ভাবনা-১৩
ইদানিং আমাদের কিছু প্রচারমাধ্যমের কিছু উপস্থাপনা নজর কাড়ছে। ছাপানো মাধ্যম বলুন আর ইলেকট্রনিক মাধ্যম বলুন--বিষয়টি দৃষ্টিএড়ানো বা শ্রুতিএড়ানো নয়। দেখছি, আগে লেখা হতো: ১লা মার্চ, ২রা জুলাই, ৪ঠা এপ্রিল, ৮ই মে, ২০শে জুন ইত্যাদি। এখন দেখি, লেখা হচ্ছে: ১ মার্চ, ২ জুলাই, ৪ এপ্রিল, ৮ মে, ২০ জুন ইত্যাদি। ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে পড়াও হচ্ছে তেমন। আচ্ছা, পরের গুলো কি শুদ্ধ হচ্ছে? আগের গুলো কি গলৎ? আসুন তবে দেখি। একটি প্রশ্ন করি: স্কুলে সাধারণত ক্লাসে যে লেখা থাকে বা ছাত্রেরা বলে: ক্লাস ফাইভ, ক্লাস নাইন, ক্লাস টেন ইত্যাদি--সে কি শুদ্ধ? আসলে শুদ্ধ নয়। বাংলায় বললে হবে: ৫ম শ্রেণী, নবম শ্রেণী, দশম শ্রেণী ইত্যাদি আর ইংরেজিতে বলতে হবে: Fifth Class, Ninth Class, Tenth Class ইত্যাদি। এখানে নির্দিষ্ট শ্রেণীকে বোঝানো হচ্ছে, কয়েক শ্রেণীকে এক সাথে নয়। যখন আপনি বলবেন: Class Five তখন মূলত বোঝানো হবে, একসাথে ৫টি শ্রেণী। কিন্তু কেউ তো একসাথে ৫টি শ্রেণীতে পড়ে না। তাহলে সে কী বলবে? বলবে: আমি ৫ম শ্রেণীতে পড়ি বা Fifth Class-এ পড়ি। তাহলে লেখাটা শুদ্ধ হলো--বলাটা শুদ্ধ হলো। এবার আসুন আমাদের মিডিয়া-পাড়ার কথায়। খবর লেখায় বা পড়ায় আগে বলা হতো, যেমন বলে এসেছি: ১লা মার্চ, ২রা জুলাই ইত্যাদি। আর এখন লেখা হচ্ছে, ১ মার্চ, ২ জুলাই ইত্যাদি। গলৎটা কোথায়? ঐ যে শ্রেণীর যুক্তিতে দেখুন, আপনি ১লা এপ্রিল, ৪ঠা এপ্রিল বললে বোঝাবে এপ্রিলের প্রথম দিন বা চতুর্থ দিন পক্ষান্তরে, ১ এপ্রিল বা ৪ এপ্রিল বললে বোঝাবে, হয় একটি এপ্রিল বা এক সাথে এপ্রিলের ৪ দিন বা ৪টি এপ্রিল মাস, যেমন আমরা বলি: একটি আম--যার মানে কখনোই এক টুকরো আম বা একটি আমের এক টুকরো নয়। বাংলায় বলতে গেলে বলতে হবে: ১ম এপ্রিল বা ৪র্থ এপ্রিল। তাহলে আপনি একটি নির্দিষ্ট দিনকে পাবেন। আশা করি পাঠক বুঝতে পেরেছেন। ঘটনা যখন কোন নির্দিষ্ট দিনে বা কোন নির্দিষ্ট দিন থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী কোন নির্দিষ্ট দিনে শেষ হয়, প্রকাশে আপনাকে সেভাবেই বলতে হবে খিচুড়ি করে নয়। কিন্তু আমরা বলি বা বলছি! হ্যা,বলছি, সেটা কিন্তু শুদ্ধ নয়, অশুদ্ধ। ভুলের উপর বলা আর কি। আসুন এবার মিডিয়া-পাড়ার দিকে। আমাদের মিডিয়ার বাক্যগঠন বা শব্দচয়ন বা সংবাদ পরিবেশনা যে কতোটা দুর্বল, সেটা বোঝানো মুশকিল। আগে সংবাদ লিখন বা পরিবেশন ছিলো মূলত সংবাদনির্ভর, ফ্যাশননির্ভর নয়। বেশি ন্যাকামো করতে গিয়ে শব্দের উচ্চারণকে কতো বিকৃত করা হচ্ছে তা শুনে বিস্মিত হতে হয়। অথচ এদের ডিগ্রীর বহর দেখলে অবাক হতে হয়। সংবাদ পরিবেশনার নামে এখন যা হচ্ছে সেখানে সাংবাদিকতা প্রাধান্য পায় না, প্রাধান্য পায় ফ্যাশন, অসামাঞ্জস্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গী। ৮০’র দশকে আমি বিবিসি ও ভয়েজ অব আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠান শুনতাম উচ্চারণ আর সংবাদ পরিবেশনার ধরন দেখতে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এসে দেখলাম লম্বালম্বা ডিগ্রী নিয়ে বিবিসি’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে কতো ভুল উচ্চারণে সংবাদ পড়তে। এখন মিডিয়াতে যা হচ্ছে, নিরঙ্কুশ অমেরুদণ্ডীয় আচরণ। এই যে উপরে বলে এলাম, তারিখের কথা; বললেই বলবে ১লা, ২রা, ৪ঠা তো বাংলা রীতি নয়, উর্দূ-ফার্সী রীতি। আমরা তো আবার ভাষার জন্য লড়েছি, তাই না! তবে ভুল কেন, বাংলাতে ১ম মার্চ, ৪র্থ এপ্রিল--এভাবে বলুন! আচ্ছা একটি প্রশ্নের উত্তর দিন। ভাষার যে দিনকে মনে রাখতে আপনারা উর্দূ-ফার্সী রীতি বর্জন করে বলছেন: ১ মার্চ, ৪ এপ্রিল, আপনারা আবার ভাষার দিনকে ‘২১শে ফেব্রুয়ারী’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, ‘অমর একুশে’ এসব লিখছেন কেন, বলছেন কেন? তখন কেন বলেন না: ২১ ফেব্রুয়ারী বা একুশ ফেব্রুয়ারী? আচ্ছা ‘ফেব্রুয়ারী’ কি বংলা? বাংলা মাস কোথাও কি নির্বাসনে গেছে? আসলে এসবের পেছনে আছে উদ্ভ্রান্ত সেক্যুলারগোষ্ঠী এবং তাদের মানসপুত্রেরা, যারা স্বকীয় সাংবাদিকতাকে বাদ দিয়ে কলকাতাইয়া সাংঘাতিকতাকে (সাংবাদিকতা) এখানে বসত গড়াতে চায়। কেবল ১লা, ২রা, ৪ঠা এগুলোতেই কি উর্দূ-ফার্সী? বাংলায় কি আর উর্দু-ফার্সী নেই? এভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ-প্রজন্মকে উদ্ভ্রান্ত করে রাখতে চায় যেন তারা ভুল বলে, ভুল শিখে কিন্তু বুঝবে না তারা যে মূলরাস্তা ফেলে ভিনরাস্তায় চলছে। এ ধরনের অপচেষ্টা এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, আসামে চলছে; বাংলা থেকে আরবী-ফারসী বাদ দিতে হবে। এটা বিজেপি-থিওরী। এর পেছনে আছে উগ্র-সাম্প্রদায়িকতা। যেখানে-সেখানে পাকিস্তানী গন্ধ খুঁজে বেড়ানো এদের কাজ। তাদের কাছে জানতে ইচ্ছে হয়, পাকিস্তানী নামেই যখন এতো অসহ্য তখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদেরকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে বারবার আহ্বান জানায়, তারা নীরব থাকেন কেন? কেন মিডিয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে?
১৬.০২.২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন