ভাবনা-১৫
অনলাইনে খবর দেখতে গিয়ে পত্রিকার পাতায় একটি কৌতুহলোদ্দীপক খবর পেলাম। গতকাল শনিবার ঢাকার মগবাজার কনভেনশন হলে অনলাইন বিজনেস ফার্ম ‘কওমী উদ্যোক্তা’ গ্রুপের তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। এটাকে কওমী আলিমদের সর্ববৃহৎ ব্যবসা-উৎসাহ দানকারী একটি অনলাইন কেন্দ্র হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২০ সালে সংশ্লিষ্ট কওমী-আলিমদের সমন্বয়ে গড়া গ্রুপটির যাত্রা শুরু। বলা হয়েছে, বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ২ লক্ষ ৫০ হাজার। দেয় তথ্যানুসারে, সহস্রাধিক আলিমকে ব্যবসায় দিকনির্দেশনা দিয়েছে উক্ত গ্রুপ। হাজারো আলিম এ গ্রুপের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন বলে বলা হয়েছে। প্রথম দেখাতে খবরটি ভালো না লাগার কোন কারণ নেই। আমাদের এ সমাজে আলিম মানে হতদরিদ্র ও প্রায় নিঃস্ব, পরের কাছে প্রার্থী একটি শ্রেণীকে মনে করা হয় যারা কেবল মসজিদ-মাদরাসা নিয়ে পড়ে থাকে। জাগতিক জ্ঞানে এঁরা পশ্চাদপদ। তাই ভালো কোন চাকরি পায় না; ছেলেপুলেদের ভালো বন্দোবস্তও করতে পারে না; পরের ঘর থেকে আনা মেয়েটার দু’আনা খরচও মেটাতে পারে না। এ ধরনের ধারণার একটি কারণও আছে বৈ কি। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে গড়ে উঠা আমাদের সমাজে ১৮৫৭’র মহাবিপর্যয়ের পর সুপুষ্ট মুসলিম জমিদার ও ধনাঢ্য শ্রেণী ইংরেজদের চক্রান্তে ও হিন্দু বাবুশ্রেণীর সহযোগিতায় পথে বসতে বাধ্য হলে প্রশ্ন দেখা দেয়: পতনোম্মুখ মুসলিম সমাজকে কোন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে? স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে একটি শ্রেণী রায় দেয়, ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা ও তাদের শিক্ষা গ্রহণ করে; ইংরেজ সরকারের চাকরিতে অংশ নিয়ে আত্মরক্ষার উপায় বের করতে হবে। অন্যদিকে তৎকালীন আলিম-সমাজ যাঁরা কখনোই হতদরিদ্র ছিলেন না, অসচ্ছল ছিলেন না কিন্তু বিপর্যন্ত পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বকীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষার আন্দোলন নিয়ে গড়ে তুললেন সম্পূর্ণ সরকারী সাহায্যমুক্ত এবং জনসম্পৃক্ত মাদরাসার বলয় যা দেওবন্দ আন্দোলন নামে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ।তাঁদের দর্শন ছিলো, একটি জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা ও সংস্কিৃতি আর সেটাকে প্রথমেই রক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে সমাজকে আত্মপ্রত্যয়ী করে গড়ে তুলতে হবে। তাই তাঁরা বৃহত্তর স্বার্থের প্রয়োজনে ইংরেজ-চাকুরির লোভকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের স্বর্বস্ব ত্যাগ করে মুসলিম-সমাজকে ইসলামী শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। তাতে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তাঁরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেন বটে, মুসলিম-সমাজকে অবক্ষয়ের মুখ থেকে রক্ষা করলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফলতার দিকে নিয়ে গেলেন। তাঁদের এ চেষ্টায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন, সন্দেহ নেই। সেই থেকে মাদরাসায় কুরআন-হাদীসের জ্ঞানদান নিয়ে পড়ে থাকা আলিম-সমাজ স্বল্প আয় সম্বল করে আজও পথ চলছেন সমাজের প্রয়োজনে, বিনিময়ে এ সমাজ থেকে পেলেন অসহায়, জাগতিকভাবে অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র শ্রেণীর ঘৃণাত্মক ও অবহেলাসূচক তকমা। বিশেষ করে অন্যান্য স্থানের তুলনায় আমাদের বাংলাদেশের অধিকতর দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিস্থিতিহেতু আলিম-সমাজের অবস্থা হয় শোচনীয়। এ থেকে পরিত্রাণের চেষ্টায় ধীরেধীরে সময়ের পরিবর্তনে কওমী আলিম-সমাজ আত্মসচেতনতায় নিজেদের পথকে নতুনভাবে পরিবর্তনের তাগিদ বোধ করলেন। মাদরাসাশিক্ষা শেষ করে কেউ গেলেন বিদেশে; কেউ স্বল্পিপুঁজি নিয়ে দেশজ বিনিয়োগে গড়ে তুললেন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। এভাবেই পথচলা শুরু। আজ যখন উপরের খবরটি নজরে পড়লো, সতর্কভাবে খুশি হয়েছি বেশ। সতর্ক এ জন্য যে, দেখেছি, কেউকেউ ওদিকে নজর দিতে গিয়ে হয় আত্মকেন্দ্রিক হয়েছেন, না হয় কওমী মৌলিকত্ব হারিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। আমি কওমী আলিমদের ব্যবসা-জগতে বিচরণকে এ জন্য সমর্থন করি যে, তাঁরা ব্যবসার রন্ধ্রেরন্ধ্রে হালাল-হারামকে প্রাধান্য দিয়ে দা’ওয়াত পেশ করবেন এবং নিজেদেরকে সচ্ছল করে গড়ে তুলে দেশ ও দশের সেবা করতে সক্ষম হবেন।। তাতে ভেতর থেকে সমাজ পরিবর্তন হবার পথ খুঁজে পাবে। অন্যথায় হারিয়ে যাবার আশঙ্কা থাকলে দুষ্ট গরুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল ঢের ভালো হবে।
১৯.০২.২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন