ভাবনা-১৬
আজ ৮ই ফাল্গুন, ২১শে ফেব্রুয়ারী। বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে মহান ভাষা-দিবস। ১৯৫২ সালের এদিনে তৎকালীন পাকিস্তানী রাষ্ট্রশক্তি কর্তৃক উর্দূকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে পাশাপাশি বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও দাপ্তরিকভাষা করার দাবিতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর আন্দোলন রফিক-সালাম-বরকতের রক্তের বিনিময়ে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার বীজ রোপণ করে—যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্তরূপ পরিগ্রহ করে। ৫২’র আন্দোলন ছিলো মূলত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, মাতৃভাষা আন্দোলন নয়। সে-সময় মাতৃভাষা নিয়ে কোন জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। ওরা, মানে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আমাদেরকে বলেনি যে, আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলতে পারবো না। ইতিহাসের বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজে দেখা যায়, কোথাও মাতৃভাষা আন্দোলনের নাম নেই, আছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্ল্যাকার্ড আর ধ্বনি। পরে সম্ভবত বাংলাদেশ আমলে এসে একটি শ্রেণী ৫২’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে মাতৃভাষা আন্দোলন বলে প্রচার করতে থাকে। এটাকে প্রচার না বলে অপপ্রচার বললে ভালো হয়। উইকিপিডিয়াতে দেখলাম লেখা হয়েছে: বাংলাভাষা আন্দোলন। হ্যা, সমস্যা নেই; রাষ্ট্রভাষা অন্দোলনকে বাংলাভাষা আন্দোলন বলা যেতে পারে একার্থে। কিন্তু সবচেয়ে পূর্ণ ও বাস্তব অবয়ব হলো—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। যাঁরা আন্দোলন করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, কারাবরণ করেছেন: তাঁদের সবাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে সরগরম ছিলেন, মাতৃভাষা আন্দোলন নিয়ে নয়। যারা প্রচার করেছেন: ওরা আমার মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো, তারা কি সঠিক বলেছেন? আমার মনে হয় না, এর কোন ভিত্তি আছে। ভাষা অন্দোলনের উপর রচিত দু’টো বই ভাষা সৈনিক অলি আহাদের লেখা ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫’ ও বামপন্থী লেখক বদরুদ্দীন উমরের লেখা ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’তে প্রদর্শিত অনেক দুর্লভ তথ্য ও ছবিতে কোথাও দেখা যায়নি ৫২-তে মাতৃভাষা আন্দোলন হয়েছে। বরঞ্চ এমন প্ল্যাকার্ডও আন্দোলনকারীদের হাতে দেখা গেছে, যেখানে লেখা ছিলো: উর্দূ-বাঙলা ভাই ভাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। তাহলে মাতৃভাষা আন্দোলন কি করে হলো? অবশ্যই বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, সে ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সংগ্রাম হয়েছিলো, মাতৃভাষা করা বা ঘোষণার দাবিতে নয়। ১৯৫২ সালের ২৯শে জুন সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের স্বাক্ষর অভিযানে অথবা সর্বদলীয় ভাষা আন্দোলন কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারীর ধর্মঘট সম্পর্কিত ইশতেহারে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির কথা বলা হয়েছে, মাতৃভাষা করার দাবি নয়। তাহলে কেন আমরা এখন বলছি, আজ মাতৃভাষা আন্দোলন বা ওরা আমাদের মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো? কথাগুলো কতোটুকু সত্য? স্বীকার করি, ৫২’র অন্দোলন অবশ্যই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা বা প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিলো, কখনোই বাংলাকে মাতৃভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার লড়াই নয়। কারণ ইতিহাস বলে না: ওরা আমাদেরকে বাংলায় কথা বলতে মানা করেছিলো। কিন্তু আমরা আজ রাষ্ট্রভাষা দিবসের পরিবর্তে মাতৃভাষা দিবস পালন করছি। অধ্যাপক ড.সলিমুল্লাহ খানও সম্প্রতি বলেছেন: ৫২-তে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিলো, মাতৃভাষা আন্দোলন নয়। এখন প্রশ্ন হলো, মাতৃভাষা আন্দোলনে সমস্যা কোথায়? সমস্যা: ঐতিহাসিক অর্থাৎ ইতিহাসে অনুপস্থিত বিষয়ের অবাস্তব উচ্চারণ এবং ইতিহাসের প্রকৃত চরিত্র ও গতিধারাকে স্থানচ্যুতকরণ—যা পরবর্তী প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করবে। আমাদের কিছু অত্যুৎসাহী অংশের চেষ্টায় জাতিসঙ্ঘ ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক বিশ্বে যে বার্তাটি যাচ্ছে, সে কি শুদ্ধ না কি অশুদ্ধ? আমরা সংগ্রাম করেছি, আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে, মাতৃভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে নয়। বাংলা তো মাতৃভাষা আগে থেকেই ছিলো, এখনও আছে। বরঞ্চ বলবো, মাতৃভাষা আন্দোলন বলতে গিয়ে আমরা ব্যাপকতা কমিয়েছি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বললে ব্যাপকতা আরও বাড়তো। বাইরের বিশ্বে যারা মাতৃভাষা দিবসের গোড়া খুঁজতে চাইবে, তারা যখন দেখবে এ তো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তখন আমাদের ইতিহাস বিকৃতির চিত্র কি ফুটে উঠবে না? আমাদের পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও বাংলা মাতৃভাষা হিসাবে প্রচলিত। অথচ ওরা বাংলার জন্য কোন ত্যাগ স্বীকার করেনি। ৫২’র আন্দোলনে ওদের কোন অংশীদারিত্বও ছিলো না।তাই, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বললে আমাদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ভেজালে বিমর্ষ হতো না। তা’ছাড়া আরও একটি কথা, আমরা যে বাংলা ভাষা দিবসকে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ বলছি, সবিনয়ে প্রশ্ন করতে পারি কি: ‘ফেব্রুয়ারী’ কোন শ্রেণীর বাংলা শব্দ? মি. জিন্নাহর উর্দূকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করাকে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক মানসিকতা বলে সমালোচনা করেছি। ঠিক আছে। কিন্তু ৮ই ফাল্গুনের পরিবর্তে একুশে ফেব্রুয়ারী মার্কা জগাখিচুড়ি পরিভাষা ব্যবহার কোন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ? এ প্রশ্নের কি কোন জবাব আছে? জানি না এসব অনাহুত বিতর্ক থেকে কবে আমাদের ইতিহাস মুক্তি পাবে।
২১.০২.২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন