ভাবনা-১৯
আওয়ামী লীগের ছাত্র-সংগঠন ছাত্রলীগের
বিশেষ করে ঢাকায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ড জাতীয়ভাবে প্রশ্ন ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। শুধু
ছাত্রলীগ নয়, ছাত্রীলীগও এখন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনায়। এসব নিয়ে
সীমিত পরিসরে হলেও পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ঘৃণার পর্যায়ে
চলে যাচ্ছে মনে হয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদের সময় সরকারীদলের
ছাত্র-সংগঠন ছিলো, ‘নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ’। ঢাকায় তাদের দৌরাত্ম্য আমি দেখেছি। যতোদূর
মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র সরকারী ছাত্র-সংগঠনের হাতে নির্যাতিত হয়ে তার শিক্ষার
যে করুণ পরিণতি হয়—সেটা
তিনি এক সাক্ষাতে সরাসরি পেসিডেন্টকে অবহিত করতে সক্ষম হন। মরহুম এরশাদ সাহেব বিন্দুমাত্র
দেরি না করে তাঁর গড়া নতুন বাংলা ছাত্র সমাজকে নিষিদ্ধ করে দেন। ছাত্র-সমাজের তৎকালীন
নেতৃবৃন্দ তা নিয়ে অনেক লম্ফঝম্ফ করেন কিন্তু মরহুম প্রেসিডেন্ট তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে
সরে দাঁড়াননি। পুরো জাতি সেদিন এমন পদক্ষেপের জন্য প্রেসিডেন্ট এরশাদকে অভিনন্দিত করে।
দোষে-গুণে মানুষ। যার যা ভালো বলতে হবে। এটা অন্য কেউ পারেন নি। রাজনীতির সুযোগে ছাত্রেরা
এসব কেন করে? এর বড়ো কারণ অপরিণত বয়সে ক্ষমতার স্বাদ ও অপব্যবহার। ছাত্রদের মূলকাজ
লেখাপড়া, জ্ঞানার্জন ও দেশসেবা। তা না করে এখন তারা যা করছে—সেসব যে নিখুঁত চোর-ডাকাত আর
অপরাধীদের কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য সবাই যে এমন, তা কিন্তু নয়। কিছু ভালো ও মেধাবী
ছাত্রও আছে। কিন্তু সংখ্যায় তারা কম। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ছাত্রলীগ কিন্তু প্রথম
দিকে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রিত কোন সংগঠন ছিলো না। ছাত্রলীগের সাবেক ছাত্রনেতারাও কিন্তু
তেমনটা বলেন। সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ফজলুর রহমান বিভিন্ন টকশোতে বারবার সে-কথা বলেছেন।
তাঁদের কথা হলো, মূল রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকেই অধঃপতনটা শুরু হয়। কারণ,
এখানে ক্ষমতার স্বাদটা বেশ কাছের। আর ক্ষমতা কে না ভোগ করতে চায়? বলা দরকার, ১৯৩৮ সালে
কোলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করা হয়। সে-সময় মুসলিম
ছাত্রলীগ মূলত তিনটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের সংগঠিত করে: (১)
সকল ক্ষেত্রে মুসলমানদের দাবি তুলে ধরা (২) মুসলমান ছাত্রদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা
(৩) শিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশ সাধন করা। (বংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাস, কে. এম. শামসুল আলম,
প্রকাশ: ১৯৯৩, পৃ:৩) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নাম পরিবর্তন করে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান
মুসলিম ছাত্র লীগ হিসাবে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ প্রচারিত
এক বিজ্ঞপ্তিমূলক দলীলে তারা জানায়, “…..সরকারের
জনকল্যাণকর কর্মপদ্ধতির প্রতি আমাদের সক্রিয় সাহায্য ও সহানুভূতি থাকবে, কিন্তু সরকারের
জন ও ছাত্র স্বার্থবিরোধী কর্মপন্থার বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াবো। পক্ষান্তরে, বাধ্যতামূলক
ফ্রি প্রাইমারী চিকিৎসার ব্যাপক ব্যবস্থা, বিনা খেসারতে জমিদার ও বর্গাদার প্রথার উচ্ছেদ,
নানাবিধ কারিগরী সুবন্দোবস্ত, পূর্বপাকিস্তানে সামরিক শিক্ষার সুবন্দোবস্তের জন্য সামরিক
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন, ডাক্তারী ও ধাত্রীবিদ্যা প্রসারের জন্য উন্নত ধরনের নতুন কারিকুলামের
দাবি, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মুনাফাকারী ও চোরাকারবারীর সমূলে বিনাশ এবং ইসলামী ভাবধারায়
শিক্ষা প্রসারের জন্য আমাদের প্রস্তাবিত নবপ্রতিষ্ঠানটি কাজ করে যাবে।” (সৌজন্যে: ঐ,
পৃ:১৮) এতোএতো মহৎ কর্মসূচী ঘোষণা করে যে দলটি ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে—সে দল কেমন করে আজকের এ অধঃপতিত
অবস্থায় পতিত হলো, সে কি কালের প্রশ্ন নয়? আমার বারবার মনে হয়, ছাত্রলীগের মতো ঐতিহাসিক
সংগঠনটির দুরাবস্থার জন্য দায়ী মূলত ক্ষমতাসীনদের অপব্যবহার। বড়োরা যদি তাদেরকে টিকে
থাকার ঢাল হিসাবে ব্যবহার না করতেন, তবে কি ছাত্রলীগ এভাবে বিতর্কের বস্তুতে পরিণত
হতো? তাদেরকে সঠিক ব্যবহারে অনেক দেশসেবী মেধাবী মানুষের জন্ম হতো, তা তো অস্বীকার
করা যায় না। বিরানী পঁচলে দুর্গন্ধে দুনিয়া ভরে যায়। এদেরও অবস্থা হয়েছে সে-রকম। এদের
ঠিকানা ছিলো পড়ালেখায়, কিন্তু আজ ঠাঁই হলো নর্দমায়। কেন?—সে প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই খুঁজে দেখতে পারে। সবাইকে
ভাবতে হবে, বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্রদেরকে ক্ষমতাসীনদের লাঠিয়াল হিসাবে ব্যবহারের প্রবণতা
রোধ করা যায় কি না।
২৪.০২.২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন