্ত সেক্যুলারগোষ্ঠী এবং তাদের মানসপুত্রেরা, যারা স্বকীয় সাংবাদিকতাকে বাদ দিয়ে কলকাতাইয়া সাংঘাতিকতাকে (সাংবাদিকতা) এখানে বসত গড়াতে চায়। কেবল ১লা, ২রা, ৪ঠা এগুলোতেই কি উর্দূ-ফার্সী? বাংলায় কি আর উর্দু-ফার্সী নেই? এভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ-প্রজন্মকে উদ্ভ্রান্ত করে রাখতে চায় যেন তারা ভুল বলে, ভুল শিখে কিন্তু বুঝবে না তারা যে মূলরাস্তা ফেলে ভিনরাস্তায় চলছে। এ ধরনের অপচেষ্টা এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, আসামে চলছে; বাংলা থেকে আরবী-ফারসী বাদ দিতে হবে। এটা বিজেপি-থিওরী। এর পেছনে আছে উগ্র-সাম্প্রদায়িকতা। যেখানে-সেখানে পাকিস্তানী গন্ধ খুঁজে বেড়ানো এদের কাজ। তাদের কাছে জানতে ইচ্ছে হয়, পাকিস্তানী নামেই যখন এতো অসহ্য তখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদেরকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে বারবার আহ্বান জানায়, তারা নীরব থাকেন কেন? কেন মিডিয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে?
১৬.০২.২৩

বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

বিবিসি’র মুদি কোয়েশ্চান

ভাবনা-১২

বৃটেনভিত্তিক সংবাদ-সংস্থা বিবিসি সম্প্রতি তাদের টেলিভিশনে “BBC: The Modi question" নামে একটি তথ্যচিত্র প্রচার করেছে দুই কিস্তিতে। এর প্রথম কিস্তিতে দেখানো হয় মুদি আমলে ২০০২ সালে সংঘটিত গুজরাটের মুসলিম গণহত্যার ভয়ালচিত্র এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে দেখানো হয় ‍মুদির প্রধানমন্ত্রিত্ব থাকাকালে ভারতের মুসলিমদের হাল-হাকীকত। অনলাইন থেকে উভয় কিস্তি আমি দেখেছি। ভারতীয় গণমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সবাই বলেছেন, বিবিসির ঐ তথ্যচিত্রে যা কিছু দেখানো হয়েছে তাতে এমন কিছু ছিলো না, যা আগে প্রদর্শিত হয়নি। তাহলে বিতর্ক কেন? মুদি সরকারের ঐ তথ্যচিত্রের বিরুদ্ধে এতো লাঠিসোটা কেন? প্রদর্শনে এতো সরকারি বাধা কেন? বিতর্কে কারণ: ১. মুদির ইমেজ-সঙ্কট ২. তথ্যচিত্র প্রচারের কাল ৩. গুজরাট গণহত্যাকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার এবং ৪. গুজরাটের ঘটনার কারণে মুদির প্রধানমন্ত্রিত্ব অর্জন। মুদিপন্থীরা ওসব বিষয়কে আমলে নিয়ে তথ্যচিত্রটি প্রদর্শনে জানপ্রাণ দিয়ে বাধা দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে বলে মনে হয়। তথ্যচিত্রটি যারা দেখেছেন, বিলক্ষণ বুঝবেন বিবিসি তাদের তথ্যচিত্রে একটি অজানা বিষয়কে সামনে এনেছে আর তা হলো, তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী জ্যাক স্ট্র গুজরাট-ঘটনা নিয়ে গোপন তদন্ত পরিচালনা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন: এক, প্রচার-মাধ্যমে যা কিছু এসেছে বাস্তবচিত্র তার চেয়েও ঢের বেশি ভয়াবহ ছিলো এবং দুই, পুরো ঘটনার পেছনে মুখ্যমন্ত্রী মুদি সরাসরি দায়ী। এ ছিলো বিবিসি’র মূল উপসংহার। এখানে ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে হয়। সেদিনকার বাস্তবচিত্রকে যদি সামনে আনা হয়, বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে, সে ছিলো মূলত একটি মুসলিম গণহত্যা। অথচ ভারতীয় গণমাধ্যম বরাবরই বলেে এসেছে-‘দাঙ্গা’। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, বাইরের বিশ্বকে এ মর্মে বিভ্রান্ত করা যে, এখানে একতর্ফা মারা হয়নি, উভয়ের মারামারি হয়েছে।  বিবিসি’র তথ্যচিত্র থেকে যে বিভৎস বিষয় উঠে এসেছে তা হলো, গুজরাটে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মুদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট দেয়ার কারণ গণহত্যা এবং সেটাকেই পুঁজি করে মুদি পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন। তাহলে ব্যাখ্যাটা কী দাঁড়ালো? ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এ কারণে মুদিকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে টিকিয়ে রেখেছিলেন যে, তিনি মুসলিমদের উচিৎ শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচন করা হয়েছে সে সক্ষমতার কারণে। তাহলে বিজেপি কেন ভারতে বেশি ভোট পায়--সে প্রশ্ন কি একান্তই জিজ্ঞাস্য? বিবিসি আসলে ভারতের সাম্প্রতিক রাষ্ট্র-চরিত্র্র ও গণচরিত্রের একটি অপ্রকাশিত দিককে উম্মোচিত করেছে--যা আন্তর্জাতিক বিশ্বকে ভাবতে বাধ্য করবে। 
১৫.০২.২৩

মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

আমেরিকার বিমার

ভাবনা-১১

সম্প্রতি প্রায় সবার অলক্ষে একটি ঘটনা ঘটে গেলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ঘটনার প্রধান চরিত্র মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধি ইলহান ওমর। ইনি ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচনে মিনেসোটা’র একটি আসন থেকে কংগ্রেস-সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম দু’জন মুসলিম মহিলা কংগ্রেস সদস্য হন। ইলহান ওমর তাঁদের একজন। ইলহান ওমরের পরিবার সোমালিয়া থেকে উদ্বাস্তু হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। তাঁর জন্ম ১৯৮২ সালের ৪ঠা অক্টোবর। উল্লেখ্য, কংগ্রেস-সদস্য হিসাবে শুরু থেকেই ইলহান ওমরকে ঘিরে শুরু হয় বিতর্ক। কারণ, তিনি বিশ্বাসগতভাবে মুসলিম, গায়ের রঙে কালো এবং পোষাকে হিজাব পরিহিতা। ইসরাঈল এবং ইসরাঈলপন্থী লবি তাঁকে তাঁকে নিয়ে ছিলো সদা উদ্বিগ্ন। ওদের নিয়ে মন্তব্য করার কারণে তাঁকে এন্টি সেমিটিক বা ইহুদীবিরোধী বলে আক্রমণ করতো ডানপন্থী সমালোচকেরা। পরে অবশ্য ইলহান তাঁর মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। একজন মুসলিম কংগ্রেস সদস্য হিসাবে তিনি ইতোমধ্যে নানা ধরনের হুমকির মুখেও পড়েছেন। টুইন টাওয়ার ধ্বংস নিয়ে ইলহান তাঁর এক বক্তব্যে বলেছিলেন: Some people did something অর্থাৎ, কিছু লোক কিছু একটা করেছে। ২০১৯ সালের ২৩শে মার্চ ইলহান কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স’র সভায় মন্তব্যটি করেন। ২০ মিনিটের ঐ ভাষণে তিনি ইসলামোফোবিয়া থেকে শুরু করে নিউজিল্যান্ডের মসজিদে সন্ত্রাসবাদী হামলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বলেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, টুইন টাওয়ার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হয়। তাঁর কথায়, “এই হচ্ছে প্রকৃত সত্য। বহুদিন ধরে আমাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে একটা অস্বস্তি নিয়ে বসবাস করতে হয়েছে এবং সত্যি বলতে কি, আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এই দেশের প্রতিটি মুসলিমেরও তাই হওয়া উচিৎ। ইলহান ওমরের এই ব্ক্তব্য ‘১৯ সালের ৯ই এপ্রিল থেকে বিভিন্নমহলের মনোযোগ কাড়তে শুরু করে। টেক্সাসের এক রিপালিকান কংগ্রেস সদস্য ড্যান ক্রেনশ তার বক্তৃতাকে 'অবিশ্বাস্য' বলে বর্ণনা করেন। এরপর বিষয়টি লুফে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের ফক্স নিউজসহ অন্যান্য রক্ষণশীল মিডিয়া, তারা এটা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারম্যান ইলহান ওমরকে 'অ্যান্টি আমেরিকান' বলেও বর্ণনা করেন। ইলহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ: তিনি টুইন টাওয়ার হামলাকে খাটো করে দেখছেন। এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে নিউ ইয়র্ক পোস্ট। তারা পত্রিকার প্রথম পাতায় নাইন ইলেভেনের হামলার একটি ছবি প্রকাশ করে ওপরে হেডলাইন দেয়: 'হিয়ার ইজ ইয়োর সামথিং।' নিউ ইয়র্ক পোস্টের এই শিরোণাম বিতর্কটিকে আরও তিক্ত করে তোলে। এভাবে সূক্ষ্ম সামপ্রদায়িক কারণে এবং ইহুদী লবির প্রভাবে ইলহান ওমরকে নাজেহাল করা শুরু হয়। এর চূড়ান্ত পরিণতি আসে সম্প্রতি মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের নবনির্বাচিত রিপাবলিকান সদস্যদের প্রভাবে ইলহান ওমরকে পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি থেকে বাদ দেয়ার মাধ্যমে। এতে ইলহান ২১৮-২১১ ভোটে হেরে যান। এ ক্ষেত্রে ২০১৯ সালে তাঁর মন্তব্যের উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, ইলহান মিনেসোটা থেকে টানা তিনবারের জয়ী ডেমোক্র্যাট সদস্য। বাদ দেওয়ার আগে এক আবেগঘন বক্তব্যে ইলহান ওমর বলেন: কমিটিতে না থাকলেও আমার কণ্ঠ, আমার নেতৃত্বকে চাপা দিয়ে রাখা যাবে না। বলাবাহুল্য, আমেরিকায় ইহুদী লবীর দৌরাত্ম্য অত্যন্ত শক্তিশালী। উপরি হিসাবে আছে, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। এ রোগ মার্কিন রাজনীতির সুউচ্চ মার্গে দণ্ডায়মান দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। বর্তমান ডেমোক্র্যাট প্রশাসন বলছে, তারা এটা নিয়ে কাজ করছে। তবু শত বাঁধা সত্ত্বেও মুসলিম মূল্যবোধ মাথায় নিয়ে ইলহান ওমররা যা করে যাচ্ছেন, তা কখনও ইতিহাস ভুলবে না। মনে করি, বিশ্বের তাবৎ মুসলিম ইলহান ওমরদের বীরত্বগাঁথাকে অনুসরণীয় করে রাখবে। 

১৪.০২.২৩         

রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

পাঠ্যক্রমে মগজধোলাই

ভাবনা-১০

অবশেষে সরকার নতুন পাঠ্যক্রমে সংযুক্ত বিতর্কিত ও সমালোচিত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দু’টি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া ঘোষণাটি অবশ্যই সময়োপযোগী ও বাহ্যত ধন্যবাদযোগ্য। একটি জাতির অন্যতম প্রাণ হলো তার শিক্ষার উপাদান ও চরিত্র। এটা নির্ভর করে ঐ জাতির বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অবয়বের উপর। জাতি ভিন্নভিন্ন গোষ্ঠীর সমন্বয়ে হতে পারে; এক-গোষ্ঠী কেন্দ্রিক হতে পারে আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সাথে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সহাবস্থানেও হতে পারে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ একটি ভূখণ্ড যেখানে ৯১.৪ শতাংশ মুসলিম ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বসবাস করে। সঙ্গতকারণে, শিক্ষার চিত্র তৈরি হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও সংস্কৃতির আনুপাতিক উপস্থিতির উপর। এখন কেউ যদি তা না করে গরিষ্ঠ-লঘিষ্ঠ সবার উপর সমান হারে বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা চাপিয়ে দিতে চায়--সে কি গ্রহণযোগ্য হবে? এতে তৈরি হবে অস্থিরতা, অসন্তোষ ও অভ্যন্তরীণ অবিশ্বাস যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হবার পথকে রুদ্ধ করবে। বিতর্কিত বই দু’টি সেদিক থেকে সম্পূর্ণ অন্যায্য। বইয়ের মলাট, ভেতরের উপাদান, উপস্থাপনার ঢং--সবকিছুতে জাতিকে বিভ্রান্ত করার কৌশল নজরে পড়ে। তাই জাতির সচেতন অংশ প্রতিবাদ করে। আমরা এখনও সন্দিহান যে, সরকার কি আসলে তার অভ্যন্তরীণ নীতিকে পরিমার্জিত করার পথ নিচ্ছে না কি আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে জনসমর্থন হারানোকে এড়িয়ে যেতে উক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলেই বৃক্ষের পরিচয় হবে। ভেতরের কথা আমরা জানি না কিন্তু আকাশের মেঘ ও হাওয়া বুঝে অনুমান করা যায়: বই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পেছনে সরকার-প্রধানের হস্তক্ষেপ থাকতে পারে। ব্যাপার যাই হোক, আপাতত এটাকে সরকারের জনগণের অনুভূতি বুঝতে পারার প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা যায়। সন্দেহ নেই, সরকারের ভেতর একটি ক্ষুদ্র ও শক্তিশালী অংশ বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষকরণ বা সেক্যুলারাইজেশন করতে দীর্ঘদিন থেকে সচেষ্ট রয়েছে। এর ফলে বর্তমান সরকারকে জনসাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিশ্বাস ও সংস্কৃতিপ্রশ্নে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখে। মানুষ এ ধরণের চেষ্টাকে ধর্মহীনকরণের চেষ্টা বলে সন্দেহের চোখেও দেখে। বিষয়টি যদি সরকার ভালোয়-ভালোয় বুঝতে পারে তাতেই মঙ্গল। আমরা আশা করবো, সরকার তার ভেতরকার অপশক্তিকে বিদূরিত করে নিজেদের সততার প্রমাণ দেবে। আরেকটা কথা এখানে বল হয়। মানুষের অনুভূতি বিবেচনায় সরকার যে সচেতন পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটা যদি অতীতে প্রদর্শিত হতো তবে ইতিহাসটাও ভিন্ন হতো। ২০১২ সালে কুখ্যাত ব্লগার রাজিব গং যখন চরম ইসরামবিদ্বেষী হয়ে লেখাজোখা শুরু করে সরকার কিন্তু সে সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোভাব বুঝতে পারেনি। ফলে, রাজিবকে সরকারের পক্ষ থেকে “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ” বলে সম্মানিত করা ও তার বাসায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সান্ত্বনা দেয়ার ঘটনায় মুসলিম সমাজ নিজেকে আহত ও অসম্মানিত মনে করে। সেদিন যদি আজকের বই প্রত্যাহারের মতো সচেতনভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভূতিকে অপমান করার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো, তবে শাপলার মতো মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা হতো না।  আশা করি ভবিষ্যতে সরকার সচেতন হবে।

১২.০২.২৩      

শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

স্মৃতি থেকে নেয়া

ভাবনা-৯

বাল্যকালে দেখেছি, ফজরের নামাযের পর বাড়ির প্রায় ঘর থেকে পুরুষের উচ্চকণ্ঠে কুরআন পড়ার ধ্বনি শোনা যেতো; মেয়েরা গুনগুনিয়ে পড়তো। ছোটরা চলে যেতো মক্তবে। সে এখন কেবলই স্মৃতি। তখন এতো সচ্ছলতা ছিলো না গ্রামে কিন্তু শান্তি ছিলো। বিশেষ করে পারিবারিক শান্তি; পারস্পারিক সৌহার্দ্য, বোঝাপড়ার মানসিকতা--এসব ছিলো। অশান্তি যে লেশমাত্র ছিলো না তা নয় কিন্তু সে নগণ্য। এখন খুঁজেও কুরআনের আওয়ায শুনতে পাওয়া যায়--এমন দু’একটি ঘর পাওয়া মুশকিল। শহরের অবস্থা তো বলাই বাহুল্য। এমন দেদার বাসাবাড়ি পাওয়া যাবে যেখানকার মুসলিম ছেলেমেয়েরা কুরআন পড়তে জানে না। আর এটাকে খুব দরকারি বলেও মনে করা হয় না। যে মূল্যে জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজনে বাসায় শিক্ষক রাখা হয়, তার সামান্য অংশও কুরআন পড়ানোর হুযুরকে দেয়া হয় না। এর বড়ো কারণ হলো অভিভাবকের অসচেতনতা। ইসলামে মা-বাবার উপর সন্তানের সর্বপ্রথম অধিকার হলো, তার বাবা যেনো একজন সতী-সাধ্বী, ধর্মপরায়ন ও সচেতন মহিলাকে বিয়ে করেন। কারণ, মায়ের কোল থেকেই সন্তান শিক্ষা-গ্রহণ শুরু করে। তাহলে দেখুন, সন্তান জন্মাবার আগেই তার বাবার উপর অধিকার বর্তাচ্ছে। এ অধিকারের কারণেই প্রত্যেক মা-বাবাকে কিয়ামাতের কঠিন দিনে আপন সন্তানের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। পবিত্র হাদীসে এসেছে, অভিযুক্ত সন্তানেরা তাদের পথভ্রষ্টতার জন্য মা-বাবার বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করবে। তাই বলা হয়, সমাজ সংশোধনের পূর্বশর্ত পরিবার সংশোধন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেককে এবং তার পরিবারের সদস্যদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। কথাগুলো হয় আমরা শোনার সুযোগ পাইনি অথবা ভুলেই গেছি। এর ফলে আমরা আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ ও শান্তি হারিয়ে ফেলছি। ক’দিন আগে খবরে দেখলাম দেশে বিশেষ করে ঢাকায় বিবাহবিচ্ছেদের হার অনেক বেড়ে গেছে। কারণ বলা হয়েছে, মূলত পারিবারিক অশান্তি। কেন? আপনি দেখবেন, পারিবারিকভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চার অভাব হলে শান্তি থাকে না। আমি বলছি না যে, শতভাগ শান্তি থাকবে; কিছু তো অস্থিরতা থাকবে সময়ে-সময়ে কিন্তু তা সমাধানের পথও মিলবে। স্থায়ী অশান্তি হবে না আল্লাহর রহমতে। এই যে ধরুন সন্তানকে যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে উৎসাহিত করা হয়, শাসন করা হয়; ফজরের নামাযের পর কুরআন পড়তে উৎসাহিত করা হয়, পড়তে না জানলে শিখানোর ব্যবস্থা করা হয়--তাতে পরিবারে প্রশান্তি আসবে, বোঝাপড়া হবে। পুরুষেরা একটু উচ্চ আওয়াজে আর মেয়েরা নিচুস্বরে তিলাওয়াত করবে। অন্তত কুরআন দিয়ে দিনটা শুরু হোক। দেখবেন আপনার অশান্তি স্থায়ী হবে না ইনশা আল্লাহ। কোন পরিবারে এমন ব্যবস্থা নেয়া হলে দেখা যাবে তাদের গুনাহ’র পরিমান কমে যাচ্ছে, গুনাহনির্ভর কাজের দিকে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এতে গুনাহ হ্রাস পেলে অশান্তিও হ্রাস পাবে। কারণ অশান্তি গুনাহ বা পাপেরই পরিণতি। আসুন আমরা ঘরকে আবাদ করি, কুরআনের ধ্বনি ও নামায দিয়ে ধৌত করি।

১০.০২.২৩          


বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

কওমীদের কথকতা

 ভাবনা-৮

আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মানুষ মাঝেমাঝে কওমী মাদরাসাগুলোর সমালোচনা করে বলেন: সেখানে বিজ্ঞান,সমসাময়িক ইতিহাস, প্রচলিত জাগতিক শিক্ষা দেয়া হয় না। তারা আরও বলেন: কওমী মাদরাসার শিক্ষার মাধ্যম মূলত আরবী, ফার্সী ও উর্দূনির্ভর। বাংলা-ইংরেজি সেখানে নেই বললেই চলে। এসব জাগতিক শিক্ষা না থাকার কারণে কওমী মাদরাসার পড়ুয়ারা প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি-বাকরি পান না; এরা বরাবরই সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন এবং তারা বেকারের সংখ্যাই বৃদ্ধি করছে। সমালোচনাকারীরা মাঝেমাঝে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে সাক্ষাৎকার দিয়ে মানুষকে এসব জানান দেয়ার চেষ্টা করেন। এতে কারওকারও মনে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। জানামতে এদের কারোর-ই কওমী মাদরাসা নিয়ে সঠিক পর্যবেক্ষণ নেই। জানা দরকার, ১৮৫৭’র মহান স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যর্থ হবার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় বিধ্বস্ত মুসলিম সমাজের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্ত্বাকে রক্ষা করতে এবং একটি সংগঠিত ও আদর্শনির্ভর প্রজন্ম গড়ে তুলতে ১৮৬৬ সালে ভারতের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসা বা ইসলামী শিক্ষালয়ের যাত্রা শুরু হয় যা বর্তমানে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী য়ুনিভার্সিটি হিসাবে কাজ করছে। বলাবাহুল্য, দেওবন্দের অনুসরণে তখন নিখিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমান পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে প্রচুর মাদরাসা বা ইসলামী শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তেমন ধারায় ১৯০১ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে বিখ্যাত মুঈনুল ইসলাম মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। জানা দরকার, মাদরাসা হিসাবে যাত্রা শুরু হলেও তারাঁ কেবল পুঁথিগত শিক্ষাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকেননি। শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক সংস্কার, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক সচেতনতা ইত্যাদি জায়গায় তাঁরা কাজ করেছেন অবিরত। সেদিনকার সামাজিক বাস্তবতায় অঞ্চলের অধিকাংশ হতদরিদ্র মানুষকে শিক্ষার আহ্বান জানিয়ে তাঁরা নিজনিজ সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি আনুগত্যের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সমাজের দুঃস্থ মানবসন্তানকে বিনে পয়সায় পড়িয়ে, খোরাকী দিয়ে যেভাবে তাঁরা সমাজকে আপন করে নিয়েছিলেন তার বিনিময়ে তাঁদের শেকড় পৌঁছে যায় অনেক গভীরে যা তাঁদেরকে এনে দিয়েছে একমাত্র সামাজিক শক্তির উপাধি। এটা কেবল মুখের কথা নয়, সমাজের সাথে যাদের জানাশোনা আছে, তাঁরা বিলক্ষণ বিষয়টি স্বীকার করবেন। প্রশ্ন হলো হলো: সামাজিক বন্ধনে যাঁরা শতশত বছর ধরে আবদ্ধ তাঁরা হঠাৎ করে সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হন কি করে? আমার মনে হয়, যারা এসব বলেন, দেশের সমাজদেহ নিয়ে তাদের জ্ঞান একবারেই সীমিত। কোন প্রকার সরকারী সাহায্য ব্যতিরেকে সমাজের প্রত্যন্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা এসব প্রতিষ্ঠান কি কেবল হাওয়া খেয়েই চলে? তাঁদের প্রাত্যহিক খরচগুলো কোত্থেকে আসে? আসে সমাজ থেকে। সমাজের সদস্যরা এ অর্থ জোগান দেন সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে। প্রশ্ন করতে হয়, যারা রাজধানীতে বসে কওমী আলিম-ছাত্রদের মূলস্রোতবিচ্ছিন্ন বলে অপবাদ দেন তারা কোন সমাজের অংশ? বিজ্ঞান-গণিত ইত্যাদি পড়ানো হয় নাএ অপবাদ অবান্তর। পড়ানো হয় তবে সেসবের উচ্চশিক্ষা নয়, প্রয়োজনমাফিক। কারণ, কওমী মাদরাসা মূলত ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একচ্ছত্র জাগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। যে যুক্তিতে সমালোচকেরা বলেন: কওমী মাদরাসা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হলে জাগতিক উচ্চশিক্ষা দেয়া হয় না কেন, সেখান থেকে ডাক্তার-ইনজিনিয়ার বের হয় না কেনতাঁদের কাছে প্রশ্ন রাখতে হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবার এক-ই যুক্তিতে বলতে হয় মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল কলেজগুলোতে কুরআন-হাদীস-ফিকাহ ইত্যাদি শেখানো হয় না কেন? ওখান থেকে আলিম-ওলামা বের হতে পারে না কেন? আসলে কওমী মাদরাসা একটি বিশেষায়িত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। এখানকার মূল আদর্শ ইসলাম। দেশের জনগণের টাকা খরচ করে সরকার নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজগুলো তাদের উৎপাদন কতোটুকু সফলভাবে করতে পারছে, তা কারও অজানা নয়। প্রতিকূলে কওমী মাদরাসা সমাজের অর্থ নিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে সম্বল করে সমাজকে যা দিয়ে যাচ্ছে তাও অজানা নয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় ও নৈতিক জগতকে বাঁচিয়ে রেখেছে এসব মাদরাসাওয়ালাই। এরা বেকার তৈরি করে না বরঞ্চ বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে অগণিত মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছেন। এঁরা তো জাতীয় সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
৯.২.২৩               

বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

জাতির পাঠশালা

ভাবনা-৭

একটি জাতি কখন শক্তিশালী হয়? কখন স্বমেরুদণ্ডে দণ্ডায়মান হতে পারে? কখন নিজ শক্তিবলে পররাষ্ট্রের সাথে দর কষাকষি করে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করতে পারে? এর উত্তর একদম সোজা: যে জাতি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন এবং ঐক্যবদ্ধ থাকে। জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলে তার প্রভাবে রাষ্ট্রও শক্তিশালী হয়। মতপথ বাদ দিয়ে য়ুরোপের দেশগুলো বা আমেরিকার কথাই ধরা যাক। কাগজে-কলমে, মাঠে-ময়দানে ওরা বিশ্বদরবারে শক্তিশালী বলে পরিচিত। বিশেষ করে অর্থনীতির অনস্বীকার্য  সাম্রাজ্যে ওদের শক্তিমত্তা ও নিরাপত্তা অনেক নিরাপদ। কারণ, জাতি হিসাবে তারা ঐক্যবদ্ধ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাপ্র্রশ্নে বিভক্তহীন। ওদের স্বার্থ নিয়ে কোন আপোষ করতে চায় না। হাল-আমলের য়ুক্রেন যুদ্ধ তার প্রমাণ। অতীতের ইরাক ও আফগানিস্তান আগ্রাসন পশ্চিমাদের ঐক্যবদ্ধ স্বার্থসচেতনাকে নির্দেশ করে। তারা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বলে কোন চুক্তিতে বা সমঝোতায় নিজেদের অবস্থানকে অধিক নিরাপদ করার দর কষাকষিতে জয়ী হয়। দেখুন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রকৃতির প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল রাষ্ট্রকে অর্থ প্রদানে নানা শর্ত আরোপ করে মাথা ঝুঁকাতে বাধ্য করে। এদের পেছনে আছে শক্তিশালী রাষ্ট্রের হাত। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোও ওদের শর্ত মানতে বাধ্য হয়। শুধু এখানেই নয়, প্রতিরক্ষাতেও ওরা শক্তিশালী। কারণ, স্বার্থপ্রশ্নে ওদের প্রশাসন-জনগণ একাট্টা। ওরা যখন কোন রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসাতে চায়, দলের আদর্শ ও সক্ষমতার দিকটি বিশেষ বিবেচনায় রাখে। ওদের আরেকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। তা হলো, সরকার তাদের কাছে জবাবদিহিতায় আক্ষরিকার্থে দায়বদ্ধ। এর অন্যথা হলে মাঝপথেই গদি হারাতে হয়। ঠিক এক-ই যুক্তিতে আসুন, আমরা জাতি হিসাবে কতোটুকু শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ এবং নিরাপত্তায় সচেতন--তা বিবেচনা করি।  উত্তরপত্র কতোটুকু ইতিবাচক হবে তা আশা করি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। প্রথমত, আমরা জাতি হিসাবে আজ বিভক্ত। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিয়ে জনসাধারণের কতোটুকু সচেতনতা আছে তা বলাবাহুল্য। আমরা যখন কোন দলকে ভোট দেই, দেখি না তার আদর্শ ও সক্ষমতা। মাত্র ক’টি টাকার বিনিময়ে যে জাতি চোখ বন্ধ করে ব্যালটে সীল মারতে পারে তাদের কাছে দলের জবাবদিহিতার প্রশ্ন কতোটুকু ওজন রাখে--তা না বোঝার কারণ নেই। দল আর সরকারও চায় না জনসাধারণ তাদের বিষয়ে সচেতন হোক। কারণ, এতে চোর নির্বিঘ্নে পালানোর পথ খুঁজে পেতে সক্ষম হবে এবং বারবার চুরির মোক্ষম সুযোগে মাল হস্তগত করতে পারবে। জাতির মধ্যে বিভক্তি সবচেয়ে ক্ষতিকর। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোন জাতির বিভক্তিতে বিদেশীশক্তির হাত থাকে। এতে বাইরের নীরব ও সরব উভয় প্রকারের হস্তক্ষেপের জায়গা থাকে।  আর বিভক্তি নিয়ে কোন জাতি স্বমেরুদণ্ডে শক্তবদনে দাঁড়াতে পারে না। আমরা এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে রীতিমতো বিভক্ত-বিধ্বস্ত। এতে বিদেশীশক্তির কতো ধরনের হস্তক্ষেপের শিকারে পরিণত হচ্ছি --সেটা দিবালোকের মতো পরিস্কার। সর্বক্ষণ অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিপক্ষের লালচক্ষুকে গণনায় রাখতে হয় আমাদেরকে। সরকারও চায় না জনগণ মননে-আওয়াজে শক্তিশালী ও সচেতন হোক। কারণ, ছাত্র বেশি মেধাবী ও প্রতিভাবান হলে অনেক শিক্ষক বিরক্ত বোধ করেন। কেননা, সে বেশি জানতে চায়, প্রশ্ন করে, কৈফিয়ত খোঁজে। তাই, সুযোগসন্ধানী সরকার বা দল চায় অসুস্থ জনগণ যেনো সরকারের জন্য বিরক্তিকর হয়ে না দাঁড়ায়। এতে রাজত্ব দীর্ঘকাল হবে। পরিণতিতে জাতি ও রাষ্ট্র স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হারায় এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে যায়।  
০৮.০২.২৩                


মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

হেফাজতের লেখাপড়া

ভাবনা-৬

সাম্প্রতিক অতীতে সরকার-প্রধানের সাথে হেফাজতে ইসলামের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের একটি সাক্ষাৎ হয়। খবরে জানা যায়, তাঁরা বন্দী নেতাকর্মীদের মুক্তি চেয়ে এবং কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলেছেন। বিষয়টি নিয়ে একটি পক্ষ মিডিয়াতে প্রশ্ন তুলেছেন: সরকার আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে হেফাজতকে বাগে আনতে চাইছে। আপত্তিকর প্রশ্ন হলো: তাঁদের বক্তব্যানুসারে, হেফাজতে ইসলামের কর্তাব্যক্তিরা সরকারের কাছে মুচলেখা দিয়ে এসেছেন যে, তাঁরা আর কোন রাজনীতি করবেন না বা রাজনৈতিক কোন কর্মসূচী দেবেন না। দলীল হিসাবে প্রশ্নতোলা ব্যক্তিবর্গ বলেছেন, সাক্ষাতের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন, কারাবন্দী নেতাকর্মীদের কেউকেউ মুক্তি পাচ্ছেন। যতোদূর জানি, হেফাজতের পক্ষ থেকে কোন প্রকার মুচলেখা দেয়ার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কেন হেফাজত রাজনীতিতে জড়িত না হবার বিতর্কে বারবার আহত হচ্ছে? হেফাজত তো বরাবরই স্বঘোষিত অরাজনৈতিক সংগঠন। এর কারণ হলো, হেফজতে ইসলাম লিখিতভাবে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন সত্য কিন্তু তাঁদের আলোচিত কিছুকিছু কর্মসূচী রাজনীতি-ঘনিষ্ট বলে বাহ্যত মনে হয়। সাথেসাথে এও বলতে হয়, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ইসলামী ব্যক্তিবর্গ হেফাজতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থেকেছেন। ফলে, হেফাজতে একটি রাজনীতি-অরাজনীতির মিশ্রন ঘটে গেছে। এ মিশ্রনের গতি-প্রকৃতি পরবর্তীতে বিভিন্ন রঙ যেমন পরিগ্রহ করে তেমনি আলোচনা-সমালোচনারও জন্ম দেয়। বলাবাহুল্য, হেফাজতে ইসলামের কর্মকর্তা, কর্মী সবাই কওমী মাদরাসাকেন্দ্রিক। তবে সমাজে শতশত বছর ধরে চলে আসা কওমী আলিম-ছাত্রদের যে সুগভীর শেকড় আর প্রভাব রয়েছে তা চরম বিরোধীরাও অস্বীকার করতে পারবে না। বলা দরকার, হেফাজতে ইসলামে আগে থেকেই রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের পদায়ন করা হয় এই  ‍যুক্তিতে যে, তাঁরা সবাই তো কওমী মাদরাসাকেন্দ্রিক এবং সংগঠনকে এগিয়ে নিতে তাঁদের ভূমিকার বিকল্প নেই। বিষয়টি এখানেই যদি থেমে থাকতো আপত্তি ছিলো না। আপত্তি হলো, হেফাজতে ইসলামের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনেকেই তাদের রাজনৈতিক সত্ত্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ফলে, গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়; বিশেষত সরকার পক্ষ শংকিত হয়ে ওঠে। সরকার মনে করতে থাকে, দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিশেষত বিএনপি ও জামাতে ইসলামী হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচী থেকে ফায়দা লুটতে পারে, এমন কি হেফাজতের রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে সংযোগ স্থাপন করে সরকারের ভাষায় ‘গোলযোগ বা অস্থিরতা’ তেরি করতে পারে। শাপলার ঘটনা থেকে শুরু করে একবারে মুদিবিরোধী বিক্ষোভ পর্যন্ত কর্মসূচীগুলোকে পর্যবেক্ষণে নিলে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচীকে ঘিরে সন্দেহ একবারে অমূলক মনে হবে না। কারণ, যারা প্রথম থেকে হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণ করার সমূহ চেষ্টা করেছেন তাদেরকে দেখা গেছে কখনও সরকার পতনের ঘোষণা দিতে, কখনও বঙ্গভবনে আপ্যায়িত হতে। সুতরাং হেফাজতে ইসলাম নিয়ে বিতর্ক কখনও মৃতরূপ ধারণ করেনি। বলতে হয়, হেফাজতে ইসলামের মৌলিক দুর্বলতা হলো, আজ পর্যন্ত তাঁরা কোন গঠনতন্ত্র তৈরি করতে পারেনি যা দিয়ে সংগঠনকে আপাদমস্তক নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এরপর সংগঠনে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সংশ্লিষ্টতা নয় পদায়ন করা ছিলো মস্তবড় ঝুঁকিপূর্ণ যা বারবার বিপদের কারণ হয়েছে। বলাবাহুল্য, হেফাজতের একটি কাউন্সিলও নিয়মতান্ত্রিক ও সংবিধানভিত্তিক হতে পারেনি। এর জন্য পূর্বাপর দায়িত্বশীলরা দায় এড়াতে পারেন না। আজ যা হচ্ছে বা হয়েছে, সেসবের ফলে যে সমূহক্ষতি আমাদের কওমী আলিম-ছাত্রদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তা কখনও মুছে যাবার নয়। যদি হেফাজত তার স্বঘোষিত নীতিকে কর্মে দেখাতে পারতো তবে আজ মুচলেখা দেবার প্রচারিত অপবাদে জর্জরিত হতে হতো না।
০৭.০২.২৩

সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

নতুন পাঠের বাছবিচার

ভাবনা-৫

অধুনা বাংলাদেশের নতুন পাঠ্যক্রমে সংযোজিত বিতর্কিত বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা উঠেছে ঢের। সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে কথা উঠছে প্রচুর। সমাজের একেবারে নিম্নস্তরের চায়ের দোকানের টকশো থেকে প্রচারমাধ্যমের টকশো পর্যন্ত কোথাও বাদ নেই। ইতিহাসের নিরিখে, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে সংযোজিত বিষয় নিয়ে বিতর্ক আর সরকারের সমালোচনা আসমান ছুঁবে মনে হয়। আপাতত ইতিহাসের পাঠ সরিয়ে রেখে বিতর্কিত ‘বিবর্তনবাদ’ নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। প্রথমত দেখা যাচ্ছে, লেখা বা সম্পাদনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের ভূমিকা এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া রহস্যজনক। মনে হচ্ছে, কোথাও আড়ালে কোন খেলা হচ্ছে। সরকারের শিক্ষামন্ত্রী বললেন: যাদেরকে বই তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তারা সরকারের সুপারিশকে পাত্তা দেননি; সঙ্গতকারণে এমন পরিবেশনা। সম্পাদকেরা ক্ষমা না চেয়ে গাবাঁচানো দুঃখ জানিয়ে কাজ সেরেছেন। এখনও সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে সঙ্গীন বিবেচনা করে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বিবর্তনবাদ ডারউইনের অত্যন্ত বিতর্কিত ও অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক একটি উদ্ভাবন। বিজ্ঞানের সাথে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। এ তত্ত্বের মূলকথা হলো, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ বানরেরই পরবর্তী প্রজন্ম; বর্তমানের মানুষ আদিযুগের কোন মানব বা মানবগোষ্ঠীর পরপ্রজন্ম নয়। এ নিয়ে অনেক গোলমাল হয়েছে অতীতে। যাক, সেদিকে না গিয়ে প্রশ্ন করা যায়, হঠাৎ করে আমাদের সন্তানদের পাঠ্যবইয়ে এ বিবর্তনবাদ ঢোকানো হলো কেন?  এর কারণ, গোটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেই একটি বিবর্তনবাদের মধ্য দিয়ে একটি বিতর্কিত গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। বলাবাহল্য, বাংলাদশের মানুষের নব্বই শতাংশ বিশ্বাসগতভাবে মুসলমান। সঙ্গতকারণে তাঁরা বিশ্বাস করে: মানুষ পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম আ.-র পর্যায়ক্রমিক সন্তান। পবিত্র কুরআন এ বিষয়ে বিশদ বিবরণ দিয়েছে। শুধু মুসলিম বলে নয়, দুনিয়ার হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদী কেউ বলে না: মানুষ বানর বা অন্য কোন পশুর পরপ্রজন্ম। যা বলছিলাম, পাঠ্যবইয়ে বিবর্তনবাদ ঢুকিয়ে বাংলাদেশের উপর একটি রাষ্ট্রীয় বিবর্তনের ধারা প্রয়োগের চেষ্টা হচ্ছে। চেষ্টাটা নতুন নয়, স্বাধীনতার পর থেকে যখন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে তথাকথিত সেক্যুলার বা ধর্মহীন করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয় তখন থেকে। যেখানে নব্বই শতাংশ মানুষ একটি বিশেষ বিশ্বাসনির্ভর দর্শনকে বহন করে সেখানে সে জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রভাব অধিকতর দৃশ্যমান হবে--সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু একটি নেতিবাচকমহল যারা নিজেদেরকে সেক্যুলার বলে দাবি করে, নিরলস চেষ্টায় ব্যাপৃত যেন সেই সংখ্যাগরিষ্ঠের আবহকে ধীরে চলমান একটি বিবর্তনবাদের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন করে শিশু-তরুণ-যুবক প্রজন্মকে এমন এক স্তরে নিয়ে আসা যায়, যেখানে ওদের বিশ্বাস হবে সংশয়পূর্ণ ও বিতর্কিত। তখন তারা নিজেদের মানব-সন্তানের পরিচয় হারিয়ে পশু-সন্তানের পরিচয়ে বড় হবে এবং ধীরেধীরে বিশ্বাসহীন একটি গোষ্ঠীতে পরিবর্তিত হয়ে পশুর মতো আচরণে অভ্যস্ত হতে চাইবে। এটা সেই গন্তব্য যাকে সেক্যুলারাইজেশন বা ধর্মরিপেক্ষকরণ নামে এখন প্রচার চালানো হচ্ছে। একটি গোষ্ঠী দীর্ঘদিন থেকে এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, তদবির করছে। ভূলবশত বা অসাবধানতাবশত পাঠ্যসূচীতে বিবর্তনবাদ ঢুকে গেছে--এমন সরলীকরণের কোন সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, ছিদ্র ছোট থাকতে বন্ধ করতে না পারলে সেখান দিয়ে এসসময় হাতি প্রবেশ করবে। শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড বলে স্বীকৃত। এখন সে শিক্ষাকে যদি একটি বিশেষমহলের লালসা পূরণের হাতিয়ার করে দেয়া হয় তা হবে জাতি ও মুসলমানদের জন্য বড় বিপদের কারণ।

০৬.০২.২৩       

রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

ড. জাফর ইকবালকে একহাত নিলেন অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান

উগ্রপন্থার দিকবিদিক

ভাবনা-৪

‘উগ্রপন্থা’ বলে একটি কথা আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। এর উল্টোশব্দ বা বিপরীত শব্দ বলে বুঝি--উদারপন্থা। হতে পারে। কিন্তু উদারপন্থা উগ্রপন্থার উল্টোশব্দ হতে পারে, প্রতিষেধক নয়। প্রতিষেধক হলো: মধ্যপন্থা। কথাটি বলছিলাম, আমাদের সমস্যা বোঝাতে। তবে উগ্রপন্থা আর চরমপন্থার মধ্যে আমার কাছে ভিন্নতা আছে মনে হয়। উগ্রপন্থার মাঝে যেমন সবসময় উগ্রতা থাকে তেমনি চরমপন্থার মধ্যে চরম বা চূড়ান্ত হবার পরিণতি বিদ্যমান থাকে। সেদিক থেকে উগ্রপন্থার মধ্যে উগ্রতা বা বাড়াবাড়ি থাকা স্বাভাবিক যা কোনভাবেই গ্রাহ্য নয়। চরমপন্থা তেমন নয়। মানুষ যখন তার কাম্য কোন গন্তব্য অর্জনের জন্য একের পর এক প্রতিকূল পরিস্থিতি মুকাবিলা করতে থাকে শেষচেষ্টা হিসাবে চরমপন্থাকে গ্রহণ করে থাকে। তাই ব্যাখ্যানির্বিশেষে কারও কাছে চরমপন্থা ইতিবাচক, কারও কাছে নেতিবাচক। রোগ থেকে বাঁচার চেষ্টায় একের পর এক অষুধে কাজ না হলে যেতে হয় অপারেশান বা অস্ত্রোপচারে। এটা অবশ্যই চরমপন্থা কিন্তু উগ্রপন্থা নয়। এখানে বাড়াবাড়ি নেই। তেমনি একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উগ্রপন্থা নয়, চরমপন্থা। তাই মুক্তিযুদ্ধকে একটি চরমপন্থী আন্দোলন বললে ভুল হবার কথা নয়। অবশ্য বৃটিশ-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তৎকালীন বাংলায় অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তরের মতো যেসব ‘চরমপন্থী’ দলের কথা উল্লেখ আছে সেগুলোর চরিত্র সর্বাংশে চরম ছিলো না; সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্বনির্ভর ও উগ্রবাদীও ছিলো। আজকে যেমন ভারতের আরএসএস, বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইত্যাদি উগ্রপন্থাকে অনুসরণ করে। ইংরেজিতে কিন্তু চরমপন্থা আর উগ্রপন্থা--উভয়কে Extremism বলে ডাকা হয়। এটা কোনভাবেই সমীচীন নয়। উগ্রপন্থা আর বাড়াবাড়ি অভিন্ন, চরমপন্থার চরিত্র ব্যাখ্যনির্ভর। আমাদের মাঝেও ক্ষেত্রবিশেষে উগ্রপন্থা দেখা দেয় যা আমাদের সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য কখনও হিতকর প্রমাণিত হয়নি। বরঞ্চ ক্ষতি করেছে অপূরণীয়। এর মূল কারণ হলো: আমাদের চিন্তার ক্ষুদ্রতা এবং উগ্রতা, চরমপন্থা ও কালের ভিত্তিতে কর্তব্যের আহ্বানকে উপলব্ধি করার ব্যর্থতা। পরিবেশকে সঙ্গী না করে আমরা যে ব্যাখ্যা দাঁড় করাই সেটাকে মুশাওয়ারা বা উদার পরামর্শের ভিত্তিতে সজ্জিত না করে একদর্শী পথ চললে উগ্রপন্থার খপ্পরে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।  আগেই বলেছি, উগ্রপন্থার প্রতিষেধক মধ্যপন্থা যাকে কুরআনের ভাষায় বলা হয়--“সিরাতুল মুস্তাকীম” অর্থাৎ, অকঠিন, অজটিল ও সহজ-সরল পথ। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এই সহজ-সরল পথকেই চিনতে আমাদের জটিলতা অত্যধিক যা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক। সঙ্গতকারণে, আমাদের বিপদ সবসময় সীমার উপরে দৃশ্যমান হয়। আমাদের রাষ্ট্রচরিত্র, রাজনীতি, ধর্মচর্চা সর্বক্ষেত্র আজ উগ্রপন্থার ভয়াল থাবার মুখোমুখী। এর একমাত্র প্রতিষেধক অবশ্যই মধ্যপন্থা এবং মধ্যপন্থা।

০৫.০২.২০২৩

শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

নির্বাচনে অপুষ্টি

 ভাবনা-৩

দেশে কোথাও কোথাও স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে। আমাদের এলাকাতেও নিকট-ভবিষ্যতে হতে যাচ্ছে পৌরসভা নির্বাচন। ইতোমধ্যে প্রার্থীদের জনসংযোগের কসরত শুরু হয়ে গেছে। গেলোবারের নির্বাচিত প্রার্থীরাও নিখোঁজ অবস্থা থেকে বেরিয়ে শুরু করছেন লাইসেন্স নবায়নের কাজ। নতুনরাও নেমেছেন মাঠে। কিন্তু প্রশ্ন: নির্বাচন কি আদৌ হবে, না কি নির্বাচনের নামে উপরের নির্দেশে বাছাই হবে, না কি ১৪, ১৮’র মডেলের নাটক প্রদর্শিত হবে? তৃণমূলে-জনমানুষ কী ভাবছে? আমরা কি জানি? আগের নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে মানুষের ভাবনার ছবি ইতিবাচক নয়। হাটে-মাঠে-ঘাটে মানুষের ভাবনা থেকে উঠে আসে ন্যায্য হতাশার করুণ ছবি। দৈনন্দিন মুখোমুখি হওয়া সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া জানলে আসন্ন নির্বাচনের সম্ভাব্য চিত্র নিয়ে আশার কিছু আছে বলে মনে হয় না। কর্তাব্যক্তিরা যতোই আশ্বাস দিক, মানুষ সেটা বিশ্বাস করে না। কারণ, অতীতে মানুষ মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস করে কি নিদারুণভাবে প্রতারিত হয়েছে--সে স্মৃতি ভুলে যাবার নয়। তবুও মানুষ নির্বাচন এলে কৌতুহলী হয়, মনের এককোণে পড়ে থাকা সংশয়কে সঙ্গী করে আশাবাদী হতে চায়। চায়ের দোকানে, বাজারে-সাজারে কিছু কথা পেড়ে. তর্কবিতর্ক করে মনের ঝাল মেটাতে চায় নির্বাচনোৎসাহী জনতা। তাঁদের এ তৎপরতায় যে সরলতার দাগ লেগে থাকে সেসব কি কখনও মূল্য পায় প্রশাসনের কাছে? তৃণমূলের মানুষের এখন একটাই হতাশা: ইলেকশন তো আগেই হয়ে যাবে, ভোট দিয়ে কী লাভ? এর দায় সরকারের-প্রশাসনের। ব্যক্তিগতভাবে আমিও ভাবছি ভোট দেবো কি না। আগে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির সুযোগ ছিলো কম। এখন তো সেখানেও রাজনীতির ভয়াল থাবা বিরাজমান। জাতীয় নির্বাচনের ভালোমন্দকে পেছেনে ফেলে মানুষ স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে মেতে উঠতো। বলতে গেলে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় নির্বাচনের সাথে সাধারণ মানুষের আত্মীয়তা ছিলো ঢের বেশি। কারণ, জাতীয় জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকে মানুষ কাছে পেতো। এখন রাজনীতি ঢোকার পর থেকে সে সুরতও উধাও। দেখা গেলো, মানুষ ক্রমেই তার নির্বাচনের স্বাধীনতা হারাচ্ছে। এখান থেকেই আজ মানুষ নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সরকারদলীয়রা যখন প্রকাশ্যে বলেন, ভোট যাকেই দিবেন আওয়ামী লীগই পাবে তখন কি মানুষ ক্ষুধা নিয়েও খেতে চাইবে? কথায় নয়, কাজে প্রমাণ দিতে হবে: মানুষের ভোটাধিকার ধর্ষিত হবে না। কিন্তু মানুষকে সে বিশ্বাস যোগাবে কে, যে তাঁর ভোটাধিকার আত্মসাৎ করা হবে না? নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও মানুষের দ্বারে যাবার তাগিদ অনুভব করেন না। কারণ, সিলেকশন।

শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

রাজনীতির অন্তরালে

 ভাবনা-২

প্রচলিত ‘রাজনীতি’ আসলে কি? এক সময় রাজনীতি ছিলো দেশ আর মানুষ-সেবার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। দেশের স্বার্থ রক্ষায়, নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা তৃণমূল পর্যায়ে পৌছে দেয়ার সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিবর্গই রাজনীতি করতেন। তাঁরা রাজনীতি করতেন আত্মসাতের প্রত্যয়ে নয়, সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মহৎ নিয়তে। তাই তাঁরা ছিলেন বরাবরই সম্মানীত, বরণীয়; আজও আছেন। সেদিক থেকে বাংলার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ মজলুম জননেতা মরহুম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। নিজের খাদ্য পাকাতে মাটির চুলোয় আগুন জ্বালাতে দেখা গেছে--এমন কেউ কি আছেন ভাসানী বিনে? খদ্দরের পান্জাবী, তালপাতার টুপি আর লুঙ্গী পরে অতিসাধারণ বেশভুষায় রাজনীতি আর আন্দোলনের মাঠে তিনি ছিলেন মহানায়ক। কেউ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। আজ ভাসানী যেমন নেই, ভাসানীর রাজনীতিও নেই। এখন রাজনীতি মানে ব্যবসা, প্রতারণা আর নিজের পকেটে মিলিয়ন-বিলিয়ন টাকার বন্দোবস্ত করা। এক সময় দেখতাম, সমাজের সৎ আর নির্ভীক মানুষগুলো পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্ন দেখতেন সমাজসেবার মানসে। এখন দু’নম্বরী ব্যবসায়ীরা পত্রিকার মালিক। নিজেদের অপরাধ ঢাকতে আর বিশেষগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় প্রকাশিত হয় পত্রিকাগুলো। অতীত সময়ে রাজনীতিক আর পত্রিকার প্রকাশক-সম্পাদকেরা সমাজে যে সম্মান পেতেন, এখন তা স্বপ্নের দেশে। আজ যত্রতত্র দেখা যায়, শোনা যায় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হবার বীভৎস চিত্র, বিদেশে বিশাল অর্থ পাচারের কুৎসিৎ সংবাদ। এ সম্পদ আর টাকার মালিক কে বা কারা? সবাই তা জানে। আসল মালিক যাঁরা, মানে জনগণ কখনও সে সম্পদ ভোগ করতে পারে না। জনমানুষ রাষ্ট্রশক্তির সহায়তা পায় না। তাই তাঁরা বঞ্চিত, নিপীড়িত। জনগণের ক’জন সন্তান দেশে লেখাপড়া করে জানেন? সবাই বিদেশের নামিদামি শিক্ষালয়ে। এরাই দেশে এসে নেতৃত্ব দেয়, বিশাল সম্পদের মালিক হয়। তাহলে সর্বসাধারণের জন্য জায়গা থাকলো আর কি? কেবল কেরানিগিরীর চেয়ার? মোট কথা, রাজনীতি এখন উর্বর ব্যবসা যার কোন জবাবদিহিতা নেই। কারণ, জবাবদিহিতা তো এখন অগ্রহণীয়। সরকারের মন্ত্রী যখন কর্মচারীদের বলতে পারেন: ঘুষ খান তো সহনীয় করে খান; তখন কি কিছু বোঝার বাকি থাকে?

বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

ভাবার দর্শন

 

ভাবনা-১

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম। 
ভাবতে পারাটাই একটা ভীষণ রকমের যোগ্যতা মনে হয় আমার কাছে। ব্যক্তিবিশেষে অবশ্য ভাবার চিত্র আর চরিত্র একরকম হয় না। তাই আমি ভাবছি আমার মতো করে। আমার চার পাশে--যা পরিবেশ নামে পরিচিত, তার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারার মধ্যে একটি আনন্দ আর সফলতা আছে বৈ কি। ইসলামী আইন বিশারদগণ যাঁদের পারিভাষিক পরিচয়: ফকীহ, বলেন, আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে যারা অজ্ঞ তারা মূর্খ। তাই পরিবেশ সম্পর্কে দূরে থাকার ভয় তো আছেই। আবার অতি পরিবেশময় হয়ে যাওয়ার বিপদও কম নয়। যেমন, ভাসার জন্য নৌকার পানির প্রয়োজন অনস্বীকার্য তেমনি ভেতরে পানির প্রবেশও আত্মঘাতী। বলছিলাম, ভাবার কথা। হ্যা, ভাবতে গেলে ভাবের সাথে ভাব করতে হয়। সীমান্তে যেমন দ্রব্য পারাপারের জন্য ওপাশের কারও সাথে সখ্যতা গড়তে হয়, তেমন আর কি। দৃষ্টি, শ্রবণ, স্পর্শ আমাদের ভাবের প্রথম দ্বার। ওখান দিয়ে যে বার্তা এসে অন্তরকে আলিঙ্গন করে সেটা মগজের ছোঁয়ায় ভাবের জন্ম দেয়। মানুষ চিন্তার খোরাক পেয়ে চিন্তায় মগ্ন হয়। এখান থেকে পথ চলে যায় সড়ক-মহাসড়কের দিকে; তারপর সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে অসীমের খোঁজে। কুরআন যখন বলে: তুমি কি মরুর উট দেখোনি? কেমন করে তার অসাধারণ দেহাকৃতি এলো, তা কি তুমি ভেবো দেখোনি? সুবিস্তৃত আকাশ কি তোমাকে ভাবায় না? উর্ধ্বশিরের প্রশস্ত পর্বতশৃঙ্গ কি তোমার অন্তরে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে না? তখন কেন তুমি সড়ক-মহাসড়ক ধরে, সাগর-মাহাসাগর পেরিয়ে অসীমের পথে ধাবিত হও না? কেন তোমার চিত্ত মগজের অলিগলিতে হেঁটে বেড়াতে চায় না?  যে ভাবে না, তার আশপাশের যা কিছু নিয়ে--সে প্রাণী হতে পারে, মগজসমৃদ্ধ মানুষ হতে পারে না।
০১.০২.২০২৩

Featured Post

জামায়াতে ইসলামীর সাথে কওমীদের ঐক্য কি আদৌ সম্ভব ? ভাবনা-৫০ বাংলাদেশে ইসলাপন্থীদের ঐক্য নিয়ে আলোচনার হায়াত অনেক দীর্ঘ । এক সময় ঐক্যের শে...