ভাবনা-৬
সাম্প্রতিক অতীতে সরকার-প্রধানের সাথে হেফাজতে ইসলামের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের একটি সাক্ষাৎ হয়। খবরে জানা যায়, তাঁরা বন্দী নেতাকর্মীদের মুক্তি চেয়ে এবং কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলেছেন। বিষয়টি নিয়ে একটি পক্ষ মিডিয়াতে প্রশ্ন তুলেছেন: সরকার আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে হেফাজতকে বাগে আনতে চাইছে। আপত্তিকর প্রশ্ন হলো: তাঁদের বক্তব্যানুসারে, হেফাজতে ইসলামের কর্তাব্যক্তিরা সরকারের কাছে মুচলেখা দিয়ে এসেছেন যে, তাঁরা আর কোন রাজনীতি করবেন না বা রাজনৈতিক কোন কর্মসূচী দেবেন না। দলীল হিসাবে প্রশ্নতোলা ব্যক্তিবর্গ বলেছেন, সাক্ষাতের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন, কারাবন্দী নেতাকর্মীদের কেউকেউ মুক্তি পাচ্ছেন। যতোদূর জানি, হেফাজতের পক্ষ থেকে কোন প্রকার মুচলেখা দেয়ার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কেন হেফাজত রাজনীতিতে জড়িত না হবার বিতর্কে বারবার আহত হচ্ছে? হেফাজত তো বরাবরই স্বঘোষিত অরাজনৈতিক সংগঠন। এর কারণ হলো, হেফজতে ইসলাম লিখিতভাবে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন সত্য কিন্তু তাঁদের আলোচিত কিছুকিছু কর্মসূচী রাজনীতি-ঘনিষ্ট বলে বাহ্যত মনে হয়। সাথেসাথে এও বলতে হয়, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ইসলামী ব্যক্তিবর্গ হেফাজতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থেকেছেন। ফলে, হেফাজতে একটি রাজনীতি-অরাজনীতির মিশ্রন ঘটে গেছে। এ মিশ্রনের গতি-প্রকৃতি পরবর্তীতে বিভিন্ন রঙ যেমন পরিগ্রহ করে তেমনি আলোচনা-সমালোচনারও জন্ম দেয়। বলাবাহুল্য, হেফাজতে ইসলামের কর্মকর্তা, কর্মী সবাই কওমী মাদরাসাকেন্দ্রিক। তবে সমাজে শতশত বছর ধরে চলে আসা কওমী আলিম-ছাত্রদের যে সুগভীর শেকড় আর প্রভাব রয়েছে তা চরম বিরোধীরাও অস্বীকার করতে পারবে না। বলা দরকার, হেফাজতে ইসলামে আগে থেকেই রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের পদায়ন করা হয় এই যুক্তিতে যে, তাঁরা সবাই তো কওমী মাদরাসাকেন্দ্রিক এবং সংগঠনকে এগিয়ে নিতে তাঁদের ভূমিকার বিকল্প নেই। বিষয়টি এখানেই যদি থেমে থাকতো আপত্তি ছিলো না। আপত্তি হলো, হেফাজতে ইসলামের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনেকেই তাদের রাজনৈতিক সত্ত্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ফলে, গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়; বিশেষত সরকার পক্ষ শংকিত হয়ে ওঠে। সরকার মনে করতে থাকে, দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিশেষত বিএনপি ও জামাতে ইসলামী হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচী থেকে ফায়দা লুটতে পারে, এমন কি হেফাজতের রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে সংযোগ স্থাপন করে সরকারের ভাষায় ‘গোলযোগ বা অস্থিরতা’ তেরি করতে পারে। শাপলার ঘটনা থেকে শুরু করে একবারে মুদিবিরোধী বিক্ষোভ পর্যন্ত কর্মসূচীগুলোকে পর্যবেক্ষণে নিলে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচীকে ঘিরে সন্দেহ একবারে অমূলক মনে হবে না। কারণ, যারা প্রথম থেকে হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণ করার সমূহ চেষ্টা করেছেন তাদেরকে দেখা গেছে কখনও সরকার পতনের ঘোষণা দিতে, কখনও বঙ্গভবনে আপ্যায়িত হতে। সুতরাং হেফাজতে ইসলাম নিয়ে বিতর্ক কখনও মৃতরূপ ধারণ করেনি। বলতে হয়, হেফাজতে ইসলামের মৌলিক দুর্বলতা হলো, আজ পর্যন্ত তাঁরা কোন গঠনতন্ত্র তৈরি করতে পারেনি যা দিয়ে সংগঠনকে আপাদমস্তক নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এরপর সংগঠনে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সংশ্লিষ্টতা নয় পদায়ন করা ছিলো মস্তবড় ঝুঁকিপূর্ণ যা বারবার বিপদের কারণ হয়েছে। বলাবাহুল্য, হেফাজতের একটি কাউন্সিলও নিয়মতান্ত্রিক ও সংবিধানভিত্তিক হতে পারেনি। এর জন্য পূর্বাপর দায়িত্বশীলরা দায় এড়াতে পারেন না। আজ যা হচ্ছে বা হয়েছে, সেসবের ফলে যে সমূহক্ষতি আমাদের কওমী আলিম-ছাত্রদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তা কখনও মুছে যাবার নয়। যদি হেফাজত তার স্বঘোষিত নীতিকে কর্মে দেখাতে পারতো তবে আজ মুচলেখা দেবার প্রচারিত অপবাদে জর্জরিত হতে হতো না।
০৭.০২.২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন