ভাবনা-৭
একটি জাতি কখন শক্তিশালী হয়? কখন স্বমেরুদণ্ডে দণ্ডায়মান হতে পারে? কখন নিজ শক্তিবলে পররাষ্ট্রের সাথে দর কষাকষি করে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করতে পারে? এর উত্তর একদম সোজা: যে জাতি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন এবং ঐক্যবদ্ধ থাকে। জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলে তার প্রভাবে রাষ্ট্রও শক্তিশালী হয়। মতপথ বাদ দিয়ে য়ুরোপের দেশগুলো বা আমেরিকার কথাই ধরা যাক। কাগজে-কলমে, মাঠে-ময়দানে ওরা বিশ্বদরবারে শক্তিশালী বলে পরিচিত। বিশেষ করে অর্থনীতির অনস্বীকার্য সাম্রাজ্যে ওদের শক্তিমত্তা ও নিরাপত্তা অনেক নিরাপদ। কারণ, জাতি হিসাবে তারা ঐক্যবদ্ধ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাপ্র্রশ্নে বিভক্তহীন। ওদের স্বার্থ নিয়ে কোন আপোষ করতে চায় না। হাল-আমলের য়ুক্রেন যুদ্ধ তার প্রমাণ। অতীতের ইরাক ও আফগানিস্তান আগ্রাসন পশ্চিমাদের ঐক্যবদ্ধ স্বার্থসচেতনাকে নির্দেশ করে। তারা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বলে কোন চুক্তিতে বা সমঝোতায় নিজেদের অবস্থানকে অধিক নিরাপদ করার দর কষাকষিতে জয়ী হয়। দেখুন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রকৃতির প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল রাষ্ট্রকে অর্থ প্রদানে নানা শর্ত আরোপ করে মাথা ঝুঁকাতে বাধ্য করে। এদের পেছনে আছে শক্তিশালী রাষ্ট্রের হাত। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোও ওদের শর্ত মানতে বাধ্য হয়। শুধু এখানেই নয়, প্রতিরক্ষাতেও ওরা শক্তিশালী। কারণ, স্বার্থপ্রশ্নে ওদের প্রশাসন-জনগণ একাট্টা। ওরা যখন কোন রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসাতে চায়, দলের আদর্শ ও সক্ষমতার দিকটি বিশেষ বিবেচনায় রাখে। ওদের আরেকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। তা হলো, সরকার তাদের কাছে জবাবদিহিতায় আক্ষরিকার্থে দায়বদ্ধ। এর অন্যথা হলে মাঝপথেই গদি হারাতে হয়। ঠিক এক-ই যুক্তিতে আসুন, আমরা জাতি হিসাবে কতোটুকু শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ এবং নিরাপত্তায় সচেতন--তা বিবেচনা করি। উত্তরপত্র কতোটুকু ইতিবাচক হবে তা আশা করি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। প্রথমত, আমরা জাতি হিসাবে আজ বিভক্ত। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিয়ে জনসাধারণের কতোটুকু সচেতনতা আছে তা বলাবাহুল্য। আমরা যখন কোন দলকে ভোট দেই, দেখি না তার আদর্শ ও সক্ষমতা। মাত্র ক’টি টাকার বিনিময়ে যে জাতি চোখ বন্ধ করে ব্যালটে সীল মারতে পারে তাদের কাছে দলের জবাবদিহিতার প্রশ্ন কতোটুকু ওজন রাখে--তা না বোঝার কারণ নেই। দল আর সরকারও চায় না জনসাধারণ তাদের বিষয়ে সচেতন হোক। কারণ, এতে চোর নির্বিঘ্নে পালানোর পথ খুঁজে পেতে সক্ষম হবে এবং বারবার চুরির মোক্ষম সুযোগে মাল হস্তগত করতে পারবে। জাতির মধ্যে বিভক্তি সবচেয়ে ক্ষতিকর। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোন জাতির বিভক্তিতে বিদেশীশক্তির হাত থাকে। এতে বাইরের নীরব ও সরব উভয় প্রকারের হস্তক্ষেপের জায়গা থাকে। আর বিভক্তি নিয়ে কোন জাতি স্বমেরুদণ্ডে শক্তবদনে দাঁড়াতে পারে না। আমরা এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে রীতিমতো বিভক্ত-বিধ্বস্ত। এতে বিদেশীশক্তির কতো ধরনের হস্তক্ষেপের শিকারে পরিণত হচ্ছি --সেটা দিবালোকের মতো পরিস্কার। সর্বক্ষণ অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিপক্ষের লালচক্ষুকে গণনায় রাখতে হয় আমাদেরকে। সরকারও চায় না জনগণ মননে-আওয়াজে শক্তিশালী ও সচেতন হোক। কারণ, ছাত্র বেশি মেধাবী ও প্রতিভাবান হলে অনেক শিক্ষক বিরক্ত বোধ করেন। কেননা, সে বেশি জানতে চায়, প্রশ্ন করে, কৈফিয়ত খোঁজে। তাই, সুযোগসন্ধানী সরকার বা দল চায় অসুস্থ জনগণ যেনো সরকারের জন্য বিরক্তিকর হয়ে না দাঁড়ায়। এতে রাজত্ব দীর্ঘকাল হবে। পরিণতিতে জাতি ও রাষ্ট্র স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হারায় এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে যায়।
০৮.০২.২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন