ভাবনা-১৪
আজ এক সুইপারের গল্প বলি। গল্পটি লিখে গেছেন মাওলানা রুমী রহ. তাঁর মসনবীতে। চমৎকার সে কাহিনী। সুইপারকে আমাদের চট্টগ্রামে আঞ্চলিক ভাষায় বলে ‘মেথর’। ওদের অবাসস্থলকে বলে মেথরপট্টি। পট্টি মানে বোঝেন-ই: পল্লী বা বস্তি। তো তেমনই এক মেথরপট্টিতে থাকতো এক সুইপার। সারা দিন আবর্জনা সাফ করতে পার হতো তার দিনকাল। একদিন সে কি এক দরকারে বাজারে গেলো। বাজারে ছিলো এক আতরের দোকান। খুশবুতে মাতোয়ারা দোকানের সামনের অংশ। পথচারীদের নাকেমুখে লাগতো আতরের মোহনীয় খুশবু। ঘটনাক্রমে ঐ সুইপার আতরের দোকানটির সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। যেতে যেই না তার নাকে আতরের খুশবু এসে লাগলো, ব্যাস, ধপাস করে পড়ে গেলো রাস্তায়। পড়েই বেহুঁশ। কি হলো, কি হলো করতে করতে লোকজন দৌড়ে এলো। দেখলো, নাকেমুখে খিঁচুনি; হাত দু’টো শক্ত হয়ে আছে। কি করা, কেউ তাকে বাতাস দিচ্ছে; কেউ দিচ্ছে পানির ছিটা। নাহ, হুঁশ ফেরার লক্ষণ নেই। একজন গিয়ে নিয়ে এলো আগরবাতি; জ্বালিয়ে ধোঁয়া দেয়ার চেষ্টা করলো। অন্তত হুঁশ তো ফিরুক! সবাই দেখলো, অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। যতোই আগরবাতির ধোঁয়া দেয়া হচ্ছে, বাতাস দেয়া হচ্ছে—ততোই অবস্থা কাহিলতর হচ্ছে। খিঁচুনি তো থামছেই না, ক্ষণেক্ষণে বাড়ছে। শেষতক কেউ একজন দৌড়ে গিয়ে তার ভাইকে খবর দিলো: যা-যা, তোর ভাই তো মরতে চলেছে! ভাই দৌড়ে গিয়ে দেখে মেথরের অবস্থা সুবিধার নয়। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আতরের দোকান। বুঝে ফেললো রোগের কারণ। সবাইকে আগরবাতির ধোঁয়া, বাতাস, পানি—এসব দিতে কঠিনভাবে মানা করলো। লোকজনকে একটু সবুর করতে বলে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এলো রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কিছু কুকুরের শুকনো মল। সেটা নাকের উপর দিতেই মেথর চোখ খুললো, হাত নাড়লো একসময় উঠে বসলো। লোকজন তো দেখে হতবাক! ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলো রহস্য কি? তখন মেথরের ভাইটি বললো: আমার ভাই জীবনভর করে এসেছে মেথরগিরি। এসব করতে-করতে দুর্গন্ধই তার কাছে স্বাভাবিক। আজকে যেই না সে আতরের দোকানের সামনে এলো, নাকে খুশবু লাগতেই তার কাছে বিশ্রী আর উৎকট মনে হলো—তাতেই বেহুঁশ। আপনারা সেটা বুঝতে না পেরে যতোই আগরবাতির ধোঁয়া, পানি ইত্যাদি দিচ্ছিলেন, তার অবস্থা ততোই খারাপ হচ্ছিলো। আমি এসেই আতরের দোকান দেখে রোগ বুঝে ফেলি। তাই দৌড়ে গিয়ে ময়লা এনে ধরতেই সে তার স্বাভাবিকতা ফিরে পেলো; হুঁশ এলো। মাওলানা রুমী রহ. ঘটনাটির বয়ান দিয়ে মন্তব্য করলেন: মানুষ তার নিত্যদিনের পরিবেশ আর আচরণে বাধ্য হয়ে যায়। তখন প্রকৃত সুগন্ধ আর দুর্গন্ধের বাছবিচার থাকে না। পরিবেশ ও আচরণের প্রভাবে সুগন্ধ যেমন দুর্গন্ধ হয়ে যায় তেমনি দুর্গন্ধ হয়ে যায় সুগন্ধ। সে দুর্গন্ধের পথকেই মনে করে তার মুক্তির পথ—আসল ঠিকানা। তাই কেউ সুগন্ধের সন্ধান দিলেও প্রত্যাখ্যান করে, অসুস্থ বোধ করে। আমি কিন্তু সেই সুইপারের মধ্যে এ সমাজকে পরখ করি। আজ আমরা যে সমাজে বাস করছি সে কেমন সমাজ? আমরা কি জানি? আসলেই কি আমরা দুর্গন্ধে অভ্যস্ত না সুগন্ধে—সে কি বুঝি? নিজেদের মনগড়া আর পশ্চিমাধারায় চলতে চলতে কখন যে দু্র্গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। এখন সেই সুইপারের মতো সুগন্ধও দুর্গন্ধ ঠেকে আমাদের নষ্ট-নাকে; আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। আল্লাহ আমাদেরকে সুরা ফাতিহায় বলেছেন, ইহুদী আর খৃস্টানদের অনুসরণ না করতে। কেন? কারণ, আল্লাহপ্রদত্ত অহী কুরআনের অনুসরণই সুগন্ধ, পরিপন্থী সব দুর্গন্ধ। আমাদেরকে তাই সুগন্ধে থাকতে বলেছেন। কিন্তু আমরা দুর্গন্ধে থাকতে-থাকতে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি; সুগন্ধে বেহুঁশ হয়ে যাই, অস্বস্তি বোধ করি। এ থেকে বের হতে না পারলে দুর্গন্ধেই থেকে যাবো, দুর্গন্ধে থাকতে-থাকতে দুর্গন্ধ নিয়ে কবরে যাবো। আল্লাহ পানাহ।
১৮.০২.২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন