বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

কওমীদের কথকতা

 ভাবনা-৮

আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মানুষ মাঝেমাঝে কওমী মাদরাসাগুলোর সমালোচনা করে বলেন: সেখানে বিজ্ঞান,সমসাময়িক ইতিহাস, প্রচলিত জাগতিক শিক্ষা দেয়া হয় না। তারা আরও বলেন: কওমী মাদরাসার শিক্ষার মাধ্যম মূলত আরবী, ফার্সী ও উর্দূনির্ভর। বাংলা-ইংরেজি সেখানে নেই বললেই চলে। এসব জাগতিক শিক্ষা না থাকার কারণে কওমী মাদরাসার পড়ুয়ারা প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি-বাকরি পান না; এরা বরাবরই সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন এবং তারা বেকারের সংখ্যাই বৃদ্ধি করছে। সমালোচনাকারীরা মাঝেমাঝে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে সাক্ষাৎকার দিয়ে মানুষকে এসব জানান দেয়ার চেষ্টা করেন। এতে কারওকারও মনে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। জানামতে এদের কারোর-ই কওমী মাদরাসা নিয়ে সঠিক পর্যবেক্ষণ নেই। জানা দরকার, ১৮৫৭’র মহান স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যর্থ হবার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় বিধ্বস্ত মুসলিম সমাজের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্ত্বাকে রক্ষা করতে এবং একটি সংগঠিত ও আদর্শনির্ভর প্রজন্ম গড়ে তুলতে ১৮৬৬ সালে ভারতের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসা বা ইসলামী শিক্ষালয়ের যাত্রা শুরু হয় যা বর্তমানে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী য়ুনিভার্সিটি হিসাবে কাজ করছে। বলাবাহুল্য, দেওবন্দের অনুসরণে তখন নিখিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমান পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে প্রচুর মাদরাসা বা ইসলামী শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তেমন ধারায় ১৯০১ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে বিখ্যাত মুঈনুল ইসলাম মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। জানা দরকার, মাদরাসা হিসাবে যাত্রা শুরু হলেও তারাঁ কেবল পুঁথিগত শিক্ষাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকেননি। শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক সংস্কার, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক সচেতনতা ইত্যাদি জায়গায় তাঁরা কাজ করেছেন অবিরত। সেদিনকার সামাজিক বাস্তবতায় অঞ্চলের অধিকাংশ হতদরিদ্র মানুষকে শিক্ষার আহ্বান জানিয়ে তাঁরা নিজনিজ সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি আনুগত্যের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সমাজের দুঃস্থ মানবসন্তানকে বিনে পয়সায় পড়িয়ে, খোরাকী দিয়ে যেভাবে তাঁরা সমাজকে আপন করে নিয়েছিলেন তার বিনিময়ে তাঁদের শেকড় পৌঁছে যায় অনেক গভীরে যা তাঁদেরকে এনে দিয়েছে একমাত্র সামাজিক শক্তির উপাধি। এটা কেবল মুখের কথা নয়, সমাজের সাথে যাদের জানাশোনা আছে, তাঁরা বিলক্ষণ বিষয়টি স্বীকার করবেন। প্রশ্ন হলো হলো: সামাজিক বন্ধনে যাঁরা শতশত বছর ধরে আবদ্ধ তাঁরা হঠাৎ করে সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হন কি করে? আমার মনে হয়, যারা এসব বলেন, দেশের সমাজদেহ নিয়ে তাদের জ্ঞান একবারেই সীমিত। কোন প্রকার সরকারী সাহায্য ব্যতিরেকে সমাজের প্রত্যন্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা এসব প্রতিষ্ঠান কি কেবল হাওয়া খেয়েই চলে? তাঁদের প্রাত্যহিক খরচগুলো কোত্থেকে আসে? আসে সমাজ থেকে। সমাজের সদস্যরা এ অর্থ জোগান দেন সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে। প্রশ্ন করতে হয়, যারা রাজধানীতে বসে কওমী আলিম-ছাত্রদের মূলস্রোতবিচ্ছিন্ন বলে অপবাদ দেন তারা কোন সমাজের অংশ? বিজ্ঞান-গণিত ইত্যাদি পড়ানো হয় নাএ অপবাদ অবান্তর। পড়ানো হয় তবে সেসবের উচ্চশিক্ষা নয়, প্রয়োজনমাফিক। কারণ, কওমী মাদরাসা মূলত ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একচ্ছত্র জাগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। যে যুক্তিতে সমালোচকেরা বলেন: কওমী মাদরাসা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হলে জাগতিক উচ্চশিক্ষা দেয়া হয় না কেন, সেখান থেকে ডাক্তার-ইনজিনিয়ার বের হয় না কেনতাঁদের কাছে প্রশ্ন রাখতে হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবার এক-ই যুক্তিতে বলতে হয় মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল কলেজগুলোতে কুরআন-হাদীস-ফিকাহ ইত্যাদি শেখানো হয় না কেন? ওখান থেকে আলিম-ওলামা বের হতে পারে না কেন? আসলে কওমী মাদরাসা একটি বিশেষায়িত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। এখানকার মূল আদর্শ ইসলাম। দেশের জনগণের টাকা খরচ করে সরকার নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজগুলো তাদের উৎপাদন কতোটুকু সফলভাবে করতে পারছে, তা কারও অজানা নয়। প্রতিকূলে কওমী মাদরাসা সমাজের অর্থ নিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে সম্বল করে সমাজকে যা দিয়ে যাচ্ছে তাও অজানা নয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় ও নৈতিক জগতকে বাঁচিয়ে রেখেছে এসব মাদরাসাওয়ালাই। এরা বেকার তৈরি করে না বরঞ্চ বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে অগণিত মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছেন। এঁরা তো জাতীয় সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
৯.২.২৩               

কোন মন্তব্য নেই:

Featured Post

জামায়াতে ইসলামীর সাথে কওমীদের ঐক্য কি আদৌ সম্ভব ? ভাবনা-৫০ বাংলাদেশে ইসলাপন্থীদের ঐক্য নিয়ে আলোচনার হায়াত অনেক দীর্ঘ । এক সময় ঐক্যের শে...